পলাশি কার চক্রান্ত?
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক কে বা কারা? মীরজাফরই শুধু বিশ্বাসঘাতক বলে জনমানসে এখনও যে ধারণা বহুল প্রচারিত, তা ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য? পলাশি কি শুধু ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র, এতে ইংরেজদের কি কোনও ভূমিকা ছিল না? এখানে অবশ্য বলে নেওয়া প্রয়োজন যে মীরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ শেষ পর্যন্ত পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন এবং নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের হাতে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই দরবারের চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের দিন পর্যন্ত তারা স্থানীয় ষড়যন্ত্রীদের নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যাতে দরবারের ওইসব অভিজাতবর্গ শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমরা সেটা পরে দেখাব— তা থেকে স্পষ্ট হবে কী ভাবে ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে সমস্ত ব্যাপারটা সংগঠিত করেছিল।
পলাশির ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মীরজাফর ও জগৎশেঠ, যদিও উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখও এতে জড়িত ছিলেন। তাই মীরজাফরই একমাত্র ‘বিশ্বাসঘাতক’, এটা সত্য নয়। জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা প্রথমে সিরাজদ্দৌল্লার জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law), যিনি দরবারের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতেন, পরিষ্কার লিখেছেন যে ‘ইংরেজরা যা করেছে [পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব] তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া তারা করতে কখনও ভরসা পেত না’।1 সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকার দায় শুধু মীরজাফরের নয়— জগৎশেঠদের দায় মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয়।
আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পেছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদেরই হাতে। জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘অনেকদিন ধরে বাংলায় যেসব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিলেন তাঁরাই [জগৎশেঠরা]।’2 ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র পড়েও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে পলাশি চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদত পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।3 তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ‘মোহনলাল যদি সুস্থ থাকতেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা-রহিত না হতেন, তা হলে জগৎশেঠদের চক্রান্ত অত সহজে সফল হত না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, মোহনলাল কিছুদিন ধরে এবং বিশেষ করে চরম বিপদের এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন’। ল’ মনে করতেন যে মোহনলাল জগৎশেঠদের পরম শত্রু এবং তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারার মতো একমাত্র ব্যক্তি।4 মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির সন্দেহ, মোহনলালকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।5
কেন এই চক্রান্ত?
যদিও ইংরেজরা পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, যে প্রশ্ন আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং যা এখনও পর্যন্ত কেউ করেননি৬০ তা হল এ চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে এত জরুরি হয়ে পড়েছিল কেন? তার প্রধান কারণ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা। সমসাময়িক নথিপত্র ও দলিলদস্তাবেজ পরীক্ষা করে দেখলে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাবে। এসব কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে— ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি প্রচুর ধনোপার্জন করে দেশে ফিরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। বাংলায় কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০-র দশক ও ’৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপরে ৪০-র দশকের শেষদিক থেকে ৫০-র দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর কারণ একদিকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে এসময় অভাবনীয় উন্নতি এবং অন্যদিকে হুগলির আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার। ফরাসিদের সঙ্গে আবার ওয়াজিদের বোঝাপড়া থাকার ফলে ইংরেজরা খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে যায় এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই বাংলা বিজয় করতে চেয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
১৭৫০-র দশকের প্রথমদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা যে নিদারুণ সংকটে পড়ে তা কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম6, কলকাতার এক ইংরেজ বাসিন্দা ক্যাপ্টেন ফেনউকের7 লেখা ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আলাপ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা ছাড়াও ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় আসা-যাওয়া করা জাহাজের যে তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে আমাদের বক্তব্যের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে। ১৭৫৪ সালে যেসব ইংরেজ জাহাজ বাংলার বন্দরে এসেছিল তাঁর মোট সংখ্যা ২০। এর মধ্যে ১২টি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র ৮টি যারা ব্যক্তিগত ব্যবসা করত তাদের। অন্যদিকে ওই বছরই বাংলায় ফরাসি জাহাজ এসেছিল ২৭টি— তাঁর মধ্যে ২২টিই ব্যক্তিগত ব্যবসাতে লিপ্ত, আর মাত্র ৫টি ফরাসি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন, এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।8 এই পরিসংখ্যান থেকেও এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পরে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা আরও বেশি সংকটের মুখে পড়ে কারণ এই প্রথম তরুণ নবাব ইংরেজদের দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি এই বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কর্মচারীরা তাদের এই লাভজনক ব্যবসা ছাড়তে একেবারেই নারাজ ছিল। তাই তারা তাদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও অন্যদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা করে। এজন্য রাজ্য জয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। তাতে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট দূর করা সম্ভব হবে তা শুধু নয়— উৎপাদনক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, ব্যবসায়ী-সওদাগর, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। একথা শুধু যে পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hindsight) ধরা পড়েছে তা নয়। কোম্পানির লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের (Colonel Scott) বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা (১৭৫২), ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের (Frankland and Manningham) ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির পণ্য সরবরাহে দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন (১৭৫৩), নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখো মনোভাব—এসবই ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তার নির্দেশক। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা কলকাতার সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার (Richard Becher) জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলিতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যাপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল’।9 এসব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.
- ঐ।
- ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368: ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.
- করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯.
- মি. রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, Orme Mss., O.V. 12,f. 83.
- BPC, Range l, vol. 15, f. 327,7 Oct. 1752; Orme Mss., O. V., 12, f. 83; Eur. G 37, Box 21, 1 Sept. 1753; Orime Mss., India, VI, f. 111vo.
- পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে উদ্ধার করে টানেজের হিসেব করা হয়েছে, Relevant volumes in VOC.
- Beng. Letters Recd., vol. 24, f. 236, 20 May 1757.