» » বিবাহ-পৰ্ব

বর্ণাকার

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সুখে, আমোদ-আহ্লাদে দেখিতে দেখিতে এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল। যানাভাবে এ পর্যন্ত নববধূ স্বামীসহ ফিরানীতে যাইতে পারে নাই। আগামীকল্য যাওয়ার দিন স্থির হইয়াছে। পূর্ব রাত্রি শয়ন-মন্দিরে নুরল এসলাম একটি সুন্দর ক্ষুদ্র বাক্স স্ত্রীর সম্মুখে খুলিলেন। পরে তাহা হইতে এক গোছা চুল বাহির করিয়া ঈষদ্ হাস্যে কহিলেন, “না বলিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম, অপরাধ ক্ষমা করিয়া আপনার বস্তু আপনি গ্রহণ করুন।” চুল দেখিয়া স্ত্রী প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিল না। শেষে যখন স্মরণ হইল যে, দাদিমা তাহাকে বলিয়াছিলেন, ‘ডাক্তার সাহেব নিজ হাতে তোমার মাথার চুল কাটিয়া নিজ হাতে জলপটী বসাইয়া দিয়াছিলেন, তখন ভাবিল, এ চুল তাহারই মাথার হইবে; তথাপি পতিকে জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা কোথায় পাইলেন?”

পতি। হাতে লইয়া দেখুন। স্ত্রী চুল হাতে লইয়া দেখিয়া কহিল, “ইহা আমার মাথার বলিয়াই বোধ হইতেছে।”

পতি। নিশ্চয় তাহাই।

স্ত্রী। সামান্য চুলের প্রতি আপনার যত্ন দেখিয়া লজ্জিত হইতেছি।

পতি। আমার নিকট ইহার মূল্য আমার জীবনের মূল্যের সমান। স্ত্রীর মুখ অধিকতর রক্তিমাভ হইয়া উঠল।

পতি। যদি আপনাকে না পাইতাম তবে এই কেশগুচ্ছ আমার জীবনের অবলম্বন হইত। স্থানান্তরে বিবাহের প্রস্তাব চলিলে আমি ঘটককে এই চুল দেখাইয়া বলিয়া দিতাম, এইরূপ সুচিক্কণ কেশযুক্তা পাত্রী না পাইলে বিবাহ করিব না। ঘটক এমন রত্ন কোথাও পাইত না; আমারও বিবাহ করা ঘটিত না।

স্ত্রী। যদি পাওয়া যাইত?

পতি। অসম্ভব।

স্ত্রী। এত বড় দুনিয়া; এত স্ত্রীলোক; পাওয়া অসম্ভব নয়?

পতি জেরায় ঠকিয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলেন, “অসম্ভব সম্ভব হইলে কি করিতাম, সে বিচার তখন হইত।”

স্ত্রীর রক্তিমাভ গোলাপ গণ্ডে ঈষৎ মলিনতার ছায়া পড়িল। সে কহিল, “বাবাজান ইতঃপূর্বে আমার বিবাহ সম্বন্ধে স্থানান্তরে দেড় হাজার টাকার গহনা, দেড় হাজার টাকা নগদ এবং তিন হাজার টাকার কাবিন চাহিয়াছিলেন, তাহাও দিতে সম্মত হইয়াছিল; যদি আপনার নিকট তাহাই চার্জ করিতেন তবে কি করিতেন?”

পতি। আমি গরিব মানুষ, তথাপি ধার-কর্জ করিয়া আপনাকে আনিতাম!

স্ত্রী। আপনাকে নগদ টাকা-পয়সা কিছুই দিতে হয় নাই, কেবল মাত্র তিন হাজার টাকার কাবিন দিয়াছেন। আমি শুনিয়াছি, আপনি এই কাবিন দিতে অনেক ওজর-আপত্তি করিয়াছিলেন। আমাকে পাওয়া যদি এতই বাঞ্ছনীয় হইয়াছিল, তবে শুধু কাবিন দিতে এত ইতস্তত করিয়াছিলেন কেন?

পতি। কাবিনে বড় ভয় হইয়াছে। বাবাজান শেষে আবার বিবাহ করিয়া অর্ধেক তালুক কাবিন দিয়া গিয়াছেন; শুনিতে পাইতেছি, মা (বিমাতা) নাকি সেই সম্পত্তি লইয়া পৃথক হইবেন। তিনি অর্ধেক ও আপনি তিন হাজার আদায় করিলে, কালই আমাকে পথে বসিতে হইবে।

পতি দুঃখের স্বরে এ কথাগুলি বলিলেন।

স্ত্রী পতির মনের ভাব বুঝিয়া তাঁহার ভাবান্তর উৎপাদনের জন্য কহিল, “এশার নামাজ পড়িয়াছেন?”

পতি। না। আজ নটায় ঘরে আসিয়াছি, নামাজ এখানেই পড়িব। স্ত্রী তখন ঘরের দক্ষিণ দিকের দ্বারের কাছে তাঁহার ওজুর জন্য একখানি জলচৌকি ও পানি রাখিয়া দিল। পতি ওজু করিতে বসিলেন। এই সময় স্ত্রী তাহার ট্রাঙ্ক হইতে রেশমি রুমালে জড়ান এক জোড়া চটিজুতা বাহির করিয়া লইয়া পতির পার্শ্বে উপস্থিত হইল। অনন্তর নিজ হস্তে তাঁহার চরণ ধৌত করিয়া নিজ হস্তে জুতাজোড়া পরাইয়া দিল এবং পরম ভক্তির সহিত তাঁহার কদমবুসি করিল। পতি স্ত্রীর এইরূপ ব্যবহারে বিস্ময়ে সুখ-সাগরে মগ্ন হইতেছিলেন। কিন্তু তখন কিছু না বলিয়া নামাজ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। স্ত্রী পতির পান-তামাক প্রস্তুত করিয়া নিজে নামাজে প্রবৃত্ত হইল।

নামাজ অন্তে পতি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ জুতা কোথায় পাইলেন?”

স্ত্রী। আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলেন কেন?

পতি। আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলেন কেন?

স্ত্রী হাসিয়া উঠিল; তারপর কহিল, “আপনি আমার পরম পূজনীয়, তাই ‘আপনি’ বলি।”

পতি। আপনি আমার মাথার মণি, এই নিমিত্ত ‘আপনি’ বলি।

স্ত্রী। আমি আপনার বাঁদী। বাঁদীর সহিত মনিবের ‘আপনি’ বলা মানায় না।

পতি। আর আমি যে আপনার কেনা; সুতরাং মুখ সামলাইয়া কথা বলা উচিত।

স্ত্রী। আপনি অমন কথা বলিলে আমি আর আপনার সহিত কথা বলিব না।

পতি। আচ্ছা, আমি এখন হইতে আপনাকে ‘তুমি’ বলিব; কিন্তু তুমি আমাকে ‘আপনি ‘ বলিলে, বুঝিব তুমি আমাকে অন্তরের সহিত ভালবাস না।

“ভালবাস না”–এই কথায়, এই চিন্তায় স্ত্রী হৃদয়ে যাতনা বোধ করিতে লাগিল, সে পতির হাত টানিয়া নিজ বুকে স্থাপন করিল। পতি হস্তস্পর্শে অনুভব করিতে লাগিলেন, উত্তাপে জল যেমন টগবগ করিয়া ফুটিতে থাকে, স্ত্রীর হৃৎপিণ্ড সেইরূপ স্পন্দিত হইতেছে। তখন পতি স্ত্রীকে কহিলেন, “প্রেমময়ী, তুমি আমাকে এতখানি ভালবাসিয়াছ? আমি যে ইহার শতভাগের এক ভাগও প্রতিদান করিতে পারি নাই। প্রাণাধিকে, তুমি মানবী না দেবী?” স্ত্রীর চক্ষু পতিপ্রেমে অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।

পতি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ জুতা কোথায় পাইয়াছ?”

স্ত্রী। আমাদের বৈঠকখানা ঘরে।

পতি একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হ্যাঁ ঠিক; মনে হইতেছে, তোমাদের বাড়িতে রাত্রিতে যখন আহার করি, তখন বৃষ্টি নামিয়াছিল। আহারান্তে নৌকায় যাইবার সময় চটিজুতায় যাওয়া অসুবিধা মনে করিয়া পাচককে নৌকা হইতে বুট আনিতে বলি, সে বুট জুতা আনিয়া দেয় এবং চটি ভুলিয়া নৌকায় তোলা হয় নাই।” পতি এই কথা বলিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই জুতা যে আমার, তাহা তুমি কিরূপে চিনিলে?”

স্ত্রী। আপনার পায়ে দেখিয়াছিলাম!

পতি। এই সামান্য জুতা এতদূর বহন করিয়া আনিবার কি দরকার ছিল।

স্ত্রী। জুতা সামান্য নয়, ইহা নিত্য দরকারী। এই বলিয়া সে কহিতে লাগিল, বৈঠকখানায় চটি পাইয়া চিনিলাম ইহা আপনার। তখনই আল্লার কাছে মোনাজাত করিলাম, ‘দয়াময়! দাসী যেন এই জুতা তাঁহার চরণে নিজ হাতে পরাইতে পারে।” আল্লাহ আজ দাসীর বাসনা পূর্ণ করিলেন।

ইহা শুনিয়া পতি বিবাহের পূর্বেই তাঁহার প্রতি স্ত্রীর প্রেম কতদূর গভীর হইয়াছিল বুঝিতে পারিলেন এবং বুঝিয়া স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করিলেন।

অতঃপর নবদম্পতি নিদ্রার কোলে শায়িত হইলেন।