» » বিবাহ-পৰ্ব

বর্ণাকার

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমজাদের পিতার যে কথা সেই কাজ। তিনি মধুপুরে ভূঞা সাহেবের বাড়িতে আসিয়া বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন ও বন্দোবস্ত একই সঙ্গে করিয়া ফেলিলেন।

বেতার মীরবংশ আভিজাত্যে দেশবিখ্যাত। আমজাদের পিতা বর্তমান সেই বংশের মুরুব্বী। তাঁহার মান-সম্ভ্রম যথেষ্ট। তিনি তেজস্বী কর্মবীর বলিয়া খ্যাত। মধুপুরে পুত্রের বিবাহ দিয়া তত্রত্য সকল লোকের সহিত পরিচিত। ভূঞা ও তালুকদার সাহেব তাহাকে বড় মুরুব্বী বলিয়া সম্মান করেন। তাঁহার আদেশ উপদেশ মত কার্য করা গৌরবজনক বলিয়া ভাবেন। উপস্থিত বিবাহ প্রস্তাবে ভূঞা সাহেব কোন ওজর আপত্তি করিতে সাহসী হইলেন না। তাঁহার কৃপণতা ও অর্থের লোভ দূরে পলায়ন করিল। মীর সাহেব বিবাহ-সম্বন্ধে দেনা ও পাওনা যাহা সাব্যস্ত করিলেন ভূঞা সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় তাহাতেই মাথা নোয়াইলেন। গোলাপজানও যেন কি বুঝিয়া বিশেষ কোন আপত্তি করিল না।

অতঃপর রতনদিয়ায় চিঠি লেখা হইল, “আগামী ২৭ শে আশ্বিন আমরা শুভ বিবাহের দিন স্থির করিয়াছি। তাহার পূর্বে বা পরে ভাল দিন নাই; সুতরাং ঐ তারিখেই যাহাতে এখানে চলিয়া আসিয়া বিবাহ সম্পন্ন হয়, আপনারা তাহাই করিবেন। বিবাহের পূর্বে এখান হইতে আপনাদের বাড়ি যাওয়ার আর সময় নাই, পরন্তু আবশ্যকতাও নাই। খোদা না করুন, এই পত্রানুযায়ী কার্য সম্পন্ন করিতে কোন বাধাবিঘ্ন ঘটিলে, পূর্বাহ্নে জানাইবেন। নির্দিষ্ট দিনে বিবাহ সম্পন্ন করিতে আপনাদিগের আশাপথ চাহিয়া রহিলাম।

পাত্রীকে কেবল তিন হাজার টাকার কাবিন দিতে হইবে। বস্ত্রালঙ্কার অন্যান্য ব্যয় আপনাদের ইচ্ছাধীন। আশা করি, এ বন্দোবস্তে আপনাদের অমত হইবে না।”

মীর সাহেবের পত্র পাইয়া নুরল এসলামের বাড়িতে বিবাহের ধূম পড়িয়া গেল। তিনি জুট ম্যানেজার সাহেবের নিকট এক মাসের বিদায় লইলেন। কেবল ভাদ্র মাসের খরিদ পাটে নুরল এসলাম কোম্পানিকে তিন হাজার টাকা লাভ করিয়া দিয়াছিলেন, এ নিমিত্ত কোম্পানির গুণগ্রাহী ম্যানেজার সাহেব তাহাকে বিবাহের সাহায্য বাবদ তিন শত টাকা দান করিলেন। নুরল এসলামের আত্মীয়-কুটুম্বে, বন্ধু-বান্ধবে, চাকর-চাকরানীতে তাহার বাড়ি-ঘর জনপূর্ণ হইয়া উঠিল। নুরল এসলামের মামু সাহেব, নুরল এসলামের পূর্বকথিত ভাগিনীদ্বয়ের বড়টিকে যমুনা-পারে একজন ভদ্রবংশীয় যুবকের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি এফ. এ. পাস্ করিয়া সুপারিশের জোরে এখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনিও ছুটি লইয়া সস্ত্রীক বিবাহে আসিলেন।

নির্দিষ্ট দিনে নুরল এসলাম নওশা সাজিয়া, পাত্র-মিত্রসহ প্রেম প্রতিমা আনোয়ারার পাণিগ্রহণ বাসনায় মধুপুরে উপস্থিত হইলেন। আজ ভূঞা সাহেবের বৃহৎ ভবন আনন্দ- কোলাহলে মুখরিত। হামিদাও সইয়ের বিবাহে আসিয়াছে। সে শুভ বিবাহে আনন্দে আত্মহারা। আনোয়ারা আজ তাহার আশাতীত আশাসাফল্যে সলাজ-প্রেম-রোমাঞ্চ- কলেবরা। তাহার দাদিমা আশাপূর্ণ হেতু উৎফুল্লা ও ব্যয়বাহুলে মুক্তহস্তা। অন্যান্য রমণীগণও বিবাহের আনন্দে আনন্দিতা। কেবল একটি স্ত্রীলোক আজ আন্তরিক আনন্দিতা না হইলেও, কেবল লোকলজ্জা ভয়ে মৌখিক আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন। বলা বাহুল্য, ইনি আনোয়ারার বিমাতা—গোলাপজান।

ভূঞা সাহেব যথাসময়ে, পাত্রপক্ষ ও স্বপক্ষ জনগণকে নাশ্তা ও পোলাও পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইলেন। দীনহীন কাঙ্গালেরা উদর পুরিয়া আহার করতঃ ভূঞা সাহেবকে আশীর্বাদ করিতে লাগিল। অপরাহ্ণে পাত্রপক্ষ হইতে নয় শত টাকার অলঙ্কার, তিন শত টাকার শাড়ী প্রভৃতি বস্ত্রাদি ও তিন হাজার টাকার কাবিননামা বাড়ির মধ্যে পাঠান হইল। হামিদা ৬০টাকা মূল্যের একটি অঙ্গুরী সখিত্বের দিনর্শনস্বরূপ সইয়ের অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিল এবং তাহার আগুল্ফ-লম্বিত কেশরাশি বিনাইয়া বিনাইয়া চিত্রবিচিত্রভাবে খোঁপা করিয়া বাঁধিয়া দিল। আনোয়ারার দাদিমার আদেশে হামিদার পুণ্যশীলা জননী আনোয়ারাকে বস্ত্রালঙ্কার পরিধান করাইলেন। আর ৪ জন স্বভাবসুশীলা ভদ্রমহিলা আয়া-স্বরূপ হামিদার মাতার সাহায্য করিলেন। হস্তস্পর্শে লজ্জাবতী লতা যেমন সহজে সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে, বালিকা বিবাহের বস্ত্রালঙ্কার পরিধান করিয়া লজ্জায় সেইরূপ জড়সড় হইয়া পড়িল; কিন্তু সমাগত স্ত্রীলোকেরা তাহাকে দুলহীন সাজে দেখিতে ইচ্ছা করায়, হামিদার মা হাত ধরিয়া তুলিয়া কন্যাকে মহিলামণ্ডলীর মাঝে দাঁড় করিয়া ধরিলেন। অকস্মাৎ বিজলীর আলোকে যেমন চক্ষু ঝলসিয়া যায়, কন্যার উত্থানমাত্র রমণীমণ্ডলীর চক্ষুও সেইরূপ ধাঁধিয়া গেল। তাঁহারা বাণীনিন্দিত মধুকণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “বাহবা বাহবা।” সে পবিত্র ধ্বনি অন্দরমহল হইতে আনন্দকোলাহল-মুখরিত ভূঞা সাহেবের বহির্ভবন মধুময় করিয়া অনন্তের পথে উত্থিত হইল। কন্যা লজ্জার ভারে অর্ধস্ফুট গোলাপকলিকার ন্যায় নিম্নদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার দেহলাবণ্য প্রভায়, অনুপম কারুকার্যমণ্ডিত পরিহিত ভূষণের সৌন্দর্য অধিকতর চাকচিক্যময় হইয়া উঠিল। তাহার স্বর্ণাভ অঙ্গের জ্যোতিঃফলিত রেশমি বস্ত্রের দীপ্তি আরও উজ্জ্বল দেখাইতে লাগিল। বালিকা ইতঃপূর্বে যাহার প্রেমে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিয়াছে অথচ যাঁহাকে সহজে পাওয়া কঠিন বা একেবারেই পাওয়া যাইবে না বলিয়াই মনে করিয়াছিল; পরন্তু না পাইলে তাঁহার পবিত্র স্মৃতি আশ্রয় করিয়া—খোদাতায়ালার সান্নিধ্যলাভের চেষ্টা করিবে ভাবিয়াছিল; ওহো! বালিকার কি সৌভাগ্য, সে আজ তাঁহারই প্রদত্ত বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা! সে আজ সেই দুষ্প্রাপ্য প্রেমাধার যুবকবরকে উপস্থিত মুহূর্তে পতিত্বে বরণ করিতে উদ্যত!

বালিকার হৃদয়ের অনুরাগ-জ্যোতিঃ এখন তাহার সুন্দর মুখে প্রতিফলিত। অন্তরের জ্যোতি বাহিরের জ্যোতিতে আসিয়া মিশিয়াছে, তাহাতে বোধ হইতেছে যেন দুইটি যৌগিক তাড়িতের সম্মিলনে পরিস্ফুট জড়িল্লতার উৎপত্তি হইয়াছে, জ্যোতির সহিত জ্যোতি মিলনে বালিকা আজ সত্যই জ্যোতির্ময়ী মূর্তি ধারণ করিয়াছে। সত্য সত্যই সে আজ বিবাহের সাজে সৌন্দর্যের মহিমান্বিত পাটরাণী সাজিয়াছে।

সমাগত স্ত্রীলোকেরা অনিমেষ দৃষ্টিতে বালিকার রূপ দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর সমালোচনা আরম্ভ করিলেন। কেহ কহিলেন, “এমন রূপ জন্মেও দেখি নাই।” কেহ কহিলেন, “এত মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ পরী।” কেহ বলিলেন, “এ মেয়ে পরীও নহে, পরীদিগের মাথার মণি।” আবার কেহ বলিলেন, “যেমন মা ছিলেন তেমনই মেয়ে হয়েছে।” গোলাপজান সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাহাকে খুশি করার জন্য আর একজন স্ত্রীলোক কহিলেন, “বাদশার মাও, ছোটবেলায় এইরূপ ছিল।” বাদশার মার ব্যথায় ব্যথী আর একজন কহিলেন, বাদশার মা বুঝি এখন বুড়ি হয়েছেন? ষাটের কোলে তাঁহার রূপ এখনো ঘরে ধরে না।” তাহা শুনিয়া অন্য একজন অল্প বয়স্ক রমণী তাঁহাকে কহিলেন, “ছি, ছি, তুমি বল কি? বাদশার মাকে কন্যার পায়ের”–এই পর্যন্ত বলিয়াই জিভ কাটিল। একজন প্রবীনা চতুরা দেখিলেন বিবাদ বাঁধে; তাই তিনি তাড়াতাড়ি কহিলেন, “বাদশার মার যে রূপ, তাহা অন্যের নাই।” বাদশার মা রাগ সমলাইয়া কহিলেন, “আমাদের গাঁয়ের রেবতী ঠাকুরের কন্যা এ মেয়ের চেয়ে বেশি সুন্দরী।” একজন মুখরা পাড়াবেড়ানী নারী সেখানে উপস্থিত ছিল, সে কহিল, “থোও থোও, রেবতী ঠাকুরের কন্যাকে আমি না দেখিলে হইত। এ মেয়ের বাঁদীর যোগ্যও সে হইবে না। আমি অনেক স্থানে অনেক মেয়ে দেখিয়াছি, এমন খুবছুরত মেয়ে কোথাও দেখি নাই।” রূপ সমালোচনা ক্রমে এইরূপ বাড়িয়া চলিল দেখিয়া দুলহীনের দাদিমা কহিলেন, “থাক মা, সকল রূপের বড়াই মিছা। তোমরা দোয়া কর, আমার আনার যেন খোদাভক্তি ও পতি-ভক্তিতে সকলের সেরা হয়।”

২৭ শে আশ্বিন সোমবার রাত্রিতে শুভক্ষণে আনন্দ-কোলাহল মধ্যে মোহাম্মদ নুরুল এসলাম মোসাম্মাৎ আনোয়ারা খাতুনের পাণিগ্রহণ করিলেন।

নুরল এসলাম বিবাহ করিয়া সস্ত্রীক বাড়ি ফিরিতে উদ্যত হইলেন। আনোয়ারা দাদিমার অঞ্চল ধরিয়া রোদন করিতে লাগিল। বৃদ্ধাও অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না, নিরুদ্ধ নয়নবারি দরবিগলিত ধারায় তাঁহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত করিতে লাগিল, তিনি শোকমোহে কতর হইয়াও পৌত্রিকে প্রবোধ ও উপদেশ দিতে লাগিলেন, “চিরদিন পিতৃগৃহে বাস করা কন্যার কর্তব্য নহে; শরিয়ত মত দুনিয়ায় পতি-গৃহই তাহার প্রকৃত আবাসস্থল; পরন্তু পতিসেবা না করিলে স্ত্রীলোকের নামাজ, রোজা, ধর্মকর্ম সব বিফল। অতএব, তুমি পতিসেবামাহাত্ম্যে ধর্মকর্ম রক্ষা করিবে। পতিকুলের তৃপ্তিসাধন ও মুখোজ্জ্বল করিবে; তাই বৎসে, তোমাকে পতিগৃহে পাঠাইতেছি। বিদায়ের সময় আসন্ন হইয়াছে, আর অধিক কি বলিব।

এই সারগর্ভ উপদেশ দিয়া বৃদ্ধা এবং স্বয়ং চোখের পানি মুছিতে মুছিতে রোরুদ্যমানা পৌত্রীকে তাহার স্বামীর সহিত বিদায় দিলেন। দুইটি চাকরানী কন্যার সঙ্গে গেল।

নুরল এসলাম মঙ্গলমত বাড়ি পৌঁছিলেন। এ বাড়িতেও দুলহীনের রূপ-সমালোচনা পূর্ণমাত্রায় চলিল। কেহ কহিলেন, “এমন খুবছুরত মেয়ে কোন্ দেশে ছিল?” কেহ বলিলেন, “ছেলে দেশে-বিদেশে ঘুরিয়া এমন রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।” নুরল এসলামের ছোট ভগিনী মজিদা বারম্বার ঘোমটা খুলিয়া নববধূর মুখ দেখিতে লাগিল। ডেপুটি সাহেব ২৫ টাকা দর্শনী দিয়া সম্বন্ধী-পত্নীর মুখ দেখিলেন। দেখিয়া কহিলেন, “পাত্রী বটে, এমনটি কখনও দেখি নাই!”