» » ষষ্ঠ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

ঊনষাট

অফিস থেকে ফেরবার পথে জ্যোতিষ্ক একটা ভয়ঙ্কর কাজ করেছে।

কাজটা করে জ্যোতিষ্ক রোমাঞ্চিত। কিন্তু স্ত্রীকে বলতে পারছে না। না বলেই ভালোই করেছে। ঘটনা শোনবার পর মেঘবতী তুলকালাম কাণ্ড করতে পারে। করতে পারে কেন, করবেই। সুটকেস গুছিয়ে বাড়ি থেকে তো বেরিয়ে যাবেই, তার থেকেও বেশি কিছু হবে।

জ্যোতিষ্ক ঠিক করেছে, তাড়াহুড়ো করবে না। ঘটনা একটু একটু করে বলে মেঘবতীকে ধাতস্ত করবে। একটু একটু করে ধাতস্ত করবার প্রক্রিয়াটি ঠিক কেমন হবে তা অবশ্য জ্যোতিষ্কর জানা নেই। কিছু একটা করতে হবে। জ্যোতিষ্ক গ্যারেজে গাড়ি রেখে শান্ত ভাবে বাড়িতে ঢুকল। গুপির মা দরজা খুলে দিয়েছে। বংশীবাদকের হাতে অপমানিত হওয়ার পর গুপির মা এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বারিধারা তাকে বারণ করে।

‘এখন কাজ ছেড়ো না গুপির মা। পুলিশ সন্দেহ করবে।’

গুপির মা তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘কেন আমাকে সন্দেহ করবে কেন? আমি কি ডাকাতি করেছি?’

বারিধারা বলেছিল, ‘আমাদের দেশের পুলিশের নিয়মটাই এরকম। নিরীহ এবং গরিব মানুষকে আগে সন্দেহ করা। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরে দেওয়া সহজ কি না।’

গুপির মা সমান তেজের সঙ্গে বলেছিল, ‘দিক। আমি ভয় পাই না।’

বারিধারা বলল, ‘ভয়ের কথা বলছি না, পুলিশকে সুযোগ না দেওয়ার কথা বলছি। তুমি বরং ক’টা দিন পরে ছেড়ে দিও।’

গুপির মা বারিধারাকে ‘ছোড়দি’ ডাকে। ছোড়দিকে সে আলাদা চোখে দেখে। এই মেয়ে পাগলাটে এবং অতিরিক্ত ভালো। বুদ্ধিও খুব। শেষ পর্যন্ত বারিধারার কথা মেনে সে কাজে থেকে যায়। পুলিশ যখন বাড়িতে তদন্ত করতে এসেছিল, মেঘবতী খুব জোরের সঙ্গে বলেছিল, ‘আপনারা গুপির মাকে কোনও ভাবে হ্যারাস করবেন না। ইনি আমাদের বাড়ির একজন মেম্বার। মনে রাখবেন, ওই বাঁশিওয়ালা তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তাকে ভয় পেয়েছিল। আর তাই হাত-পা বেঁধে রান্নাঘরে আটকে রেখেছিল।’

ঘটনা সত্যি। ঘটনার দিন গুপির মা চিৎকার করতে গিয়েছিল। ডাকাতরা তাকে জোর করে রান্নাঘরে আটকে দেয়। পুলিশ প্রথমে গাঁইগুঁই করে। তারা চেয়েছিল, গুপির মাকে থানায় নিয়ে গিয়ে ধমকধামক দিতে। জ্যোতিষ্ক নিজে বড় সরকারি অফিসার বলে পারেনি। তার পরেও আড়াল থেকে মহিলার ওপর নজর রাখে। তবে ক’দিনের মধ্যে তারা জানতে পারে মহিলা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।

যাই হোক, গুপির মা শেষ পর্যন্ত এ বাড়িতে রয়ে গেছে। রয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অনেকদিন পর্যন্ত তার বিশ্বাস ছিল, সেদিনের ডাকাতরা আবার ফিরে আসবে। তাদের সে মুখোমুখি হতে চায়। খানকতক বঁটির কোপ এদের প্রাপ্য। তাদের জানা দরকার, গুপির মা কোনও এলেবেলে মেয়ে নয়। সেদিন হাত-মুখ না বাঁধলে মজা টের পাইয়ে দিত। আবার সুযোগ পেলে, ঠেলা বুঝিয়ে দেবে। রান্নাঘরে গুপির মা একটা বঁটি আলাদা করে রেখে দিয়েছিল। ছোট বাঁটি। তাতে ধার দেওয়াও থাকত। কদিন আগে পর্যন্ত দুপুরের দিকে কলিং বেল বাজলে গুপির মা বঁটি হাতে নিয়ে দরজা খুলতে যেত। বঁটি লুকোনো থাকে পিছনে। দরজার আই হোল দিয়ে চেনা লোক দেখেও বঁটি শক্ত করে ধরে রাখত। চেনা লোক তো কী হয়েছে? ওই বাঁশিওয়ালা তো চেনা হয়ে গিয়েছিল। পরে বংশীবাদকের মৃত্যু, সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ডাকাতরা ধরা পড়ে, বাড়ির গায়নাগাটি, টাকাপয়সা, জামাকাপড় অনেকটাই উদ্ধার হওয়ার খবর জেনে গুপির মা বঁটি ত্যাগ করেছে।

ঘরে ঢুকেই জ্যোতিষ্ক খবর নিল মেঘবতী কোথায়।

গুপির মা বলে, ‘বড়দি ওপরে।’

জ্যোতিষ্ক একটু ইতস্তত করে বলল, ‘গুপির মা গেস্টরুমের কী অবস্থা?’

গুপির মা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী অবস্থা মানে?’

‘ঘরের কন্ডিশন কী? ধুলো টুলো ঝাড়া আছে?’

গুপির মা’র ভুরু আরও কুঁচকে গেল। বলল, ‘এ বাড়ির সব ঘরের ধুলোই ঝাড়া হয়।’

জ্যোতিষ্ক একটু হাসবার চেষ্টা করল। বলল, ‘গুড। বাড়িতে ধুলোময়লা থাকা মোটে স্বাস্থ্যকর নয়। ঠিক আছে তুমি চা করো। চা করে ওপরে নিয়ে এসো।’

মেঘবতী এখন দোতলায়, বেডরুমে। ফোনে বারিধারার সঙ্গে কথা বলছে। গত ক’দিন ধরে ঝড়ের মতো সব ঘটনা ঘটে গেছে। অর্চিনকে সুন্দরবনের গ্রাম থেকে নিয়ে এসে থানায় তার মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছে বারিধারা। পুলিশ যে শুধুমাত্র কড়া হয় এমন নয়, মানবিকও হয়। বারিধারার মুখে সব শোনবার পর তারা ব্যবস্থা নিয়েছে। নিয়মকানুনের অনেক বাধানিষেধ টপকে মাতা-পুত্রকে আলাদা ঘরে মুখোমুখি বসিয়ে দিয়েছে। বড় ঝুঁকি থাকা সত্বেও সেই সময় ঘরের মধ্যে কোনও গার্ড ছিল না। সেই সময় থানায় বারিধারা, শ্রবণ তো ছিলই, এসেছিলেন বিমলকান্তি, মণিকুন্তলা। আর ছিল ঋষা। মায়ের সঙ্গে দেখা করে সহজ ভাবে থানার বাইরে বসে অর্চিন। একদিন রাতে সেনবাড়িতে থেকে আবার সুন্দরবনে ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে বিমলকান্তি, মণিকুন্তলাদেবী, বারিধারার সঙ্গে বসে কথা বলে।

‘আমি মায়ের জন্য ভালো ল’ইয়ার দেব।’

বিমলকান্তি বলেছেন, ‘অবশ্যই দেবে। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা কোরো না।’

অর্চিন বলে, ‘মা যা করেছে তাতে আইনের চোখে অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিত। হবেও। তার পরেও আমি লড়ব।’

মণিকুন্তলাদেবী নরম ভাবে বলেন, ‘বড় শাস্তি হবে এমন ভাবছ কেন। কাজটা তো তিনি পরিকল্পনা করে করেননি। তাকে প্রাোভোক করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তিনি…।’

অর্চিন মণিকুন্তলাদেবীকে পুরো কথা বলতে দেয় না। মলিন হেসে বলে, ‘শুধু এই হত্যা নয়, অতীতে মা যা যা অপরাধ করেছে তার শাস্তিও তো প্রাপ্য হয়ে রয়েছে। সে শাস্তিও কম হবে না। ফাঁসি না হোক, যাবজ্জীবন জেল তো বটেই।’

বারিধারা নীচু গলায় বলে, ‘দেখাই যাক না কী হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে নিশ্চয় কিছু করা যাবে।’

মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘তুমি অতটা ভেঙে পোড়ো না।’

অর্চিন বলে, ‘আমি ভেঙে পড়িনি। আপনারা আমার জন্য অতীতে যা করেছেন এবং এখনও যা করছেন সে ঋণ মেটানোর ক্ষমতা আমার নেই। চেষ্টাও করব না।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘এভাবে ভেবো না। তুমিও তো সেনবাড়ির একজন।’

অর্চিন মাথা নামিয়ে বলে, ‘জানি। জানি বলেই এত কথা বলতে পারছি। কোনও আইনে মায়ের শাস্তি কমানো যাবে না। আমি যে খুব একটা শাস্তি কমাতে চাই এমনটাও নয়। মাও চায় না। আমাকে বলেছে, তুই চিন্তা করিস না। এটাই আমার ভবিতব্য ছিল। আমার যা সাজা হওয়ার হবে। সব থেকে ভালো হয় যদি ফাঁসি হয়। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ব্যস আমার কাজ শেষ।’

অর্চিন একটু থামল। নিজের মনে একটু হাসলও যেন। মণিকুন্তলা কোনও রকমে চোখের জল সামলালেন। ছোট মেয়ে তাকে সাবধান করে রেখেছে।

‘মা, অর্চিনদার সামনে তুমি কোনও রকম দুর্বলতা দেখাবে না। সে একজন খাঁটি মানুষ। কোনওরকম সহানুভূতি, করুণা, চোখের জল সে পছন্দ করবে না। সব থেকে বড় কথা, তার সামনে আমরা যদি দুর্বল হই, সে নিজেও ভেঙে পড়তে পারে। আমরা তাকে শক্ত হতে সাহায্য করতে পারি মা, ভেঙে পড়তে নয়।’

মণিকুন্তলা মেয়ের এই কথা মেনে চলতে চাইছেন। তিনি ঠোঁট কামড়ে রইলেন।

অর্চিন মাথা নামিয়ে বলল, ‘কিছু করতে পারব না জেনেও আমি আদালতে মায়ের হয়ে লড়ব। প্রাণপণ চেষ্টা করব। মা যেন বুঝতে পারে, তার ছেলে তার পাশে আছে। যত অন্যায় করুক, সন্তানের পাশে যেমন বাবা-মা থাকে, কেউ থাকে না, শুধু তারাই থাকে। আমিও সেভাবে মায়ের পাশে থাকব। মৃত্যুপথযাত্রী জেনেও তো সন্তান বাবা-মায়ের চিকিৎসা করে। ছেড়ে তো পালায় না। তাই না?’

অর্চিন মুখ তোলে। বাকিদের কাছ থেকে যেন সমর্থন চাইছে। তার মুখ ছিল উজ্জ্বল। বিমলকান্তি সিরিয়াস মানুষ। সেন্টিমেন্ট তাকে খুব একটা স্পর্শ করে না। স্পর্শ করলেও তিনি তা গোপন রাখলেন। এটাই তার নিয়ম। বহু বছর পড়ে তিনি নিয়ম ভাঙলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃজ্ঞতার কালি একটা ছোট ছেলে কত সহজে ধুয়ে দিল। বিমলকান্তি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে অর্চিনকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘অর্চিন, তুমি নিজের ইচ্ছে মতো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছ। নিজের ইচ্ছে মতো ব্রাইট কেরিয়ার ছেড়ে দিয়েছ। নিজের ইচ্ছেয় তুমি আমাদের ছেড়ে গ্রামে চলে গেছ। এবার একটা কথা আমার ইচ্ছে মতো তোমাকে শুনতে হবে।’

অর্চিন মৃদু গলায় বলল, ‘কী কথা?’

বিমলকান্তি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘আগে বলো শুনবে। আমি তো কখনও কোনও বিষয়ে তোমাকে জোর করিনি, কিন্তু এবার করছি।’

অর্চিন একটু থমকাল। বলল, ‘আচ্ছা, কথা দিচ্ছি।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘তোমার মায়ের জন্য তুমি যে আইনি লড়াই করবে তার সব খরচ আমরা দেব। বেস্ট ল’ইয়ার থাকবেন।’

অর্চিন কিছু একটা বলতে গেল। বিমলকান্তি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কোনও কথা শুনব না। এটাই ফাইনাল। সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটসে যে ল’ইয়ার ফার্মের সঙ্গে কাজ করে তুমি তার সঙ্গে বসবে।’

বারিধারা নিজেই আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কারও সামনে সে কাঁদতে পারে না।

অর্চিন পরদিন সকালেই সুন্দরবনে ফিরে গেছে। সেখানে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে। সেই কাজ অন্যদের খানিকটা বুঝিয়ে দিতে হবে। কোর্টের দিনগুলো তাকে কলকাতায় থাকতে হবে। তা বলে আসল কাজ তো বন্ধ হতে পারে না। এর দু’দিনের মধ্যেই পুলিশ বৈশাখীকে জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পুলিশ যাতে বৈশাখীকে আর খুব বেশি চাপাচাপি না করে তার জন্য জ্যোতিষ্ক ওপর মহল থেকে কিছু ব্যবস্থা করেছিল। আসামি যদি সবটাই স্বীকার করে নেয়, তা হলে আর থানা লকআপে আটকে রাখবার দরকার কী?

সেই অর্থে সেনবাড়িতে ঝড় কিছুটা কমেছে। বারিধারা-মেঘবতী দুই বোন বহুদিন পর টেলিফোনে প্রাণের-মনের গল্প করেছে। এতই প্রাণের-মনের যে অফিস থেকে স্বামীর ফিরে আসবার সাড়াশব্দও মেঘবতী পায়নি।

‘দিদি, একটা ঝামেলায় পড়েছি।’

মেঘবতী মোবাইল কানে চেপে ধরে বলল, ‘আবার ঝামেলা!’

বারিধারা বলল, ‘এখনও হয়নি তবে হবে মনে হচ্ছে।’

মেঘবতী বলল, ‘পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে?’

বারিধারা বলল, ‘ধুস, কী যে বলিস। এখন কীসের রেজাল্ট। সবে তো পরীক্ষা শেষ হল। ইউনিভার্সিটিতে রেজাল্ট বেরোতে সাত মাস।’

মেঘবতী বলল, ‘তা হলে এখন কীসের ঝামেলা বৃষ্টি?’

বারিধারা রহস্যভরা গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে একটা ঝড় ঝামেলা ঘটতে চলেছে।’

মেঘবতী বিরক্ত গলায় বলল, ‘এত ভণিতা না করে সরাসরি বল।’

বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘আমি একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে চলেছি।’

মেঘবতী আঁতকে উঠল। এই বোনটাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।

‘কী বলছিস যা তা।’

বারিধারা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘যা তা নয় রে দিদি, সত্যি বলছি। ঘটনা জানাজানি হলে, আমার নামে একেবারে ঢি ঢি পড়ে যাবে। তোরা আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবি না। খুব সম্ভবত আমাদের সিরিয়াস বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। মা তিনদিন না খেয়ে থাকবে। হয়তো আমি তোর বাড়িতে আশ্রয় নেব। তুই আমাকে যত্ন আত্তি করবি ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলবি, আর বলবি, এটা তুই কী করলি! কেমন করে করলি বৃষ্টি! সেনবাড়ির সম্মানের কথা একবার মনে এল না।’

মেঘবতী আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল। সোজা হয়ে বসল। ধমক দিয়ে বলল, ‘ড্রামাবাজি থামা বৃষ্টি। কী হয়েছে বল।’

বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘চেঁচাস না। বলছি তো এখনও হয়নি, হতে চলেছে। শ্রবণ বোকাটা একটা বিরাট বোকামি করে ফেলেছে।’

মেঘবতীর ভুরু কুঁচকে গেল। বৃষ্টি কি ইঙ্গিত দিচ্ছে? হতে পারে না। অসম্ভব। সে বলল, ‘শ্রবণ করেছে মানে! সে তো খুব ভালো ছেলে।’

বারাধিারা ফোনের ওপাশ থেকে ফিক করে হেসে বলল, ‘আহা! দিদি, এমন ভাবে বলছিস, যেন ভালো ছেলেরা কখনও বোকামি করে না। তাদের জন্য আমার মতো সহজ সরল মেয়েদের কেলেঙ্কারি হয় না।’

এ তো স্পষ্ট ইঙ্গিত। মেঘবতী উত্তেজনায় খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। আবার বসল। ভয়ে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগে এ সব কী কাণ্ড!

‘বৃষ্টি, ঠাট্টা বন্ধ করে সোজা কথা বল।’

বারিধারা স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘বললাম তো শ্রবণ বোকামি করেছে।’

মেঘবতী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আর তুমি কী করছিলে? নেকা? তুমি বড় হওনি? তুমি জানো না কী থেকে কী হয়? ছি ছি বৃষ্টি। তুই এটা করলি…। আমি ভাবতেও পারছি না।’

বারিধারা বলল, ‘দেখলি তো দিদি, আমার নামে কেমন ঢি ঢি পড়ে যাবে। তুই পর্যন্ত ছি ছি করছিস। তাও তো কেলেঙ্কারি এখনও হয়নি। কিছুদিন পরে হবে।’

মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বৃষ্টি, আমি কিন্তু এবার কেঁদে ফেলব। আগে বল, তুই এ সব ঠাট্টা করে বলছিস। বল আগে।’

জ্যোতিষ্ক দরজার আড়াল থেকে মেঘবতীর ‘এবার কেঁদে ফেলব’ কথাটুকু শুধু শুনতে পেল। বেডরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। এই রে! মেঘবতী যদি কেঁদে ফেলবার মুডে থাকে তা হলে তো খুব মুশকিল। সে যে ভয়ঙ্কর কাজটা করে বসে আছে সেটা জানাবে কী করে?’

কেঁদে ফেলবার জন্য মেঘবতীর মন আকুলি বিকুলি করছে। করবে না? একেই তার কাদুনি স্বভাব। যে কোনও ছোটখাটো ব্যাপারে কান্না পায়, আদরের বোন যদি এরকম একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তো কেঁদে ফেলবারই কথা। আজকালকার ছেলেমেয়ে কখনও এমন ভুল করে! এ তো আর পঞ্চাশ-একশো বছর আগের ব্যাপার নয়। এখন কত ব্যবস্থা এসেছে, কত সহজ কায়দাকানুন হয়েছে।

টেলিফোন কানে চেপে মেঘবতী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। কান্নার পূর্বলক্ষণ।

ওপাশ থেকে বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘দিদি, তোর কি কান্না পাচ্ছে?’

মেঘবতী বলল, ‘ফাজলামি করবি না বৃষ্টি। আমার ভালো লাগছে না।’

বারিধারা বলল, ‘ঘটনা শুনে তারপর কান্নাকাটি শুরু কর। মন খুলে কাঁদতে পারবি।’

মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ঘটনা তো বলছিস না। খালি ঘোরাচ্ছিস। তবে বৃষ্টি একটা কথা জেনে রাখ, যত কেলেঙ্কারিই ঘটিয়ে থাকিস না কেন, আমি তোর সঙ্গে আছি। তুই আমার এখানে চলে আসবি। আমি আর তোর জ্যোতিষ্কদা মিলে, সব ব্যবস্থা করে দেব। কেউ জানতেও পারবে না। তবে পাকামি করতে যাস না। তোকে নিয়ে ওইটাই আমার চিন্তা।’

বারিধারা বলল, ‘আমারও চিন্তা। তার আগে ঘটনাটি শুনে নে দিদি। বললাম না, কান্নাকাটি করতে সুবিধে হবে।’

বারিধারা গুছিয়ে সব বলল। শ্রবণ সত্যি একটা বোকামি করে বসেছে। মুম্বইয়ের যারা তাকে প্রাইজ দিচ্ছে, তারা জানিয়েছিল, দুজনের ব্যবস্থা করবে। শ্রবণ যেন সঙ্গে একজন স্পেশাল গেস্ট নিয়ে আসে। তবে প্লেনের টিকিট, হোটেল, খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব সব তাদের। কদিন আগে তারা স্পেশাল গেস্টের নাম চাইলে, শ্রবণ বারিধারার নাম পাঠিয়ে দিয়েছে। বারিধারাকে জিগ্যেস করা হয়নি। সেদিন অর্চিনকে নিয়ে আসতে যখন দুজনে মিলে সুন্দরবনের নোনাজল গ্রামে যাচ্ছিল, তখন বলেছে।

‘একটা গোলমাল করে ফেলেছি বারি।’

‘বারিধারা শান্তভাবে বলেছিল, ‘এটা আর নতুন কথা কী? গোলমাল করাটাই তো তোমার কাজ। গোলমালটা কী জানতে পারি?’

শ্রবণ কাঁচুমাচুভাবে বলল, ‘আসলে তোমাকে বলতাম ধারা, তোমার কাছে পারমিশান নিতাম ঠিকই, কিন্তু তোমরা এমন সমস্যায় রয়েছ যে এই বিষয়ে কথা বলবার সুযোগ হয়নি।’

বারিধারা চোখ কটমট করে বলেছিল, ‘আমার পারমিশন ছাড়া কী করেছ?’

শ্রবণ মাথা চুলকে বলল, ‘মুম্বাইয়ে তোমার নাম পাঠিয়ে দিয়েছি বারি। প্রাইজ গিভিং সেরিমনিতে তুমি আমার স্পেশাল গেস্ট হয়ে যাবে।’

বারিধারা সেদিন আর বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারেনি। দু’দিন পরে শ্রবণকে চেপে ধরেছিল।

‘আমার নাম পাঠালে কেন?’

শ্রবণ বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে।’

বারিধারা বলল, ‘বোকামি করো না। তোমাকে আমার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে।’

শ্রবণ বলল, ‘বিশ্বাস করো ধারা, ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। দিন তিনেকের তো ব্যাপার। প্রাইজ নেব, চাকরির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলব, একদিন একটু এদিক-ওদিক ঘুরব, ব্যস।’

বারিধারা ধমক দিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বোলো না। বাড়ির কাউকে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?’

শ্রবণ বলল, ‘কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে যাব? সবাই তো গাল ফোলাবে। যাক তুমি যখন যেতে পারবে না, একাই চলে যাব।’

বারিধারা চাপা গলায় বলল, ‘বেশি সেন্টু দেখিও না। তুমি ভালো করেই জানো শ্রবণ, আমি ওসবে ঘাবড়ানোর পার্টি নই। দুটো অবিবাহিত ছেলেমেয়ে হুট করে একসঙ্গে তিনদিনের ট্যুর করতে পারে?’

শ্রবণ বলল, ‘কেউ জানতে পারবে?’

বারিধারা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মানে! না বলে চলে যাব?’

শ্রবণ মুচকি হেসে বলল, ‘কেন? এই তো সেদিন আমাকে দিয়ে তুমি বাড়ি পালানো প্র্যাকটিস করালে। এবার তোমার পালা। তুমি পালিয়ে দেখাও বারি।’

স্মার্ট, বুদ্ধিমতী বারিধারা এখানেই কুপোকাত হয়ে গেছে। শ্রবণ এভাবে তার দেওয়া প্যাঁচ মেরে তাকেই ফেলে দেবে ভাবতেও পারেনি। গাধাটার বুদ্ধিতে খুবই খুশি হল বারিধারা। সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার আমার পালা। আমি তোমার সঙ্গে পালাব। তবে তিনদিনের জন্য।’

শ্রবণ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘সত্যি বারি? সত্যি কথা বলছ? তুমি মুম্বাইতে আমার সঙ্গে যাচ্ছ ধারা?’

বারিধারা গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুমি জানো না শ্রবণ যে আমি দুরকম কথা বলি না?’

বোনের মুখে ‘কেলেঙ্কারির ঘটনা’ শুনে মেঘবতী যেমন খুশি, তেমন উত্তেজিত। আবার খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়ল।

‘এ তো খুব আনন্দের কথা বৃষ্টি। শ্রবণ অত বড় একটা প্রাইজ পাবে, আর তুই সেই সময় থাকবি না তা হতে পারে?’

বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘এই জন্যে তোকে আমি আর দাদু মিলে মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টের ওপর দিকে রেখেছিলাম। সত্যিই তুই খুব বোকা দিদি।’

মেঘবতী এক গাল হেসে বলল, ‘আমি বোকা হই আর যাই হোক, তুই শ্রবণের সঙ্গে যাবি এটা খুব ভালো হয়েছে। আমি তোদের এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাব।’

বারিধারা বলল, ‘উফ দিদি বুঝতে পারছিস না। বাবা, মা ছাড়বে নাকি? মা যদি বা রাজি হয়, বাবার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে। বিয়ের আগেই মেয়ে হবু জামাইয়ের একসঙ্গে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। দাদু থাকলে একটা কথা ছিল। বাবাকে ধমক দিয়ে রাখত।’

মেঘবতী বলল, ‘ধুস ওসব ছাড় তো। বাবা রাগ করুক আর যা-ই করুন, তুই চলে যা। বাকিটা আমি বুঝে নেব।’

বারিধারা গলা নামিয়ে বলল, ‘দিদি, আসল সমস্যাটার কী হবে?’

মেঘবতী বলল, ‘আবার কী সমস্যা?’

বারিধারা বলল, ‘আরে, এতক্ষণ ধরে কী বললাম? কেলেঙ্কারির ব্যাপারটা কী হবে? আমাকে আর শ্রবণকে যদি রাতে একঘরে থাকতে হয়? তখন কিছু যদি হয়ে যায়?’

মেঘবতী হেসে বলল, ‘একটা চড় খাবি। বড় দিদিকে এসব কেউ বলে? একঘরে থাকতে হলে থাকবি। দু’দিন পরে বিয়ে আর এখন উনি ঘর দেখাচ্ছেন। মারব এক থাপ্পড়।’

বারিধারা নাটকীয় কায়দায় বলল, ‘না রে দিদি, পরে ঢিঢি পড়ে যাবে। আমি আলাদা ঘর চাইব।’

মেঘবতী বলল, ‘নেকা। আলাদা ঘর থাকলে যেন তোমরা আলাদা ঘরে কত থাকবে! তবে সাবধান। ঝামেলায় পড়বে না। বড় হয়েছ, সতর্ক থাকবে।’

বারিধারা এবার অভিনয় ছেড়ে জোরে হেসে উঠল।

‘তাহলে বলছিস দিন তিনকের জন্য পালাব?’

মেঘবতী হাসতে হাসতে বলল, ‘অবশ্যই পালাবি। আমি বাবাকে বলব, বৃষ্টি আমার এখানে আছে। খুব মজা হবে। ইস তোর জ্যোতিষ্কদাটা একদম রোমান্টিক নয়। তাহলে আমরাও পালাতাম।’

বারিধারা বলল, ‘তোরা কার কাছ থেকে পালাতিস!’

মেঘবতী বলল, ‘আরে পালানোটাই মজা রে বৃষ্টি, কার কাছ থেকে পালাতাম সেটা কি বড় কথা? এখন রাখি। চিন্তা করিস না। আমি রইলাম।’

বারিধারা বলল, ‘আমি জানতাম, আমার বোকা ছিঁচকাদুনে দিদি সিরিয়াস সময়ে ঠিক একটা পথ বের করে দেবে। টা টা। তোর জন্য মুম্বাই থেকে কিছু আনতে পারব না বলে দুঃখ করিস না। পালানোর সময় কিছু কেনাকাটা করা যায় না।’

স্ত্রীর হাসাহাসি শুনে দরজার আড়ালে দাঁড়ানো জ্যোতিষ্ক মনে জোর পেল। মেয়েরা এরকমই, এই একটু কাঁদে তো পরমুহূর্তে হাসতে শুরু করে। এ ব্যাপারে তার স্ত্রীর তো কোনও জবাব নেই। তাহলে এবার তার ভয়ঙ্কর ঘটনাটা বলা যাবে।

ঘটনা সত্যি ভয়ঙ্কর।

আজ অফিস থেকে ফেরবার পথে বাইপাসের ধারে হ্যান্ডিক্র্যাফটের মেলায় নেমেছিল জ্যোতিষ্ক। কলকাতা শহরে অজস্র মেলা হয়। তার মধ্যে বইমেলা আর এই হস্তশিল্প মেলা হল সেরা। এই দুই মেলা শুধু কলকাতার সেরা মেলা নয়, দেশের সেরা মেলা। সঠিকভাবে বিচার করা হলে পৃথিবীতেও মেলার ‘বেস্ট টেন’ তালিকায় এরা এক থেকে দশের মধ্যে হাসতে হাসতে জায়গা পেয়ে যাবে। ঠিকমতো বিচার হয় না তাই। অন্য কোনও দেশ হলে এই দুই মেলা নিয়ে এমন লাফালাফি করত যে বিদেশ থেকে লোকজন ছুটে আসত। হোটেল ভর্তি হয়ে যেত। বাংলাদেশের একুশের বইমেলা আর জার্মানিতে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা খুব নামকরা। কিন্তু এই দুটোর কোনওটাতেই কলকাতা বইমেলার মতো পাঠক থাকে না। শুধু পাঠক দেখবার জন্যই তো বিদেশ থেকে বইভক্তদের আসা উচিত। বই তো আছেই। আর হস্তশিল্প মেলার তো কোনও তুলনা নেই। বাংলার গাঁ-গঞ্জে যে কত শিল্পী আছে একমাত্র এই মেলাতে এলেই জানা যায়। বিশ্বের মানুষ প্যারিস বলতে অজ্ঞান। সেখানে শিল্পীরা গিজগিজ করে। দুনিয়া কাঁপানো সব শিল্পী। বাংলার হস্তশিল্প মেলা নিয়ে দুনিয়াকে বলুক, এখানকার মানুষের কথা বলতে অসুবিধে কোথায়? বাংলার গরিব শিল্পীরা এখানে হাতের কাজ নিয়ে আসেন বলে? দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে ভালো জিনিস নিয়ে লাফালাফি কম হয়। হস্তশিল্প মেলায় জ্যোতিষ্ক কম করে চার-পাঁচদিন ঢুঁ মারে। এর মধ্যে দুদিন মেঘবতীর সঙ্গে। আজ গিয়েছিল একা। গোপন কাজ ছিল। এই কাজ স্ত্রীর সঙ্গে গেলে হওয়ার নয়। বংশীবাদকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই জ্যোতিষ্কর ভালো বাঁশি কেনবার শখ। এই মেলায় নিশ্চয়ই বাঁশি মিলবে। কিন্তু বাঁশির বদলে দেখা মিলল কুটকুটের সঙ্গে। কুটকুট একজন দশ-এগারো বছরের বালক। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে মেলার এক কোনায়, আধো আলো, আধো অন্ধকারে বসে সে কাঠের টুকরোর গায়ে রং দিচ্ছিল। মলিন হাফপ্যান্ট আর কলার ছেঁড়া জামা। জ্যোতিষ্ক সামনে দাঁড়িয়ে বালকের কাঠের রঙ করা দেখছিল। দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেল। মিনিট দশকের মধ্যে কাঠের টুকরো একটা পুতুলের চেহারা পেলে। প্রাণ পেল যেন। রঙে ঝলমলে। কুটকুট যতটা বর্ণহীন পুতুলটা ঠিক তার উলটো।

‘কী দ্যাখেন?’

‘তোর কাজ দেখি।’

‘কাজ দেখে কী হবে? পুতুলটা নেবেন?’

‘দাম কত?’

‘দশ টাকা।’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘ধুস, একটা কাঠের টুকরোর দাম দশ টাকা কী রে বেটা!’

‘কুটকুটে ছোট বলে, তার সঙ্গে দরদাম করেন না।’

জ্যোতিষ্কর খুব মজা লাগল। বলল, ‘তোর নাম কুটকুটে?’

বালক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘নাম জেনে আপনার কাম কী? পুতুলটা কিনবেন তাই বলেন?’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘তুই কাঠের পুতুল বানাস?’

‘সবের পুতুল বানাই। একটা মাটির ঢেলা দেন পুতুল বানিয়ে দেব। আমি সবরকম হাবিজাবি দিয়ে পুতুল বানাতে পারি।’

বলতে বলতে কুটকুটে একটা পোড়া মাটির ঢেলা নিয়ে ঝটপট চোখমুখ আঁকতে বসল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গোলগাল হাসিখুশি একটা ছেলের মুখ বানিয়ে ফেলল। বলল, ‘আমি সবের পুতুল বানাতে পারি। কাঠ, মাটি, ফেলে দেওয়া কাগজের গোল্লা।’

জ্যোতিষ্কর মুগ্ধতা দশগুণ বেড়ে গেল। যে কোনও অসাড় জিনিসকে এই ছেলে নিমেষে প্রাণ দিতে পারে! এ তো অতি ক্ষমতাবান! অথচ বসে আছে ভিখিরির মতো। সামনের এক টুকরো চটে কিছু পুতুল সাজানো থাকলেও মেলার খরিদ্দাররা সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সারাদিনে দু-চারটেও বিক্রি হয়েছে কিনা সন্দেহ। জ্যোতিষ্কর মনে হল, সে একজন বিরাট শিল্পীকে খুঁজে পেয়েছে। উবু হয়ে বসে গল্প শুরু করল।

‘তোর বাড়ি কোথায়?’

‘গ্রামে।’

‘বাড়িতে কে আছে? বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিস নাকি?’

কুটকুটে কাপড়ের টুকরোয় রং করতে করতে বলল, ‘বাপ-মায়ে নাই। এর বাড়ি, তার বাড়ি থাকি। গ্রামের এক কাকা নিয়ে এসেছে। ভারী মালপত্র টানাটানি করবার জন্য। বড্ড খাটায়, খেতে দেয় না। তিনদিন হল সেই কাকাকে ছেড়ে চলে এসেছি। কাকাই তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি পুতুল বানাচ্ছি বলে বদটা আমায় চড় মেরেছে। আমিও হাত কামড়ে দিয়েছি। সে বলেছে, তুই দূর হয়ে যা। আমি বলেছি, বয়ে গেছে। আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেব। তাই নিজেই পুতুল বানিয়ে বেচছি। যা বিক্রি হয় তাই দিয়ে মুড়ি কিনে খাই। রাতে অফিসঘরের নীচে বস্তা পেতে ঘুমোই।’

জ্যোতিষ্কর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত বড় একজন শিল্পীর এই দুরবস্থা!

‘আমাকে পুতুল বানানো শেখাবি?’

‘শেখাতে পারি, তবে টেইম লাগবে।’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আমি সময় করে নেব। তুই আমার বাড়িতে থাকবি।’

কুটকুটে বলল, ‘বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে পারব না।’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘দুর পাগল ছেলে। তোর মতো এক আর্টিস্ট ওসব কাজ করে সময় নষ্ট করবে কেন? তুই আমাকে হাবিজাবি দিয়ে পুতুল বানাতে শেখাবি আর খাবিদাবি খুমোবি। লেখাপড়াও শিখবি। যাবি আমার বাড়ি?’

কুটকুটে একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘বাড়িতে খাওয়াদাওয়া কেমন?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘খুব খারাপ নয়।’

কুটুকুটে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘পেট ভরবে তো? বহুদিন পেট ভরে খাই না।’

জ্যোতিষ্ক আর পারল না। হাত বাড়িয়ে বালকের জটপাকানো চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ভরবে। আমার ভরলে, আমার বউয়ের ভরলে, তোরও ভরবে।’

‘মামি কি খিটখিটে?’

জ্যোতিষ্ক হেসে ফেলল। এরমধ্যে মামা-মামি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে বেটা।

‘তা একটু খিটখিটে, তবে খুব ভালো।’

কুটকুটে বলল, ‘ভালোমানুষ খিটখিটে হলে সমস্যা নেই। খারাপ মানুষ খিটখিটে হলে সমস্যা আছে। আমি থাকব না। খাবার না পেলে ক্ষতি নাই, কিন্তু খারাপ লোকের ধমকধামক শুনি না। পেস্টিজে লাগে।’

জ্যোতিষ্ক সস্নেহে বলল, ‘তোকে কেউ ধমক দেবে না, যাবি?’

কুটকুটে তার পুতুলের মতো চোখ তুলে বলল, ‘চলেন তাহলে। দেখি আপনার বাড়ি পছন্দ হয় কিনা।’

থলিতে পুতুল, মাটির ঢেলা, কাগজ, কাঠের টুকরো, কাপড় আর সস্তার রং গুছিয়ে নিয়ে জ্যোতিষ্কর সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

সেই ছেলেকে গ্যারাজে লুকিয়ে জ্যোতিষ্ক মেঘবতীর কাছে এসেছে। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সে কি বুঝবে? বুঝবে না। বংশীবাদকের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। খুবই খারাপ। আবার একজনকে রাস্তা থেকে বাড়িতে নিয়ে এলে সে কি অ্যালাও করতে পারে? কখনওই পারে না। তারপরেও চেষ্টা চালাতে হবে। বয়েসে যতই ছোক হোক এমন শিল্পীকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলে আসা যায় না।

মেঘবতী কুটকুটের ঘটনা শুনে থম মেরে থাকল। তারপর বলল, ‘কালই আমি মায়ের ওখানে চলে যাব। সেদিন বাঁশির নাম করে ডাকাতদের বাড়ি ঢুকিয়েছিল, আজ পুতুলের দোহাই দিয়ে ছিঁচকে চোরকে বাড়িতে নিয়ে এসেছ। তোমার কোনও শিক্ষা হয় না।’

জ্যোতিষ্ক কাঁচুমাচুভাবে বলল, ‘খুবই ভুল করেছি মেঘ। কালই ছেলেটাকে মেলায় ছেড়ে দিয়ে আসব। মেলায় তো কত মানুষ হারিয়ে যায়, এই ছেলেও যাবে। শুধু আজকের রাতটা কি তাকে গেস্টরুমে রাখা যায় না?’

মেঘবতী গনগনে গলায় বলল, ‘আমি জানি না। আমি এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।’

রাতে মেঘবতীর গুছিয়ে দেওয়া দুধ ভাত কলা মাখা খেতে খেতে কুটকুটে বলল, ‘মামি, আপনাদের কলায় তেমন স্বাদ নেই। কেমন কষটে মার্কা। কাল ভালো কলা আনতে বলবেন। দেন, আর একটু ভাত দেন দেখি। দু’দিন ভাত খাওয়া হয় নাই।’

মেঘবতী কুটকুটের বাটিতে আরও খানিকটা ভাত আর দুধ দিল। তার চোখভরা জল। কোনও কোনও সময় সুন্দর চোখে জল থাকলে, চোখ আরও সুন্দর দেখায়। মেঘবতীকেও খুব সুন্দর লাগছে।