ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে যুদ্ধ
ইব্রাহীম লোদি তাঁর কিছু ভ্রান্ত আচরণের জন্য তাঁর আমির—ওমরাহদের কাছে খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই আমিররা তাঁর হঠকারিতা ও ভ্রান্তির কবল থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। বাবুর ভারত জয়ের পথে তাঁর আমিরদের একাংশের বড়ই আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন। এদিকে বাবুর ১২,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং লোদির আমিরদেরও তাঁর পক্ষে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পথে বাবুরের সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছিল, সেই সঙ্গে স্থানীয় অনেকেই তাঁর বাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় সংঘর্ষ হয় বাবুর পুত্র হুমায়ূনের নেতৃত্বে, ১৫২৬ ঈসায়ী সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। হুমায়ূনের বয়স তখন ১৭। হুমায়ূন এই যুদ্ধে অসাধারণ সামরিক যোগ্যতার পরিচয় দিতে সমর্থ হন। তিনি ইব্রাহীম লোদির উন্নত বাহিনীর সঙ্গে শুধু যুদ্ধই করেননি বরং তাদের হস্তিবাহিনীর কিছু হাতি ও সৈন্যকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। এই যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়নি। হুমায়ূনের আদেশে তাদের তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবুর লিখেছেন—‘উস্তাদ আলী কুলী খাঁকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাদের তোপের মুখে উড়িয়ে দিতে। এটা ছিল হুমায়ূনের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা …।’
ইব্রাহীম লোদি প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য ও শতাধিক হাতির একটি বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাবুরের সৈন্যসংখ্যা ছিল লোদির চার ভাগের এক ভাগ। ১৫২৬ ঈসায়ী সনের ২১ এপ্রিলে সংঘটিত এই যুদ্ধটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদি অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে মাটিতে নেমে আসেন এবং বীরগতি প্রাপ্ত হন। লোদির মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তৎকালীন গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ। তিনি বলেছিলেন—‘এটি ছিল কাচ ও পাথরের যুদ্ধ।’ উল্লেখ্য যে, এখানে কাচ বলতে ইব্রাহীম লোদির বাহিনীকে বোঝানো হয়েছে এবং পাথর বলতে বাবুর বাহিনীকে। অর্থাৎ পাথর যেমন কাচকে চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দেয়, বাবুরের বাহিনী তেমনই ইব্রাহীম লোদির বাহিনীকে চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। বাবুর ভারতের মাটিতে পানিপথের যুদ্ধে সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেছিলেন। আর তার পরিচালক ছিলেন উস্তাদ আলী কুলী খাঁ। তৎকালীন যুগ পর্যন্ত ভারতবাসী সম্ভবত এর চেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ আর কখনো দেখেনি। যুদ্ধ জয়ের পর বাবুর অতি দ্রুত দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে নিয়েছিলেন। ওই দিনই বাবুর হুমায়ূনকে দ্রুত আগ্রা রওনা করিয়ে দেন যাতে রাজকোষ লুটপাট না হতে পারে। হুমায়ূন আগ্রায় গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাজিতের পরিবারকে পেয়ে যান। রাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। এ পরিবার আগ্রা দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পথে হুমায়ূনের হাতে ধরা পড়ে যান। তিনি তাদের সসম্মানে আগ্রা দুর্গে নিয়ে আসেন। রাজপরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মূল্যবান হিরে জহরাতাদি উদ্ধার হয়। তার মধ্যে ‘কোহিনূর’ নামে একটি মণি পাওয়া যায়। যার অর্থ ‘আলোর পর্বত।’ হুমায়ূন এটি বাবুরকে উপহার দেন, বাবুর পুনরায় এটি হুমায়ূনকে উপহার দেন। কালানুক্রমে এই মণিটি চলে যায় ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে। সেটি এখন সেখানেই মজুত রয়েছে। বাবুর তাঁর স্মৃতিকথায় এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন—‘এর মূল্য সমগ্র জগদবাসীর আড়াই দিনের পানাহারের মূল্যের সমান।’
বাবুর বিজয়ের তৃতীয় দিনে দিল্লি পৌঁছান। সেখানে পৌঁছেই তিনি সুলতানুল আউলিয়া হজরত নিজামউদ্দীনের দরগায় হাজিরা দেন। তারপর, হজরত কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর মাজারে। উল্লেখ্য যে, তাইমুর লঙ্গও দিল্লি জয়ের পর নিজামউদ্দীনের দরগায় হাজিরা দিয়েছিলেন। কথিত আছে, হজরত নিজামউদ্দীন তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাঁকে দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। বলাবাহুল্য, সেই নির্দেশ শিরোধার্য করে তাইমুর লঙ্গ দিল্লি ছেড়ে চলে যান। বিজিত ভূমি তার নিজের জায়গাতেই গড়ে থাকে। বাবুরের দিল্লি বিজয় ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। বাবুর দিল্লির সালতানাতকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে মনে করতেন। হজরত নিজামউদ্দীন তাঁকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেননি। দিল্লির মানুষ তাঁকে খুব আপন করেই গ্রহণ করেছিলেন। দিল্লির পুরাতন রাজধানী যমুনার তীরে তাঁর উপস্থিতি উদযাপন করা হয় এবং তা শুক্রবার পর্যন্ত স্থায়ী করা হয়। মুসলমানরা শোকরানা নামাজ আদায় করেন, দিল্লির তৎকালীন জামে মসজিদে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ হয়। পরে তিনি আগ্রা রওনা হয়ে যান পুত্র হুমায়ূনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। পরে ওই কোহিনূর মণির প্রসঙ্গ আসে। যা জগতের একটি অতি মূল্যবান বস্তু।
রাজপুতদের সঙ্গে যুদ্ধ
ভারতে মুসলিম রাজ কায়েম হওয়ার সাথে সাথেই পৌত্তলিক সমাজ তথা নেতৃত্ব যে তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, এমনটা কখনোই নয়। মুহম্মদ বিন কাশিমের বিরুদ্ধে দাহির, মুহম্মদ ঘুরির বিরুদ্ধে পৃথ্বিরাজ, বাবুরের বিরুদ্ধে রাণা সাঙ্গা সকলেই মুসলিমদের বিতাড়িত করে দিল্লি—রাজ কায়েমের স্বপ্নে মশগুল ছিলেন। প্রতি পদেই তারা ব্যর্থ ও পরাজিত হন। মুহম্মদ বিন কাশিম থেকে বাবুর আটশো বছরের সুদীর্ঘ পথ। এই পথে দিল্লির সালতানাত কায়েমে বাধা হয়ে দিল্লি রাজের স্বপ্ন দেখা রাণা সাঙ্গার নেতৃত্বে রাজপুতেরা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠেছিল। রাজা বিক্রমাজিত ইব্রাহীম লোদির পক্ষে পানিপথের যুদ্ধে লড়ে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ক্ষমতার অলিন্দ পেরিয়ে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করবেন। তা—ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এবার রাণা সাঙ্গার পালা, তিনি বাবুরকে পরাজিত করে দিল্লি রাজ কায়েমের স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রচুর সৈন্য ছিল রাজপুতদের, বাবুরের সৈন্য সংখ্যা তার অর্ধেকও ছিল না। যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। অবশেষে ১৫২৭—এর মার্চে বাবুর ও রাজপুতদের মধ্যে খানুয়ায় যুদ্ধ হলো। রাজপুতরা ভালোই যুদ্ধ করছিল। বাবুরের সৈন্যরা পিছু হটছিল। তারপর, বাবুরের সংরক্ষিত সেনা অগ্রগামী রাজপুতদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখনও বিজয়ের মূলমন্ত্র বাবুরের হাতেই ছিল। উস্তাদ আলী কুলী খাঁ—র কামান গর্জে উঠল। তাঁর গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাজপুত বাহিনী। রাজা সাঙ্গা পালিয়ে গেলেন। তবুও বাঁচতে পারলেন না। শোনা যায় তাঁর কোনো মন্ত্রী তাঁকে বিষ খাইয়েছিলেন। তাতেই মারা যান রানা সাঙ্গা। বাবুর মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব পুরুষের রাজ্য উদ্ধার করতে এসেছিলেন। করলেনও। অবিসংবাদিত বাদশাহ রূপে প্রতিষ্ঠিত হলো মোগল সাম্রাজ্য। যা তাঁর পরবর্তী ৩০০ বছর যাবত স্থায়ী হয়ে রয়ে গেল।
মৃত্যু
কথিত হয়েছে, আল্লাহ বাবুরের জীবন কবুল করে হুমায়ূনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৫৩০ ঈসায়ী সনে ৪৭ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁকে কাবুলে দাফন করা হোক। কিন্তু প্রথমে আগ্রায় এবং তার ন’ বছর পরে শেরশাহ সূরী তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন এবং কাবুলে দাফন করেন।
সিংহাবলোকন
কারো কারো প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সোনার বা রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু বাবুরের ক্ষেত্রে কী বলা হবে?
নিঃসন্দেহে তিনি একহাতে অসি ও আরেক হাতে মসি নিয়ে জন্মেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দু—একটা দেখা গেছে। বাবুর হলেন সেই দৃষ্টান্ত, যিনি একাধারে লেখক এবং কবি তো আরেক দিকে তিনি সৈনিক, সেনাপতি, বাদশাহ। বাবুর শুধু ভারতের নন, বরং তিনি সমগ্র মধ্য এশিয়ার সম্রাট। জন্মেছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারগানা নামক রাজ্যের আন্দিজান শহরে, একাদশ বছর বয়সে পিতৃহারা বালক বাবুর তাঁর পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছেন। কিন্তু সেই রাজ্য হাতছাড়া হতে তাঁর খুব বেশি দেরি হয়নি। আত্মীয়—স্বজনদেরই ষড়যন্ত্রে তাঁকে রাজ্য হারাতে হয়েছে, জীবন নিয়ে প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। নিঃস্ব—অসহায়ের মতো পথে পথে ঘুরতে হয়েছে।
ফারগানা তাঁর রাজ্য, আন্দিজান তাঁর জন্মভূমি। তাঁর মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা তাঁকে করতে হয়েছে। করেছেনও কিন্তু হারাতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। কী অসাধারণ সৈনিক প্রতিভা ও মনোবল নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন তা ভাবতে অবাক লাগে। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন কিন্তু পুনঃপুনঃ ভাগ্য—পরীক্ষায় বারবারই অবতীর্ণ হয়েছেন। একদিকে শত্রুর বিরুদ্ধে ভূমি অধিকারের লড়াই, আবার অন্যদিকে তাঁর কবি—আত্মা, কবিমন, পরম শান্তিতে আত্মজীবনী লিখছেন, কাব্য—কবিতা লিখছেন, নিজের মাতৃভাষার লিপি সংস্কার করছেন। তাঁর রচনাবলি, তাঁকে ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদ, কাব্য ও সাহিত্যবিদ, সংগীতজ্ঞ ও লিপিবিশারদ বলে প্রতিষ্ঠা দেয়। এ এক বিস্ময়কর মনীষা।
তাঁর জন্মস্থান ফারগানা উপত্যকায় অবস্থিত আন্দিজান। তাঁর আত্মকথায় তিনি সেই আন্দিজানের ভূ—প্রকৃতি, আবহাওয়া, ফলমূল, জীবন জীবিকা ও সাংস্কৃতিক জীবনের অপূর্ব বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘আন্দিজানের বাজার ও লোকালয়গুলোতে তুর্কি জাতির লোকেদেরই দেখা যায়। তাদের কথন এবং লিখনশৈলী সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ। … বলাবাহুল্য, ভাষার কথন ও লিখনশৈলীর মূল্যায়ন করতে গেলে সে বিষয়ে তাঁকে মাহির হতে হয়। বাবুর তা—ই ছিলেন। তিনি সেখানকার মানুষদের ধার্মিক বলে অভিহিত করেছেন। সেখানকার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ইউসুফের কথাও লিখেছেন। যিনি আন্দিজানে জন্মানোর জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। সেখানকার আবহাওয়ারও প্রশংসা করেছেন বাবুর। সেখানকার দুটি প্রধান ঋতুর তিনি বড়ই প্রশংসা করেছেন। শরৎ ও বসন্ত। আবহাওয়া যে মানুষের রীতি রেওয়াজ ও সাংস্কৃতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে একথাও বলতে এবং লিখতে ভোলেননি বাবুর।
আন্দিজানের বাগ—বাগিচা ও ফলমূলেরও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানকার পাহাড় বেষ্টিত বাগ—বাগিচায় নানা ফুলেরও যেমন বর্ণনা দিয়েছেন তেমনই দিঘি ও পুকুরগুলোতে ফুটে থাকা নীল বর্ণের ঘণ্টাকৃতির ফুলের বর্ণনাও দিয়েছেন, রঙ—বেরঙের ফুলের মধ্যে বিশিষ্ট ফুল রূপে গোলাপের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। এখানকার সুস্বাদু ও রসালো ফলগুলোর মধ্যে তিনি বিশেষ করে আনার ও খুবানি ফলের কথাও উল্লেখ করেছেন।
আন্দিজানের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বর্ণনাও দিয়েছেন বাবুর। এখানকার ঐতিহাসিক বর্ণনা প্রসঙ্গে এসেছে সমরখন্দ ও বুখারার কথা। যা তাঁর পূর্বপুরুষ আমির আইমুর নিজহাতে গড়ে গিয়েছেন। এখানকার একশ্রেণির মানুষের পশুপাখি শিকার করার শখের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। সমরখন্দ ও বুখারার মানুষদের ভাষারূপে তিনি ফার্সি ভাষার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘এখানকার সকল মানষই ফার্সি ভাষা ব্যবহার করেন।’ তিনি সমরখন্দের পাহাড়ি এলাকায় এখন একটি উজ্জ্বল পাথরের বর্ণনা দিয়েছেন, ইংরেজিতে যাকে ‘মিরর স্টোন’ বলা হয়, বাংলায় বলে, ‘আয়না পাথর’। তাতে সবকিছুই আয়নার মতোই প্রতিফলিত হয়। তিনি এখানকার ফলমূলের মধ্যে বাদামের নামই বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য ফলের প্রাচুর্যের কথাও আছে।
সমরখন্দ থেকে সড়ক পথে ‘খুজন্দ’ নামক একটি শহরের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এখানকার কৃষির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নানাবিধ ফলের মধ্যে আনারের কথা বিশেষ করে লিখেছেন। খুজন্দের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘শাইহুন’ নদীর কথা তিনি এক অপূর্ব উপমা খচিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন—‘শাইহুন নদী কিছু দূর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো বয়ে গেছে। এখানে অনেক মূল্যবান পাথরের খনির কথা তিনি লোকমুখে জানতে পারেন। সেই সঙ্গে তিনি এখানে সাপের উপদ্রবের কথাও লিখেছেন এবং এও লিখেছেন যে কিষাণ ও খরগোশ অতিমাত্রায় দেখা যায়। এখানকার আবহাওয়া তেমন মধুর নয়, দূষিত। ফলে, মানুষ নানা রোগ—পীড়া এবং বিশেষত জ্বরে আক্রান্ত হয়। কথিত আছে যে, এখানে জ্বরের জীবাণু প্রধানত পার্বত্য এলাকাগুলো থেকে উড়ে আসা পাখিরা বয়ে আনে।
বাবুর ফারগানা রাজ্যের অধীনস্ত কিছু নগর—মহানগরের বর্ণনা দেওয়ার পর তাঁর পূর্ব—পুরুষদের বর্ণনা দিয়েছেন অতি—সংক্ষেপে। এখানে লেখক তাঁর পিতা উমর শেখ মির্জার অকাল মৃত্যুর কথা অত্যন্ত সংক্ষেপে অথচ সুন্দর আলঙ্কারিক ভাষায় লিখেছেন—‘সোমবারের দিন রমজান মাসের, মোতাবেক জুন মাসের ৮ তারিখে উমর শেখ মির্জা তাঁর সমস্ত কবুতর উড়িয়ে দিলেন এবং নিজে বাজ হয়ে গেলেন (অর্থাৎ তাঁর মৃত্য হয়ে গেল)।’ বাবুর এখানে তাঁর বংশাবলির বর্ণনা দিয়েছেন এবং নিজেকে তাইমুর বংশের চতুর্থ প্রজন্মের ওয়ারিশ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। উমর শেখ মির্জা হানাফি মজহাবভুক্ত সুন্নি মুসলিম ছিলেন। তিনি ছিলেন সাচ্চা মুসলিম, নামাজি এবং পরহেজগার। বাবুরও তাই ছিলেন। বাবুর তাঁর পিতা সম্পর্কে লিখেছেন—‘তিনি ছিলেন প্রাকৃতিক কলাপ্রেমী, সৌখিন এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন মানুষ। লেখক তাঁর পিতৃকুলের মতোই মাতুল কুলের পরিচয়ও লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানকার পরিচয় থেকে জানা যায় যে, তিনি মাতুল কুলের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের চতুর্দশতম অধঃস্তন পুরুষ।
পিতা উমর শেখ মির্জার অকালমৃত্যু বালক বাবুরের জীবনে ভয়াবহ বিড়ম্বনা বয়ে আনে। কিন্তু তাঁর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিভাবান বালক ছিলেন প্রকৃতপক্ষে অতিপ্রাকৃত কিংবা অপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী। সীমাহীন উদ্যম ও অসাধারণ কর্মক্ষমতা, প্রকৃতপক্ষে তাঁকে অতিপ্রাকৃত করেই তুলেছিল। এ সব ছাড়াও তিনি ছিলেন অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিত। ‘হয় মারব না হয় মরব’ বলে তাঁর দলে এসে ভিড়ত, মরণ—পণ যুদ্ধ করত আর তাঁকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছ দিত। বাবুর যে কখনো—কখনো হারের মুখ দেখতেন না, তা নয়। তিনি বরং জয়—পরাজয়কে একই মুদ্রার এপিঠ—ওপিঠ বলেই গণ্য করতেন। এ সব স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার মতো অতিপ্রাকৃত মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা তাঁর ছিল।
প্রসঙ্গত, তাঁর সমরখন্দ অভিযানের কথা। সমরখন্দ তিনি প্রথমবার জয় করলেন। সমস্ত বাধা—বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি সমরখন্দ জয় করলেন। বিজয়মদমত্তে সৈন্যরা তাল হারিয়ে ফেলল। লুটপাট চালাল। অথচ তিনি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন যেন লুটপাট না হয়। ইয়াম নামক শহরের বাজারে সৈন্যরা লুটপাট চালায়, অথচ তিনি ইয়ামবাসীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন লুটপাট হবে না। সৈন্যরা এটা করে ফেলাতে তিনি অত্যন্ত বিব্রতবোধ করলেন। ওয়াদা ভঙ্গের দায়ে বিবেকের দংশনে পড়লেন। কিন্তু তিনি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করতেন না। বাধ্য হয়ে তিনি সৈন্যদের মাঝখানে গিয়ে বিষয়টির উল্লেখ করলেন। সৈন্যরা অনুগত ও বাধ্য বালকের মতো লুটের সমস্ত মাল তাদের ফিরিয়ে দিল। বাবুর লিখেছেন—‘আমার কথা শুনতেই সৈনিকেরা যে অনুশাসনের পরিচয় দিল তা অতুলনীয়। ওই দিন প্রথম প্রহরে আমার সৈনিকেরা যে মাল যেখান থেকে লুটেছিল সেখানেই নিয়ে রেখে এল। তারা সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছিল। এক টুকরো সুতো পর্যন্তও, এমনকি ভেঙে যাওয়া সুচটিও পর্যন্ত নিজেদের কাছে রাখল না। সবকিছুই বণিকদের কাছে পৌছে গেল, যারা যার মালিক ছিল।
লেখক সমরখন্দের যে প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়েছেন তা বড়ই আকর্ষণীয়। বাবুরের ভাষায়—‘সমরখন্দ খুব সুন্দর শহর। এর পূর্বে কোহিক নদী প্রবহমান। এ নদী কোহিক পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে বলে এর এই নাম। এই নদী থেকে অনেক নহর বের করে আনা হয়েছে। যা সেচের সাধন হয়েছে। বাগিচা পর্যন্ত নহরের পানি পৌঁছে যায়, যার কারণে সমরখন্দে ফসল উৎপন্ন হয়। এই নদী বুখারা পর্যন্ত রয়ে গিয়ে তাকে শস্য—শ্যামল করে তুলেছে।’
এখানে অন্য নদীর বর্ণনাও এসেছে। সমরখন্দের উৎপাদিত ফল—ফসলের মধ্যে আঙুর, তরমুজ, আপেল এবং আনারের কথা বিশেষভাবে এসেছে। তিনি এ—ও লিখেছেন, ‘সমরখন্দের আপেল ও আঙুর জগদ্বিখ্যাত। প্রাকৃতিক অবস্থার কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন—‘এখানে খুব ঠান্ডা পড়ে, তবে কাবুলের মতো নয়।
বাবুর সমরখন্দের ঐতিহাসিকতার কথা অত্যন্ত মহিমান্বিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন। প্রকৃত সত্য হলো—সমরখন্দ তো আমির তাইমুরের হাতে গড়া শহর। এই শহরের বর্ণনায় বাবুর লিখেছেন—‘সমরখন্দের উপনগরগুলোতে অনেক সুন্দর সব ইমারত রয়েছে। এ সকল ইমারত ও এখানকার সুন্দর বাগিচাগুলো তাইমুর বেগ ও ঔলংগ বেগ মির্জা নির্মাণ করিয়েছিলেন।… এর এক উপনগর সিল্ক সরাইয়ে—তাইমুর বেগ যেখানে নিজের দুর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি চার দরজাবিশিষ্ট বিশাল দুর্গ। নগর চারদিক থেকে প্রাচীর বেষ্টিত। মুখ্য দ্বার লৌহ দরওয়াজা রূপে রয়ে গিয়েছে। নামাজে জুমআর জন্য এখানে একটি বিশাল মসজিদ নির্মিত হয়। এ মসজিদ প্রস্তর নির্মিত। এতে পাথর খুদে নকশা করা হয়। পাথর শিল্পীদের হিঁদুস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর গম্বুজ মেহরাব—বিশিষ্ট। এতে আলোকিত লিপি অংকিত আছে যেগুলো কুরআনের আয়াত। লিপি এত স্পষ্ট যে, দু’মাইল দূর থেকেও তা পড়া যায়।’… এ ছাড়া আরো ঐতিহাসিক বর্ণনা এ প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন বাবুর। লেখক এখানে ঐতিহাসিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
সমরখন্দের ভৌগোলিক বর্ণনা প্রসঙ্গে বাবুর লিখেছেন—‘সমরখন্দের সবচেয়ে বড় নগর বুখারা। এই নগর যেখানে সুন্দর নগরগুলোর অন্যতম সেখানে এখানকার তরমুজ এতই সুস্বাদু যে তার কোনো তুলনা করা যায় না। বুখারার কুলেরও কোনো তুলনা হয় না।….’
সমরখন্দ শহরের ভৌগোলিক অবস্থান, তার ঋতুকালীন বৈচিত্র্য, খাদ্য—পানীয়ের সাধন, নদী—নালা, উর্বর ভূমি ও উচ্চ স্তরের কৃষি উৎপাদন এ সব বিবেচনা করেই যে আমির তাইমুর সমরখন্দকে তাঁর রাজধানী করেছিলেন, সে কথাও লিখতে ভোলেননি তাঁর চতুর্থ অধঃস্তন বাবুর। তিনি লিখেছেন—‘অবশ্যই এখানকার উর্বর ভূমির কারণেই তাইমুর বেগ সমরখন্দকে তাঁর রাজধানী করার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ‘
সমরখন্দের পর বাবুর তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি আন্দিজান উদ্ধারে অভিযান চালান এবং তা অধিকারও করে নেন। আন্দিজানের পর বাবুর তাশখন্দ অভিযানে রওনা হয়ে যান। বুখারা, সমরখন্দ ও তাশখন্দ আমির তাইমুরের নিজহাতে গড়া শহর। বাবুর ওই শহরগুলোকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে বিবেচনা করতেন।
সেনানায়ক ও সম্রাট হিসেবে বাবুরের জীবনে জয়—পরাজয়ের ঘটনা পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়েছে। যে সমরখন্দকে তিনি পরম আপনার বলে বিবেচনা করতেন, যা নিয়ে তাঁর এতই গর্ব ছিল, সেই সমরখন্দ বেশিদিন তাঁর অধিকারে থাকতে পারেনি। উজবেকদের সহায়তায় শায়বানি খানের নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে বাবুর পরাজিত হন এবং সমরখন্দ তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের ফারগানাও।
সমরখন্দ ও ফারগানা হারানোর পর বাবুর তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন—‘আমার হাত থেকে সমরখন্দও বেরিয়ে গেল এবং ফারগানাও।
তার পরের অবস্থা সম্বন্ধে বলছেন—‘এবার আমার জানা ছিল না যে, আমি কোথায় যাচ্ছি, আমার মনজিল কোথায়।’ তারপর, এক অবিস্মরণীয় কষ্টদায়ক যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন বাবুর। এক এবড়ো—খেবড়ো ভয়ংকর পার্বত্য পথ। পদে—পদে বিপদ। পাহাড়ি খাদ। পা পিছলালে মানুষ পড়ে গেলে কোথায় যে হারিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক—ঠিকানা থাকবে না। সেই পথ পেরিয়ে তিনি এক সুন্দর ঝিলের কিনারে এসে পৌঁছালেন। তিনি শ্রান্ত সৈনিক কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য দৃষ্টির তুলনা হয় না। কারণ, তিনি লেখক—কবি শিল্পী। তিনি সেই সুন্দর ঝিলের পাড়ে যাত্রা বিরতি করলেন ক্লান্তি নিবারণের জন্য।
কিন্তু বীর—সৈনিকের জীবনে অলসতার জায়গা নেই। তিনি যে কর্মবীর। তিনি বাদশাহী লাভ করবেন, পৃথিবীর এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রের। একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই সামাজ্যের কোটি কোটি মানুষের তিনি ভাগ্য বিধাতা হবেন। তাই আর বিলম্ব নয়। চলে প্রস্তুতি। পুনঃ সমরখন্দ বিজয়ের প্রস্তুতি।
পদে পদে চলতে থাকেন। এ চলার যেন শেষ নেই। অবিরাম পথ চলা। চলার পথে যেখানেই নামাজের সময় হয়েছে, সেখানেই নামাজ পড়ে নিয়েছেন। তিনি যে মুসলিম। যে আল্লাহর বাধ্য, সে মুসলিম। আর মুসলিম পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নামাজ। সেই নামাজ তাই ছুটে যেতে পারে না। বলাবাহুল্য, এ যাত্রায় বাবুর সমরখন্দ অতি সহজে জয় করে নিলেন।
৭ জুন ১৫০২ ঈসায়ী থেকে ২৬ জুন ১৫০৩ ঈসায়ী তক সময়ের মধ্যে সমরখন্দ ফারগানার লালসায় হাতছাড়া হয়ে গেল। বাবুর তাঁর এই বিপর্যয়ের কথা অতি সংক্ষেপে লিখেছেন : ‘আন্দিজান অবধি আমার সেনা পৌঁছাতে পেরেছিল তখন কোথাও থেকে আমার সৈনিকদের কাছে খবর পৌঁছাল যে, খানেদের সমর্থন আমার পক্ষে আর নেই। … এ খবর যখন পৌঁছাল তখন আমি গন্তব্যে পৌঁছাতে অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছিলাম, তখন রাতের অন্ধকারে আমার অধিকাংশ সৈন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেল।’
বলাবাহুল্য, ফারগানার লালসায় সমরখন্দ বাবুরের হাতছাড়া হয়ে গেল।
তারপর আসে বাবুরের কাবুল বিজয়ের কথা। এক দীর্ঘকালীন উত্থানপতন ও দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাবুর একটি সুগঠিত ও স্থায়ী রাজ্য লাভ করেন, যার নাম কাবুল। কাবুলকে ঘিরেই বাবুরের হিঁদুস্তান বিজয়ের স্বপ্ন যেমন সফল হয়েছিল তেমনই কাবুল তাঁকে পারিবারিক শান্তি—সুখের মুখ দেখিয়েছিল। এ রাজ্যে তাঁর বংশের আর কারো কোনো অধিকার ছিল না। একমাত্র বহিঃশত্রু ছাড়া ঘরশত্রুদের উৎপাতের কোনো সুযোগ এখানে আর ছিল না। বাবুর কাবুলের বাদশাহ হয়ে বসেন। তিনি সেখানকার মানুষের আপনজন হয়ে যান এবং তাঁরাও তাঁর আপনজন হয়ে যান। হয়ে যায় ‘বসুধৈব কুটুম্বকম।’ বাবুর তাঁর কাবুল বিজয় সম্পর্কে একস্থানে লিখেছেন—‘আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে কাবুল ও গজনীর প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমার অধিকারে এসে গেল।’
ফারগানা রাজ্য ও আন্দিজান ছিল বাবুরের মাতৃপিতৃভূমি। যে ভূমিতে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেননি তিনি। দীর্ঘ সংগ্রামদীর্ণ পথ পেরিয়ে তিনি নতুন ভূমি পেয়েছিলেন—কাবুল ও গজনী। এ তাঁর মাতৃপিতৃভূমির মতোই যেন তাঁকে আপন করে নিয়েছিল।
কাবুলকে তিনি বড় আপন করে পেয়েছিলেন। সেই কাবুলের ভৌগোলিক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন একজন ভূ—তত্ত্ববিদ পণ্ডিতের মতো, সেখানকার আবহাওয়া, ভূ—প্রকৃতি ও মাটি—মানুষের প্রতিটি তথ্য যেন তাঁর নখদর্পণে।
তিনি যেমন দিয়েছেন কাবুলের নগরীয় বর্ণনা, তেমনি দিয়েছেন এই পর্বতবেষ্টিত নগরীর জীবনযাত্রার নির্ভরযোগ্য তথ্য। কাবুলের বাণিজ্য নগরীর বর্ণনা পড়লে মনে হবে একজন প্রবীণ সাহিত্যিকের কলমের অনর্গল বাক্য—প্রবাহ। এখানে তাঁর লেখনী যেন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ধারাপ্রবাহ হয়ে বয়ে গেছে। কাবুলের আবহাওয়া ও উৎপন্ন ফসলাদির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি আবহাওয়া বিশারদ পণ্ডিতের মতো। সেখানকার ফলমূলের মধ্যে বিশেষ করে নাম করেছেন আঙুর, আনার, চেরি, আলুবুখারা, নাশপাতি ইত্যাদির। গ্রীষ্মকালের জনপ্রিয় পানীয়ের মধ্যে তিনি লেবু পানি ও আখের রসের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক মধু উৎপন্নের কথাও বলেছেন। মৌমাছিরা এখানে বড় বড় চাকে মধু ভরে রাখে। এছাড়া নানা ফলমূল থেকে যে প্রচুর শরাব উৎপন্ন হয় সে কথাও লিখতে তিনি ভোলেননি। তিনি এখানকার মধুর আবহাওয়ার কথাও লিখেছেন। তবে খাদ্য—শস্য উৎপাদন যে তেমন হয় না, তার জন্য যে তাদের অন্য দেশের মুখাপেক্ষী থাকতে হয় একথা তিনি একজন দায়িত্বশীল বাদশাহর মতো অনুভব করেছেন এবং একজন দায়িত্বশীল লেখকের মতো সে কথা লিখেছেন।
কাবুলের বাদশাহ ও পণ্ডিত, বাবুর কাবুলের কোনো বর্ণনাই প্ৰায় বাদ দেননি। তিনি কাবুলের গৃহপালিত পশুদের চারণক্ষেত্র বা তৃণভূমির বর্ণনা দিতেও ভোলেননি।
তিনি কাবুলের পার্বত্যাঞ্চলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হিন্দুকুশ পর্বতামালার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর লেখনীতে। তিনি এখান থেকে উদ্ভূত পার্বত্য পথগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। কোন ঋতুতে কোন পথ কেমন, কীভাবে তা অতিক্রম করা হয় তার কোনোটাই বাদ যায়নি তাঁর লেখনী থেকে। কাবুল থেকে হিঁদুস্তানে যাওয়ার পথের বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন খাইবার গিরিপথের কথা। তাঁর রচনায় বিভিন্ন সময় হিঁদুস্তানের কথা এসেছে। আমি লক্ষ করি, হিঁদুস্তান শব্দটি উচ্চারণের সময় তাঁর মধ্যে একটা সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধা ভাবের প্রকাশ ঘটে। এ এক অদ্ভুত দুর্বলতা। বোঝা যায়, এদেশ দেখার বা জয় করার আগে এ দেশকে তিনি বড় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাকে জায়গা দিয়েছিলেন অন্তরের অন্তঃস্তলে।
বাবুর তাঁর কাবুল বিষয়ক লেখায় সেখানকার বাসিন্দাদের জাতি ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয় দিয়েছেন একজন নৃবিজ্ঞান বিশারদ পণ্ডিতের মতো। তিনি এখানকার বাসিন্দাদের জাতিগত পরিচয় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উল্লেখ করেছেন। বলাবাহুল্য, বাবুরের আত্মকথায় কাবুলের বর্ণনা সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে বিদ্যমান রয়েছে।
বাবুর কাবুলের মানব ও প্রাকৃতিক সাধনের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ করতে গিয়ে সেখানকার জ্বালানি কাঠেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তা ছাড়া ফসলপাতি উৎপাদনে পানিসেচ ও তার সাধনের কথাও সবিস্তার উল্লেখ করেছেন। তিনি সেখানকার ব্যাধ পেশার লোক ও মৎস্যজীবী পেশার মানুষদের কথাও সবিস্তারে লিখেছেন।
আগেই বলা হয়েছে, বাবুর হিঁদুস্তান বিজয়ের স্বপ্ন আজীবন দেখে এসেছেন। তবে, কাবুলই হয়েছিল তার হিঁদুস্তান বিজয়ের সবচেয়ে বড় আর্থিক—সামরিক ও ভৌগোলিক সহায়। ভারত বিজয়ের জন্য বাবুরের যে আজীবন প্রস্তুতি ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ভারত বিজয়ের পথে সামরিক—আর্থিক—মানবিক—সামরিক—ভৗগোলিক—প্রাকৃতিক বহু সহায় একযোগে তাঁর সহযোগী হয়েছিল। তাঁর ভারত বিজয় ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।
জীবনের নানা উত্থান—পতন আর বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাবুর অবশেষে হিঁদুস্তান বিজয়ে সফল হলেন। বলা চলে, বাবুর ভারত জয় করেছিলেন মানে দেশ হারিয়ে দেশ পেয়েছিলেন। ফারগানা তাঁর পিতৃরাজ্য আন্দিজান তাঁর জন্মভূমি—কোথাও তিনি শান্তি স্বস্তি ঠাঁই পাননি। কখনো বিজয়ীর মতো কখনো যাযাবরের মতো, কখনো অসহায় আতুরের মতো, আর কখনো বা জীবন রক্ষায় পলায়নপর পরাজিত সৈনিকের মতো মধ্য এশিয়ার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ অবশেষে বীরের কাছেই ধরা দিল। বাবুর জন্মেছিলেন আন্দিজানে, শাসক হয়েছিলেন ফারগানার, তারপর কত উত্থান, কত পতন, দুর্গম কণ্টকাকীর্ণ প্রস্তর—বেষ্টিত পথ, কখনো বা কাঁটাদার মরুভূমি, কখনো বা সমতলভূমি, উপত্যকা অধিত্যকা পেরিয়ে এক এতিম, অথচ প্রতিভাধর বালক, যার এক হাতে ছিল অসি, আরেক হাতে মসি – তাই দিয়ে তিনি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জয় করলেন। অসির জোরে হলেন বিজিত ভূখণ্ডের বাদশাহ, মসির জোরে হলেন জগদ্বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক। মানব জাতি ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর উদাহরণ।
বাবুর ভারত জয় করলেন। এ ছিল তাঁর চিরস্থায়ী বিজয়। মাতৃভূমি ফারগানা ও আন্দিজান তাঁকে জন্ম দিয়েছিল, প্রতিষ্ঠা দেয়নি, উপেক্ষা দিয়েছিল ভূখণ্ড দেয়নি। এক প্রতিভাবান বালক পথেই কিশোর হয়েছেন, পথেই যুবক হয়েছেন। তারপর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাদশাহ হয়েছেন। জীবনের এই পতন—অভ্যুদয় বন্ধুর পথ পেরিয়ে সন্তান—সন্ততির জনক হয়েছেন। নিজের জন্মভূমি তিনি তাদের দেখাতে পারেননি, তা সত্ত্বেও তিনি তাদের স্থায়ী ভূমি দিয়েছেন, স্থায়ী ঠাঁই দিয়েছেন, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার পথ দেখিয়েছেন।
তিনি ভারত জয় করেছেন, ভারত তাঁর জন্মভূমি হয়নি, কিন্তু মৃত্যুভূমি হয়েছে, তাঁর জীবন এবং মৃত্যুকে ঠাঁই দিয়েছে ভারতের ভূমি। ভারত শুধু তাঁর নয়, তাঁর জন্ম, কর্ম ও সাধনার বলে তাঁর উত্তর পুরুষদের চিরকালের ঠিকানা হয়ে গেছে! আন্দিজান থেকে দিল্লি, ফারগানা থেকে লালকেল্লা সুদীর্ঘ পথ। এই পথ ছিল তাঁরই আঁকা পদচিহ্নের স্বরূপ। তাঁর আত্মজীবনীর কল্যাণে বিশ্বসাহিত্য তাঁকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না আর ফারগানা থেকে দিল্লি বিজয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস কেউ কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না। সেই ধারাবাহিকতার কেউ অস্বীকার করবে না ভারতবর্ষের আর্থ—সামাজিক ও রাজনৈতিক—সংস্কৃতির ইতিহাস, কেউ অস্বীকার করতে পারবে না স্থাপত্যকলা ও শিল্প—সংস্কৃতির ইতিহাস। শিল্প—সংস্কৃতির সঙ্গে লেখা হয়ে গেছে সাহিত্যের ইতিহাসও। কে ভুলতে পারে এই গৌরবময় ইতিহাসের ধারা, কে ভুলতে পারে বাবুর থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের অবধিকার সেই সোনালি শৃঙ্খলকে, যা ভারতবর্ষের মাটিতে চিরকালের জন্য অমর হয়ে রয়ে গেছে!!
‘তুজুক—ই—বাবরী’র ফার্সি অনুবাদ থেকে ইংরেজি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন মিসেস বেভারিজ। ‘মেমোরিজ অব বাবুর’ নামে এই গ্রন্থ সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় লেখক সৈয়দ আবিদ রিজভি এ গ্রন্থের উর্দু ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে একটি হিন্দি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এ গ্রন্থ এরই বঙ্গানুবাদ।
মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস
চৈতা বিশ্বাসবাড়ি
বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ঈসায়ী