প্রথম খণ্ড

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দূর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে (১৫৮০ থেকে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) মোগল শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার পাঠান-বিদ্রোহ এবং মোগল-পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিকায় রচিত। এই বিদ্রোহ দমন করেন মোগল-সম্রাট আকবরের অন্যতম সেনাপতি অম্বরাধিপতি মানসিংহ।

‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের কাহিনীসূত্র বঙ্কিমচন্দ্র পেয়েছিলেন তাঁর খুল্লপিতামহের কাছ থেকে। “… তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম গড়মান্দারণের ঘটনা শুনিয়াছেন, যদিও ঐ ঘটনা আকবর শাহা বাদশাহের সময় ঘটিয়াছিল তথাচ তিনি উহা জানিতেন। সেকালে প্রাচীনেরা মুসলমান বাদশাহদিগের সময়ের অনেক ঘটনা জানিতেন। আমাদের মেজঠাকুরদার মধ্যে মধ্যে বিষ্ণুপুর অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। মান্দারণ গ্রাম জাহানাবাদ ও বিষ্ণুপুরের মধ্যস্থিত। ঐ অঞ্চলে মান্দারণের ঘটনাটি উপন্যাসের ন্যায় লোকমুখে কিম্বদন্তী রূপে চলিয়া আসিতেছিল। মেজঠাকুরদা উহা ঐ স্থানে শুনিয়াছিলেন, এবং মান্দারণের জমিদারের গড় ও বৃহৎ পুরী ভগ্নাবস্থায় দেখিয়াছিলেন। তাঁহার মুখে প্রথম শুনি যে, উড়িষ্যা হইতে পাঠানেরা মান্দারণ গ্রামের জমিদারের পুরী লুটপাট করিয়া তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রী ও কন্যাকে বন্দী করিয়া লইয়া যায়, রাজপুত কূলতিলক কুমার জগৎ সিংহ তাঁহাদের সাহায্যার্থে প্রেরিত হইয়াছিলেন। এই গল্পটি বঙ্কিমচন্দ্র আঠার-উনিশ বর্ষ বয়ক্রমে শুনিয়াছিলেন। তাহার কয়েক বৎসপর পরে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ রচিত হইল।”

খুল্লপিতামহের কাছে পাওয়া কাহিনী সূত্রের সঙ্গে চার্লস স্টুয়ার্টের ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ থেকেও বঙ্কিমচন্দ্র দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে স্টুয়ার্টের বর্ণনার হুবহু অনুবাদ প্রদান করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র স্টুয়ার্টের ইতিহাস এবং কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ রচনা করেন। এই উপন্যাস রচনাকালে ‘দূর্গেশনন্দিনী’র সময়কার অনেক ঐতিহাসিক তথ্যই অজ্ঞাত ছিল। পরবর্তীকালে নবাবিষ্কৃত তথ্যাদির নিরিখে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আমাদের জানিয়েছেন— “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দূর্গেশনন্দিনী’তে সত্য ইতিহাস কতটুকু আছে? মানসিংস, জগৎসিংহ, কুৎলু খাঁ, খ্বাজা ইসা, উস্‌মান— ইঁহারা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ এবং সে যুগে বঙ্গের ঠিক সেই স্থলে বাস করিতেন। ইহাও সত্য ইতিহাস যে, জগৎসিংহ অগণিত পাঠানদের নিকট পরাজিত হইয়া এক দূর্গে আশ্রয় লন এবং তাহার কিছুদিন পরেই কুৎলু খাঁর মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার দেওয়ান খ্বাজা ইসা কুৎলুর বালক পুত্রদের রাজ্য বাঁচাইবার জন্য মানসিংহের সহিত দেখা করিয়া বহুমূল্য উপঢৌকন দিয়া সন্ধি করেন। ইহা ভিন্ন ‘দূর্গেশনন্দিনী’র আর সব কথা কাল্পনিক। এই সন্ধিতে জগৎ সিংহ মধ্যস্থ ছিলেন না। তবে, বঙ্কিম কি বাকী সব ঐতিহাসিক দৃশ্যপট নিজ কল্পনা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন? আয়েষা, তিলোত্তমা, বিমলা সকলেই কাল্পনিক। এ কথা পাঠক সহজেই ধরিয়া ফেলিবেন; এবং তাহাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু জগৎ সিংহের আহত হওয়া, কুৎলুর দূর্গে আবদ্ধ থাকা, এবং তাহার দ্বারা কুৎলুর মরণকালে সন্ধিভিক্ষা করা, এই শাখাপল্লবগুলি ইতিহাসের বাহিরে হইলেও বঙ্কিমের নিজকল্পনায় সৃষ্টি নহে। এগুলি আসিয়াছে ঐতিহাসিক নামজাদা একজন ঘোর কাল্পনিক সাহেবের লেখা হইতে, তিনি কাপ্তান এলেকজাণ্ডার ডাও (Alexander Dow)। এই সাহেবটি ফিরিস্তার রচিত হিন্দুস্থানের ইতিহাস ইংরেজীতে প্রায়শঃ অনুবাদ করিয়া দিতেছেন বলিয়া এবং নিজ গ্রন্থের নামপত্রে ফিরিস্তার নাম সংযোগ করিয়া দিয়া অপর্য্যাপ্ত মেকী কথা চালাইয়াছেন, যাহা ফিরিস্তাতেও লেখেন নাই; এমন কি, কোনও পারসিক লেখকের পক্ষে সেরূপ লেখাও সম্ভব ছিল না।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার রচিত ‘দূর্দেশনন্দিনী’ উপন্যাসের ‘ঐতিহাসিক ভূমিকা’র অন্যত্র তিনি লেখেন— “মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎ সিংহ মদিরামত্ত অবস্থায় কৎলু খাঁর সেনাপতি বাহাদুর খাঁ কর্তৃক পরাজিত ও আহত হইয়া বিষ্ণপুরের রাজা বীরহাম্বিরের যত্নে সেই রাজধানীতে পলাইয়া গিয়া বাঁচেন, ইহা সত্য ঘটনা— এবং ইহা আবুল ফজল বর্ণনা করিয়াছেন।”

পক্ষান্তরে স্টুয়ার্টের ইতিহাসে বলা হয়েছে, ধরপুরে আফগানরা জগৎসিংহের কাছে পরাজিত হয়ে সন্ধির জন্য আলোচনার ভান চালিয়ে যায়, যা জগৎসিংহ ধরতে পারেননি, এবং সেই সুযোগে গোপনে কৎলু খাঁকে সংবাদ পাঠিয়ে অতিরিক্ত সৈন্য আনানো হয়। ফলে জগৎসিংহ পরাজিত ও বন্দী হন। পাঠানদের হাতে জগৎসিংহের বন্দীত্বের যে বিবরণ স্টুয়ার্ট দিয়েছেন ‘আকবর নামা’ অনুসারে তা সঠিক নয়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র পাঠানদের হাতে জগৎসিংহের বন্দীত্বের সূত্রটিকে অত্যন্ত সুকৌশলে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে কাজে লাগিয়েছেন। এই সূত্র ধরেই জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার প্রণয় কাহিনীর সঙ্গে আয়েষা ও ওসমান যুক্ত হওয়ায় ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসটি বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই অনৈতিহাসিক হলেও এই সূত্রকে অবহেলা করা যায় না। আবার ঐতিহাসিক বিচ্যুতির জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকেও দায়ী করা যায় না। কারণ, প্রথমতঃ দূর্গেশনন্দিনীর রচনার সময় পর্যন্ত ‘আকবরনামা’র কোন ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি এবং ফারসি না জানায় বঙ্কিমচন্দ্র মূল গ্রন্থটিও পড়তে পারেন নি। দ্বিতীয়তঃ তিনি তাঁর সময় কালে আধুনিক পদ্ধতিতে রচিত স্টুয়ার্টের বাংলাদেশের ইতিহাস যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন। সুতরাং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন, এই কথা বলা যায় না।

এই উপন্যাসে তিলোত্তমা, বিমলা, আয়েষা, অভিরাম স্বামী প্রভৃতি চরিত্র অনৈতিহাসিক। দাউদ খাঁ, মনাইম খাঁ, খাঁ আজিম, শাহবাজ খাঁ, সৈদ খাঁ প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে এই সব ঐতিহাসিক চরিত্রের নামোল্লেখ ভিন্ন উপন্যাসের কাহিনী মধ্যে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই।

মোগল-পাঠান সংঘর্ষের পটভূমিকায় রচিত ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস। মোগল পক্ষের প্রধান দিল্লী সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি মানসিংহ। তাঁর রণকৌশল ও বাহুবলে বঙ্গদেশ থেকে কাবুল পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে দারুকেশ্বর নদীতীরে শিবির সংস্থাপন করে সাইদ খাঁর জন্য প্রতীক্ষা এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদে ‘নবীন সেনাপতি’ নির্বাচন করে পাঠানদের গ্রাম-লুণ্ঠন ও প্রজাপীড়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাই,— যা বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থ দক্ষতায় উপস্থাপিত করেছেন। তবে এই উপন্যাসে বিমলা কর্তৃক কতলু খাঁ হত্যা ঘটনাটি অনৈতিহাসিক।

দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের পরিচ্ছেদ সমূহ