আট
হজরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতি (র) আজমীর শরীফে চিশতিয়া তরিকার আধ্যাত্মিক সাধনার সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করে হিঁদুস্তানের মাটিতে তাঁর আধ্যাত্মিক সালতানাত কায়েম করে হিঁদুস্তানের জনগণের হৃদয়ের উপর তাঁর অলৌকিক আধ্যাত্মিক শাসন জারি করেছিলেন। জাতি—ধর্ম—নির্বিশেষে আজমীর আধ্যাত্মিক সাধনার এক মহান তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। মহাত্মা খাজা তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার ও শিক্ষার উত্তর—দায়িত্ব অর্পণ করেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) উপর। এ মহাত্মা দিল্লিতে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষার খানকাহ—রূপ সিংহাসন স্থাপন করে সেখানে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে দেন। এভাবে দিল্লি মুসলমানদের রাজনৈতিক রাজধানীর মর্যাদা লাভের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্ররূপে তার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করল।
এদিকে দিল্লিতে আধ্যাত্মিক শিক্ষাক্রম জারি রইল আর ওদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের কাজ সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলল। দিল্লিতে মুসলিম রাজ প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দীন আইবেকের ইন্তিকাল হওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল চলল কিছুকাল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ—যা দাসবংশ রূপে পরিচিত হয়ে আছে; সুলতান কুতুবউদ্দীনের ইন্তিকালের পর তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে কিছুদিন টালমাটাল চলে; কিন্তু এর অল্পকাল পরেই বদায়ুনের প্রশাসক ও তাঁর জামাতা শামসুদ্দীন আলতামাশ অনতিবিলম্বেই দিল্লির রাজনৈতিক উত্তরাধিকার গ্রহণ করেন। সুযোগ্য, জ্ঞানী, দূরদর্শী, অসাধারণ সাহসী—সর্বোপরি প্রাজ্ঞ কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ আলতামাশ দিল্লি—কেন্দ্রিক মুসলিম সাম্রাজ্যকে সুগঠিত করেন, সার্থক অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা কায়েম করে রাজ্যের অধিবাসীদের সুখশান্তি সুনিশ্চিত করেন। সে সময়ে ভারতের উত্তর—পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বারবারই মোঙ্গলদের ঝটিকা আক্রমণের তুফান আসছিল। সে সব ভয়াবহ আশঙ্কা থেকে ভারতকে মুক্ত রেখে তিনি দেশের জনগণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন। সুলতান আলতামাশের বঙ্গবিজয় সে সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার পরে বঙ্গদেশ দিল্লির অধিকারে আসে এবং সেখানকার পৌত্তলিক সমাজ ও বাতিলপন্থী শাসকদের কবল থেকে বঙ্গ—ভূখণ্ডের এক—একটি এলাকা অধিকার করে সেখানে ইসলামের বিজয়—পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে—আধ্যাত্মিক শান্তিসুধার সুশীতল বারি সিঞ্চনের ব্যবস্থা করে তাদের ইহপরকালের মুক্তির পথ প্রদর্শন—এসব বিজয়কে মহিমান্বিত করে।
উল্লেখ্য যে, ভারতের রাজপুত রাজা ও প্রজারা মুসলমান শাসক ও প্রশাসকদের সাথে বারবারই বেয়াদপি, বিদ্রোহ ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে থাকলে, তাদের সে বেয়াদপি ও বর্বরতার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য তাদের উদ্দেশে বারবার সামরিক মিশন পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আলতামাশের পূর্ববর্তী শাসকদের যেমন—তেমনই সুলতান আলতামাশেরও তাদের বিরুদ্ধে সামরিক মিশন পরিচালনা করতে হয় উচ্ছৃঙ্খল ও বর্বর রাজপুতদের দমন করে সেখানে শান্তি ও সুস্থিতি প্রতিষ্ঠাকল্পে। সে উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে তিনি রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র ও মালব অধিকার করেন।
সামরিক তেজস্বিতা, দুর্নিবার সাহস ও অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী সুলতান সামসুদ্দীন আলতামাশ ভারতে একটি সুসংগঠিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান জনগোষ্ঠী গড়ে তুলে এ উপমহাদেশে তাদের শান্তিতে বসবাস করার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে গিয়েছেন। উপমহাদেশের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনেক। তিনি ছিলেন ধার্মিক, দয়ালু, বিচক্ষণ শাসক; বিদ্যোৎসাহী ও স্থাপত্যশিল্পের অনুরাগী। ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রথম স্থপতি কুতুবউদ্দীন আইবক দিল্লির প্রসিদ্ধ সাধক কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে নামাঙ্কিত যে বিজয়—স্মারক বা কীর্তিস্তম্ভ—যা কুতুবমিনার নামে পরিচিত—তা নির্মাণের কাজ শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি; তা সম্পন্ন করেন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্যতম সার্থক উত্তরসূরি সুলতান শাসুদ্দীন আলতামাশ। আজমীরের অপূর্ব সুন্দর মসজিদ—যা ইসলামি স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন, তা তাঁরই অমর কীর্তি। তিনিই প্রথম মুসলমান শাসক যিনি ভারতীয় মুদ্রা—ব্যবস্থায় প্রথম আধুনিকতা আনয়ন করেছিলেন, স্বর্ণমুদ্রায় আরবি হরফে পবিত্র কলেমা খচিত মুদ্রাব্যবস্থা তাঁর অমর কীর্তি। সুলতান আলতামাশের শাসনকালকে ভারতের প্রাথমিক যুগের তুর্কি শাসনের শ্রেষ্ঠ কাল বলে অভিহিত করা হয়।
সময়ের চলমান ধারায় একের পর এক পালাবদলের পালা আসে। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ সময়ের চলমান ধারায় অন্তর্হিত হলে তাঁর স্থলে এলেন রুকনউদ্দীন ফিরোজ শাহ। কিন্তু তিনি অপসারিত হলেন। পরে এলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা সুলতানা রাজিয়া। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার রাজপথ জগতে কোনো কালেও কুসুমাস্তীর্ণ থাকেনি; সব সময়েই তা কণ্টকাকীর্ণ। সে কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে পদদ্বয় স্বতই হয় ক্ষতবিক্ষত—হৃদয় হয় রক্তাক্ত; কিন্তু সে পথ অতিক্রম করে নিজেদের যারা আসীন রাখতে সমর্থ হন—তাঁরা হন অসাধারণ বীর বীরভোগ্যা বসুন্ধরা তাদেরই পদানত হয়।
প্রবল প্রতাপান্বিত সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ—এর ইন্তিকালের পর তাঁর সমকক্ষ উত্তরাধিকারী না থাকায় দিল্লির রাজনৈতিক রাজপথ আবার কণ্টকাকীর্ণ হলো এবং হৃদয় রক্তাক্ত হলো। এভাবে তাঁর ইন্তিকালের ত্রিশ বছরের মধ্যে চারজন সুলতানের ক্রম অতিবাহিত হয়ে গেল।
এদিকে দিল্লিতে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ক্রম জারি রইল, অন্যদিকে হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্রমও সমভাবে জারি রইল। এঁরা উভয়েই সম্রাট। কেউ কায়েম করেন রাজনৈতিক শাসন, কেউ কায়েম করেন আধ্যাত্মিক শাসন। উভয়ই শাসক; তবে একে অন্যের পরিপূরক।
দিল্লিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক রাজধানী স্থাপনের সাথে সাথেই সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। নূর—কুতুবুল আলম কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে উৎসর্গিত কুতুবমিনার সে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিজয়ের স্মারকরূপে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখল। এভাবেই সেখানে রাজনৈতিক উত্থান—পতনের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক পরম্পরাও সমভাবে জারি রইল।
সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশের তিরোধানের পর প্রায় ৩০ বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্র উড্ডীন রাখার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেল গিয়াসউদ্দীন বলবনের উপর। তিনি ২১ বছর তাঁর শাসন কায়েম রাখেন। তুর্কি বংশোদ্ভূত সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন পূর্বের স্বনামধন্য সুলতানদের রবদবা ও তাঁদের সামরিক মিশন পরিচালনার ধারা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হন এবং একটি সুস্থিত কেন্দ্রীয় শাসন কায়েমের পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর একুশ বছরের শাসনব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো স্বদেশীয় বিদ্রোহীদের দমন ও মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ। এভাবেই তিনি এ দেশের জনগণকে সুস্থ ও স্বাধীনভাবে বাঁচার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এদিকে দিল্লিতে যখন এই রাজনৈতিক ক্রমধারা বিরাজমান, অন্যদিকে তেমনি আধ্যাত্মিক ক্রমধারা অতিদ্রুত সমস্ত হিঁদুস্তানের হৃদয় জয় করার পথে অগ্রসরমান।
ন্যায়বিচারক, সুদক্ষ শাসক, জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ও ধার্মিক সুলতান বলবনের হাতে এদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি আরও সুসংহত হয়ে ওঠে
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১২৬৬—১২৭৭ খ্রি.) বিরাট ছত্র ধরে দিল্লিতে ২০ বছর যাবত তাঁর শাসনকার্য অব্যাহত রাখেন। তারপরেই ক্ষমতাসীন হন সুলতান গিয়াউদ্দীন বলবন ( ১২৬৬—১২৮৭ খ্রি.)। এ সময়কালের মধ্যে ইসলামের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা একান্ত আবশ্যক।
নয়
হজরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও সাধনার খিলাফত বা উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান হজরত খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকর রহমাতুল্লাহ আলাইহেকে
ইনি ছিলেন পরবর্তী ভারতের আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার পীর বা আধ্যাত্মিক আচার্য। আলোচ্য গ্রন্থে তাঁর প্রসঙ্গ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হলেও তা হবে খুবই কিঞ্চিৎ। এখানে তাঁর জীবন ও সাধনা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা একান্ত আবশ্যক। লক্ষণীয় যে, চিশতিয়া পরম্পরার পীর খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করেছিলেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে (র), তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত করেন খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরকে (র), তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত করেন খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়াকে (র)।
মহাত্মা খাজা ফরীদউদ্দীন ৫৬৯ হিজরি মোতাবেক ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা কাজী শুয়াইব তাতারী আক্রমণের ডামাডোলের মধ্যে মাতৃভূমি কাবুল ত্যাগ করে পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই তিনি একটি জায়গর লাভ করেন। খুব ছোট বয়সে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালের বিখ্যাত ইলমি শিক্ষাকেন্দ্র মুলতানে চলে যান। সেখানকার দ্বীনি—মারকাজে থেকে সেখানকার বড় বড় উস্তাদদের কাছে তিনি দ্বীনি—শিক্ষা হাসিল করেন। তিনি মওলানা মিনহাজউদ্দীন তিরমিজির কাছে ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ওখানেই তিনি ৫৮৪ হিজরি সনে খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) দর্শন লাভ করেন এবং ওখানেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর শুরু হয় তাঁর কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার জীবন। হিঁদুস্তান ও তার বাইরে থেকে তিনি শিক্ষা সমাপন শেষে নিজ আধ্যাত্মিক আচার্যের সেবায় দিল্লি এসে উপস্থিত হন। সেখানে গজনৈর দরওয়াজার কাছে একটি স্থান নির্বাচন করে তিনি গভীর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হন। এ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর তাঁর পীর খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র) তাঁকে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন। গুরুর আদেশে তিনি হাঁসী অভিমুখে রওনা দেন। ইতোমধ্যেই শেখের ইন্তিকাল হয়ে গেলে তিন দিনের মাথায় তিনি দিল্লি ফিরে এসে তাঁর মাজারে ফাতিহা পাঠ করেন। কাজী হামিদুদ্দীন নাগৌরী (র) শেখের অসিয়ত মোতাবেক তাঁকে খিরকা ও উত্তরদায়িত্বের আমানত প্রদান করেন। কৃতজ্ঞতাসূচক নফল নামাজ পড়ে শেখের সাধনার উত্তরাধিকারীরূপে তিনি তাঁর স্থানে সমাসীন হন। তারপর তিনি পুনরায় হাঁসী অভিমুখে রওনা দেন। সেখান থেকে রওনা দেন অযোধানে—যার বর্তমান নাম পাকপত্তন। এটি এখন পাকিস্তানের পঞ্জাবের মন্টোগোমারী জেলার অন্তর্গত একটি বিখ্যাত স্থান। এখানে রয়েছে তাঁর মাজার ও খানকাহ শরীফ—যেটি আজমীর ও দিল্লির মতো এক আধ্যাত্মিক তীর্থক্ষেত্ররূপে তার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছে। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (র) হলেন সেই মহাত্মারই আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি। আর তাঁর শিষ্য ছিলেন সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক। মুহম্মদ তুগলক খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্চশকরের মাজারে সুদৃশ্য গম্বুজ বানিয়ে দেন।
এসব পর্যালোচনায় দেখা গেল যে, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার যে ধারা শুরু করেছিলেন, শিষ্য পরম্পরা তা শেখ নিজামউদ্দীন আউলিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হলো। তারপর, তাঁর ও নানা শিষ্য—পরম্পরায় প্রায় হাজার বছর ধরে হিঁদুস্তানের মাটিতে তার ধারা অব্যাহত রয়ে গেল।
দশ
১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সিংহাসনারোহণের পর তিনটি রাজবংশের আট জন সুলতান দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে দিল্লিতে আসেন এবং ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুগলকের সিংহাসনারোহণের প্রথম মাস পর্যন্ত তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষার ধারা অব্যাহত রাখেন। নিজামউদ্দীন আউলিয়া দিল্লিতে পঞ্চাশ বছর অবস্থান করেন এবং এসব রাজাবাদশাহদের আগমন—নির্গমনের ধারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন—কিন্তু মনের ভুলেও রাজ্য ও রাজনীতির প্রতি চোখ তুলেও তাকাননি। এখন আমরা সংক্ষেপে দিল্লির রাজনৈতিক উত্থান—পতন নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হব।
হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার তিরোধানের বেশ কয়েক বছর পর বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা দিল্লিতে আসেন। তিনি হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার শিষ্য মুহম্মদ বিন তুগলকের শাসনাধীনে দিল্লিতে প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। এখানে তিনি আট বছরেরও অধিককাল অবস্থান করে রাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের এ সময়কার কথা বিশ্ববিখ্যাত ‘সফরনামা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। তিনি সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবক থেকে শুরু করে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। সে গ্রন্থটি ঐ যুগের ইতিহাসের এখানা বিশ্বস্ত দলিল বলে স্বীকৃত। আমি পরম আগ্রহভরে সে গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ সম্পন্ন করি। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার বৃত্তান্ত অত্যন্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। মূল গ্রন্থ থেকে তা এখানে উদ্ধৃত করছি—‘দিল্লিতে ওলী (হজরত) নিজামউদ্দীন বাদায়ুনী বসবাস করতেন। জুনাহ খাঁ সর্বদাই এই মহাপুরুষের সেবায় উপস্থিত থেকে তাঁর আশীর্বাদের অভিলাষে দিন অতিবাহিত করতেন। একদিন তিনি হজরতের সেবকদের বললেন, তিনি যখন আল্লাহর উপাসনায় গভীরভাবে নিমগ্ন থাকবেন তখন তা আমাকে জানাবে। একদিন হজরতকে এ অবস্থায় দেখে তারা যুবরাজকে তা জানিয়ে দিলেন। সংবাদ পেয়েই তিনি অতিদ্রুত হজরতের সেবায় উপস্থিত হলেন। শেখ তাঁকে দেখামাত্রই বললেন, ‘আমরা তোমাকে সাম্রাজ্য প্রদান করলাম। এ সময়ের মধ্যে শেখের তিরোধানও হয়ে গেল। তাঁর মৃতদেহ যুবরাজও নিজ স্কন্ধে বহন করলেন।’
ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সে সময়কাল হিঁদুস্তানের অনেক প্রসিদ্ধ সাধকের কথা বর্ণনা করে গিয়েছেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার পীর হজরত খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরের কথাও তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখে গিয়েছেন। তাঁর সাথে ইবনে বতুতার সাক্ষাৎও হয়েছিল। ইবনে বতুতা তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন—‘এটি (অযোধন—বর্তমান নাম পাকপট্টন) শেখ ফরীদউদ্দীনের (বদায়ুনী) স্মৃতিবিজড়িত একটি ছোট্ট অথচ সুন্দর এক নগর। শেখ বুরহানউদ্দীন ইসকান্দারী (আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী) আমাকে বলেছিলেন, তোমার চলার পথে শেখ ফরীদউদ্দীনের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ যে, সত্যিই এখানে তাঁর সাথে আমর সাক্ষাৎ হয়। ইনি ভারত—সম্রাটের পীর। এবং সদাশয় সম্রাট এ নগরটি তাঁকে প্রদান করেছেন। শেখ মহোদয় খুবই সংশয়ী মানুষ; সেজন্য তিনি অপরিচিত কারো সথে মোসাফাহ করেন না; এবং কারো কাছে এসে বসেনও না। কারো বস্ত্র পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেললে হাত ধুয়ে ফেলেন। আমি তাঁর দীওয়ানখানায় এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে শেখ বুরহানউদ্দীনের সালাম পৌঁছে দিতেই তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন—‘হয়তো অন্য কাউকে দিয়ে থাকবেন।’ আমি এঁর দু’পুত্রের সাথেও সাক্ষাৎ করলাম। এঁরাও খুবই বিদ্বান ছিলেন। এঁদের নাম ছিল মুঈজউদ্দীন ও ইলমউদ্দীন। মুঈজউদ্দীন ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাজ্জাদানশীন হন। এঁদের দাদা শেখ ফরীদউদ্দীন বদায়ুনীর সমাধিতে গিয়েও জিয়ারত সম্পন্ন করি। বদায়ুন সম্ভল নামক এলাকায় অবস্থিত। ওখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় ইলমুদ্দীন আমাকে তাঁর পিতার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। সে সময়ে তিনি শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে ছাদের সবচেয়ে উচ্চস্থানে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর মাথায় বাঁধা পাগড়ির একটা অংশ তাঁর শরীরের একপাশে ঝুলছিল। তিনি আমার জন্য দোয়া করলেন এবং বাতাসা ও মিছরি আমাকে তাবারুক স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন।’
তৎকালীন যুগের উপমহাদেশের ইতিহাসের এক আকরগ্রস্থ ও ‘সফরনামা’য় দিল্লির রাজনৈতিক উত্থান—পতনের এক ধারাবাহিক ও রোচক বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে। সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের দিল্লিবিজয় থেকে শুরু করে মুহম্মদ বিন তুগলকের রাজত্বকাল পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজবৃত্তান্ত তিনি তাতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমরা এখানে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন থেকে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত শাসকদের ধারাবাহিক বৃত্তান্ত অতি সংক্ষেপে পেশ করার প্রয়াস চালাব।
ইতোপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লি সাম্রাজ্যকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনয়ন করেছিলেন, অত্যন্ত ধার্মিক ও বিচক্ষণ সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কায়কোবাদকে তাঁর উত্তরাধিকারী (১২৮৭ খ্রি.) মনোনীত করে যান। সুলতান বলবন তাঁর পুত্র কায়কোবাদকে দিল্লির সিংহাসনের উপযুক্ত উত্তরাধিকারীরূপেই গড়ে তুলেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, তিনি শাসনকার্যে উপযুক্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। তাঁর সম্পর্কে ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন—‘মুআজউদ্দীন (কায়কোবাদ) মাত্র চার বছর রাজত্ব করেন। তাঁর আমলের দিনগুলো ঈদ—উৎসবের মতো এবং রাতগুলো শবে—বরাতের মতো ছিল। এ সম্রাট অত্যন্ত দানশীল এবং দয়ালু ছিলেন। তাঁর আমলের যেসব লোকেরা স্বচক্ষে তাঁকে দেখেছিলেন, তাঁরা আমার সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা সম্রাটের ধর্মভীরুতা ও দানশীলতার ভুরি ভুরি প্রশংসা করতেন। দিল্লির সুবিখ্যাত জামে মসজিদ—যার মিনার ছিল জগতের অদ্বিতীয়—তিনিই নির্মাণ করান। বিষয়বিত্ত ভোগের সাথে—সাথে অতিমাত্রায় মদিরা পানের কারণে তিনি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। অনেক হাকিম—বৈদ্য তা নিরাময়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সম্রাটের এ দুরবস্থার সুযোগে নায়েব জালালউদ্দীন ফিরোজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং নগরের বাইরে ‘কুবা—এ—জায়শানী’ নামক টিলার কাছে শিবির স্থাপন করলেন। এখানে শুধু এতটুকু উল্লেখ করা যথেষ্ট হবে যে, এরপর জালালউদ্দীন সম্রাট হলেন।’
এগারো
১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে সত্তর বছর বয়সে দিল্লির সিংহানের আরোহণ করেন সুলতান জালালউদ্দীন খিলজি। ঐ বয়সে ক্ষমতাসীন হওয়া এবং শক্ত হাতে সাম্রাজ্যের হাল ধরা অতীব কঠিন কাজ। তা সত্ত্বেও তিনি দিল্লিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের প্রয়াস চালান। তাঁর সিংহাসনে আরোহণ করার পর কতকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সে সময় ঘটে। তিনি রণথম্ভোরে অভিযান পরিচালনা করে সেখানে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে মজবুত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, কেউ তাঁকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন এই বলে যে, তাতে দুর্গমূল্য অপেক্ষা মূল্যবান মানবজীবন বেশি বিনষ্ট হবে। তাঁর রাজত্বকালে তিনি আরও একটি কাজ করেছিলেন, যা শুধু তাঁর জন্য নয়; ভারতের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি তার দ্বারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মহাত্মা খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরের বিখ্যাত শিষ্য সে সময়ে ভারতে এসেছিলেন। তুর্কি অমাত্যদের সঙ্গে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমে বন্দী ও পরে হত্যা করা হয়।
তাঁর রাজত্বকালের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খানের পৌত্র আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ভারত আক্রমণ। বৃদ্ধ সুলতান জালালউদ্দীন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মোঙ্গলদের ঝটিকাবহ্নিকে নির্বাপিত করে দিয়েছিলেন। পরাজিত অধিকাংশ মোঙ্গল ভারত ত্যাগ করে চলে যায় কিন্তু চেঙ্গিস খানের পুত্র উলুগ খান তাঁর অসংখ্য সমর্থক সহ পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করে ভারতেই থেকে যান এবং মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে থাকেন। ইতিহাসে এঁরা নও মুসলিম’ নামে সুপরিচিত। দিল্লির উপকণ্ঠে তাঁদের বসবাস করার অনুমতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে ঐ এলাকাটি ‘মোগলপুরা’ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।
সুলতান জালালউদ্দীন খিলজি সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন—‘ইনি (জালালউদ্দীন) অত্যন্ত বিদ্বান এবং সহিষ্ণু সম্রাট ছিলেন। এ সহিষ্ণুতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। … সম্রাটের রুকনউদ্দীন নামে এক পুত্র ও আলাউদ্দীন নামে এক ভাইপো ছিলেন। ইনি সম্রাটের জামাতাও ছিলেন। সম্রাট তাঁকে কড়ামানক পুরের হাকিম (গভর্নর) নিযুক্ত করেছিলেন। ভারতবর্ষে এ এলাকাটিকে অত্যন্ত উর্বর বলে মনে করা হতো।… আলাউদ্দীন অত্যন্ত সাহসী ও বীরপুরুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর পর্যাপ্ত ধন—সম্পদ ছিল না। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সম্রাট জালালউদ্দীন খিলজির নিহত হওয়ার বৃত্তান্তটিও বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘একবার তিনি (আলাউদ্দীন) মালব ও মহারাষ্ট্রের রাজধানী দেবগিরিতে আক্রমণ চালালেন। এখানকার হিদুরাজাদের সব রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হতো। অভিযান চালাকালে আলাউদ্দীনের ঘোড়ার পা একস্থানে মাটিতে দেবে যায় এবং সে সাথে ‘টং’ করে আওয়াজ হয়। স্থানটি খোঁড়া হলে সেখানে বহু ধনসম্পদ পাওয়া গেল। এ বিপুল সম্পদ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হলো। দেবগিরিতে পৌঁছালে সেখানকার রাজা বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করে প্রচুর ধন—সম্পদ দিয়ে তাঁকে বিদায় দিলেন। ‘কড়া’য় ফিরে আসার পর আলাউদ্দীন এ সম্পদ সম্রাটের কাছে পাঠালেন না। অমাত্যদের ভয় দেখিয়ে সম্রাট তাঁকে ডেকে পাঠালেন তবু তিনি গেলেন না। পুত্রের চেয়েও প্রিয় হওয়ার কারণে নিজেই তার সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মতো তিনি সুসজ্জিত হয়ে সসৈন্য ‘কড়া’ অভিমুখে রওনা হলেন। নদীর কিনারে যেখানে মুআজউদ্দীন শিবির স্থাপন করেছিলেন তিনিও সেখানেই শিবির স্থাপন করে নৌকায় চড়ে ভাইপো—র প্রতি অগ্রসর হলেন।
আলাউদ্দীন অন্য প্রান্ত হতে নৌকায় করে এলেন। তিনি পূর্বেই তাঁর ভৃত্যদের সংকেত দিয়ে রেখেছিলেন। সেই মতো তিনি সম্রাটের সাথে গলা মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় তাঁর ভৃত্যরা পূর্ব—পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে হত্যা করল। সম্রাটের কিছু সৈন্য আলাউদ্দীনের পক্ষাবলম্বন করল এবং কিছু সৈন্য দিল্লি অভিমুখে পালিয়ে গেল। সৈন্যরা দিল্লি ফিরে এসে সম্রাটের পুত্র রুকনউদ্দীনকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকেই সম্রাট বলে ঘোষণা করল কিন্তু এ নবীন সম্রাট তখন আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন তখন এরাও বিপক্ষীয় বাহিনীতে গিয়ে যোগ দিল। বেচারা রুকনউদ্দীন নিরুপায় হয়ে সিন্ধু অভিমুখে পালিয়ে গেলেন।
এভাবে খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দীন খিলজির জীবনাবসান হলো। তারপর ইতিহাসের গতিধারা আপন পথেই এগিয়ে চলল। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’—র ভোগী তারাই, যারা তার উপযুক্ত—অসাধারণ এবং প্রবল। রাজনৈতিক পালাবদলের বিচিত্র গতিপথ পেরিয়ে আলাউদ্দীন খিলজি দিল্লির সিংহাসন অধিকার করলেন। এদিকে যখন দিল্লির শাহী—তখতের এ পালাবদল চলছে, ওদিকে দিল্লির সন্নিকটবর্তী স্থানে গিয়াসপুরে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক সিংহাসন স্বমহিমায় বিরাজমান থেকে হিঁদুস্তানের হৃদয় জয় করার মহান সাধনায় নিয়োজিত।
বারো
১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দীন খিলজি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করার পর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে কুড়ি বছর দেশ শাসন করলেন। সম্রাট আলাউদ্দীনের জীবন, রাজ্যজয় ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অত্যন্ত বিশ্বস্ত বিবরণ পেশ করেছেন ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন—‘রাজধানীতে প্রবেশ করে আলাউদ্দীন বড়ই যোগ্যতার সাথে কুড়ি বছর দেশ শাসন করলেন। তাঁকে এদেশের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। হিদুরাও পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি রাজকার্য স্বয়ং পরিচালনা করতেন। মুহতাসিব নামক কর্মকর্তা—যাঁকে এদেশে ‘রঈস’ বলা হয়—তিনি সম্রাটকে প্রত্যহ এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতেন।’
সুলতান আলাউদ্দীনের শাসনামলে ১২৯৬ হতে ১৩০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট সাত বার মোঙ্গল আক্রমণ সংঘটিত হয়। সম্রাটের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব যে, মোঙ্গলদের এ আক্রমণকে তিনি বারবার পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হন এবং মোঙ্গলদের এমনভাবে পরাজিত করেন যে, তাঁদের দিল্লি অধিকারের স্বপ্ন চিরকালের জন্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সম্রাট আলাউদ্দীনের সুযোগ্য সেনাপতিদের নেতৃত্বে মোঙ্গলবাহিনী এভাবেই বিধ্বস্ত হয়। সুলতান আলাউদ্দীনের মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের ঘটনা এ দেশের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
অত্যন্ত সাবধানী, অত্যন্ত হিসেবি ও অত্যন্ত সংশয়ী ব্যক্তি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন। নিরঙ্কুশ শাসন কায়েম ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সারা দেশে তিনি গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির শাসক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রে নিরঙ্কুশ ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন কায়েমের জন্য আইন মোতাবেক মৃত্যুদণ্ড দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। সে সময়ে তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য শাসন—সংস্কার ছিল সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর আইন জারি করেছিলেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণজনিত বিধি ও তজ্জনিত শাস্তির বিধান তিনি শরিয়ত মোতাবেক কার্যকর করতেন। এর ফলে, দেশে একটা ক্রম জারি হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ইবনে বতুতা একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাঁর গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন—‘সম্রাট মুহতাসিব—এর কাছে একদিন মাংসের দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলেন। এর জবাবে মুহতাসিব জানালেন যে, মাংসের উপর জাকাত (কর—বিশেষ) আরোপ করার জন্য এমনটি হচ্ছে। সম্রাট ঐদিন এ ধরনের সমস্ত কর প্রত্যাহার করলেন এবং ব্যবসায়ীদের ডেকে রাজকোষ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ঋণ—স্বরূপ প্রদান করলেন বাজার থেকে গরু—ছাগল ইত্যাদি কেনার জন্য। এ শর্তে তাদের ঋণ দেওয়া হলো যে, বিক্রির পরে কৃতঋণ তারা রাজকোষে জমা দেবে। ব্যবসায়ীদেরও তাদের পারিশ্রমিক বাবদ কিছু বেতন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। একই প্রকারে দৌলতাবাদ থেকে নিয়ে আসা বস্ত্রাদিও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।
খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্রাটের নির্দেশে সরকারি গুদাম খুলে দেওয়া হলো। ফলে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ হয়ে গেল। সম্রাট ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী তা বেচাকেনার আদেশ দিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সে আদেশ মানতে অস্বীকার করল। এর ফলে, তিনি সরকারি গুদাম খুলে দিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন এবং ছয় মাস যাবত সরকারি মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়বিক্রয়ের ক্রম জারি রাখলেন। স্বার্থপর ব্যবসায়ীরা তাদের খাদ্যশস্য অবিক্রীত ও নষ্ট হতে দেখে সরকার—নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সম্রাটের কাছে প্রার্থনা জানাল। এভাবে সরকার নির্ধারিত মূল্য মেনে নিতে তারা বাধ্য হলো।’
ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সম্রাট আলাউদ্দীনের ধর্মপরায়ণতার এক রোচক বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘সম্রাট কখনো কোনো কিছুতে সওয়ার না হয়ে বাইরে বেরুতেন না; কিন্তু শুক্রবার ও ঈদের দিনগুলোতে তিনি নিজেই পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়তেন।’
অত্যন্ত সাবধানী ও সংশয়ী ব্যক্তি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন। তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাইপো—র আক্রমণে নিহত হতে হতে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর এ জীবনলাভ শুধু তাঁর জন্য নয়; দেশ ও জাতির জন্যও হয়েছিল মঙ্গলজনক।
ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘ভারতবর্ষে মুসলিম—প্রভুত্বের স্বপ্নদ্রষ্টা।’ তিনি তাঁর সময়কাল পর্যন্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তীকাল পর্যন্ত শাসক হিসেবে অন্যান্য সুলতানদেরও অতিক্রম করে দিয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন খাঁটি ও গোঁড়া মুসলমান। ভারতীয় মুসলিম মিল্লাতের জন্য জীবন—পণ করা সংগ্ৰামী সুলতান আলাউদ্দীনের নাম ইতিহাস কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
সুলতান আলাউদ্দীন যখন দিল্লির শাসনকর্তারূপে এদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে পাকাপোক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েচ্ছিলেন, সুলতানুল আউলিয়া, আউলিয়াকুলের সম্রাট হজরত নিজাউদ্দীন বদায়ুনী তখন সেখানে তাঁর আধ্যাত্মিক সালতানাতের ছত্র ধরে খ্যাতি ও সাধনার মধ্য গগনে অবস্থান করছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীনের রাজসভা অন্যান্য সুলতানদের রাজসভার অন্যতম সভাসদ মহাকবি আমির খসরু তখন হজরত নিজামউদ্দীনের শিষ্যরূপে দিল্লিতে তাঁর কবি—খ্যাতি ও অন্যান্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। তৎকালীন দিল্লির দু’প্রান্তে দুটি দরবার বসত। একটি দরবার ছিল রাজনৈতিক—তার রাজনৈতিক অভিভাবক, সর্বেসর্বা ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর রূপে সম্রাট আলাউদ্দীন সে মসনদ আলো করে অবস্থান করছিলেন; আর অন্যদিকে—দিল্লির অনতিদূরেই গিয়াসপুরে তাঁর দীওয়ানখানায় আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাটরূপে বিরাট ছত্র ধরে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে তাঁর আসন অধিকার করে আধ্যাত্মিক সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন মানুষের হৃদয়ের চিকিৎসক, আউলিয়াকুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন। কেউ কারো অধীনে ছিলেন না; এবং কেউ কাউকে বিরক্ত ও বিব্রত করেননি। সর্বোপরি, সুলতান আলাউদ্দীন ছিলেন যথার্থ ধার্মিক এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। হজরত নিজামউদ্দীনকে জানার, বোঝার এবং তাঁকে মর্যাদা দেওয়ার মতো যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব তাঁর ছিল, সেজন্য কুচক্রী সভাসদদের কুমন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি নিজামউদ্দীনকে কখনো বিরক্ত করেননি। এভাবে দুটি মসনদ দিল্লির দু’প্রান্তে সসম্মানে সমাসীন ছিল।
সম্রাট আলাউদ্দীনের পুত্র খিজির খাঁ ছিলেন হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার বিশ্বস্ত শিষ্য ও নিবেদিতপ্রাণ অনুচর। খিজির খাঁ ও দেবলা দেবীর প্রেম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মহাকবি আমির খসরু ‘দেবলা দেবী ও খিজির খাঁ’ নামে যে কাব্য লিখেছেন, জগতের প্রেম কাব্যের ইতিহাসে তা অমর হয়ে আছে। এ কাব্যে মানব—মানবীর প্রেমের আড়ালে সুফি ভাবধারা কেন্দ্রিক আশেক—মাশুকের এক মহৎ আধ্যাত্মিক ভাব ফুটে উঠেছে—সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
সম্রাট আলাউদ্দীন দুর্ভাগ্যবশত, খিজির খাঁ—এর প্রতি খুবই নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন। যার ফলে, খিজির খাঁ—এর জীবন এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ট্রাজেডি বরণ করে। সুলতান আলাউদ্দীন শেষ জীবনে তা অনুভব ও উপলব্ধিও করেন কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। ওদিকে খিজির খাঁ—এরও মৃত্যু হয়, এদিকে সুলতানও মৃত্যুবরণ করেন (১৩১৬ খ্রি.)। নইলে সুলতান আলাউদ্দীনের পরে তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরূপে খিজির খাঁ দিল্লির সিংহাসন অলংকৃত করতে পারতেন। কিন্তু বিধাতার অভিপ্রায় বোধ হয় ছিল ভিন্ন—তাই তাঁর ভালে হয়তো এরকম দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সংঘটিত হয়েছিল। ইবনে বতুতা এ বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন—‘সম্রাট বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রধান রাজমহিষী ও খিজির খাঁর মাতা মাহক তাঁর পুত্রকে (খিজিরকে রাজসিংহাসনে বসানোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য তাঁর ভাই সনজরকে (অলপ খাঁ) ডেকে আনালেন এবং এ কথা বলে শপথ করালেন যে, সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর জন্য সব রকমের প্রয়াস চালাবেন।’
‘সম্রাটের নায়েব মালিক আলফী (অর্থাৎ মালিক কাফুর) এ প্রতিজ্ঞার কথা জানতে পেরেই তা সম্রাটকে জানিয়ে দিলেন। একথা শুনেই তিনি (সম্রাট) তাঁর দাসদের আদেশ দিলেন যে, সনজর এসে সম্রাট প্রদত্ত খিলআত ইত্যাদি পরিধান করতে শুরু করা মাত্রই.. তাকে যেন হত্যা করা হয়। সম্রাটের আদেশানুসারে তা—ই করা হলো। খিজির খাঁ ঐদিন দিল্লি থেকে কুড়ি মাইল দূরে সনদপ্ত নামক স্থানে ধর্মাত্মা—মহাপুরুষদের কবর জিয়ারতে গিয়েছিলেন। এ পথ হেঁটে গিয়ে সেখানে তিনি তাঁর অসুস্থ পিতার আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানত করেছিলেন। পিতা কর্তৃক তাঁর মামার হত্যাকাণ্ডের এ খবর শুনে তিনি শোকাবেগে তাঁর পরনের বস্ত্র ফেড়ে ফেললেন। এ খবর সম্রাটের কাছে খুব খারাপ প্রতীয়মান হলো। খিজির খাঁ তাঁর পিতার কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে খুব ভর্ৎসনা করলেন এবং সেই সাথে বন্দী করে তাঁকে নায়েবের কাছে পাঠিয়ে গোলালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখার আদেশ দিলেন। এ মজবুত দুর্গটি দিল্লি থেকে দুশো মাইল দূরে হিদুদের রাজ্যগুলোর মধ্যে অবস্থিত। খিজির খাঁ—কে সে দুর্গের রক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে আদেশ দেওয়া হলো যে, তাঁর সাথে রাজপুত্রের মতো ব্যবহার না করে যেন বন্দী—শত্রুর মতো ব্যবহার করা হয়।
সম্রাটের রোগ দিনের পর দিন বেড়ে চলল। তিনি যুবরাজ হিসেবে অভিষেক করার জন্য খিজির খাঁ—কে নিয়ে আসতে চাইলেনও… কিন্তু নায়েব (মালিক কাফুর) ‘হাঁ’ সূচক জবাব দিয়ে তাঁকে আনাতে অযথা বিলম্ব করলেন; এবং সম্রাট তার খবর জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে জানানো হলো যে, তিনি (খিজির খাঁ) এখুনি এসে পড়বেন। ইতোমধ্যে সম্রাটের জীবনাবসান হয়ে গেল।’
সম্রাট আলাউদ্দীনের ইচ্ছা মোতাবেক খিজির খাঁকে যুবরাজ মনোনীত করা গেল না। মালিক আলফী বা মালিক কাফুরের ষড়যন্ত্রে খিজির খাঁ নিহত হন। খিজির খাঁ—এর হত্যাকাণ্ডের বৃত্তান্তটি খুব মর্মপীড়াদায়ক। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেছেন—‘গোয়ালিয়রের কাজী জৈনুদ্দীন মুবারক আমাকে বলেছিলেন, মালিক শাহের ওখানে (গোয়ালিয়র দুর্গে, যেখানে খিজির খাঁ—কে বন্দী করে রাখা হয়েছিল) পৌঁছানোর সময় আমি স্বয়ং খিজির খাঁ—এর কাছে বসেছিলাম। এ আমীরের আগমনের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই ভয়ে তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মালিক শাহ সেখানে পৌঁছালে খিজির খাঁ সেখানে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন—‘আখবন্দে আলম (জগতের প্রভু)। আমি প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সম্পন্ন করার জন্য এখানে এসেছি।’ একথা শুনে খিজির খাঁ জিজ্ঞাসা করলেন—‘আমার জীবন নিরাপদ তো?’ তিনি উত্তর দিলেন ‘হাঁ।’
এরপর তিনি কোতয়ালকে হাঁকলেন এবং আমাকে সহ তিনশ’ দুর্গরক্ষককে সাক্ষী করে সবাইকে সম্রাটের আদেশ পড়ে শোনালেন। তারপর তিনি শিহাবুদ্দীনের কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এ কাজ সমাধা করার সময় তাঁর মধ্যে ভয় দ্বিধা—সংকোচ কোনো কিছুই লক্ষ করা যায়নি। এরপর শাদী খাঁ ও আকবর খাঁ—র পালা এল। তিনি যথাপূর্ব তাদের ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন খিজির খাঁ—র পালা এল তখন তিনি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। সে সময় তাঁদের মাতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। … এরপরে, খিজির খাঁ—কে হত্যা করা হলো।… তাঁর মাকে ৭২৮ হিজরি সনে আমি মক্কা শরীফে দেখেছিলাম।
খিজির খাঁ—এর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঐতিহাসিক বদায়ুনী লিখেছেন—‘৭১৮ হিজরির প্রথম দিকে খিজির খাঁ—কে হত্যার পরে দেবলা দেবীকে রণিবাসে নিয়ে আসার জন্য শাদী খাঁ—কে পাঠানো হয়। প্রসিদ্ধ কবি আমির খসরু তাঁর ‘দেবলা দেবী ও খিজির খাঁ’ নামক কাব্যে এ বৃত্তান্ত এভাবে লিখেছেন : মুবারক শাহ (খিলজি) (দেবলা দেবীকে পাওয়ার জন্য) এ কথা লিখে (খিজির খাঁ—কে) পাঠিয়েছিল যে, যদি তুমি তোমার ভার্যাকে আমাকে দিয়ে দাও তাহলে আমি তোমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে কোনো একটি রাজ্যের শাসনকর্তা বানিয়ে দেবো। কিন্তু খিজির খাঁ সে অঙ্গীকার করতে রাজি হননি। মহাকবি আমির খসরুর ভাষায়:
‘চো বামন হাম সরন্তই ইয়রে জানী।
সরে মন দূর জুম জাঁ জস পদানী॥’
অর্থাৎ ‘প্রাণ—প্রিয়া যদি এ হৃদের সাথে করে মধু—আচরণ।
তাহলে আমার প্রাণ—বধ ছাড়া কর যাহা চায় মন॥’
তাঁর এ জবাব সম্রাটের কাছে খুব খারাপ লাগে এবং বলেন:
‘ব তুন্দী সর্ সলাহীরা তলব কর্দ॥
কে বায়দ সদ্ কিরো ইরোজ শবকদ্॥
রো অন্দর গালিয়োর ইমম্ ন বসদের।
সরে সেয়াং মলক আপগান ব শামশের॥’
এর তাৎপর্য হলো : সক্রোধে অস্ত্রাধ্যক্ষকে ডেকে একশো ক্রোশ দূরত্বের রাস্তা এক রাতেই অতিক্রম করে গোয়ালিয়রে গিয়ে তাকে হত্যা কর। ঐতিহাসিক ফিরিশতা লিখেছেন—‘চোখ সেলাই করা অবস্থায় খিজির খাঁ—কে হত্যা করার পর তাঁর পত্নীকে (দেবলা দেবীকে) রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হলো।’
বলাবাহুল্য, খিজির খাঁ খুব গভীরভাবে রাজনৈতিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। এভাবে, সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির ভাবী উত্তরাধিকারীকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এ প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং মর্মপীড়াদায়ক।