সপ্তম পরিচ্ছেদ
আজ ফুলশয্যা। মুসলমানের ফুলশয্যার সম্বন্ধে কোন বিশেষ আচারবিধি না থাকিলেও, যিনি ইহার বিধানকর্ত্রী তিনি বিশেষ সখ করিয়া এই ফুলশয্যার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। একমাত্র ভাই, জগৎ-সেরা বৌ; তাই-সর্বগুণসম্পন্না ভগিনী রশিদনের উদ্যেগে আজ এই মহোৎসব।
রাত্রি এক প্রহর। সকলের আহার শেষ হইয়াছে। নুরল এসলাম আহারান্তে বৈঠকখানায় বন্ধু-বান্দব পরিবৃত হইয়া গল্পগুজব করিতেছিলেন। গল্প করিতেছিলেন মুখে, কিন্তু মনটি তাঁর অন্তঃপুরে; চক্ষুদ্বয় তাঁহার দেওয়ালের সংলগ্ন ঘড়ির দিকে কর্ণদ্বয় তাঁহার অন্ত-পুরের আহ্বান শ্রবণে সতর্কিত ও ব্যকুলভাবে উৎকণ্ঠিত। ক্রমে ঘড়িতে ১১টা বাজিল। বন্ধুগণ একে একে উঠিয়া স্ববাসে প্রস্থান করিলেন। নুরল এসলাম তখন ওজু করিয়া পরম ভক্তিপূর্ণ চিত্তে এশার নামাজ পড়িলেন। অনন্তর আরাম-কেদারায় গা ঢালিয়া দিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের একখানি মানচিত্র মানসপটে অঙ্কিত করিতে লাগিলেন। অঙ্কন যেখানে ভাল হইল না, সেখানে মুছিয়া নূতন করিয়া গড়িতে লাগিলেন।
এদিকে রশিদন্নেছার আদেশে দাসীরা ফুলশয্যা রচনায় ব্যস্ত। রশিদনের ছোট ভাগিনী মজিদা ও বৈমাত্রেয় ভগিনী সালেহা সেখানে উপস্থিত। রশিদন মজিদাকে কহিলেন, “কি লো, সাঁজের ফুলগুলি কোথায় রাখিয়াছিস?” মজিদা দৌড়াইয়া গিয়া গৃহাভ্যন্তর হইতে সাজিভরা ফুল আনিল, তাহাতে রক্তপদ্ম, বেলী, চামেলী, গোলাপ, জবা—নানা জাতীয় ফুল ছিল। রশিদনের আদেশে দাসীরা পূর্বেই নুরল এসলামের শয়ন ঘরখানি পরিষ্কার-পরিছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল; এক্ষণে শয্যা রচনা করিয়া ফুলগুলি যথোপযুক্তস্থানে সন্নিবেশ করিল। লোবান জ্বালান হইল। ফুলের সৌরভে, লোবানের সুগন্ধে ফুলময়গৃহ পরী নিকেতন হইয়া উঠিল।
অতঃপর মজিদা, সালেহা প্রভৃতি নববধূকে ঘরে দিতে ঘিরিয়া লইয়া আসিল। এই সময় নববধূর বড়ই বিপন্ন অবস্থা। প্রেম ও লজ্জা একসঙ্গে বালিকাকে লইয়া টানাটানি আরম্ভ করিল। শেষে প্রেম তাহাকে ধীরে—অতি ধীরে ঘরে উঠিতে উপদেশ দিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে নুরল এসলাম সলজ্জভাবে বাসর ঘরে প্রবেশ করিলেন। ননদেরা নববধূকে দুনিয়ার বেহেস্তের বাগানে ফেলিয়া পলায়ন করিল। বালিকা অবগুন্ঠনে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। যুবকও নীরব। নীরবতার পীযুষপানে উভয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিলেন। শেষে বালিকা ধীর শরমকম্পিতচরণে একটু অগ্রসর হইয়া চির-আকাঙ্ক্ষিত স্বামীর দুর্লভ চরণ চুম্বন করিল; যেন বসন্তের সুখানিলস্পর্শে নবমঞ্জরিত মাধবীলতা দুলিতে দুলিতে সহকারমূলে আনত হইল। নুরল এসলাম তখনই সেই কনক-প্রতিমার চম্পকবিনিন্দিত কোমলকরাঙ্গুলি করে ধারণ করিয়া ধীরে—অতি ধীরে উঠাইলেন এবং প্রেমপুরিত মধুর কণ্ঠে কহিলেন, “চূরি করিয়া কি এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয়?” নিমেষমধ্যে আনোয়ারার মানস- নেত্রে সেই খিড়কীদ্বারে নৌকাদর্শন হইতে আরম্ভ করিয়া এতদিনের আশা-নৈরাশ্য ও সুখমোহবিজড়িত মর্মকোণে লুক্কায়িত গুপ্ত কাহিনীগুলি চিত্রের ন্যায় জীবন্ত হইয়া উঠিল লজ্জায় তাহার সুকোমল গণ্ড কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হইয়া গেল। মুখমন্ডলে প্রভাতকালে রক্তপদ্মের উপর শিশির বিন্দুর মত স্বেদবিন্দু ফুটিয়া উঠিল; কিন্তু লজ্জায় সে মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারিল না। মুখে অবগুন্ঠন থাকায় নুরল এসলামও প্রাণ প্রতিমার এই অপার্থিব মাধুরী দেখিতে পাইলেন না। তিনি কিয়ৎক্ষণ আত্মহারাবৎ দণ্ডায়মান থাকিয়া প্রিয়তমার মুখের নিকট মুখ লইয়া মৃদুহাস্যে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “টগর জবার দাম পাইয়াছেন?” এবার বালিকা কথা না বলিয়া আর থাকিতে পারিল না। লজ্জা তার গলা চাপিয়া ধরিলেও টগর ও জব্বার নামে প্রেম ও বিস্ময় বালিকাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিল, সে তখন কহিল, “আপনি টগর-জবার নাম জানিলেন কি করিয়া?”
যুবক। সেই দিনই প্রেম বৈঠকখানায় আসিয়া আমার কানে কানে বলিয়া গিয়াছিল।
প্রেমের ভয়ে লজ্জা আর বালিকাকে পীড়ন করিতে সাহস পাইল না। বালিকা স্বামীর কথার উত্তরে কহিল,–-“টগর-জবার নগদ মূল্য পাই নাই। কিন্তু তাহার বদলে যে মহামূল্য রত্ন পাইয়াছি, তাহাতে জিন্দেগী সফল মনে করিতেছি।”
যুবক। কি রত্ন লাভ করিয়াছেন?
বালিকা। এই ত, সম্মুখে উপস্থিত।
যুবক। কই, দেখিত’ না?
বালিকা ধীরে নিজহস্তে স্বামীর হস্ত গ্রহণ করিয়া কহিল, “এইত।” নুরল এসলাম আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া স্ত্রীকে কহিলেন, “আজ আমিও কোহিনূর লাভ করিয়া ধন্য হইলাম; এখন আসুন, উভয়ে একত্রে এজন্য খোদাতালার শোকরগোজারী করি।” এই বলিয়া তিনি স্ত্রীকে আপন বামপার্শ্বে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। বালিকা পতির পবিত্র প্রথম আদেশ সসম্মানে পালন করিতে তাহার পার্শ্বে উপবেশন করিল। যুবক কহিলেন, “আমার কথিত বাক্যে মোনাজাত করিবেন ও আমিন আমিন বলিবেন।” এই বলিয়া ঊর্ধ্ব হস্তে বলিতে লাগিলেন “হে আল্লাহুতা’লা! আজ আমরা, তোমার নবীর সুন্নত পালন করিলাম। কিন্তু দয়াময়! দুর্বল আমরা, নির্বোধ আমরা যাহাতে আমরা আমাদের এই নূতন জীবনের কর্তব্য সুসম্পন্ন করিতে পারি, তাহার শক্তি আমাদিগকে দাও। হে প্রেমময়! যেন আমাদের প্রেম তোমারই প্রেমের জন্য হয়। হে মধুর! হে সুন্দর! যেন আমাদের চির-জীবন মধুময় হয় ও আমাদের কর্ম সৌন্দর্যময় হয়। হে আমাদের অস্তিত্বের স্বামী, যেন আমরা এক মনে এক প্রাণে সর্বদা তোমার সেবা করিতে পারি। আমিন্ ইয়া রাব্বিল আলামিন, আমিন!”
মোনাজাত অন্তে নুরল এসলাম গাত্রোত্থান করিলেন; কিন্তু বালিকা উঠিল না; নুরল এসলাম তাহার ঘোমটা খুলিয়া দিলেন, দেখিলেন—তাহার শতদল নিন্দিত নেত্রদ্বয় হইতে মুক্তাফল গড়াইতেছে। মুখমণ্ডল আনন্দে উৎফুল্ল, নয়নযুগল হইতে অশ্রুবিগলিত! প্রেমময় স্বামীর পত্নীভাবে এই প্রথম ব্যবহার। নুরল এসলাম কহিলেন, “কাঁদিতেছেন কেন?” প্ৰেম বালিকাকে কহিল—–উত্তর দাও? লজ্জা কহিল—ছি! প্রেমের কথায় তোমার এই স্বর্গীয়ভাবের মাধুর্য নষ্ট করিও না। নুরল এসলাম কোন উত্তর পাইলেন না; কিন্তু ভাবদৃষ্টে বুঝিলেন, এ মুক্তাফল শোকর-গোজারীর দক্ষিণা। অতঃপর তিনি প্রিয়তমার কর ধরিয়া ফুলাসনে আরোহন করিলেন।