পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পাঁচ বিঘা জমি জুড়িয়া নুরল এসলামের বাড়ি। চারিদিকে অনতিউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত। প্রাচীরের ভিতর দিকে যথাস্থানে রোপিত ফলবান বৃক্ষাদি, পশ্চিমাংশে পুষ্করিণী। বাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় এগারোখানি ঘর; তন্মধ্যে রান্নাঘর, ভাণ্ডার ঘর ও বৈঠকখানা ঘর করগেট টিনে নির্মিত। অন্যান্য ঘরগুলি খড়ের। নুরল এসলামের পিতা টিনের ঘর ভালবাসিতেন। বৈঠকখানার ঘরখানি সাহেবী ফ্যাসানে প্রকাণ্ড আটচালা। আটচালার সম্মুখে ফুলের বাগান, তাহার সম্মুখে দূর্বাদল শোভিত পতিত ক্ষেত্র। পতিত ক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে মনে হয় যেন একখানি সবুজ গালিচা বিস্তৃত করিয়া রাখা হইয়াছে। বাগান হইতে পতিত ক্ষেত্রের উপর দিয়া অনতিউচ্চ সরল বাঁকা রাস্তা দক্ষিণ প্রাচীরের সদর দ্বার পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গুবাকবৃক্ষ সৈন্যশ্রেণীর ন্যায় সদর্পে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে প্রাচীরের বাহিরে অনতিদূর দিয়া গবর্নমেন্টের বাঁধা সড়ক বেলগাঁও বন্দর হইতে দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে জেলা পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে।
আমজাদ হোসেনকে বৈঠকখানা ঘরের অন্দরমহল-সংলগ্ন প্রকোষ্ঠে স্থান দেওয়া হইয়াছিল। তাঁহার পিতা ও শ্বশুরকে মধ্য প্রকোষ্ঠে স্থান দেওয়া হইল। ৪/৫ দিনের মধ্যে আমজাদ সুস্থ হইয়া উঠিলে তাঁহারা বাড়ি যাইতে উদ্যত হইল; কিন্তু নুরল এসলামের বিশেষ অনুরোধে তাঁহাদিগকে আরও দুই তিন দিন তথায় থাকিতে হইল। তাঁহারা নুরল এসলামের আতিথ্য সৎকারে ও অমায়িক ব্যবহারে একান্ত মুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। আমজাদের সহিত নুরল এসলামের বন্ধুত্ব সবিশেষ ঘনীভূত হইল। দৈবঘটনায় আমজাদ হোসেনের পীড়া উপলক্ষে ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেবের সহিত পুনরায় দেখা হওয়ায়, নুরল যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, তাঁহাড়ের বাড়ি রওয়ানা হইবার পূর্বে আমজাদ নুরল এসলামকে কহিলেন, “এখন আমার রেলওয়ের গণনা, কার্যে পরিণত করিতে ইচ্ছা করি।” নুরল এসলাম তাঁহার বিবাহের কথা বিমাতা ও ফুফু-আম্মাকে জানাইলেন। ফুফু-আম্মা আগ্রহ সহকারে মত দিলেন। অগত্যা বিমাতাও সম্মতি জানাইলেন। নুরল এসলাম স্মিতমুখে আসিয়া বন্ধুকে কহিলেন, “শুভস্য শীঘ্রম।” আমজাদ পিতা ও শ্বশুরের নিকট বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন। তালুকদার সাহেব তাঁহার বেহাইকে নুরল এসলামের পাট খরিদ, আনোয়ারার চিকিৎসা, তার দাদিমার মনের ভাব, আজিমুল্লার পুত্রের সহিত আনোয়ারার বিবাহ-প্রসঙ্গ এবং ভূঞা সাহেবের টাকার লোভ প্রভৃতি কথা খুলিয়া বলিলেন।
মীর সাহেব শুনিয়া কহিলেন, “রতনদিয়ায় দেওয়ান-গোষ্ঠী বুনিয়াদী ঘর। আমি এ ঘরের পরিচয় পূর্ব হইতেই জানি। এমন ঘরে, এমন বরে কন্যা দিতে পারিলে, ভূঞার চৌদ্দ পুরুষ স্বর্গে যাইবে। টাকার লোভে ত’ দূরের কথা, বিনা অর্থে সত্বর যাহাতে এ কার্য হয়, আমি বাড়ি যাইয়া ভূঞা শালার কান ধরিয়া তাহা করিতেছি।”
পরদিন আহারান্তে পিতা ও শ্বশুরের সহিত আমজাদ বাড়ি রওয়ানা হইলেন। যথেষ্ট শিষ্টাচার সহকারে নুরল এসলাম তাঁহাদিগকে স্টিমারে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। বৈকালে তাঁহারা বাড়ি পৌছিলেন। আমজাদের মা ছেলেকে পাইয়া হাতে স্বর্গ পাইলেন, অন্যান্য সকলে আনন্দিত হইলেন, হামিদা স্বামী দর্শনে মৃতদেহে প্রাণ পাইল এবং দুই রাকাত শোকরানার নামাজ আদায় করিল।