অপরাহ্নে কথামত ওসমান রাজপুত্র সমক্ষে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “যুবরাজ! প্রত্যুত্তর পাঠাইবার অভিপ্রায় হইয়াছে কি?”

যুবরাজ প্রত্যুত্তর লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, পত্র হস্তে লইয়া ওসমানকে দিলেন। ওসমান লিপি হস্তে লইয়া কহিলেন, “আপনি অপরাধ লইবেন না; আমাদের পদ্ধতি আছে, দুর্গবাসী কেহ কাহাকে পত্র প্রেরণ করিলে, দুর্গ-রক্ষকেরা পত্র পাঠ না করিয়া পাঠান না।”

যুবরাজ কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ হইয়া কহিলেন, “এ ত বলা বাহুল্য। আপনি পত্র খুলিয়া পড়ুন; অভিপ্রায় হয়, পাঠাইয়া দিবেন।”

ওসমান পত্র খুলিয়া পাঠ করিলেন। তাহাতে এই মাত্র লেখা ছিল–

“মন্দভাগিনি! আমি তোমার অনুরোধ বিস্মৃত হইব না। কিন্তু তুমি যদি পতিব্রতা হও, তবে শীঘ্র পতিপথাবলম্বন করিয়া আত্মকলঙ্ক লোপ করিবে।

জগৎসিংহ।”

ওসমান পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র! আপনার হৃদয় অতি কঠিন।”

রাজপুত্র নীরস হইয়া কহিলেন, “পাঠান অপেক্ষা নহে।”

ওসমানের মুখ একটু আরক্ত হইল। কিঞ্চিৎ কর্কশ ভঙ্গিতে কহিলেন, “বোধ করি, পাঠান সর্বনাশে আপনার সহিত অভদ্রতা না করিয়া থাকিবে।”

রাজপুত্র কুপিতও হইলেন, লজ্জিতও হইলেন। এবং কহিলেন, “না মহাশয়! আমি নিজের কথা কহিতেছি না। আপনি আমার প্রতি সর্বাংশে দয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এবং বন্দী হইয়াও প্রাণদান দিয়াছেন; সেনা-হন্তা শত্রুর সাংঘাতিক পীড়ার শমতা করাইয়াছেন;- যে ব্যক্তি কারাবাসে শৃঙ্খলবদ্ধ থাকিবে, তাহাকে প্রমোদাগারে জড়িত হইতেছি; এ সুখের পরিণাম কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। আমি বন্দী হই, আমাকে কারাগারে স্থান দিন, এ দয়ার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করুন। আর যদি বন্দী না হই, তবে আমাকে এ হেমপিঞ্জরে আবদ্ধ রাখার প্রয়োজন কি?”

ওসমান স্থিরচিত্তে উত্তর করিলেন, “রাজপুত্র! অশুভের জন্য ব্যস্ত কেন? অমঙ্গলকে ডাকিতে হয় না, আপনিই আইসে।”

রাজপুত্র গর্বিত বচনে কহিলেন, “আপনার এ কুসুমশয্যা ছাড়িয়া কারাগারের শিলাশয্যায় শয়ন করা রাজপুতেরা অমঙ্গল বলিয়া গণে না।”

ওসমান কহিলেন, “শিলাশয্যা যদি অমঙ্গলের চরম হইত, তবে ক্ষতি কি?”

রাজপুত্র ওসমান প্রতি তীব্র দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “যদি কতলু খাঁকে সমুচিত দণ্ড দিতে না পারিলাম, তবে মরণেই বা ক্ষতি কি?”

ওসমান কহিলেন, “যুবরাজ! সাবধান! পাঠানের যে কথা সেই কাজ!”

রাজপুত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “সেনাপতি, আপনি যদি আমাকে ভয় প্রদর্শন করিতে আসিয়া থাকেন, তবে যত্ন বিফল জ্ঞান করুন।”

ওসমান কহিলেন, “রাজপুত্র, আমরা পরস্পর সন্নিধানে এরূপ পরিচিত আছি যে, মিথ্যা বাগাড়ম্বর কাহারও উদ্দেশ্য হইতে পারে না। আমি আপনার নিকট বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য আসিয়াছি।”

জগৎসিংহ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন। কহিলেন, “অনুমতি করুন।”

ওসমান কহিলেন, “আমি এক্ষণে যে প্রস্তাব করিব, তাহা কতলু খাঁর আদেশমত করিতেছি জানিবেন।”

জ। উত্তম।

ও। শ্রবণ করুন। রাজপুত পাঠানের যুদ্ধে উভয় কুল ক্ষয় হইতেছে।

রাজপুত্র কহিলেন, “পাঠানকুল ক্ষয় করাই যুদ্ধের উদ্দেশ্য।”

ওসমান কহিলেন, “সত্য বটে, কিন্তু উভয় কুল নিপাত ব্যতীত একের উচ্ছেদ কত দূর সম্ভাবনা, তাহাও দেখিতে পাইতেছেন। গড় মান্দারণ-জেতৃগণ নিতান্ত বলহীন নহে দেখিয়াছেন।”

জগৎসিংহ ঈষন্মাত্র সহাস্য হইয়া কহিলেন, “তাহারা কৌশলময় বটেন।”

ওসমান কহিতে লাগিলেন, “যাহাই হউক, আত্মগরিমা আমার উদ্দেশ্য নহে। মোগল সম্রাটের সহিত চিরদিন বিবাদ করিয়া পাঠানের উৎকলে তিষ্ঠান সুখের হইবে না। কিন্তু মোগল সম্রাটও পাঠানদিগকে কদাচ নিজকরতলস্থ করিতে পারিবেন না। আমার কথা আত্মশ্লাঘা বিবেচনা করিবেন না। আপনি ত রাজনীতিজ্ঞ বটেন, ভাবিয়া দেখুন, দিল্লী হইতে উৎকল কত দূর। দিল্লীশ্বর যেন মানসিংহের বাহুবলে এবার পাঠান জয় করিলেন; কিন্তু কত দিন তাঁহার জয়-পাতাকা এ দেশে উড়িবে? মহারাজ মানসিংহ সসৈন্য পশ্চাৎ হইবেন, আর উৎকলে দিল্লীশ্বরের অধিকার লোপ হইবে। ইতিপূর্বেও ত আকবর শাহা উৎকল জয় করিয়াছিলেন, কিন্তু কত দিন তথাকার করগ্রাহী ছিলেন? এবারও জয় করিলে, এবারও তাহা ঘটিবে। না হয় আবার সৈন্য প্রেরণ করিবেন; আবার উৎকল জয় করুন, আবার পাঠান স্বাধীন হইবে। পাঠানেরা বাঙ্গালি নহে; কখনও অধীনতা স্বীকার করে না; একজন মাত্র জীবিত থাকিতে কখন করিবেও না; ইহা নিশ্চিত কহিলাম। তবে আর রাজপুত পাঠানের শোণিতে পৃথিবী প্লাবিত করিয়া কাজ কি?”

জগৎসিংহ কহিলেন, “আপনি কিরূপ করিতে বলেন?”

ওসমান কহিলেন, “আমি কিছুই বলিতেছি না। আমার প্রভু সন্ধি করিতে বলেন।”

জ। কিরূপ সন্ধি?

ও। উভয় পক্ষেই কিঞ্চিৎ লাঘব স্বীকার করুন। নবাব কতলু খাঁ বাহুবলে বঙ্গদেশের যে অংশ জয় করিয়াছেন, তাহা ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছেন। আকবর শাহাও উড়িষ্যার স্বত্ব ত্যাগ করিয়া সৈন্য লইয়া যাউন, আর ভবিষ্যতে আক্রমণ করিতে ক্ষান্ত থাকুন। ইহাতে বাদশাহের কোন ক্ষতি নাই; বরং পাঠানের ক্ষতি। আমরা যাহা ক্লেশে হস্তগত করিয়াছি, তাহা ত্যাগ করিতেছি; আকবর শাহা যাহা হস্তগত করিতে পারেন নাই, তাহাই ত্যাগ করিতেছেন।

রাজকুমার শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “উত্তম কথা; কিন্তু এ সকল প্রস্তাব আমার নিকট কেন? সন্ধিবিগ্রহের কর্তা মহারাজ মানসিংহ; তাঁহার নিকট দূত প্রেরণ করুন।”

ওসমান কহিলেন, “মহারাজের নিকট দূত প্রেরণ করা হইয়াছিল; দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁহার নিকট কে রটনা করিয়াছে যে, পাঠানেরা মহাশয়ের প্রাণহানি করিয়াছে। মহারাজ সেই শোকে ও ক্রোধে সন্ধির নামও শ্রবণ করিলেন না; দূতের কথায় বিশ্বাস করিলেন না; যদি মহাশয় স্বয়ং সন্ধির প্রস্তাবকর্তা হয়েন, তবে তিনি সম্মত হইতে পারিবেন।”

রাজপুত্র ওসমানের প্রতি পুনর্বার স্থিরদৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলুন। আমার হস্তাক্ষর প্রেরণ করিলেও মহারাজের প্রতীতি জন্মিবার সম্ভাবনা। তবে আমাকে স্বয়ং যাইতে কেন কহিতেছেন?”

ও। তাহার কারণ এই যে, মহারাজ মানসিংহ স্বয়ং আমাদিগের অবস্থা সম্পূর্ণ অবগত নহেন; আপনার নিকট প্রকৃত বলবত্তা জানিতে পারিবেন। আর মহাশয়ের অনুরোধে বিশেষ কার্যসিদ্ধির সম্ভাবনা; লিপি দ্বারা সেরূপ নহে। সন্ধির আশু এক ফল হইবে যে, আপনি পুনর্বার কারামুক্ত হইবেন। সুতরাং নবাব কতলু খাঁ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, আপনি এ সন্ধিতে অবশ্য অনুরোধ করিবেন।

জ। আমি পিতৃসন্নিধানে যাইতে অস্বীকৃত নহি।

ও। শুনিয়া সুখী হইলাম; কিন্তু আরও এক নিবেদন আছে। আপনি যদি ঐরূপ সন্ধি সম্পাদন করিতে না পারেন, তবে আবার এ দুর্গমধ্যে প্রত্যাগমন করিতে অঙ্গীকার করিয়া যাউন।

জ। আমি অঙ্গীকার করিলেই যে প্রত্যাগমন করিব, তাহার নিশ্চয় কি?

ওসমান হাসিয়া কহিলেন, “তাহা নিশ্চয় বটে। রাজপুতের বাক্য যে লঙ্ঘন হয় না, তাহা সকলেই জানে।”

রাজপুত্র সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, পিতার সহিত সাক্ষাৎ পরেই একাকী দুর্গে প্রত্যাগমন করিব।”

ও। আর কোন বিষয়ও স্বীকার করুন; তাহা হইলেই আমরা বিশেষ বাধিত হই।–আপনি যে মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করিলে আমাদিগের বাসনানুযায়ী সন্ধির উদ্যোগী হইবেন, তাহাও স্বীকার করিয়া যাউন।

রাজপুত্র কহিলেন, “সেনাপতি মহাশয়! এ অঙ্গীকার করিতে পারিলাম না। দিল্লীর সম্রাট আমাদিগের পাঠানজয়ে নিযুক্ত করিয়াছেন, পাঠান জয়ই করিব। সন্ধি করিতে নিযুক্ত করেন নাই, সন্ধি করিব না। কিম্বা সে অনুরোধও করিব না।”

ওসমানের মুখভঙ্গীতে সন্তোষ অথচ ক্ষোভ উভয়ই প্রকাশ হইল; কহিলেন, “যুবরাজ! আপনি রাজপুতের ন্যায় উত্তর দিয়াছেন, কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখুন, আপনার মুক্তির আর অন্য উপায় নাই।”

জ। আমার মুক্তিতে দিল্লীশ্বরের কি? রাজপুতকুলেও অনেক রাজপুত্র আছে।

ওসমান কাতর হইয়া কহিলেন, “যুবরাজ! আমার পরামর্শ শুনুন, এ অভিপ্রায় ত্যাগ করুন।”

জ। কেন মহাশয়?

ও। রাজপুত্র! স্পষ্ট কথা কহিতেছি, আপনার দ্বারা কার্যসিদ্ধি হইবে বলিয়াই নবাব সাহেব আপনাকে এ পর্যন্ত আদরে রাখিয়াছিলেন; আপনি যদি তাহাতে বক্র হয়েন, তবে আপনার সমূহ পীড়া ঘটাইবেন।

জ। আবার ভয়প্রদর্শন! এইমাত্র আমি কারাবাসের প্রার্থনা আপনাকে জানাইয়াছি।

ও। যুবরাজ! কেবল কারাবাসেই যদি নবাব তৃপ্ত হয়েন, তবে মঙ্গল জানিবেন।

যুবরাজ ভ্রূভঙ্গী করিলেন। কহিলেন, “না হয় বীরেন্দ্রসিংহের রক্তস্রোত বৃদ্ধি করাইব।” চক্ষু হইতে তাঁহার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল।

ওসমান কহিলেন, “আমি বিদায় হইলাম। আমার কার্য আমি করিলাম, কতলু খাঁর আদেশ অন্য দূতমুখে শ্রবণ করিবেন।”

কিছু পরে কথিত দূত আগমন করিল। সে ব্যক্তি সৈনিক পুরুষের বেশধারী, সাধারণ পদাতিক অপেক্ষা কিছু উচ্চপদস্থ সৈনিকের ন্যায়। তাহার সমভিব্যাহারী আর চারি জন অস্ত্রধারী পদাতিক ছিল। রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কার্য কি?”

সৈনিক কহিল, “আপনার বাসগৃহ পরিবর্তন করিতে হইবেক।”

“আমি প্রস্তুত আছি, চল” বলিয়া রাজপুত্র দূতের অনুগামী হইলেন।