» » বিবাহ-পৰ্ব

বর্ণাকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন প্রাতে হামিদা একখানা চিঠি হাতে করিয়া আনোয়ারার নিকট আসিয়া বসিল এবং কহিল, “সই হাদিসের একটি উপদেশ বাবাজানের মুখে শুনিয়াছিলাম—’আল্লা যখন যাহা করেন, সবই নর নারীর মঙ্গলের নিমিত্তই করিয়া থাকেন।’ তোমার বিবাহভঙ্গ এই মহতী বাণীর এক জ্বলন্ত প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বাজ পড়িল, ঘর পুড়িল, গো-শালায় গরু মরিল, কূপে কলসী ডুবিল, ইহা তোমার মঙ্গলের নিমিত্তই ঘটিয়াছে। তাহা না হইলে চাচাজানের যেরূপ মতিগতি তাহাতে কালই তোমাকে দোজখে নিক্ষেপের বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিতেন। দেখ, তোমার সয়া কি লিখিয়াছেন।” এই বলিয়া হামিদা চিঠিখানির উপরের ৪ লাইন ও নিচের ৩ লাইন ভাঁজ করিয়া নিচে ফেলিয়া মধ্যাংশ সইকে পাঠ করিতে দিল। আনোয়ারা হাসিয়া কহিল, “যদি সমস্ত চিঠি আমাকে পড়িতে না দাও তবে আমি উহা পড়িব না।” সরল প্রকৃতির সই যে এমন প্যাচের কথা বলিবে, হামিদা মোটেই চিন্তা করে নাই, তাই হঠাৎ ফাঁপরে পড়িল। শেষে ইতস্তত করিয়া কহিল, “যদি তুমি ভাঁজ করা নিচের অংশদ্বয় মনে মনে পড়িয়া অবশিষ্ট অংশ বড় করিয়া পাঠ কর, তবে সব চিঠি তোমাকে পড়িতে বলি।“ আনোয়ারা তথাস্তু বলিয়া চিঠিখানি হাতে লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। উপরের ৪ লাইনে লেখা ছিল, “প্রাণের হামি, তোমার ১৬ই ভাদ্রের পত্র পাইয়াছি। আমার বাড়ি পৌছিবার ৩/৪ দিন পূর্বে বোধ হয় তুমি বেল্লা আসিবে। যাহা হউক, তোমার সহিত সম্মিলন সুখের আশায় হৃদয়ে যে উল্লাসলহরী খেলিতেছে, তাহা তোমাকে বুঝাইতে ভাষা পাইলাম না।” উপরের এই অংশ আনোয়ারা মনে মনে পড়িতে আরম্ভ করিয়া মুখ ফুটিয়া পড়িয়া ফেলিল। তাহার পরের অংশ আবার বড় করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াই মনে মনে পড়িতে লাগিল। হামিদা কহিল, “সই, ও কি? পরের বেলায় উচ্চভাষে, নিজের বেলায় চুপটি আসে। মনে মনে পড়িলে ছাড়িব না, বড় করিয়া পড়িয়া যাও।” আনোয়ারা বাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল, “যাহা হউক, প্রতি পত্রের প্রতি ছত্রে তোমার সইয়ের ভাল ঘরে ভাল করে বিবাহ দিবার অনুরোধ করিয়া আসিতেছ; আমিও এক- প্রাণে তাঁহার যোগ্য বর খুঁজিতেছি; কিন্তু তোমার অদ্যকার পত্রে তাঁহার বিবাহের সম্বন্ধের কথা শুনিয়া মর্মাহত হইলাম। যদি চাচাজান অর্থলোভে এ বিবাহ দেন, তবে একটি বেহেস্তের হুরকে দোজখে ডুবান হইবে। অতএব এ বিবাহ যাহাতে না হয়, তোমরা বাবাজানকে (শ্বশুরকে) বলিয়া তাহা করিবে। আমি বাড়ি পৌছিয়া মধুপুরে যাইয়া সব গোল মিটাইয়া দিব এবং খোদাতায়ালা সালামতে রাখিলে প্রতিজ্ঞা করিতেছি,— যেরূপে পারি তোমার সইয়ের—” এই পর্যন্ত পড়িয়া আনোয়ারা উঠিবার চেষ্টা করিল, হামিদা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “যাও কোথা? পত্রের সকল কথা পড়িয়া শুনাইতে হইবে।” আনোয়ারা লজ্জিতাননে ছোট গলায় পড়িল, ‘প্রাণচোরা’ পুরুষ-বর আনিয়া তাঁহার শ্রীপাদপদ্মে হাজির করিব। তুমি লিখিয়াছ তোমার সইয়ের হৃদয়-দেবতা ঠিক এই গরিব বেচারার চেহারাবিশিষ্ট! এইরূপ হইলে তোমার প্রাণ উড়িবার কথাই বটে! আমার ভয় হইতেছে, যদি তোমার উড়া-প্রাণপাখী আবাসে না ফিরিয়া সইয়ের প্রাণ-চোরার হৃদয়ে বাসা লয়, তবে যে আমি নিরুপায়—পথের কাঙ্গাল! যাহা হউক, আমার নিকটে তোমার প্রবঞ্চনা- পাপের প্রায়চিত্ত হেতু সই তোমার যে উপদেশ দিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাকে—” আবার আনোয়ারার মুখ বন্ধ হইয়া আসিল, হামিদা কৃত্রিম বিরক্তি সহকারে বলিল, “সব পত্র পড়িবে কথা দিয়াছ, অঙ্গীকার ভঙ্গের গোনার ভয় নাই?” আনোয়ারা অত্যন্ত লজ্জার সহিত ভাঙ্গা গলায় পড়িতে লাগিল, “সাধারণ মানবকন্যা বলিয়া মনে হয় না; কোন সুরবালা ভ্রমক্রমে মর্ত্যে নামিয়া মধুপুর আলোকিত করিয়াছে। তুমি বহু পুণ্যফলে তাঁহাকে সখীরূপে প্রাপ্ত হইয়াছে। তোমার সহিত আমিও ধন্য হইয়াছি। তাঁহাকে আমার হাজার হাজার সালাম জানাইবে।” এই পর্যন্ত পড়া হইলে হামিদা “ভোলার মাকে একটি কথা বলিয়া আসি” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলে আনোয়ারা তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিয়া বড় গলায় পড়িতে লাগিল, “জীবন্ময়ী—আর একটি কথা, আগামী রবিবার অপরাহ্ণে ৪টার সময় বাড়ি পৌঁছিব। যাইয়া যেন তোমাকে তোমার ফুলবাগানে উপস্থিত পাই। মনে রাখিও, এবার পুষ্পোৎসবের পালা আমার।

– তোমারই
আমজাদ

পত্রপাঠ শেষ করিয়া আনোয়ারা কহিল, “সই, তুমি বড়ই দুষ্টামি করিয়াছ। এখানকার সব কথা না লিখিলে কি চলিত না?”

হামিদা। সই, আমি দুই কানে যাহা শুনি, দুই চোখে যাহা দেখি, তাহা তাঁহাকে না জানাইয়া থাকিতে পারি না। কাছে থাকিলে মুখে বলি, দূরে গেলে পত্রে লিখি।

আনোয়ারা। আচ্ছা, তোমাদের পুষ্পোৎসবের পালা কিরূপ?

হামিদার তখন নবনীত-কমল হরিদ্রাভ গণ্ডস্থলে হিঙ্গুলের দাগ পড়িল। আনোয়ারা তাহা লক্ষ্য করিয়া কথাটি জানার জন্য সইকে বিশেষভাবে চাপিয়া ধরিল। হামিদা সইয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে সলজ্জভাবে কহিতে লাগিল, “গত বাসন্তি পূর্ণিমায় আমার বিবাহের ৩ বৎসর পূর্ণ হইয়াছে, এই সময় মধ্যে আমি স্বামী চিনিয়াছি। তিনি বড়ই পুষ্পপ্রিয়। তাঁহার মনস্তুষ্টির নিমিত্ত আমাদের শয়ন-ঘরের দক্ষিণে খিড়কির সম্মুখে, আমি নিজ হাতে গাছ পুতিয়া একটি ফুলের বাগান রচনা করিয়াছি। ঐ দিন বাসন্তী চন্দ্রালোকে ভুবন ভরিয়া গিয়াছে; বাগানে বেল, যুঁই, কামিনী, মল্লিকা, গোলাপ, গন্ধরাজ প্রভৃতি ফুল ফুটিয়া সৌরভে দিক মাতাইয়া তুলিয়াছে, তিনি ও আমি বাগানমধ্যে সামনা-সামনি দুইখানা চেয়ারে বসিয়া আছি। তিনি আমাকে হযরত রসূলের প্রতি বিবি খোদেজা ও বিবি আয়শার প্রেম-ভক্তির প্রভেদ বুঝাইতেছিলেন; সহসা আমার মগজে খেয়াল আসিল, হায়! এই সুখের বাসন্তী পূর্ণিমায় এমন স্বর্গীয় প্রেম-ভক্তির কথা পতিমুখে আর শুনিতে পাইব কি না কে জানে? তাই তাড়াতাড়ি চেয়ার হইতে উঠিয়া দ্রুতহস্তে পুষ্প চয়ন করিয়া একটি ফুলের মুকুট ও এক ছড়া মালা তৈয়ার করিলাম। তাঁহাকে বাতাস করিবার নিমিত্ত ফুলের পাখা পূর্বেই তৈয়ার করিয়াছিলাম, ঘর হইতে তাহা আনিলাম। অনন্তর ধীরে ধীরে মুকুটটি তাঁহার মাথায় দিয়া, মালা ছড়া তাঁহার গলায় দিয়া, ফুলের পাখায় তাঁহাকে বাতাস করিলাম। নীরবে স্মিতমুখে তিনি আমার কার্য দেখিতে লাগিলেন। পরে আমি পাখা রাখিয়া তাঁহার পায়ের কাছে বসিলাম এবং পাঁচবার পদচুম্বন করিয়া ঊর্ধ্বহস্তে দাঁড়াইয়া কহিলাম, হে আমার দয়াময় আল্লাহতায়ালা! আজ দাসীর বাসনা পূর্ণ হইল। করজোরে প্রার্থনা করিলাম—প্রভো! আমার ফুলের সম্রাট পতিদেবকে দীর্ঘজীবী কর। আমি যেন প্রতি বৎসর, এই সময় এইরূপে তাঁহার পদসেবা করিয়া ধন্য হইতে পারি।’ সই, ইহাই আমার পুষ্পোৎসব।”

আনোয়ারা হামিদার স্বামী-ভক্তির কথা শুনিয়া তাহাকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। হামিদা পত্র হস্তে বাড়ি ফিরিল।