চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আজ শনিবার অপরাহ্ণ। শারদীয় পূজা উপলক্ষে শিয়ালদহ স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, মহাজনী আড়ত প্রভৃতি বন্ধ হইয়াছে। উকিল-মোক্তার, ছাত্র- শিক্ষক, হাকিম-মুনসেফ, কেরানী-চাপরাশী প্রভৃতি নানা-শ্রেণীর লোক গৃহে ফিরিবার জন্য প্লাটফরমে উপস্থিত। প্রায় সকল লোকের সহিত ছোট বড় নানা সাইজের নানাবর্ণের স্টিলট্রাঙ্ক, ব্যাগ ইত্যাদি। পিতা-মাতা-ভ্রাতা-ভগিনী, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সম্বন্ধী-স্ত্রী, শ্যালিকা, তস্য নিকট সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের জন্য যথাযোগ্য উপহার দ্রব্যে ট্রাঙ্কাদি পরিপূর্ণ।
আজ টিকিট করা যে কত কঠিন, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতিত অন্যকে বুঝান দায়। আবার রেলগাড়িতে উঠা তদপেক্ষা কঠিন ব্যাপার। গাড়ির বেঞ্চে আজ স্থানের অভাব। কেহ বেঞ্চের নিচে, কেহ ঝুলান বেঞ্চের উপরে আশ্রয় গ্রহণ করিল। কেহ বা দাঁড়াইয়া রহিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি ব্যতিত অন্য দুই শ্রেণীর কোন প্রভেদ রহিল না—তথাপি স্থানের অভাব, তথাপি ঘরমুখো বাঙ্গালী গাড়িতে উঠিয়া হাসিখুশী গল্পগুজবে মত্ত। ড্রাইভারের ইঙ্গিতে কলের গাড়ি গুরুতর লোকরাণ্যবোঝা বুকে করিয়া যথাসময়ে গোসাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস হুস্ হুস্ করিতে করিতে গন্তব্যপথে প্রস্থান করিল।
ইন্টার ক্লাস গাড়ির একটি কামরায় এক বেঞ্চে পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষিভাবে দুইটি যুবক উপবিষ্ট। উভয়ের মাথায় তুর্কী টুপী; কিন্তু একজন কালো কোট-প্যান্টধারী, অন্যজন কালো আচকান ও সাদা পায়জামা পরিহিত। কামরার অধিকাংশ আরোহীর দৃষ্টি উভয় যুবকের উপর পতিত। একজন হিন্দু ভদ্রলোক মুখ ফুটিয়া কহিলেন, ‘আপনারা কি যমজ?” যুবকদ্বয়ের মধ্যে একজন কহিলেন, “না”।
হিন্দু। আপনাদের যেরূপ একাকৃতি, উভয়কে বদল দেওয়া চলে; এমন দুইটি কখনও দেখি নাই।
একজন বৃদ্ধ মুসলমান কহিলেন, “সব খোদাতায়ালার মরজি; নইলে, যমজ নয় অথচ এক চেহারা।” যুবকদ্বয় পরস্পরের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন। তৎপর কোটধারী যুবক আচকানধারী যুবককে কহিলেন, “আপনি কোথায় যাইবেন?”
আ ধা। বেলগাঁও জুট কোম্পানির অফিসে।
কোটধারী তাঁহার দিকে সবিস্ময়ে তাকাইয়া রহিলেন। তাহার পর কহিলেন, “আপনি তথায় চাকরি করেন?”
আ-ধা। জ্বি, হাঁ।
কো-ধা। আপনি কি পাটের মরশুমে মফঃস্বলে যান?
আ-ধা। জ্বি, হাঁ।
কো-ধা। গত ভাদ্রমাসে কি মফঃস্বলে গিয়াছিলেন?
আ-ধা। জ্বি।
কো-ধা। কোন্ দিকে গিয়াছিলেন?
আ-ধা। মধুপুর অঞ্চলে।
কোটধারী মনে মনে ভাবিলেন, ইনিই হামির লিখিত আনোয়ারার প্রাণ চোরা পুরুষবর হইবেন।
আ-ধা (স্মিতমুখে)। মোয়াক্কেলের নিকট মোকদ্দমার অবস্থা শুনিয়া উকিল-মোক্তারেরা যেরূপ বাদী বা আসামীকে প্রশ্ন করিয়া থাকেন, আপনার জিজ্ঞাসার ধরণ প্রায় সেইরূপই দেখিতেছি। যাহা হউক, আপনি কোথায় যাইবেন?
কোটধারী স্মতমুখে কহিলেন, “বেলতা”।
যে দিবস রাত্রিতে নুরল এসলাম ভূঞা সাহেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, সেই দিন গল্পগুজব প্রসঙ্গে তিনি তালুকদার সাহেবের নিকট শুনিয়াছিলেন, তাঁহার কন্যার জামাতা কলিকাতায় ল-ক্লাসে পড়িতেছেন, বাড়ি বেতা, নাম আমজাদ হোসেন এবং তাহার চেহারা ঠিক তাঁহারই চেহারার মত। এক্ষণে ভাবিলেন, ইনিই তালুকদার সাহেবের জামাতা হইবেন এবং বোধহয় খিড়কীদ্বারে দৃষ্টা অলঙ্কারাদি পরিহিতা বালিকাই এই মহাত্মার সহধর্মীনী হইবেন; পরন্তু ইহার স্ত্রীই বোধহয় পত্রযোগে ইহাকে সব কথা লিখিয়া জানাইয়াছেন।
ফলতঃ এইরূপ দৈব-মিলনে, এইরূপ কথোপকথনে মনে মনে একে অন্যকে অনেকটা চিনিয়া লইলেন। তথাপি খাঁটি সত্য জানিবার জন্য আচকানধারী কোটধারীকে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি কলিকাতায় ল-ক্লাসে পড়েন?” কোটধারী রহস্যভাবে কহিলেন, “আপনাকে জ্যোতির্বিদ বলিয়া মনে হইতেছে?”
আ-ধা। জ্যোতির্বিদ্যায় ত’ আপনিই প্রথম পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছেন।
কো-ধা। আমার পাণ্ডিত্য আনুমানিক।
আ-ধা। আমারও তদ্রূপ।
কো-ধা। আচ্ছা, আপনি অনুমানে আরও কিছু বলিতে পারেন কি?
আ-ধা। আপনার নাম আমজাদ হোসেন নয় কি?
কো-ধা। তারপর?
আ-ধা। মধুপুর আপনার শ্বশুরবাড়ি।
কো-ধা। তারপর?
আ-ধা। আনুমানিক গণনায় আর কিছু পাইতেছি না।
কো-ধা। অল্পদিন হইল আমিও কিছু গণনা বিদ্যা শিখিয়াছি, পরীক্ষা করিবেন কি?
আ-ধা। (হাসিয়া) তাহা হইলে আমার অদৃষ্ট বর্ণনা করুন দেখি?
কো-ধা। আপনার নাম নুরুল এসলাম, আপনি এখনও অবিবাহিত!
আ-ধা। তারপর?
কো-ধা। সম্প্রতি আনোয়ারা নাম্নী এক বেহেস্তের হুর মধুপুর আলোকিত করিয়া অবস্থান করিতেছে।
এইটুকু বলিয়া কোটধারী আচকানধারীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাঁহার মুখ আবেগ উৎকণ্ঠায় ভরিয়া গিয়াছে। তিনি সেই অবস্থায় কহিলেন, “তারপর?”
কো-ধা। আপনি সেই বেহেস্তের হুরকে কোরান পাঠে মুগ্ধ করিয়া, চিকিৎসায় আরোগ্য করিয়া বিবাহের পূর্বেই তাহার সরল মনটি চুরি করিয়া আনিয়াছেন। এখন বাকী তাহার লাবণ্যভরা দেহখানি। বোধহয়, এখন সেইটা পাইলেই আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
আ-ধা। (লজ্জিতবাবে) আপনি সত্য গণক; খোদার ফজলে আপনার গণনা সফল হউক।
কো-ধা। গণনা খোদার ইচ্ছায় নিশ্চয়ই ফলিবে।
আ-ধা। (স্মিতমুখে) আপনার গণনা বিদ্যার গুরু কে?
কো-ধা। (স্মিতমুখে) নাম প্রকাশ নিষেধ আছে।
আচকানধারী এখন বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার স্ত্রীই পত্রযোগে সব কথা তাঁহাকে জানাইয়াছেন।
উল্লিখিতরূপে রহস্যালাপে ক্রমে উভয়ের প্রকাশ্য পরিচয় হইয়া উঠিল। পরিচয়ে হৃদ্যতা জন্মিল।
এই সময়ে হঠাৎ নবপরিচিত যুবক যুগলের বিশ্রান্তালাপের মধ্যে এক বিষাদের ছায়া আসিয়া পড়িল। গাড়িতে কোটধারী অর্থাৎ আমজাদ হোসেনের উদরাময়ের লক্ষণ দেখা দিল। বিশেষ ভাবনার কথা। তখন কলিকাতা অঞ্চলে কলেরার খুব বাড়াবাড়ি। আচকানধারী নুরুল এসলাম চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাল ভাল হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এবার বাক্স পুরিয়া লইয়া বাড়ি চলিয়াছেন। ট্রাঙ্ক হইতে রুবিনীর ক্যাম্পার বাহির করিয়া এক দাগ আমজাদকে সেবন করাইলেন। রাত্রি সাড়ে ৩ টার সময় রেলের মধ্যে আর একবার দাস্ত হইল। নুরুল এসলাম আরও একদাগ ক্যাম্পার দিলেন। ভোরে উভয়ে গোয়ালন্দ স্টেশনে নামিলেন। নামিবার পর রাস্তায় আমজাদের অত্যন্ত বমি হইল, এবার তিনি খুব কাতর হইয়া পড়িলেন। নুরুল তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া স্টিমারে তুলিলেন এবং নিচের তলায় সুবিধামত স্থান লইলেন।
নুরুল এসলাম কোম্পানির কার্যে কলিকাতায় গিয়াছিলেন, কার্য শেষ করিয়া বেলগাঁও যাইতেছিলেন। আমজাদ পূজার ছুটিতে বাড়িতে চলিয়াছেন।
আমজাদকে স্টিমারে লইয়া গিয়া নুরুল এসলাম, বিশেষ বিবেচনাপূর্বক ঔষধ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ফলে স্টিমারে আর একবার মাত্র দাস্ত হইল; কিন্তু পেটে বেদনা ধরিয়া উঠিল। সম্মুখে নুরুল এসলামের নামিবার স্টেশন। আমজাদকে প্রায় সমস্ত দিন রাস্তায় কাটাইতে হইবে। তখন বেলা ১০ টা। নুরুল এসলাম ভাবিলেন, ইনি যেরূপ কাতর হইয়াছেন, তাহাতে সত্বর ভাল চিকিৎসা হওয়া আবশ্যক। এমতাবস্থায় একাকী ইহাকে দিনমানে রাস্তায় ফেলিয়া যাওয়া বা ছাড়িয়া দেওয়া কর্তব্য নহে। আমজাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল পাল্কী করিয়া তাঁহাকে নিজ বাড়ি লইয়া গেলেন।
বাড়িতে লইয়া যাওয়ার পর, আমজাদের ঘন ঘন ভেদ-ভূমি হইতে লাগিল, প্রস্রাব বন্ধ হইয়া পেট ফাঁপিয়া উঠিল, রাত্রিতে খিচুনী প্রভৃতি কলেরার যাবতীয় উপসর্গ একযোগে দেখা দিল। নুরুল এসলাম মহা চিন্তিত হইলেন। আমজাদ ভাঙ্গা গলায় কহিলেন, “দোস্ত, আর বাঁচিবার আশা নাই। আমার বাড়িতে একটা তার করিয়া দাও। তোমার উপকারের প্রতিকার করিতে পারিলাম না; ইহাই আক্ষেপ থাকিল।” এই বলিয়া আমজাদ কাঁদিয়া ফেলিলেন। নুরল এসলাম তাঁহার চক্ষের পানি মুছিয়া দিয়া কহিলেন, “তুমি ভীত হইও না, ইহা অপেক্ষা কঠিন কলেরায় লোকে আরোগ্য হয়। আমি বেলগাঁও হইতে এসিস্টান্ট সার্জনকে আনিতে পাঠাইয়াছি।” এই সময় সার্জন বাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন, অবস্থা দেখিয়া ঔষধ দিলেন এবং রাত্রিতে আসায় চতুর্গুণ ভিজিট লইয়া বিদায় হইলেন। নুরুল ও তাঁহার ফুফু সারারাত আমজাদকে ঔষধ সেবন করাইলেন ও সেবাশুশ্রূষা করিলেন।
রাত্রি প্রভাত হইল; কিন্তু পীড়ার উপশম না দেখিয়া নুরল প্রাতে স্বয়ং বেলগাঁও যাইয়া বেতা ‘তার’ করিলেন, তারের সংবাদ পাঠক পূর্বেই পাইয়াছেন আবার আপনাদিগের পূর্বে হামিদা মনস্তাপে স্বামীর অমঙ্গল সংবাদ যে অবগত হইয়াছে, তাহাও জানেন।
‘সাধ্বী ললনার হৃদয় স্বামীর হৃদয়ের সহিত এইরূপ এক তারে বাঁধা’ এ তার টেলিফোনকে হারাইয়া দেয়। সুদূর প্রবাসে থাকিলেও স্বামীর মঙ্গলামঙ্গল সাধ্বী তারযোগে ঘরে বসিয়া জানিতে পারে। ভক্তির সংযোগ ইহা সতীহৃদয় সর্বদা জ্যোতির্ময় করিয়া রাখে। মেসমেরিজমের মূলে যেমন গভীর একাগ্রতা, এ তারের মূলে তেমনি নিরবচ্ছিন্ন পরিচিন্তা বা প্রেমের সাধনা।
তার পাইয়া আমজাদের পিতা মীর নবাব আলী সাহেব ও আমজাদের শ্বশুর ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেব ছেলেকে দেখিতে রতনদিয়ায় রওয়ানা হইলেন।
এদিকে নুরল এসলাম বেলগাঁও হইতে প্রাতে আর একজন ভাল ডাক্তার লইয়া গেলেন। আল্লার ফজলে তাঁহার চিকিৎসায় আমজাদ আরোগ্যের পথে দাঁড়াইলেন। তাঁহার পিতা ও শ্বশুর রতনদিয়ায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে দেখিয়া আশ্বস্ত হইলেন এবং বাড়িতে পুনরায় ‘তার’ করিলেন। মীর নবাব আলী সাহেবের পুত্রের সহিত নুরল এসলামের একাকৃতি দেখিয়া তাজ্জব বোধ করিতে লাগিলেন।