রাণুর প্রথম ভাগ
২
রসিকের এই প্রথম অপরাধ নয়, এবং এইটাই যে সবচেয়ে উৎকট তাহাও নহে। ছোকরা পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান, শিবাজী, নাদিরশাহ প্রভৃতি কয়েকটি দুর্ম্মদ ঐতিহাসিক চরিত্রের অত্যন্ত পক্ষপাতী এবং তাহাদের ভূমিকায় এ যাবৎ যে সব দৌরাত্ম্য করিয়াছে, তাহার এক-একটাতেই এক-একটি রোমাঞ্চকর কাহিনী হইয়া দাঁড়ায়। সে সব ভীষণ ব্যাপারের উল্লেখ যত কম করা যায়, ততই ভাল।
রসিকের নাম কাটিয়া দেওয়া হইল। তাহার পিতা গিয়া হেডমাস্টারের হাতে ধরিলেন। নূতন লোক — কড়া প্রিন্সিপ্লের, বলিলেন, অমন দুর্দ্দান্ত বদমায়েশ ছেলের নাম আর লেখা যেতে পারে না; তবে আমি গুড ক্যারেক্টারের সার্টিফিকেট দিচ্ছি, অন্য স্কুলে আপত্তি করবে না। কি জানেন? ছেলেদের সত্যি কথা বলতে উপদেশ দোব আর নিজেদের কথার কিংবা কাজের একটা — ইত্যাদি।
রসিকের শিক্ষাপর্ব্ব এইরূপে শেষ হইল। পিতা বলিলেন, হতভাগাকে এবার এমন জায়গায় দোব যে, উঠতে বসতে বেত–উঠতে বসতে বেত।
রসিকের ঠাকুরমা উৎকণ্ঠিতভাবে বলিলেন, ওমা, কি অলুক্ষুণে কথা গো! ঢের বিদ্যে হয়েছে; কুলীনের ছেলে — এইবার বিয়ে দিতে আরম্ভ কর। তিনি বেঁচে থাকলে এতদিন ক’টা বিয়ে যে —
রসিকের পিতা বলিলেন, ‘আরম্ভ কর’ মানে? তোমরা কি ভেবেছ, কুলীন বলে ছেলের গলায় দশ-বারোটি বউ ঝুলিয়ে দোব? আমার চারটে মা, ছটা সেজো বুড়ী, আর তিনটে নিজের পাপ পুষতে পুষতে নাজেহাল হতে হল; আবার ও পাঠ আমি পড়ি? বিয়ে দেব সেই ‘একে চন্দ্র’, তাও এখন ঢের দেরি।
রসিকের ঠাকুরমা তখন তিনটি পুত্রবধূ এবং তদনুরূপ নাতনী নাতবউ সকলকে লইয়া একটা কড়া দল তৈয়ার করিয়া অষ্টপ্রহরই কান্নাকাটি শুরু করিয়া দিলেন। প্রথম প্রথম কর্ত্তার অগোচরেই এবং অবশেষে তাহার জ্ঞাতসারেই ঘটকিনী যাতায়াত করিতে লাগিল। প্রথমটা কর্ত্তা রোষ এবং বিরক্তি প্রকাশ করিতে লাগিলেন, তাহার পর ঔদাসীন্য এবং অবশেষে ঘটকিনীর হাতের শাঁসালো কন্যাপক্ষের পরিচয় পাইয়া খোশামোদ শুরু করিয়া দিলেন।
শেষে একদিন, স্কুল ছাড়িবার মাস তিনেকের মধ্যে, এক জমিদার রায় সাহেবের কন্যার সহিত রসিকের শুভবিবাহ হইয়া গেল। মেয়েটি থার্ড ক্লাস পর্য্যন্ত পড়া; রসিকেরও বিদ্যার সীমা ওই পর্য্যন্ত বলিয়া সকলে বলিল, বাঃ, এও এক রকম রাজঘোটক।
জোড়ে গিয়া রসিক অন্যান্য উপহারের মধ্যে শালীদের তরফ হইতে যোগীন্দ্রনাথ বসুর একখানি ‘পৃথ্বীরাজ’ মহাকাব্য লাভ করিল। ছয়সাত দিন পরে যখন ফিরিয়া আসিল, কাব্যখানি হইতে বাছা বাছা অংশ তাহার অনেক কণ্ঠস্থ হইয়া গিয়াছে। মাখনের সঙ্গে দেখা হইতে বলিল, অ্যায়সা এক কেতাব পাওয়া গেছে রে!
মাখন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
তবে শোন। — বলিয়া রসিক বইটা হইতে খানিকটা গুরুগম্ভীর কবিতা গড়গড় করিয়া আওড়াইয়া গেল। শেষ করিয়া বুকটা চিতাইয়া অল্প অল্প হাসিয়া মাথা নাড়িতে লাগিল। বলিল, কেমন, রক্ত টগবগ করে ওঠে না?
মাখন নিরীহ ভাল মানুষের মত মাথা নাড়িয়া জানাইল, ওঠে।
রসিক বলিল, বিকেলবেলায় আসিস; সেইখানটায় গিয়ে দুজনে লড়া যাবে — রোজ। শ্বশুরবাড়িতে বউয়ের সঙ্গে পড়তাম। আগে সে চুপিচুপি কি একটা বই বের করলে, কি বিদ্যের বই, তার বউদি বিয়েতে উপহার দিয়েছে — মোটেই ভাল লাগল না। তারপর দুজনে এইখান পড়তাম। সমস্ত রাত কেটে যেত — তার তো আমার চেয়ে বেশি মুখস্থ হয়ে গেছে; খুব বিদ্বান, ভাই; দেখতে, সবাই বলে, বেশ; মাথায় তোর মতন হবে —
মাখন বলিল, তোর সঙ্গে কথা কয়?
রসিক বিস্মিতভাবে চাহিল।
মাখন জবাবদিহিস্বরূপ বলিল, বউদি দাদার সঙ্গে কথা কয় না কিনা।
রসিক বিজ্ঞের মত প্রায় উচ্চহাস্য করিয়াই বলিল, ওটা ওদের দিনের বেলা লোক-ঠকানো; রাত্তিরে সব বউয়ের কথার জাহাজ — তোর বউদিও, আমার বউও। বিয়ে করলে দেখবি, এই রকম অনেক নতুন মজা আছে।
তাহার পর গম্ভীরভাবে কহিল, কিন্তু ভাই, গরিব বসিকের একটা কথা মনে রেখো, যে বাড়িতে মেলা শালাজ আছে, সেখানে বিয়ে কোরো না, আড়ি পেতে পেতে নাকাল করে মারবে। একদিন রাত্তিরে আমার রক্ত মাথায় উঠে এসেছিল, একটা এসপার কি ওসপার করেছিলাম আর কি — বউ পা দুটো জড়িয়ে ধরলে তাই রক্ষে। শালাজ কাকে বলে জানিস তো? হুঁঃ, তুই বেচারী আর কোত্থেকে জানবি? শালার বউ — ডবল কুটুম কিনা, এক নম্বর বদমাইশ। তোদের নবীন স্টারের বেতকেও হার মানাতে পারে।
নবীন মাস্টারের নামে তাহার আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, জিজ্ঞাসা করিল, অন্তা কোথায় র্যা? তাকে একদিন আচ্ছা করে গো-বেড়েন দিতে হবে, সেদিন তেমন জুত হয় নি।
এই রকম ভাবে পনরো-ষোল দিন কাটিল; একদিন রসিক চোখ চাইয়া বলিল, তোদের রসিক যে কাঁদিয়ে চলল রে ছোঁড়া, একেবারে যার নাম বিলেত; শশুর টাকা দিচ্ছে। — বলিয়া মাখনের মুখের ভাবট। লক্ষ্য করিবার জন্য চাহিয়া রহিল। একটু পরে তাহার কাঁধে একটা সখ্যতার চাপড় বসাইয়া হাসিয়া বলিল, না রে, না; তুই যে ভেবেই খুন! শ্বশুরের পয়সায় ছেলেকে বিলেত পাঠাবে, বাবা সে বান্দাই নয়। তা ছাড়া আমরা না কুলীন? সে কথা বুঝি ভুলেই গিছলি তুই? শ্বশুর কিন্তু উঠে পড়ে লেগেছে ভাই; বলে, এইখানে এসে পড়াশুনো করুক, তারপর বিলেত গিয়ে —
মাখনের মনে অন্য একটা বিষয় তোলপাড় করিতেছিল, কহিল, অন্তাকে মারবার একটু সুবিধে হয়েছে।
রসিক সাগ্রহে প্রশ্ন করিল, কি রকম?
আমরা যেখানে বসে বই পড়ি, সে জায়গাটা টের পেয়েছে; আজ আসবে; আমায় বললে, বলে দিস তোর গুরুদেবকে।
রসিক তাহার পিঠে তিন-চারটা ছোট চাপড় দিয়া বলিল, চট করে যা, সেইখানটায় কতকগুলো ইট ভেঙে জড় —
মাখন বলিল, সে রেখে এসেছি, আর নদী থেকে পাঁক তুলে রেখেছি — চোখের জন্যে, আর ভিজে মাটি আর বিচুটির ঢেলা।
রসিক বিস্ময় এবং প্রশংসায় চাহিয়া রহিল; ভাষা পাইল না যে, মনের ভাবটা প্রকাশ করে।
গিয়া দেখিল, একটা কথা ও মিছা নয়; যুদ্ধের মালমসলা গাঁদি করা রহিয়াছে।
কখন আসবে? — বলিয়া বসিয়া গল্প করিতে লাগিল। বলিল, বলেতে যাবার আমারই কি ইচ্ছে নাকি তোদের ছেড়ে? বউটাও তাহলে বাঁচবে না। বউয়ের নাম অমলা। বাবা বলেছে, এ কটা মাস ঠাণ্ডা হয়ে থাকুক, তারপর হেড-মাস্টারকে বলে-কয়ে নাম লিখিয়ে দোব ’খন! কেন শ্বশুরের পয়সায় বিলেত যাবে, আর কেনই বা শ্বশুরের ভাতে পড়ে থাকতে যাবে? তা, আর ডাংপিটেপনা ছেড়েই দোব ভাবছি; শুধু একবার অন্তাকে আচ্ছা-আ করে —
মাখন অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া ছিল, বলিল, ওই সব আসছে।
একা জঙ্গলের মোড় ফিরিয়া চার-পাঁচ জন ছেলে দেখা দিল — ‘বিশ-ত্রিশ গজ দূরে : দুই-একজনের পকেট ভারী, মাখন বলিল, ঢিল আছে। অন্তা পিছনে ছিল, কহিল, আরে মাখনা যে! এখানে? তোমরা সব দেখে রাগ ভাই, স্যার আমাদের অত করে একজনের সঙ্গে মিশতে —
কথা শেষ হইবার পূর্ব্বেই পাশের একজনের মাথায় ঠকাস করিয়া একটা ঢিল সজোরে আসিয়া পড়িল। আর একজনের ঠোঁটের উপর একটা বিচুটিবাহক ঢেলা পড়িয়া একসঙ্গে যন্ত্রণা এবং কুটকুটুনিতে অস্থির করিয়া দিল। অনন্তকুমার সুড়ুৎ করিয়া বনের আড়ালে সরিয়া পড়িয়াছিল, সেখান হইতে বলিল, তোমরা কেউ পিঠ দেখিও না, চালিয়ে যাও; আমি বাবার বন্দুকটা নিয়ে এলুম বলে —
রসিক উৎকট চীৎকার করিয়া তাহাকে তাড়া করিতে তাহার ডান পায়ে একটা আধলা ইট আসিয়া পড়িল, তাহারও উপর অগ্রসর হইতে একটা ঢিলে কপালটা ফাটাইয়া দিল। বিপক্ষদল অনন্তকুমারের পথ ধরিল।
রসিক নিজের কাপড়টা ছিঁড়িয়া মাখনকে বলিল, বেঁধে দে। তাহার পর তাহার কাঁধে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি চলিল। পথে বলিল, অন্তা হারামজাদা খুব সটকে পড়ল। আচ্ছা, রসিককে কতদিন ফাঁকি দিয়ে থাকবে?
বাড়িতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। রসিকের বাপ বলিলেন, নাঃ, ভেবেছিলাম, হতভাগাকে ঘরজামাই হতে দেব না; ওর কপালে শ্বশুরবাড়ির ঝাঁটা লেখা আছে, তার আমি কি করব? কাল পর্য্যন্ত ওর শ্বশুরের চিঠি এসেছে — আমি কাটান দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আর না, দোব বিদেয় করে। যাক, সেখানে গিয়েই থাকুক, আর গ্রামের ত্রিসীমেয় ঢুকতে দোব না।
ঠাকুরমা কান্নার আওয়াজ চড়াইয়া বলিলেন, ওরে, তারা যে বিলেত পাঠিয়ে খেরেস্তান করে অমন সোনার চাঁদকে পর করে দেবে রে। আমার বুড়ো বয়সে কি শেষে এই দুগ্গতি ছিল। আজ তিনি বেঁচে থাকলে তোরা এমন কথা কি মুখে আনতে পারতিস?
এক সৎমা বলিলেন, তার চেয়ে বউকে নিয়ে এস বাপু, ছেলে ঠাণ্ডা থাকবে ’খন, ডাগর বউ —
অন্য সৎমা পরামর্শ দিলেন, কিংবা আর একটি বিয়ের কথাবার্ত্তা শুর করে দাও না কেন? ছেলে একটু অন্যমনস্ক থাকবে ’খন। সেই রানাঘাটের মেয়েটি আমার যেন চোখে লেগে আছে।
রসিকের মা কিছু বলিলেন না; শুধু অশ্রুজলের তর্ক চালাইয়া গেলেন।
কিন্তু কোন ফল হইল না। কপালের ঘাটা সারিয়া গেলে শ্বশুরবাড়ির যাত্রী হইয়া রসিক রেলগাড়িতে সওয়ার হইল। গাড়িটা ঠিক ছাড়িবার সময় মাখন প্ল্যাটফর্মের একটা কোণ হইতে সজল নেত্রে মৌনভাবে আসিয়া গাড়ির সামনে দাঁড়াইল। রসিক চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া হাসিয়া বলিল, কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ? তাহার পর চাপা গলায় ডাকিল, শোন্।
মাখন কাছে আসিলে চুপিচুপি বলিল, শিগগির ফিরে আসছি; শিবাজী সন্দেশের চেঙারির মধ্যে কেমন বাদশাকে কলা দেখিয়ে পালিয়েছিল, মনে নেই? — বলিয়া মাখনের দিকে চাহিয়া মিটিমিটি হাসিতে লাগিল।
মাখন এই সঙ্কেতের গৃঢ় অর্থটুকু হৃদয়ঙ্গম করিয়া হাসিয়া অশ্রুসিক্ত মুখখানি অন্য দিকে ফিরাইল।