তৃতীয় পরিচ্ছেদ
স্বামী বাড়ি পৌছিবার তিনদিন পূর্বে, হামিদা শ্বশুরালয়ে আসিয়াছে। পূর্বোল্লিখিত পত্রানুযায়ী নির্দিষ্ট রবিবার বৈকালে, সে খিড়কীর ফুলবাগানে উপস্থিত ছিল। একটু পায়চারি করিয়া নিজ হাতে সে বাগান পরিষ্কার করিতে লাগিল। শরতের ফুটন্ত ফুলগুলি তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কটাক্ষে হাসিতে লাগিল। হামিদা রাগ করিয়া তাহাদের কতকগুলি বৃন্তচ্যুত করিয়া আঁচলে পুরিল। শেষে কামিনী-তলায় বসিয়া তাহাদিগকে নানাভাবে বিন্যাস করিয়া সুন্দর একখানি পাখা ও একগাছি মোহনমালা রচনা করিল। আশা, পথশ্রান্ত পতিকে পাখার বাতাস করিবে, প্রণয়োপহার স্বরূপ মোহনমালা তাঁহার গলায় ঝুলাইবে। পুষ্পগন্ধে অলিকুল গুন গুন ভন্ ভন্ করিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কেহ কেহ ফুলের পাখায়, কেহ বা মোহনমালায় উড়িয়া উড়িয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বসিতে লাগিল। হামিদা তখন বিরক্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এই সময় হঠাৎ তাহার মাথার উপর দিয়া একটি দাঁড়কাক কা—কা–খা—খা—করিতে করিতে উড়িয়া গেল। অমঙ্গলাশঙ্কায় সহসা হামিদার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। সে মনে মনে ভাবিল, “হায়, মন এত উতলা হইতেছে কেন, এমন ত কখনও হয় নাই?” তাহার চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে বেলা ডুবিল। সাঁঝের আলো নিভিয়া গেল; অন্ধকার ঘনাইয়া চোরের ন্যায় বাগানে প্রবেশ করিল। হামিদা তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বিষণ্ন মনে ঘরে প্রবেশ করিল এবং মনের শান্তির জন্য ও প্রোষিত পতির মঙ্গল-কামনায় অজু করিয়া নামাজ পড়িতে বসিল।
সন্ধ্যা অতীতপ্রায়। অপরাহ্ ৪টার সময় আমজাদ হোসেনের বাড়ি পৌঁছিবার কথা; কিন্তু এতক্ষণে আসিলেন না কেন? হামিদার উদ্বেগ ক্রমশ বাড়িয়া উঠিল, মনের ভাব কাহাকেও খুলিয়া বলিতে পারিতেছে না। যুবতীর এই অবস্থা খুবই ক্লেশজনক। কিছুক্ষণ পরে হামিদার বড় জা তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “কি লো আছরে ঘরে ঢুকিয়াছিস্ মগরেব অতীত প্রায়, তবু যে বাহির হইতেছিস্ না? ওলো বুঝিয়াছি—
নাগর না আসায় উতলা মন—
রন্ধন ভোজনে কিবা প্রয়োজনে?”
হামিদা লজ্জা ত্যাগ করিয়া কহিল, “বুবু, সত্যি আমার মন বড় উতলা হইয়াছে, এরূপ কখনও হয় নাই। পথে বুঝি কোন বিপদ ঘটিয়াছে?” বড় জা কহিলেন, “মিছে ভাবনায় মন খারাপ করিস না, এখনও আসার সময় যায় নাই, একান্ত যদি আজ না আসে, কাল আসিবে; চল বাহিরে চল।” এই বলিয়া তিনি হমিদার হাত ধরিয়া রান্নাঘরের আঙ্গিনায় লইয়া গেলেন।
রাত্রি দেড় প্রহর, তথাপি আমজাদ আসিলেন না, বাড়ির সকলেই চিন্তিত হইলেন। হামিদার উৎকণ্ঠা চরমে উঠিল। তাহার মাথার উপর তাহার কানের কাছে—কা—কা–খা- খা—শব্দ হইতে লাগিল। পতির অমঙ্গল ভাবনায় তাহার মনে চিন্তার তুফান ছুটিল, থাকিয়া থাকিয়া গা ঘামিয়া উঠিতে লাগিল। কেবল প্রকৃতির শাসনে সে নীরব—নির্বাক। বড় জা’র অনেক সাধাসাধি সত্ত্বেও সে অনাহারে শাশুড়ীর নিকট যাইয়া শয়ন করিল; কিন্তু শয্যা কন্টকময় হওয়ায়, সারারাত্রি তাহার অনিদ্রায় অতিবাহিত হইল। পরদিন বেলা এক প্রহরের সময় টেলিগ্রাম আসিল, “আমজাদ বেলগাঁও থানার অন্তর্গত রতনদিয়া গ্রামে—নুরল এসলামের বাড়িতে কলেরায় কাতর। আপনাদের আসা আবশ্যক।” সংবাদ শুনিয়া বাড়িতে কান্নার রোল উঠিল, হামিদার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল।