অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’
প্রাক্-পলাশি বাংলায় অভ্যন্তরীণ সংকট প্রসঙ্গে যে বক্তব্য তাঁর আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমে রাজনৈতিক সংকট। সত্যিই কি এমন কোনও সংকট দেখা দিয়েছিল? আমাদের উত্তর, মোটেই না। সাধারণভাবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণি, ভূস্বামী ও অভিজাতবর্গের যে নতুন শ্রেণিবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার পরে একেবারে ভেঙে পড়ে কারণ তিনি তাঁর ব্যবহারে ওইসব শ্রেণির লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর ফলেই রাজনৈতিক সংকট। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসংঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এটা মনে রাখা দরকার যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণিনির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেবার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব, তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়— এটা মুর্শিদকুলির শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্বনীতির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। তা ছাড়া, এই তথাকথিত জোটবন্ধন একেবারেই শ্রেণিভিত্তিক নয়— ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। আবার এ শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিশ্ছিদ্র কোনও সংগঠনও নয়। বারে বারে তার মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। তাই সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর ‘নতুন শ্রেণিগত জোটবদ্ধতা’ ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়— এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।1
ঠিক এমনি ভাবেই দেখানো যায় যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় কোনও অর্থনৈতিক সংকটও ছিল না। এ সময় বাংলার শিল্পবাণিজ্যে যে অবক্ষয়ের কথা বলা হয় তা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকরা যে বিপুল পরিমাণ পণ্য রফতানি করেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিল্পবাণিজ্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তাঁর দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। এটা ঠিকই, ১৭৪০-র দশকের শেষদিকে ও ৫০-র দশকের প্রথমদিকে ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্য কিছুটা কমে যায়। তবে সেটা বাংলার শিল্পবাণিজ্যে সংকটের জন্য নয়, কোম্পানির নিজস্ব সমস্যার জন্য। এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, এতদিন বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের কোনও ধারণা আমাদের ছিল না, ফলে এটাকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। ইদানীং আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পেরেছি যে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, ইউরোপীয়দের সম্মিলিত বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি।2 তাই যে সময় বাংলা থেকে এশীয় ও ইউরোপীয়রা এত বিশাল পরিমাণ পণ্য রফতানি করছে, সে সময় শিল্পবাণিজ্যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, এ কথা মানা যায় না।
তা ছাড়া পলাশির প্রাক্কালে বাংলার ব্যাঙ্কিং-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর্থিক দূরবস্থার মধ্যে পড়ে বলে যে বক্তব্য তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আমরা দেখিয়েছি যে এ-সময় ওই গোষ্ঠীর বেশ শ্রীবৃদ্ধিই হয়েছিল। বাংলার তিন বণিকরাজার—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও আর্মানি খোজা ওয়াজিদ— আর্থিক সমৃদ্ধি তখন তুঙ্গে। তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে একদিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে চলেছিলেন, অন্যদিকে বাংলার বস্ত্র ও রেশমশিল্পে লিপ্ত ব্যবসায়ীদের অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের মহাজনি ব্যবসার তখন রমরমা। সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করার জন্য নগদ টাকার অভাব মেটাতে বণিকরাজা ও অন্য মহাজনদের কাছে নিয়মিত টাকা ধার করত।3 এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় ব্যাঙ্কার ব্যবসায়ীদের আর্থিক দুর্গতির কথা মেনে নেওয়া কঠিন।
আবার মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল বলে যে ধারণার ওপর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছি যে প্রাক-পলাশি বাংলায় মূল্যস্তর এমন কিছু বাড়েনি যাতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এটা বলা যায়। প্রায় কুড়ি বছরের কাপড়ের দামের যথাযথ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি যে ১৭৩০ থেকে ১৭৫০-র প্রথমদিক পর্যন্ত বেশির ভাগ কাপড়ের দামই তেমন কিছু বাড়েনি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম কমেছে। কাঁচা রেশমের দামে যদিও ওঠা-পড়া লক্ষ করা গেছে, ক্রমাগত ও নিয়মিত দাম বেড়েছে, এমন কথা কোনওমতেই বলা যায় না। চালের দামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে— বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে দাম কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে কিন্তু সাধারণভাবে চালের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে চলেছে এমন কিছু কিন্তু চোখে পড়ে না। তাই পলাশির আগে বাংলায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার।4
‘কোলাবোরেশন থিসিসও’ কিন্তু অচল। এটা যুক্তিগ্রাহ্য হত যদি দেখানো যেত যে মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী-মহাজনদের সমৃদ্ধি ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। আমরা অন্যত্র5 দেখিয়েছি যে ওই সময় ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করেছিল এবং তাই তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করেছিল, এ বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ইউরোপীয়দের তুলনায় এশীয়/ভারতীয় বণিকদের বাংলা থেকে পণ্য রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, ফলে তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ আমদানি করেছিল, ইউরোপীয়রা নয়। সুতরাং বলা যেতে পারে যে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের সমৃদ্ধি বহুলাংশেই নির্ভর করত এশীয়দের বাণিজ্যের ওপরেই, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ওপর নয়। তাই বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিকদের স্বার্থ ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল এটা কিছুতে বলা যায় না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হবে। বাংলার অন্যতম প্রধান বণিকরাজা জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকার মতো। তার মধ্যে খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ লক্ষ টাকার মতো আয় হত ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে। অর্থাৎ শতকরা ৩৩ ভাগের মতো। বাকিটা অবশ্যই এশীয় বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্তির ফলে।6 তাই ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসের মূল যে প্রতিপাদ্য— বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিক-মহাজন, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাতবর্গের ভাগ্যের সঙ্গে ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের, ভাগ্য ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেবেন এই ভয়ে ওরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব ঘটাতে বাধ্য হয়— তা ধোপে টেঁকে না।
পরিশেষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজ। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত।7 সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে ব্যগ্র হয়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ প্রেক্ষিতে প্রাক-পলাশি সময়ে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে যেটা মনে রাখা প্রয়োজন তা হল, পলাশি শুধু হিন্দুদের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়— হিন্দুরাই শুধু মুসলমান নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেনি। হিন্দু-মুসলমান-জৈন-আর্মানি সব সম্প্রদায়ের লোকই এতে লিপ্ত হয়েছিল। তবে পলাশি বিপ্লব মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণির একটি শক্তিশালী অংশকে— যার মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও— সামিল করতে পেরেছিল। বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল— ১৭২৭ এবং ১৭৩৯/৪০ সালে, যখন শাসকগোষ্ঠীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং এ দুটি বিপ্লবের সময় যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬/৫৭ সালেও সে প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।
পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হত, তা হলে সমসাময়িক সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাস গ্রন্থে তা অবশ্যই প্রতিফলিত হত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তখনকার সাহিত্য বা ইতিহাসবেত্তার লেখায় দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয় থাকতে পারে, শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়। তার মূল শ্রেণিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলে আসছিল, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তার পরিপূর্ণ রূপ দেখা যায়। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে— এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র সৃষ্টি- যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের ‘সত্যপীর’ কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।8 এডওয়ার্ড সি ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষের’ পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।9 দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কবি ফৈজুল্লার ‘সত্যপীর’ কবিতা, যেখানে ‘যে রাম সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।10 সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।
তা ছাড়া এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রাক্-পলাশি বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কথা বলা হয়। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের হেগ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক পলাশির আগে বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমি পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরম-এর তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুদের দখলে, একমাত্র মুসলমান বক্সি হল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু।11 দ্বিতীয় তালিকাটি বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom)। সেই তালিকাতেও নায়েব দেওয়ান রায় রায়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের একচ্ছত্র প্রাধান্য।12 ১৭৫৪/৫৫ সালের এই যে চিত্র, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা আরও স্পষ্ট হয়। তরুণ নবাবের ডানহাত ও সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসভাজন ছিলেন মোহনলাল। বস্তুতপক্ষে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দুপ্রাধান্য এত বেশি ছিল যে তা দেখে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেন:13
The Gentoo (Hindu) connection became the most opulent influence in his [Alivardi’s] government of which it pervaded every department with such efficacy that nothing of moment could move without their participation or knowledge.
ওপরের সব তথ্য বিচার করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সোজাসুজি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 13-16; Prelude to Empire, pp 73-76.
- ঐ, পৃ. ২০২-১১, ২৪৯-৫৯।
- ঐ, পৃ. ১০৯-৩১ এ বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
- বিস্তারিত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, ‘Was there a Crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’ in Richard B. Barnett, ed., Rethinking Early Modern India, pp. 129-52.
- S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 70-73.
- Luke Scrafton to Robert Clive, 17 Dec. 1757, Orme Mss., India, XVIII, f. 5043.
- বিস্তারিত তথ্যের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36; Orme to Clive, 25 Aug. 1752, Orme Mss., O.V. 19, ff. 1-2.
- ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা; D. C. Sen, History of Bengali Language and Literature, PP. 288, 793.
- Edward C. Dimmock, Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, p. 2.
- আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।
- Orme Mss., India VI, ff. 1500-1502.
- Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb. 1755, VOC 2849, ff. 125-26.
- Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 52-53.