সম্রাট কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহ—ইতিহাসে যিনি মুবারক খিলজি নামে পরিচিত তাঁর সহোদর ভাইদের প্রতি এ নিষ্ঠুর আচরণজনিত পাপের পরিণাম ফল তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছিল। ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়েন। সুলতান আলাউদ্দীন যেমন মালিক কাফুরের পাতা ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পারেনি; তেমনি মুবারক খিলজিও পারেননি নীচু জাতের হিদু থেকে ধর্মান্তরগ্রহণকারী খসরু খাঁ—র পাতা ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে। অতীতে কৃত তাঁর এ পাপকর্মফল বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে তাঁকেই আঘাত করে শেষ পর্যন্ত ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে দুনিয়ার বুক থেকে তাঁকে চিরকালের জন্য সরিয়ে দেয়। এখানে একটা বৃত্তান্ত সবিশেষ উল্লেখ করা একান্ত প্ৰয়োজন।
আউলিয়া—কুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া হিঁদুস্তানের জনগণের হৃদয়ে অলৌকিক শাসন সমানে জারি রেখেছিলেন। স্বৈরাচারী, বিলাসী ও স্বেচ্ছাচারী মুবারক খিলজি দুর্ভাগ্যবশত, স্বকপোলকল্পিত এক আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সাথে অকারণে এক বিবাদে খাড়া করেন। কোনো আমির বা অমাত্য তাঁকে নিজামউদ্দীন সম্পর্কে সম্ভবত ভুল বুঝিয়ে থাকবেন। অদূরদর্শী ও বলদর্পে অন্ধ মুবারক খিলজি নিজামউদ্দীনকে তাঁর মসনদ থেকে অন্যায়ভাবে সরিয়েও দিতে চেয়েছিলেন; চেষ্টাও কম করেননি; কিন্তু আল্লাহর রাজত্বে কার মসনদ থেকে কে কাকে সরিয়ে দেয়? অবশেষে, মুবারক খিলজির মাথা হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ থেকে নিচে পড়ে গড়াগড়ি খেল। আউলিয়াকুলের সম্রাট নিজামউদ্দীন তাঁর মসনদে আসীন থেকে সমানে রাজত্ব চালিয়ে গেলেন।
মুবারক খিলজি তাঁর প্রিয়পাত্র খসরু খাঁ—র হাতে কীভাবে নিহত হয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইবনে বতুতা লিখেছেন—‘কুতুবউদ্দীনের (মুবারক খিলজি) আমিরদের মধ্যে খসরু নামক অত্যন্ত সুন্দর ও সাহসী এক বীরপুরুষ ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের চান্দেরি ও মেরার রাজ্য দুটি ইনিই জয় করেছিলেন। সম্রাট খসরু খাঁর সাথে অত্যন্ত বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
সম্রাটের শিক্ষক কাজী খাঁ (আসল নাম মওলানা জিয়াউদ্দীন বিন মওলানা শিহাবুদ্দীন খাতাত) সে সময়ে ‘সদরে জাহাঁ’ ছিলেন। তাঁকে আজিমউশ্শানও (মহান ঐশ্বর্যশালী) বলা হতো।
কাজী খাঁ মালিক খসরুকে (খসরু খান) অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন হিদু এবং তিনি হিদুদের ব্যাপারে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতেন। এজন্য তিনি কাজী সাহেবের ক্রোধের পাত্রে পরিণত হন। ইনি সম্রাটকে খসরুর ব্যাপারে বারবারই সাবধান করে দিতেন কিন্তু সম্রাট তাঁর কথায় কোনও গুরুত্ব না দিয়ে তা অমূলক বলে উড়িয়ে দিতেন। আল্লাহ তো তাঁর মৃত্যু তার হাতেই লিখেছিলেন, তা কে খণ্ডাতে পারে? কারণ এটাই ছিল যে, সম্রাট তাঁর পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা কানে পর্যন্ত তোলেননি।
একদিন খসরু খাঁ সম্রাটের কাছে নিবেদন করলেন—কিছু হিদু মুসলমান হতে চাচ্ছেন। সে যুগের প্রথানুসারে হিদুরা মুসলমান হতে চাইলে সম্রাটের উপস্থিতি আবশ্যক বলে গণ্য হতো। এবং সম্রাটের পক্ষ হতে খিলআত ও স্বর্ণকঙ্কন পারিতোকিরূপে প্রদান করা হতো। প্রথানুসারে সম্রাটও ঐ সব লোকেদের রাজদরবারের ভিতরে আসার জন্য বললেন; খসরু খান বললেন, তারা তাদের স্বজাতীয়দের কাছে লজ্জিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কারণে, রাতের বেলায় আসতে চাইছে। সম্রাট সে অনুমতিই দিলেন।
এবার মালিক খসরু (খসরু খান) বেশ কয়েকজন লম্বা—তাগড়া হিদু যুবককে ঠিক করে তার নিজের ভাইকেও সে দলে ভিড়িয়ে নিলেন। গরমের দিন ছিল। সম্রাটও উঁচু ছাদের উপরে ছিলেন। কয়েক জন দাস ছাড়া আর কেউ তাঁর আশপাশে ছিল না। এ লোকেরা চতুর্থ দরজা পেরিয়ে পঞ্চম দরজায় পৌঁছালে তাদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখে কাজী খাঁ সন্দিহান হয়ে তাদের পথ রোধ করলেন এবং আখবন্দে আলম (জগতের প্রভু) সম্রাটের অনুমতি চাইতে বললেন। একথা বলতেই তারা কাজী সাহেবকে ঘিরে ফেলে হত্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল শুরু হয়ে গেল। সম্রাট এর কারণ জানতে চাইলে মালিক খসরু বললেন, কাজী সাহেব হিদুদের ভিতরে আসতে দিচ্ছেন না বলে ঝগড়া—ঝামেলা হচ্ছে। সম্রাট এবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হলেন দরজা বন্ধ ছিল। তিনি দরজায় আঘাত দিতে দিতেই খসরু খাঁ তাঁকে এসে আক্রমণ করল। কিন্তু সম্রাট ছিলেন খুবই বলশালী। শত্রুকে দাবিয়ে রাখতে তাঁর কিছুমাত্রও বিলম্ব হলো না। কিন্তু ইতোমধ্যেই অন্য হিদুরাও সেখানে এসে গেল। খসরু চিৎকার করে বললেন, সম্রাট আমাকে দাবিয়ে রেখেছেন। একথা শুনতেই হিদুরা সম্রাটকে হত্যা করে তাঁর মাথাটা হাজার স্তম্ভের রাজপ্রাসাদের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল।’
মুবারক খিলজির হত্যাকাণ্ডের ভিতর দিয়ে ভারতের সুলতানি আমলের খিলজি শাহী বংশের অবসান ঘটল। তারপরেই নিবর্ণের হিদু থেকে আগত খসরু খাঁ—ইবনে বতুতার বর্ণনানুসারে, মনেপ্রাণে যিনি হিদু ছিলেন, এবার দিল্লির রাজসিংহাসনে তিনিই আসীন হলেন।
তেরো
কোনো রাজবংশের সাথে সম্পর্কবিহীন এক ব্যক্তি, যার শিরা ও ধমনিতে প্রবাহিত ছিল না রাজরক্ত, নিবর্ণের পৌত্তলিক সমাজ হতে আগত, নামেমাত্র ইসলামগ্রহণকারী এক ব্যক্তি, মনে—প্রাণে তিনি আদৌ মুসলমান ছিলেন কি—না সন্দেহ, সম্পূর্ণ ছলনা, কপটতা ও বিশ্বাঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে নিজপ্রভুকে হত্যার মাধ্যমে দিল্লির মসনদে সমাসীন হয়ে মুসলমান দণ্ডধারী হয়ে মুসলমানদের উপর চণ্ড—পীড়ন চালাতে শুরু করলেন। অনতিবিলম্বেই তাঁর জাতিপরিচয়গত বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর আচরণে সুপরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগল। তাঁর চণ্ডশাসনে মুসলিম জনমনে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠতে লাগল। যদিও তিনি কূটনৈতিক চাতুরতার আশ্রয় নিয়ে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, আলেম—ওলামা ও পীর—মাশায়েখদের সর্বপ্রকারে খুশি রেখে নিজের চণ্ডক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার জন্য সর্বপ্রকারের প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। সিংহাসনে আসীন হয়েই প্রচুর অর্থ ও ধন—সম্পদ ব্যয় করলেন সমাজের অভিজাতদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা আদায়ের জন্য। দিল্লির আধ্যাত্মিক মসনদে সমাসীন হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়াকেও দেওয়া হয় পাঁচ লক্ষ মুদ্ৰা। মহাত্মা নিজামউদ্দীন তা গণীমতের মাল বিবেচনা করে দিল্লির নিঃস্ব ও গরিবদুঃখীদের মধ্যে অনতিবিলম্বেই বিলিয়ে দিলেন।
খসরুর চণ্ডশাসনের মুসলিম সমাজের সর্বত্রই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। তাই এসব বদান্যতা তার কৃত পাপ থেকে তাকে রক্ষা করতে পারল না। মুসলমানদের প্রতি খসরু খাঁ—র নিষ্ঠুর ও বর্বর আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন—‘খসরু মালিক (খসরু খাঁ) ক্ষমতাসীন হয়েই গো—হত্যার বিরুদ্ধে আদেশ জারি করলেন। গো—হত্যাকারীকে গরুর চামড়া দিয়ে সেলাই করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিতে লাগলেন। এ জাতির (হিন্দু) লোকেরা গরুকে পূজা করে। ধর্ম ও ঔষধীয় জ্ঞানে তারা গো—মূত্র পান করে এবং তার মল দিয়ে গৃহ ও প্রাচীর—আদি লেপন করে থাকে। খসরু খাঁ—র বড় খাহেশ ছিল যে, মুসলমানরাও এমনটিই করুক। এর ফরে, জনগণ (মুসলমানরা) তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তুগলক শাহের (গিয়াসউদ্দীন তুগলক) পক্ষ অবলম্বন করল।’
সম্রাট পদে আসীন হওয়ার পর খসরু খাঁ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজ—ফরমান পাঠালেন। এ ফরমান যখন গিয়াসউদ্দীন তুগলকের কাছে গিয়ে পৌঁছাল, তখন তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তা পা দিয়ে দলে দিয়ে চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেন। বস্তুত, বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ইবনে বতুতা—র বর্ণনা—‘সম্রাজ্যের উপর তুগলকের এ আক্রমণের ফলে ভয়ানক যুদ্ধ হলো। যখন সম্রাটের সমস্ত সৈন্য পালিয়ে গেল এবং সম্রাটের কাছে আর কেউ রইল না, তখন তিনি অশ্বপৃষ্ঠ হতে অবতরণ করে রাজপোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে ভারতবর্ষের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মাথার চুল পিছনের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে এক বনের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। খসরু খাঁ তিনদিন যাবত সেই বনেই পালিয়ে রইলেন।
গাজী মালিক ‘গিয়াসউদ্দীন’ উপাধি ধারণ করে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে অসীন হলেন এবং সুদৃঢ় মনোবল ও বিচক্ষণতার দরুন অনতিবিলম্বেই তিনি সাম্রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হলেন। ওদিকে জঙ্গলে খসরু খাঁ—র সন্ধান পাওয়া গেল।’ ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে—‘তুগলক খসরু খাঁ—কে ধরার জন্য তাঁর পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন। খসরু খাঁ—কে এভাবে ধরে ফেলা হলো। জুনাহ খাঁ যখন তাঁকে ঘোড়ার গাড়িতে করে সম্রাটের সামনে নিয়ে এলেন, তখন তিনি সম্রাটকে বললেন—‘আমি ক্ষুধার্ত। একথা শুনে সম্রাট তাঁর জন্য খাদ্য ও শরবত আনালেন।
তুগলক যখন তাঁকে পান—শরবতাদি খাইয়ে দিলেন তখন খসরু সম্রাটকে বললেন—‘এভাবে ভর্ৎসনা না করে আমার সাথে সম্রাটের মতো আচরণ করা হোক। একথা শুনে তুলগক বললেন—‘আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য।’ একথা বলার পর তিনি (সম্রাট তুগলক) আদেশ দিলেন—‘কুতুবউদ্দীনকে (মুবারক খিলজিকে) যেখানে ফেলে সে হত্যা করেছিল, সেখানে নিয়ে গিয়ে সেভাবেই হত্যা করে তার মাথাটাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দাও।’ যথাযথভাবে সে আদেশই পালন করে মৃতদেহকে স্নান ও কাফন পরিয়ে কুতুবউদ্দীনের সমাধিক্ষেত্রেই সমাধিস্থ করা হলো।’
দিল্লির সিংহাসনে সমাসীন হওয়ার পর সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সাথে এক অযথা মনোমালিন্যের অবতারণা করেন। তাঁর মতো সর্বত্যাগী, সাধক মহাপুরুষের সাথে অযথা মনোমালিন্য ও অশান্তি সৃষ্টি করে তিনি নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছিলেন। সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদের আমল থেকে তৎকালীন সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ব্যাপী দিল্লির অদূরেই গিয়াসপুরে নিজের দীওয়ানখানায় বসে যিনি হিঁদুস্তানবাসীর হৃদয়ের চিকিৎসকরূপে তাঁদের উপর এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক শাসন কায়েম রেখে চলেছিলেন, কিন্তু মনের ভুলেও দিল্লির রাজনৈতিক অঙ্গনের পানে চোখ তুলে তাকাননি; সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ থেকে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত সুদীর্ঘ অর্ধশতাধিক বর্ষের দিল্লি রাজনৈতিক উত্থান—পতনের তিনি ছিলেন নীরব সাক্ষী; তিনি কখনই রাজ্য ও রাজনীতির প্রতি কোনো প্রকারের আগ্রহ প্রকাশ করেননি; কাউকে বিব্রতও করেননি; নিজেও বিব্রত হননি; কিন্তু দু’জন সুলতান তাঁর প্রতি অযথা
অন্যায় আচরণ করেছেন; কিন্তু সবকিছু তিনি নীরবে মুখ বুজে সয়ে গিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, তাঁদের দুঃখজনক পরিণতিরও তিনি জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন—কিন্তু নীরব সাক্ষী। কারো প্রতি সামান্য কটাক্ষ ও সামান্যতম মন্ত ব্যও করেননি।
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি খুবই বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার এ নীরব সাধনার গুরুত্ব উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা তাঁর ছিল; তাই তাঁকে সামান্য একটু ঘা দিয়ে নিজে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলকের গুণও ছিল কিন্তু তার সাথে ছিল দুর্বল এক রাজনৈতিক স্খলন। দিল্লির সুলতানরা বিশাল ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, কিন্তু দিল্লির অদূরেই ত্যাগী—সন্ন্যাসী—সাধকপীর নিজামউদ্দীন আউলিয়ার গিয়াসপুর কখনোই দিল্লির সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি; দিল্লির সম্রাটদের শাহী—ফরমান সেখানে চলত না। কী করে তা সম্ভব? যেখানে আউলিয়া—কুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন তাঁর আধ্যাত্মিক সিংহাসনে সমাসীন থেকে সমগ্র হিন্দুস্থানের উপরে তাঁর নৈতিক শাসন জারি রেখেছেন, সেখানে দিল্লির কোন সম্রাটের সাধ্য যে সেখানে রাজনৈতিক ফরমান জারি করেন? বাস্তবিকই কেউ তা পারেনি। তা পারার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন মুবারক খিলজি ও গিয়াসউদ্দীন তুগলক। তাঁদের দুঃখজনক পরিণতির কথা তো ইতিহাস পাঠকের অনবগত থাকার কথা নয়!—‘রে শিয়াল, তুই তোর নিজের জায়গা ছেড়ে বাঘের সাথে লড়াই করতে এসেছিস? তাহলে তার মজা দেখে নে’ এবং ‘হনুজ দিল্লি দূর্ অস্ত্’– অর্থাৎ দিল্লি এখনও অনেক দূর—এ দুটি উক্তির মধ্যে ইতিহাসের দুই নৃপতির দুঃখজনক পরিণতির কথা ইতিহাসে চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেছে। সম্রাট গিয়াসউদ্দীন তুগলক দিগ্বিজয় শেষে দিল্লিতে ফিরে আসার আগেই শাহী ফরমান জারি করেছিলেন—তাঁর দিল্লিতে আগমনের পূর্বেই যেন নিজামউদ্দীন দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। এ কথার জবাবে হজরত নিজামউদ্দীনের প্রতিক্রিয়া ঐ একটি কথাতেই চিরস্মরণীয় হয়ে আছে—‘হনুজ দিল্লি দূর—অস্ত্’—অর্থাৎ দিল্লি এখনও অনেক দূর।
সম্রাট গিয়াসউদ্দীন তুগলক দিগ্বিজয় শেষে দিল্লিতে ফিরছিলেন। এর পরের বর্ণনা উদ্ধৃত করছি ইবনে বতুতার গ্রন্থ থেকে—‘রাজধানীর নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছানোর পর সম্রাট তাঁর পুত্র জুনাহ খাঁ—কে আফগানপুরে তাঁর জন্য এক নতুন প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দিলেন। জুনাহ খাঁ তিনদিনের মধ্যেই প্রাসাদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন। মাটিতে কাঠের খাম্বা স্থাপন করে তার উপরে প্রাসাদ নির্মাণ করা হলো। সেখানে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাষ্ঠফলকও লাগানো হয়েছিল। সম্রাটের মনোনীত ও ‘খাজা জাঁহা’ উপাধিপ্রাপ্ত বাস্তুবিদ্যাবিশারদ আহমদ ইবনে আয়াযের প্রদত্ত নকশা অনুযায়ী এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। এ প্রাসাদের স্থান—বিশেষে হাতির পায়ের চাপ পড়তেই পুরো ভবনটি ধসে পড়ে।’—এভাবেই সম্রাটের অকস্মাৎ মৃত্যবরণ করতে হয়।
গিয়াসউদ্দীন তুগলক বাংলা থেকে নিজামউদ্দীন আউলিয়ার উদ্দেশে ফরমান পাঠিয়েছিলেন এই বলে—‘ইয়া শায়খ আনজা বাশদ ইয়া মন’—অর্থাৎ আপনি এখানে আসুন নতুবা আমি ওখানে যাই। এর জবাবে হজরত নিজামউদ্দীন বলেছিলেন—‘হনুজ দিল্লি দূর অস্ত’—দিল্লি এখনও অনেক দূর।
দিল্লি পৌঁছানোর পূর্বেই সম্রাট মৃত্যুমুখে পতিত হন—এবং তিনিও। সম্রাট আলাউদ্দীনের পুত্র খিজির খাঁ তাঁর শিষ্য ছিলেন এবং তিনিই শেখের জীবতকালেই তাঁর জন্য সমাধি নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি তাঁর মৃতদেহ দাফন করার অনুমতি দিয়ে যাননি। বর্তমান সমাধি ভবনটি সম্রাট আকবরের আমলে ফওয়াইদু খাঁ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং সম্রাট শাহজাহানের আমলে শাহজাহানপুরের হাকিম (গভর্নর) খলিলুল্লাহ এর চারিপাশে লাল পাথরের গোলাকার প্রাচীর নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
এখানে ইতিহাসের সামান্য পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন।
মুহম্মদ ঘুরির মুক্ত দাস কুতুবউদ্দীন আইবক ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে ঘুরি—সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেন তথা তুর্কি সাম্রাজ্য বা দাস বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব প্রান্তে বঙ্গ—বিজয়ী বখতিয়ার খিলজি বাংলা ও বিহারে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। কুতুবউদ্দীন আইবক ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে ইলতুতমিশ দিল্লির সুলতান হলেন (১২১০ খ্রি.)। সালতানাত লাভের পরই তিনি উত্তর—পশ্চিম ভারতসহ বাংলা ও বিহারের প্রতি মনোেযাগী হন। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছর রাজত্বের পর ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল—মে মাসে ইলতুতমিশের পুত্র রুকনউদ্দীন ফিরোজ সিংহাসনারোহণ করেন। কিন্তু তিনি অযোগ্য সাব্যস্ত হওয়ার পর ইলতুতমিশের সুযোগ্য কন্যা রাজিয়া সুলতানা ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ নভেম্বর ক্ষমতাসীন হন। ১২৩৬ এর ১৯ নভেম্বর থেকে ১২৪০ এর ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত তিন বছর অবধি রাজত্ব করার পর রাজিয়া সুলতানা নিহত হন। তারপর মুইজউদ্দীন বাহরাম শাহ ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল ক্ষমতাসীন হন। ১২৪২ খ্রিষ্টাব্দে ১০ মে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে আলাউদ্দীন মাসউদকে দিল্লির সিংহাসনে বসানো হয়। ১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে পদচ্যুত করে সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদকে সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি ছিলেন শামসী যুগের শেষ সুলতান। দিল্লির সিংহাসনে তিনি ২০ বছর আসীন ছিলেন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়। এ ২০ বছরের সময়কালে দিল্লি সালতানাতের রাজনৈতিক ক্ষমতা মূলত তাঁর মন্ত্রী বলবনের হাতেই ছিল। ঐ সময়ে ভারতের উত্তর—পশ্চিম সীমান্তে মঙ্গোলদের খুব বাড়বাড়ন্ত চলছিল। মঙ্গোলদের আতঙ্কিত করার জন্য বলবন ১২৪৬—৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু অভিমুখে রওনা হন কিন্তু সোদরা নদীর তট থেকে ১৫ মার্চ দিল্লিতে ফিরে আসেন। ঐ বছরেই তিনি যমুনা ও কালিঞ্জরের মধ্যবর্তী এলাকার হিদু বিদ্রোহী দলাকিমলাকীদের নির্মূল করে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন ১২৬৬ থেকে ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কুশল নেতৃত্ব দিয়ে দিল্লিকে মঙ্গোল আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। তাঁর রাজত্বকালে দিল্লি সালতানাতের সীমা উত্তর—পশ্চিমে সিন্ধুনদ, পূর্বে বাংলা, পশ্চিমে গোয়ালিয়র, বিয়ানা ও চান্দেরি এবং দক্ষিণ—পূর্বে কালিঞ্জর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তাঁর জীবতকালেই খিলজি তুর্কিদের উত্থান ঘটে এবং তাঁর মৃত্যুর পর দিল্লির সালতানাত থেকে বলবন—বংশীয়দের উৎখাত করে ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন সুলতান জালাউদ্দীন ফিরোজশাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং দিল্লির সালতানাতে খিলজি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর দু’বছর পর সুলতানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আলালউদ্দীন খিলজি তাঁর পতন ঘটিয়ে ১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে বসেন। পাক—ভারত—বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির ন্যায় প্রতিভাবান ও সুযোগ্য শাসক খুব বেশি আসেননি। ১২৯৬ হতে ১৩০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে সর্বমোট সাত বার মোঙ্গল আক্রমণ সংঘটিত হয়। সুলতান আলাউদ্দীন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাদের প্রত্যেকটি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেন। তিনি সর্বমোট ২০ বছর দেশ শাসন করার পর ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর ক্ষমতাসীন হন তাঁর পুত্র কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩১৬)। ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি অত্যন্ত স্বৈচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন এবং আপন ভাইদের প্রতি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করে একে একে তাঁদের হত্যা করান এবং তাঁরই একদা বিশ্বাসী পাত্রের হাতে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজেও নিহত হন। এভাবে খিলজি বংশের পতন ঘটে যায়।
কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহের হত্যাকারী খসরু খাঁ আসলে নিবর্ণের হিন্দু থেকে আগত ধর্মান্তরিত মুসলমান। ইসলাম ধর্মের স্বাভাবিক উদারতার কারণেই মুসলমানও উদার হয়ে থাকে। এজন্য কেউ নামে মাত্র ইসলাম গ্রহণ করলেও মুসলমানরা তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখেন না। খসরু খাঁ মুসলমানদের এই উদারতার সুযোগ নিয়ে কুতুবউদ্দীনকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন (১৩২০ খ্রি.) মুসলমানদের উপর চণ্ডশাসন কায়েম করেন। ঐ সময়কার আরব—পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—‘খসরু মালিক ক্ষমতাসীন হয়ে গো—হত্যার বিরুদ্ধ আদেশ জারি করলেন। গো—হত্যাকারীকে গরুর চামড়া দিয়ে সেলাই করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিতে লাগলেন। এ জাতির লোকেরা গরু পুজো করে। ধর্ম ও ঔষধীয় জ্ঞানে তারা গো—মূত্র পান করে এবং এবং গো—মল দিয়ে গৃহ—প্রাচীর ইত্যাদি লেপন করে থাকে। খসরু খাঁ—র বড় খাহেশ ছিল যে, মুসলমানরাও এমনটিই করুক। এর ফলে, জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে তুগলক শাহের পক্ষ অবলম্বন করল।’1
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গিয়াসউদ্দীন তুগলক তাঁকে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসলেন। এভাবে দিল্লির সালতানাতে তুগলকশাহী বংশের উত্থান ঘটল।
অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন ও করিৎকর্মা সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে পাঁচ বছর শাসন (১৩২০—২৫ খ্রি.) করার পর দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পর ক্ষমতায় আসেন তাঁর সর্বগুণসম্পন্ন পুত্র উলুগ খাঁ—জুনা খাঁ, ইতিহাসে যিনি মুহম্মদ বিন তুগলক (তুগলকের পুত্র মুহম্মদ) নামে জগৎ—প্রসিদ্ধ। ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সিংহাসনারোহণের সাথে সাথে ভারতের ইতিহাসে এক নয়া যুগের উত্থান ঘটে। তাঁর মতো প্রতিভাবান এবং সর্বগুণসম্পন্ন সুলতান তাঁর আগে এবং পরে আর কেউ আসেননি। তবে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা ব্যতীত। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর রাজত্ব করে ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে পীড়াগ্রস্ত হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরে ক্ষমতাসীন হন সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক (১৩৫১)। তিনি ৩৭ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক তাঁর জীবৎকালে তাঁর পুত্র মুহম্মদ শাহকে ১৩৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর দাস দলপতিরা মুহম্মদ শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে পরলোকগত ফতেহ খাঁ—র পুত্র তুগলক শাহকে সিংহাসনে বসাতে তাঁকে বাধ্য করেন। সুলতান মুহম্মদ শাহ তিনবার সিংহাসনচ্যুত হন এবং তিনবারই সিংহাসন অধিকার করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। রাজনৈতিক ডামাডোল ও বিদ্রোহ—অশান্তির মধ্যে অকস্মাৎ তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। তখন তাঁর পুত্র হুমায়ু খাঁ সুলতান আলাউদ্দীন সিকান্দারশাহ পদবি গ্রহণ করে হিংহাসনে বসে যান। এক মাস পনেরো দিন শাসন করার পর তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর দু’সপ্তাহ যাবত দিল্লি সিংহাসন খালি পড়ে থাকে। এর পর খাজা জাঁহার—র পরামর্শে পরলোকগত সুলতানের পুত্র মাহমুদকে, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পদবিসহ সিংহাসনে বসানো হয়। তাঁর শাসনকালেই জৌনপুর ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জৌনপুর তথা শর্কীরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে দিল্লি সালতানাতের ভাঙন ধরে। বিভিন্ন রাজ্য স্বাধীন হয়ে যেতে থাকে। নতুন নতুন রাজ্যের উদ্ভব ঘটতে থকে। দিল্লিতে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন না থাকাতে চারদিকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের অধীনে দিল্লি থেকে পালম গাঁও অবধি প্রদেশ মাত্র রয়ে যায়। ওদিকে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ গোয়ালিয়র পুনরাধিকার করার জন্য রাজধানী দিল্লি ত্যাগ করলে তাঁর বিরোধী আমিররা ফতেহ খাঁ—র পুত্র নুসরত খাঁকে মেওয়াত থেকে ডেকে নিয়ে ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরাত শাহ উপাধি দিয়ে ফিরোজাবাদের সিংহাসনে বসিয়ে দেন। ফলে দুই সুলতানের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। অন্য দিকে দীপালপুরের শাসক সারঙ্গখান ও মুলতানের শাসক খিজির খাঁ—র মধ্যে ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। সারঙ্গখান তাঁর ভাই মলু ইকবাল খাঁ—র সহায়তায় মুলতান ছিনিয়ে নেন এবং শায়খা খোকর ইরানে চলে যান এবং তিনি আমির তাইমুরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানন। তিনি তাঁর পথ প্রদর্শন করেন এবং সংক্ষিপ্ত পথ ধরে হিঁদুস্তান অভিমুখে অগ্রসর হন। সমরকন্দ থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে আমির তাইমূর তাঁর পৌত্র পীর মুহম্মদকে অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্ব দিয়ে হিঁদুস্তান অভিমুখে পাঠিয়েছিলেন। পীর মুহম্মদ ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু নদী পেরিয়ে উছ অবরোধ করেন। ৫ মার্চ ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পীর মুহম্মদ মুলতান অধিকার করে নেন। আর ওদিকে আমির তাইমূর ১০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ঝড়ের বেগে এসে উপস্থিত হন এবং ২৪ সেপ্টেম্বর ১৩৯৮ এ সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। তারপর তিনি পথের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে দিল্লি পৌঁছে ইকবাল খাঁ এবং সুলতান নাসিরুদ্দীনের সৈন্যদের পরাজিত করেন। ইকবাল খাঁ ও সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পালিয়ে গেলেন। তাইমুরের বীভৎস আক্রমণ ও দিল্লি জয়ের ফলে দিল্লিতে তুগলকশাহী বংশের পতন ঘটে গেল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে, তাইমূর দিল্লি জয় করেও নিজেকে দিল্লি তথা হিঁদুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করলেন না। বিপুল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে তিনি তাঁর আপন মাতৃভূমি ও তাঁর স্বপ্নের রাজধানী সমরকন্দে ফিরে গেলেন। আর তাঁর চতুর্থ অধস্তন পুরষ জাহিরউদ্দীন মুহম্মদ জালালউদ্দীন বাবুরের জন্য মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করে গেলেন!
তাইমুরের প্রস্থানের পর যুযুধান পক্ষগুলো দিল্লিতে আবার ফিরে এলেন। ইতোমধ্যে দিল্লি সালতানাত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মহু ইকবাল খাঁ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে মালব থেকে ডেকে এনে পুনরায় দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু তিনি তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে কনৌজ চলে যান। মলু ইকবাল খাঁ—র মৃত্যুর পর তিনি ১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দে আবার দিল্লি ফিরে আসেন এবং ১৪০৫ থেকে ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দিল্লির সিংহাসনে আসীন থাকেন। ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তুগলক বংশের শেষ শাসক সুলতান মাহমুদের মৃত্যু (১৪১২ খ্রি.)—র পর সমস্ত আমির দৌলত খাঁ লোদির প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে সুলতান বলে মেনে নেন। কিন্তু খিজির খাঁ, দৌলত খাঁ লোদিকে বন্দী করে হিসার—ফিরোজায় পাঠিয়ে দিয়ে ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে তিনি সৈয়দশাহী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুলতান রূপে শাসনকার্য শুরু করে দেন। দীর্ঘ ৭ বছর শাসন করার পর তিনি ২০ মার্চ ১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর উত্তরাধিকারী মুবারক শাহ ১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩ বছর যাবত শাসনকার্য চালান। তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা গেলে আমিররা তাঁর দত্তক পুত্র মুহম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু তাঁর সিংহাসন নিষ্কণ্টক ছিল না। এদিকে শর্কী শাসক ইব্রাহীম শর্কী দিল্লি সালতানাতকে কর পাঠানো বন্ধ করে দেন। ফলে কেন্দ্র আবারও ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। এদিকে দিল্লির আমির এর উলেমারা মালবের শাসক মাহমুদ খিলজিকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ দিল্লির উপকণ্ঠে এসে তাঁর শিবির ফেলেন। এর ফলে সুলতান মাহমুদ সামানা থেকে বাহলুল লোদিকে দিল্লিতে ডেকে নেন। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কিন্তু এক সন্ধির মধ্য দিয়ে এ সংকটের অবসান ঘটল। ১৪৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ শাহ মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর তাঁর পুত্র আলাউদ্দীন আলম শাহ সিংহাসনে বসলেন কিন্তু দিল্লির রাজনীতির প্রতি বিরক্ত হয়ে তিনি বদায়ুনে চলে গেলেন এর তাঁর উজির হুসাম খাঁ প্রশাসনের দেখভাল করতে লাগলেন। অবশেষে দিল্লির জনগণ বাহলুল লোদিকে দিল্লির সিহাসনে বসার জন্য আহ্বান জানালেন। সুলতান আলাউদ্দীন কোনো আপত্তি করলেন না এবং তিনি আমৃত্যু বদায়ুনেই ১৪৭৬ অবধি রয়ে গেলেন।
বাহলুল লোদি দিল্লি এসে পৌঁছালেন এবং ১৯ এপ্রিল ১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসলেন। এ সময় অবধি দিল্লি সালতানাতের সীমা দিল্লি থেকে পালমগাঁও অবধি মাত্র রয়ে গিয়েছিল। তাঁর সামনে ছিল দিল্লি সালতানাতকে পুনর্গঠন করার সমস্যা। সমস্ত হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করা আর জাতি—ধর্ম—নির্বিশেষে সমস্ত বিদ্রোহী শাসক ও রাজা—জমিদারদের দিল্লির অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করা। সেই মতোই নতুনভাবে নতুন পদক্ষেপ শুরু করলেন বাহলুল লোদি। ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ ও সংস্কারকর্মের মধ্য দিয়ে বাহলুল লোদি ৩৮ বছর যাবত শাসনকার্য চালানোর পর ১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইটাওয়া থেকে দিল্লি ফেরার পথে রোগগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দিল্লির সকল সুলতানদের মধ্যে বাহলুল লোদির নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৬ জুলাই ১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সিকান্দর লোদি দিল্লির সিংহাসনে বসেন। বাহলুল লোদির অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব অবশেষে তাঁকেই গ্রহণ করতে হয়। দিল্লি সালতানাতের পুনর্গঠনে তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাম্রাজ্যের অনেক হৃত এলাকা তাঁকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। দীর্ঘ ২৮ বছর যাবত তিনি দিল্লি শাসন করেন। তারপর ২১ নভেম্বর ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সিকান্দর লোদির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহীম লোদি ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর যুগ দীর্ঘ হয়নি। ইব্রাহীম লোদির মধ্যে কিছুটা ক্ষমতার দম্ভ ছিল আর ছিল কিছু হঠকারিতা। এসব তাঁর জন্য কাল হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাইয়েরা এবং তাঁর আমিররা তাঁর প্রতি বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর পতন কামনা করছিলেন। অবশেষে, তাঁর ভাই আলম খাঁ লোদি আমির তাইমূরের চতুর্থ অধঃস্তন কাবুলের শাসক জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবুরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানালেন। অনন্তর, বাবুর কাবুল থেকে হিঁদুস্তানের উদ্দেশে প্রস্থান করলেন এবং ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত ও নিহত করে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
প্রথম পর্যায়ে অষ্টম শতাব্দীতে মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়, দ্বিতীয় পর্যায়ে একাদশ শতাব্দীতে (১০০০—১০২৬ খ্রি.) সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে পুনঃপুনঃ ভারত অভিযান এবং তৃতীয় পর্যায়ে মুহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান (১১৭৫—১২০৬ খ্রি.) এবং কুতুবউদ্দীন আইবক কর্তৃক দিল্লিতে মুসলিম রাজ কায়েম পর্যন্ত সময় কালের মধ্যে ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মুসলিম বিজয়ের ধারাবাহিকতায় এ ৩২০ বছরটি হলো সুলতানি ভারতের সুসংহত বিজয় ও শাসনের যুগ। এ সময়কালটি ইসলামের ইতিহাসে সুলতানি আমল নামে পরিচিত। তার আর্থ—সামাজিক—রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস উপমহাদেশের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৩২০ বছর সময় উপমহাদশের ইতিহাসের উত্থান—পতননের নীরব সাক্ষী। এই ৩২০ বছরের ইতিহাসে উপমহাদেশ অনেক ভাঙা—গড়া—উত্থান—পতন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও
ভাঙা—গড়া—উত্থান—পতন, প্রশাসনিক পরিবর্তন দেখেছে। এ ৩২০ বছরে দিল্লিার রাজনৈতিক মঞ্চে যত শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের একটি তালিকা এখানে প্রদত্ত হলো:
- কুতুবউদ্দীন আইবক
- ইলতুতমিশ
- রুকনউদ্দীন ফিরোজশাহ
- সুলতানা রাজিয়া
- মুঈজউদ্দীন বাহরাম
- আলাউদ্দীন মাসুদশাহ
- নাসিরুদ্দীন মাহমুদ
- গিয়াসউদ্দীন বলবন
- কায়কোবাদ
- জালাল উদ্দীন ফিরোজশাহ
- রুকনউদ্দীন ইব্রাহীমশাহ
- আলাউদ্দীন খিলজি
- শিহাবউদ্দীন উমর
- কুতুবউদ্দীন মুবারকশাহ
- খসরু খাঁ
- গিয়াসউদ্দীন তুগলক
- ফিরোজশাহ
- ফিরোজশাহ ও ফতেহ খাঁ
- ফিরোজশাহ ও জাফর খাঁ
- তুগলক শাহ
- আবুবকর শাহ
- মুহম্মদ শাহ
- মাহমুদ শাহ
- নুসরত শাহ
- মুবারক শাহ
- মুহম্মদ
- আলমশাহ
- বাহলুল
- সিকান্দর লোদি
- ইব্রাহীম লোদি