কেল্লার সংস্কার
উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ ও সংঘাত, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখা দরকার। কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকে স্পষ্ট যে, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৭৪০-র দশকে মারাঠা আক্রমণের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারদিকে গড়খাই (ditch) খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি ১৭৫২) যে ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।1 অবশ্য ওই পরিচালক সমিতি ১৭৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামকে জানাচ্ছে, নবাবকে যেন বোঝানো হয় কেল্লা সুসংহত করার ‘মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।’2 কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য বলছেন3 ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করছিল, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল লন্ডনে লিখেছিল যে এর মূল উদ্দেশ্য ‘দেশীয় শত্রুদের [অবশ্যই নবাব] আক্রমণ প্রতিহত করা’।4 সুতরাং সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজদের এ প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:5
নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just pol-icy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে।… এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।
এখানে এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা শুধু ইংরেজদের নয়, ফরাসিদেরও আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যেসব নির্মাণকার্য করেছিল, সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু নির্মাণ করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেল। কিন্তু ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ, নবাবের কথায় তারা কর্ণপাতও করল না।6 হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে ইংরেজরা তাদের ‘অধিকারের সীমা লঙ্ঘন’ করেছিল এবং ‘নবাবের অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কেল্লা সুসংহত করেছিল।7 সুতরাং এটা অবশ্যই বলা যায় যে এ-ব্যাপারে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করা যায় না।
দস্তকের অপব্যবহার
দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বে-আইনি অপব্যবহার সম্বন্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তকের সাহায্যে তারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে বাণিজ্যশুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী এ দস্তক তারা এশীয় বণিকদের কাছেও বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্য কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্য প্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে’।8 এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্বহানি হচ্ছিল সিরাজ স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা লেখক জানাচ্ছেন:9
সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্য দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
এমনকী এস. সি. হিলও স্বীকার করেছেন যে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যেসব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা বলতেই হবে যে ইংরেজরা যেভাবে দস্তকের ব্যবহার করেছে, তা [ফারুখশিয়রের] ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।10 সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে তাঁর ‘মিথ্যা অজুহাত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান
নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দি খানও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।11 কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। কৃষ্ণদাস রাজবল্লভের পুত্র আর রাজবল্লভ ছিলেন ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারী এবং সে সুবাদে ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত। রাজবল্লভের বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ ছিল এবং সেটা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। রাজবল্লভ ভয় পেয়ে ওয়াটসকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য । ওয়াটসের ধারণা হয়েছিল ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্য লাভ করবে। তাই তিনি কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেককে (Roger Drake) লেখেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দিতে কারণ ‘রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে’।12 কৃষ্ণদাস সপরিবারে ৫৩ লক্ষ টাকার ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন আলিবর্দির মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে।13 এরপরে কিন্তু ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই এবং ড্রেককে লেখেন যে কৃষ্ণদাসকে এ অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন নয়। ড্রেক তাতে কর্ণপাতও করেননি।14 কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, মসনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিরাজের যে বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যে অভিযোগ তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।
সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের (জুন ১৭৫৬) আগের যে ঘটনাবলি তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে কলকাতার ইংরেজদের কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ সংঘর্ষকে অপরিহার্য করে তোলে। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। এ সংঘর্ষ বাধার তিনদিন আগে পর্যন্ত সিরাজ কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাঠানো দূত নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিস্ফল হল মূলত গভর্নর ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করেন। ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করার পর নবাব কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন।15 এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ করে নবাবের দূত নারায়ণ সিংকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে, কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:16
Could it be ever imagined any Prince would suffer a set of merchants to protect from him any of his subjects, much less a man who had enjoyed a considerable post under the government or would tamely put up with the insult to his messenger? …turning the messenger away will be construed an insult by the whole world.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের (লন্ডন) চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.
- ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. I, p. 68.
- C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.
- C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31; Watts to Drake and Fort William Council, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.
- Mss. Eur, D. 283, f. 26; প্রায় একই রকমের বক্তব্য হলওয়েলের, Holwell to Court of Directiors, 30 Nov, 1756, Hill, II, p. 18; জোরটা আমার দেওয়া।
- Law’s Mentoir, Hill, III, pp. 164-65.
- Hill, I, pp. liv-lv.
- Mss. Eur. D. 283, ff, 15, 25.
- ঐ, পৃ. ২৫।
- Hill, I, p. lv.
- Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.
- কোর্টকে ওয়াটস, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd. vol. 23, f. 378.
- S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 43 and fn. 30.
- Hill, III, pp. 332-33; II, pp. 4-5.
- বিস্তারিত বিবরণের জন্য, সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৫২-৫৪; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 43-46, 58-61.
- ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f, 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে বেচার, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.