» » পঞ্চম অধ্যায় : পলাশি

বর্ণাকার

পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা

পলাশি-প্রাক্‌কালের ঘটনাবলি এবং আমাদের কাছে এখন যেসব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে দেখানো যাবে যে ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা দখল করে (জুন ১৭৫৬) ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠায়। কাউন্সিল তাঁদের যে নির্দেশ দেয় (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। এ নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং নবাবের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়ই’ শুধু অভিযাত্রী দলের উদ্দিষ্ট হবে না। তাদের চেষ্টা করতে হবে ‘to effect a junction with any powers in the province of Bengal that might be dissatisfied with the violence of the nawab’s gov-ernment or that might have pretensions to the nawabship’.1 শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর দরবারের মধ্যে যে অসন্তোষ ছিল তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ’ করেছিল2 এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।

নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে ঠিকই কিন্তু ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সেজন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। অংশত তার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি (৩১ জানুয়ারি) থেকে তা সুস্পষ্ট।3 ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।4 ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে (John Walsh) লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। তিনি লিখছেন:5

ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে…· মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন…·. এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি [my old favourite scheme] সফল হতে পারে।

স্ক্র্যাফ্‌টন আবার ১৮ এপ্রিল ওয়ালসকে লিখছেন, ইয়ার লতিফ খানকে নতুন নবাব হিসেবে বসাবার প্রস্তাব দিয়ে, যেটা ওয়াটস ও উমিচাঁদ মিলে চেষ্টা করছিলেন।6 ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখা ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে এ পরিকল্পনা সমর্থন করলেন। এদিকে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হল। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ জানালেন, স্ক্র্যাফ্‌টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারেন তাঁর অনুমতি দেবার জন্য কারণ ওখানে স্ক্র্যাফ্‌টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে হবে।7 এ কাজটা ‘যে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ তা অনুমান করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নিল, ক্লাইভ যেন ‘দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নবাবের প্রতি মনোভাব এবং এ নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোককে নিয়োগ করেন’।8 সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্রাফ্‌টন ‘ইংরেজদের পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যবর্গের সমর্থন লাভের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন।

ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম লিখেছেন যে নবাবের দরবারে অভিজাতবর্গের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের পরিমাপ করতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর পরই উমিচাঁদ নবাবের উচ্চপদস্থ অমাত্যদের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে দেন।9 ফলে ২৩ এপ্রিল ইয়ার লতিফ খান ওয়াটসের সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওয়াটস তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে উমিচাঁদকে নবাবের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে পাঠান। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে তাঁর নবাব হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন এবং জানান যে রায়দুর্লভ ও জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেন এবং ক্লাইভকে জানিয়ে দেন। ক্লাইভও তাঁর সম্মতি জানিয়ে দিলেন। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে লতিফ সম্বন্ধে ক্লাইভের কোনও ধারণাই ছিল না। তাঁর সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না, ইয়ার লতিফ হিন্দু না মুসলমান তা পর্যন্ত নয়। তাই এর ঠিক দু’দিন পরে (২৮ এপ্রিল) তিনি ওয়াটসকে লিখলেন: ‘লতিফ কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’10 এ থেকে স্পষ্ট যে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য এতই ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল যে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই সিরাজের জায়গায় নবাব করতে চেয়েছিল। তিনি কেমন ব্যক্তি, ভাল কি মন্দ, তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি।

এমনি সময় মসনদের জন্য আরেকজন প্রার্থী, মীরজাফর, রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হন। যদিও রবার্ট ওর ম বলছেন যে মীরজাফর কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেক্রসের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাব ইংরেজদের কাছে পাঠান, ওয়াটস নিজে তাঁর পিতাকে পরে লিখেছিলেন যে তিনি ‘নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ’ করেন। তিনি এটাও জানান যে মীরজাফর ‘খুব আগ্রহভরে আমার প্রস্তাবে সায় দেন এবং আমাদের সহায়তায় নবাব হওয়ার বিনিময়ে যে কোনও যুক্তিসঙ্গত শর্তাবলিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হন’।11 খুব সম্ভবত ইংরেজরা হয়তো বুঝতে পেরেছিল, শুধু ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের ‘কঠিন কার্যোদ্ধার’ করতে পারবে না। তাই তারা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ মীরজাফর শুধু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সৈন্যাধ্যক্ষই নন, তাঁর পেছনে রয়েছে জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন।12 কলকাতায় সিলেক্ট কমিটিও মীরজাফরকে নতুন নবাব করার সিদ্ধান্ত নিল এবং ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দিল।

কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্গুরাবস্থা এবং ইংরেজরা মীরজাফরের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিল না। মীরজাফরও তখন পর্যন্ত যড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’13 এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্‌টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে:

আমাদের পরিকল্পনাকে কী ভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাকে ভাল করে বোঝাতে… এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাকে নিশ্চিন্ত করতে।14

এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করছিল। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই তিনি ২২ মে ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’15 পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।16 অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।

এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়াতে ওয়াটস প্রায় ক্ষেপে যান। মীরজাফর পলাশি থেকে ফিরে ৩০ মে থেকে মুর্শিদাবাদে ছিলেন। তা সত্ত্বেও ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি সম্পাদন করতে পারেননি। অনুমান, তার জন্য মীরজাফরের কিছুটা অনীহা। তাই অত্যন্ত বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ওয়াটস ৩ জুন লিখছেন: ‘এসব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদলোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’17 ব্যাপারটা নিয়ে লোকে বলাবলি করছে দেখে ক্লাইভও চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে ওয়াটস ৫ জুন মীরজাফকে দিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তি সই করাতে সক্ষম হলেন। লাল কাগজের চুক্তিটি, যাতে নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য বলে বলা হল সেটি নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। এতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সই ক্লাইভের জ্ঞাতসারেই জাল করা হয়েছিল বলে যে সন্দেহ করা হয়, তা খুব অমূলক নয়।18 নবাব পদে উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী ইয়ার লতিফকে বাদ দেওয়ার ফলে উমিচাঁদ নবাবের সম্পত্তির যে ভাগ চেয়েছিলেন, তা ফাঁকি দেওয়ার জন্যই ক্লাইভের এই চাতুরি। এদিকে রায়দুর্লভ সাদা কাগজের চুক্তি সম্বন্ধেও আপত্তি জানালেন এই বলে যে চুক্তির চাহিদা মেটাবার মতো অর্থ নবাবের কোষাগারে নেই। নবাবের সম্পদের পাঁচ শতাংশ তাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করা হল।

চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেও কিন্তু সিলেক্ট কমিটি তাদের বিপ্লবের পরিকল্পনা তাড়াতাড়ি রূপায়ণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তাই কমিটি ১১ জুন বিস্তারিত আলোচনা করল, ‘তখনই সোজা মুর্শিদাবাদ অভিযান করা সমচিত হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত খবর এবং কার্যোদ্ধারে কী ভাবে অগ্রসর হবে তার একটা খসড়া পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে’। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নিল যে ‘মীরজাফরকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা সেটা সম্পন্ন করার জন্য এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না’। কারণ আর দেরি করলেই সিরাজদ্দৌল্লা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি জেনে ফেলতে পারেন। তখন মীরজাফরকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং ফলে ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে’। ইংরেজদের তখন ‘দেশের সংঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে’ আর তা হলে ইংরেজদের পরাজয় অনিবার্য।19 কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্লাইভ ১৩ জুন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন।

ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করেন তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ১৮ জুন তিনি কাটোয়া দখল করলেন। সেখানে ‘দারুণ অস্বস্তির মধ্যে’ দু’দিন কাটান। তিনি সিলেক্ট কমিটিকে জানালেন যে মীরজাফরের কাছ থেকে স্পষ্ট সংকেত না পেয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন’। তিনি আরও লিখলেন যে, মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও যেভাবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চাইছেন তাতে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যাবার আশঙ্কা। এটাও তিনি জানালেন যে, মীরজাফর তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি নদী পেরোবেন না। বর্ষা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে প্রয়োজন হলে মারাঠারা বা বীরভূমের রাজা বা এমন কী দিল্লির উজির গাজিউদ্দিন খান, কারও না কারও সঙ্গে সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার করা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে লিখছেন যে, তাঁর ইচ্ছা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোনো যাতে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর কোনও বড় রকমের ক্ষতি না হয়। কারণ এ ফৌজ অক্ষত থাকলে আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা সফল না হলেও ভবিষ্যতে যে কোনও সময় বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি আমাদের বজায় থাকবে।’20

এ থেকে পরিষ্কার, মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠাতে ইংরেজদের শেষ পর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও, ইংরেজরা অন্য কারও সহায়তায় এ কাজ সম্পন্ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হত না এবং সেই অন্য কেউ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যরাই যে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংরেজদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কেউ হলেই চলত। আসলে তখনও পর্যন্ত ক্লাইভ মীরজাফর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন, যদি মীরজাফর সাহায্য করতে এগিয়ে না আসেন তা হলে কী করা যাবে? তবে বিপ্লব ঘটাতে তিনি এতই উদ্‌গ্রীব ছিলেন যে মীরজাফরের ওপর আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি এবং তাকে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যোগ দিতে বারবার প্ররোচিত করতে লাগলেন। কাটোয়া থেকে ১৯ জুনও তিনি মীরজাফরকে লিখলেন:21

আপনার পক্ষে বিশেষ করে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আপনি খুব একটা গা করছেন না দেখে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এ ক’দিনের মধ্যে আমি যখন ফৌজ নিয়ে অভিযান করছি তখন আমি ঠিক কী করব বা কী ব্যবস্থা নেব সে সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত বা নির্দেশ পাইনি। আপনার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব, আর এগুবো না। আমার মনে হয় অতি সত্বর আমার ফৌজের সঙ্গে আপনার যোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ক্লাইভ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও অস্থির হয়ে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সভা ডাকলেন ২১ জুন— উদ্দেশ্য, নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না ইংরেজরা যেখানে আছে সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর নবাবের বিরুদ্ধে মারাঠাদের ‘আমাদের সঙ্গে’ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।22 এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশি যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার, সিরাজকে হঠাবার যে চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (project)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত— মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না। এদিকে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তখনই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইল, যদিও ক্লাইভ ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করলেন এবং পরের দিনই পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে স্থির করলেন। তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে কোনও ইতিবাচক নির্দেশ বা সংকেত এসে পৌঁছয়নি।23 এতেই স্পষ্ট যে বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই, সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে, ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:24

যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারি…· আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এটার ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই [বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার [নবাব] হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হোন। আমাদের কিন্তু [পরে] বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।

মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন এবং অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তাঁর উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌছল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।

এদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অবস্থা বেশ কাহিল। অস্থিরচিত্ত ও বিপদের সময় বিহ্বল হয়ে পড়াটা তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত, তাঁর অন্যতম দুর্বলতা। অবশ্য এটা মনে না রাখলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে যে তখন কতগুলি ঘটনা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল। এসময় তাঁর দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের কতগুলি কারণও ছিল। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই আহমদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে বাংলায় আফগান আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক করে হোক বা ভুল করে হোক, তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজদের চাইতে আফগানরাই তখন বড় বিপদ। তাই তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ অংশকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে বিহার সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে তাঁর দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ও ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই সম্ভবত তিনি যারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বলে সন্দেহ করছিলেন তাদের সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তখনও তাঁর আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লা মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্যান্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে বিরাট ভুল করেছিলেন। এটা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন25 এবং জাঁ ল’ও26 স্পষ্ট ভাষাতে জানিয়েছেন। অথচ সিরাজের অনুগত সেনাপতিরা, বিশেষ করে মীরমর্দান, আব্দুল হাদি খান প্রমুখ তাঁকে বারংবার অনুরোধ ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা নিলে ইংরেজরা আক্রমণ করতে কোনওমতেই সাহস করবে না।27 কিন্তু নবাব তাতে কর্ণপাতও করলেন না, তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশিতে ইংরেজদের মুখোমুখি হলেন ২৩ জুন।

পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায়দুর্লভ রাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিতান্ত দর্শক হয়ে, যেন মজা দেখতেই যুদ্ধে আসা।28 আর রিয়াজের লেখক বলছেন, মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাকে বারবার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তিনি একবিন্দু নড়লেন না।29 তা সত্ত্বেও কিন্তু পলাশির তথাকথিত যুদ্ধের হারজিত আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি। ২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্‌টন হতবাক—’they made a most pompous and favourable appearance…. their disposition, as well as their regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them’.30

পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন। সকাল ৮টা নাগাদ (ক্লাইভের ভাষ্য অনুযায়ী ৬টায়) যুদ্ধ শুরু হল। ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত ও দক্ষ সেনাপতি মোহনলাল, মীরমর্দান, খাজা আবদুল হাদি খান, নবসিং হাজারি প্রমুখের নেতৃত্বে ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর সাঁ ফ্রে’র অধীনে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা ক্লাইভের কাছে খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে, তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের সৈন্যরা এবং সেনাপতিরা তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ, তাই তারা ইংরেজদের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তো তিনি দেখছেন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।31 পলাশির যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জন উড (John Wood) নামে এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়।32 ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’33

যুদ্ধ চলতে লাগল। নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত সেনাপতিদের নেতৃত্বে অসম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজ ফৌজের দিকে এগুতে লাগল। বেলা তখন প্রায় তিনটে। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছিল।34 ঠিক এসময় দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমর্দান গুরুতর আহত হয়ে পড়েন, তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্‌টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীরমর্দান নিহত হন’।35 মীরমর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদ্দৌল্লা দিক্‌বিদিক্‌ জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীরমর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেনাপতিদের সকলেই প্রথমে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন— এই যুক্তিতে যে ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। কিন্তু সিরাজের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।36 ইউসুফ আলি লিখেছেন, ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।37

সিরাজদ্দৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল ৫টার মধ্যেই পলাশির তথাকথিত যুদ্ধ শেষ। পলাশি যুদ্ধের সাক্ষী ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে কোনওরকমের মুখোমুখি যুদ্ধ বা আক্রমণ ছাড়াই এমন একটি ‘great and decisive’ যুদ্ধের নিষ্পত্তি এবং তাঁর সঙ্গে একটি রাজ্যজয়ও হয়ে গেল।38 সন্ধ্যা ৬টায় ক্লাইভ মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন— ‘আপনার পরিকল্পনা সফল হওয়ায় অভিনন্দন গ্রহণ করুন’।39 এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্‌টন মারফত দাউদপুর থেকে মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘এ জয় আপনার। আমার নয়। অতি সত্বর আমার সঙ্গে মিলিত হলে খুশি হব। আপনাকে নিয়ে কালই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব বলে ঘোষণা করার সম্মান আমি পাব।’40 ক্লাইভই মুর্শিদাবাদে মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় নবাবের মুকুট পরিয়ে দেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Orme Mss., vol. 170, f. 99; Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.
  2. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 442.
  3. সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 205.
  4. ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Orme Mss., India, V, f. 1275; Orme Mss.. O.V. 170, f. 397,
  5. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.
  6. স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.
  7. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, f. 1212; O.V. 170, f.222.
  8. ক্লাইভকে সিলেক্ট কমিটি, ২৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, 368; Select Committee Consults., 28 April 1757, Orme Mss., India, f. 1214.
  9. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec I. p. 148.
  10. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.
  11. তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.
  12. Watts’ Memoirs, p. 82.
  13. ক্লাইভ ওয়াটসকে, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 373.
  14. Orme Mss., India V,f. 1228; O. V. 170, f. 265.
  15. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.
  16. ঐ, ১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.
  17. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
  18. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ১৮ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 387; পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ওয়ালসের সাক্ষ্য, Hill, III, p. 318; জন কুকের [John Cooke] সাক্ষ্য, Hill, III, p. 120.
  19. Select Committee Proceedings, 11 June 1757, Orme Mss., India V, ff. 1232-33; O. V. 170, ff. 256-57; জোরটা আমি দিয়েছি।
  20. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 417-18.
  21. মীরজাফরকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419. জোরটা আমি দিয়েছি।
  22. Journal of Eyre Coote, Orme Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p. 54.
  23. S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 145.
  24. Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.1), Hill, II, pp. 420-21, Recd., 22 June at 3 p.m., Hill, II, p. 420; Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.2), despatched at 6 p.m., Hill, II, p. 421; জোরটা আমার দেওয়া।
  25. Scrafton, Reflections, pp. 91-92.
  26. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.
  27. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫।
  28. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
  29. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫।
  30. Scrafton, Reflections, pp. 93-94.
  31. ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts, Memoirs, p. 110.
  32. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 178.
  33. Watts’ Memoirs, p. 110.
  34. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
  35. Scrafton, Reflections, p. 110.
  36. তারিখ-ই-বংগলা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।
  37. তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবংজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।
  38. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.
  39. ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭। (ক্লাইভ পেলেন সন্ধ্যা ৬টায়), Orme Mss., India, XI, f.2814,
  40. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, VI, p. 2815.