» » ষষ্ঠ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

একান্ন

কর্ণিকা বাড়িতে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।

ড্রইংরুমে দুজন মহিলা বসে। এদের মধ্যে একজনকে কর্ণিকা চেনে। মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। করবী মাসি। টালিগঞ্জের দিকে কোথায় যেন থাকে। অন্যজনকে চিনতে পারছে না। করবী মাসি সোফায় বসে আছেন, অচেনা মহিলার জন্য ভিতর থেকে কাঠের চেয়ারটা এনে দেওয়া হয়েছে। হাঁটু, কোমরে ব্যথা থাকলে অনেক সময় সোফায় বসতে কষ্ট হয়। তখন ভেতর থেকে কাঠের চেয়ারটা এনে দেওয়া হয়। মা-ও সোফায় বসে আছে। মুখে হাত কচলানো ভাব। কোনও বিষয়ে খুব গদগদ হলে মানুষের মুখে হাত কচলানো ভাব আসে। এটা একটা ভয়ের ব্যাপার। কর্ণিকা সতর্ক হল।

‘ওই তো কনি, ওই তো এসেছে। আয় কনি, আয়।’

কর্ণিকা অবাক হল। মা এমন ভাব করছে যেন কনির বাড়িতে আসবার কথা ছিল না। অথচ সে রোজ কমবেশি এই সময়েই অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। এক সময় ফেরবার পথে দোকান-বাজার করে ফিরত। মায়ের জন্য আনাজপাতি, বাবার জন্য মুড়ি, চানাচুর, ভাইয়ের জন্য চিপস, মোবাইল রিচার্জ কার্ড, নিজের জন্য তেল, শ্যাম্পু। যখন যেমন লাগে। আজকাল সমস্যা হয়। প্রাোমোশনের পর অফিসের গাড়ি দিয়ে যায়। গাড়ি থামিয়ে কীভাবে কেনাকেটা করবে? তারপরেও মাঝে মাঝে নামে। বাজারের কাছে গাড়ি ছেড়ে দেয়। কেনাটাকা করে রিকশা নেয় অথবা হেঁটে ফেরে। আজও তাই করেছে। হাতে একগাদা প্যাকেট। মা উদগ্রীব হয়ে উঠল।

‘কীরে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি? উফ তোকে কতবার বলেছি, গাড়ি ছাড়বি না। সারাদিন খেটেখুটে আসিস, তারপর আর দোকান বাজারে নামবার দরকার নেই।’

কর্ণিকা বুঝতে পারল, দোকান বাজারে আপত্তি নয়, মা আসলে অতিথিদের শোনাচ্ছে মেয়ে গাড়ি করে ফেরে। সে হতভম্ব ভাব কাটাতে মা এক মুখ হেসে বলল, ‘কনি, করবীকে তো তুই জানিসই, আর ইনি হলেন মিসেস বোস। রানী বোস। লেডি ম্যাকলিন কলেজের প্রিন্সিপাল।’

ববকাট এবং মূলত সাদা চুলের অচেনা মহিলা অভিজাত হেসে বললেন, ‘প্রিন্সিপাল নয়, এক্স প্রিন্সিপাল।’

মল্লিকাদেবী হাত কচলে হেসে বললেন, ‘ওই একই হল মিসেস বোস। টিচার চিরকাল টিচারই থাকে। কখনও এক্স হয় না। এই তো এখনও ছোটবেলার কোনও দিদিমণিকে দেখলে আগে প্রণাম করি।’

মিসেস বোস অহঙ্কারের হাসি হাসলেন।

কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, দু-হাতে প্যাকেট নিয়ে কর্ণিকা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। শুধু প্যাকেট নয়, হাতে একটা বেগুনও আছে। বাবা ক’দিন ধরে বেগুনপোড়া খাওয়ার বায়না করছে। মেয়েকেও বলেছে।

‘বুঝলি কনি, বেগুনপোড়া একটা ওয়াণ্ডারফুল প্লেট। ঠিক মতো তৈরি করতে পারলে জবাব নেই। এক থালা ভাত খেয়ে ফেলা যায়।’

কর্ণিকা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি আবার বেগুনপোড়া নিয়ে পড়লে কেন বাবা?’

সুখময়বাবু এক গাল হেসে বললেন, ‘সেদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল।’

কর্ণিকা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘টিভিতে বেগুনপোড়াও দেখায় নাকি!’

সুখময়বাবু মেয়ের বিরক্তিতে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘আরে, ওই যে রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান হয় না? ওখানে দেখাচ্ছিল। কী যেন নাম প্রাোগ্রামটা…আহা। কী যেন নাম…খাচ্ছি খাব? না না, খাব খাচ্ছি…না না তাও নয়…। যাক গে, যে নামই হোক রান্নাবান্না ভালো দেখায়।’

কর্ণিকা রেগে গিয়ে বলল, ‘উফ বাবা, তুমি টিভি দেখা বন্ধ করো। একটা সুস্থ সবল লোক বাড়িতে বসে টিভিতে রান্নার শো দেখছো! এই কারণে বলি কাজ না করে তোমার মাথাটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

মেয়ের ধমকেও পাত্তা দিলেন না সুখময়বাবু।

‘বুঝলি কনি, একেক দিন একেক রকম রান্না। কোনও দিন ঝাল, কোনও দিন ঝোল, কোনও দিন কষা, কোনও দিন অম্বল। সেদিন ছিল তোর পোড়া। বেগুন পুড়িয়ে পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা, অল্প লেবু, তার ওপর কাসুন্দি, আহা। এই দেখো জিভে জল এসে গেছে। কতদিন যে বেগুনপোড়া খাইনি। আহা! যাক টিভিতে দেখেই সুখ। এদের উচিত এই ধরনের প্রাোগ্রাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া!’

কর্ণিকা আরও রাগ দেখাতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। এই মানুষকে রাগ দেখিয়ে কী লাভ? জীবনটাকে সহজ সরল করতে করতে একেবারে বেগুনপোড়ায় নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে। কাজকর্ম ছাড়া ঘরে বসে থাকলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। মায়াও হয়।

আজ বাজারে বেগুন দেখে কর্ণিকার বাবার কথা পড়ে গেল। একটা বড় দেখে কিনেও ফেলেছে। নিজেই গ্যাসে পুড়িয়ে দেবে। যতই হোক, বাবা তো।

সেই বেগুনই এখন হাতে।

মল্লিকাদেবী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, ‘প্রণাম কর কনি’।

করবী মাসি বলল, ‘আহা, মেয়েটাকে হাতের জিনিসপত্র তো রাখতে দেবে মল্লিকাদি।’

মল্লিকাদেবী বললেন, ‘ঠিক আছে, রেখে আয় চট করে। মিসেস বোস আবার বেরিয়ে যাবেন। ওঁর আবার কোথায় মিটিং আছে।’

মায়ের এত অর্ডারে কর্ণিকার রাগ হল। মিসেস বোসের মিটিং আছে তো কী! উনি কে? যার জন্য ছুটে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে হবে?

মিসেস বোস দাঁত চেপে বললেন, ‘মিটিং নয়, সেমিনার। বাংলা আকাদেমিতে যাব। ভাষা নিয়ে একটা আলোচনা আছে। ভাষার বিবর্তন। আমি এসবে মোটে যেতে চাই না। ওরা এমন জোর করে। যাক, মা তুমি হাতের জিনিসগুলো রেখে এসো। দুটো কথা বলে চলে যাই।’

ভিতরে যেতে মানার সঙ্গে দেখা। দিদিকে দেখে ফিচ করে হাসল।

‘মানা, এরা কারা? কেন এসেছে? মা অমন গদগদ ভাব করছে কেন?’

মানা চোখ নাচিয়ে বলল, ‘তোর শাশুড়ি। আমি মিষ্টি আনতে যাচ্ছি। সঙ্গে ইয়া বড় বড় শিঙাড়া।’ মানা হাত ঘুরিয়ে শিঙাড়ার সাইজ দেখাল।

কর্ণিকা অবাক হয়ে বলল, ‘শাশুড়ি! কী বলছিস?’

মানা বলল, ‘ঠিকই বলছি। তোকে দেখতে এসেছে। তোর উড বি শাশুড়ি। গিয়ে দেখ।’

মানা ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে দিয়ে সানাই বাজানোর ঢঙে বলল, ‘প্যাঁ প্যাঁ…প্যাঁ প্যাঁ।’

কর্ণিকার মনে হল, ভাইকে একটা চড় লাগায়। কিন্তু সে এতটাই হতভম্ভ হয়ে পড়ল যে চড় লাগানোর কথা ভুলেই গেল। পাকা ছেলেটা কী বলছে এ সব!

ঠিক বলছে। কর্ণিকা কোনওরকমে চোখে মুখে জল দিয়ে আবার ড্রইংরুমে যেতেই ব্যাপারটা আঁচ করল।

মিসেস বোস সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বললেন।

‘প্রথমে করবী, তারপর তোমার মায়ের কাছ থেকে তোমার কথা শুনলাম। তুমি তো লেখাপড়ায় ভালো ছাত্রী। আরও পড়লে না কেন?’

কর্ণিকা কী বলবে বুঝতে পারল না। চেনা নেই, জানা নেই, এই মহিলার প্রশ্নের উত্তর সে দেবে কেন? আবার উপায়ও নেই। বাড়ি বয়ে এসেছে। অপমানও করা যায় না। ইচ্ছে থাক বা না থাক, কিছু একটা তো বলতেই হবে।

‘চাকরি করাটা দরকার ছিল।’

মিসেস বোস একটু চুপ করে বসে বললেন, ‘আরও পড়তে ইচ্ছে করে না?’

কর্ণিকা বলল, ‘উপায় নেই।’

মিসেস বোস বললেন, ‘উপায় থাকলে পড়বে?’

কর্ণিকা ইতস্তত করে বলল, ‘এখনই ভাবছি না।’

মল্লিকাদেবী গলে যাওয়া গলায় বললেন, ‘ও তো অফিসে বড় প্রাোমোশন পেয়েছে। অনেক দায়িত্ব। বড় অফিসার হয়েছে।’

কর্ণিকার এত রাগ হল যে ইচ্ছে করল মায়ের মুখ চেপে ধরে।

করবী মাসি এক গাল হেসে বলল, ‘মিসেস বোস সব জানেন। উনি তোমার মেয়ে সম্পর্কে সব খবর নিয়েই আজ এসেছেন।’

মিসেস বোস ঠোঁটের কোনায় হেসে বললেন, ‘কর্ণিকা, শুনেছি, তুমি অফিসে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করো। কথাটা ঠিক?’

‘ঠিক না ভুল সে তো আমার অফিস বলতে পারবে।’

মিসেস বোস চোখ সরু করে বললেন, ‘সে তো জানি। তোমার নিজের ধারণা কী? সেলফ অ্যাসেসমেন্টটাই আসল।’

কর্ণিকা মুখ তুলে বলল, ‘আমার ধারণা আমি আমার ডিউটি সিরিয়াসলি করি।’

মিসেস বোস হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। কর্ণিকা তোমার হাতে দেখলাম তুমি কি বেগুন দিয়ে কোনও রান্না করবে?’

কর্ণিকার মনে হল, এবার একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার। বলল, ‘হ্যাঁ, করব। বেগুনপোড়া বানাব। আমার বাবা খেতে চেয়েছেন।’

মল্লিকাদেবী তাড়তাড়ি বললেন, ‘আমার মেয়ের রান্নার হাত কিন্তু অতি ভালো। আজ না বলে চলে এলেন তাই, নইলে হাতের রান্না খাওয়াতাম। আর একদিন আসুন না।’

মিসেস বোস খানিকটা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘ভালো রান্না খাবার জন্য রেস্টুরেন্টে যাব। এখানে আসব কেন?’

কর্ণিকা হেসে বলল, ‘মা কিন্তু বাড়িয়ে বলছে। আমি রান্নার কিছুই পারি না।’

মিসেস বোস সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘মায়েরা অমন বাড়িয়ে বলেই, আমাকে যখন ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এসেছিল, আমার মা বলেছিল, আমি নাকি খুব ভালো গান করি। এদিকে আমার তো গলায় সুর বলে কিছু নেই। আমি তখন কী বলব বুঝতে পারলাম না। তোমাদের মতো তো আমরা স্মার্ট ছিলাম না। ছেলের মামি বললেন, একটা গান শোনাও তো মেয়ে। আমি তো দর দর করে ঘামতে শুরু করলাম। তারপর…।’ কথা থামিয়ে মহিলা হাসতে লাগলেন। কর্ণিকার এবার বেশ লাগল। মানুষটার মধ্যে একটা সোজাসাপটা ভঙ্গি আছে তো। কিন্তু হঠাৎ এসব কী হচ্ছে! এই ভদ্রমহিলা কোথা থেকে এলেন!

মিসেস বোস হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। মহিলার পোশাক-পরিচ্ছদ, হাবভাবের মধ্যে এক ধরনের শিক্ষিত, রুচিশীল ব্যাপার আছে। কর্ণিকার মনে হচ্ছে, প্রথম দর্শনে মহিলার প্রতি যে অনীহা, বিরক্তি, রাগ তৈরি হয়েছিল, এখন যেন খানিকটা কমছে।

মিসেস বোস মল্লিকাদেবীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, এবার যে আমাকে উঠতে হবে।’

মল্লিকাদেবী হা হা করে উঠলেন। নিজেও উঠে দাঁড়ালেন।

‘কিছুতেই না দিদি। চা না খাইয়ে আপনাকে ছাড়বই না। এখনই মানা আসবে। একটু মিষ্টি আনতে গেছে।’

মিসেস বোস হাত বাড়িয়ে মল্লিকার হাত ধরলেন। নরম গলায় বললেন, ‘আজ থাক। আপনাকে না জানিয়ে এসেছি। আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। করবীকে বললাম, আজই যাব। উইদাউট এনি প্রিপারেশন আমি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। করবী তো আকাশ থেকে পড়ল। সে গাইগুঁই করছিল। আমি শুনিনি। ঘটা করে মেয়ে দেখতে আসা আমি পছন্দ করি না। খুব খারাপ সিস্টেম। গত মাসে কোনও একটা অফিসিয়াল পার্টিতে আপনার মেয়ের সঙ্গে সুস্নাতর আলাপ হয়। আলাপ না বলে ঝগড়াই বলা যেতে পারে। ঝগড়ার বিষয় ছিল কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট। সেই ঝগড়ার কথা সুস্নাত আমাকে গল্প করে। শুধু তাই নয়, সে আমাকে বার বার বলে মেয়েটির সঙ্গে তার মতে মেলেনি, কিন্তু মেয়েটিকে তার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। বাঙালি মেয়ের মধ্যে এই ধরনের কর্পোরেট লজিক নাকি খুব একটা দেখা যায় না। ছেলে আমাকে মেয়েটির নাম বলে। কর্ণিকা। অফিসের নামটাও বলতে পারে। সে নিশ্চয় আপনার মেয়ের কাছে থেকে শুনে মনে রেখেছিল। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এতটা মনে রাখায় আমার কেমন সন্দেহ হয়। মায়ের মন তো। এদিকে সুস্নাত তো আমেরিকায় ফিরে যায়। আপনাকে তো বললাম, ছেলে নিজের বিজনেস কনসালটেন্সি ফার্ম করেছে। কলকাতায় অফিসের কাজেই এসেছিল। তার মধ্যে কয়েকটা পার্টিও অ্যাটেন্ড করতে হয়।’

মিসেস বোস কথা থামিয়ে কর্ণিকার দিকে ঘাড় ঘোরালেন। হেসে বললেন, ‘কী কর্ণিকা, আমার এখানে আসবার কারণ স্পষ্ট হচ্ছে? দাঁড়াও আর একটু আছে। আমি তো অথৈ জলে পড়ি। ছেলে তো আমাকে বিরাট বিপদে ফেলল। সে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করে গেল, যার শুধু নাম জানি, অফিস জানি, আর কিছুই জানি না! এমনকী মেয়েটি বিবাহিত কিনা তা-ও নয়। একদিন করবীকে দুঃখ করে গল্প করেছিল। করবী লাফিয়ে উঠল। মেয়ে তার আত্মীয়। একেই বলে কোইনসিডেন্স। আসলে জীবনে বড় বড় বাঁকগুলো সব আকস্মিকই পাওয়া যায়। আমি করবীকে বলি, এখনই কিছু বলবার দরকার নেই। আগে, ছেলের পারমিশন নিই। খোঁজখবর নিই। তারপর।’

কর্ণিকার মাথা ঝমঝম করছে। সে সুস্নাত নামে যুবকটির মুখ মনে করবার চেষ্টা করছে। অফিসের কারণে ন’মাসে ছ’মাসে তাকে একটা-আধটা পার্টিতে যেতে হয়। স্যর বা অন্য কেউ যেতে না পারলে তার ঘাড়েই চাপ পড়ে। নেমন্তন্ন করলে কোম্পানির একজন প্রতিনিধির যাওয়া উচিত। সাধারণত অ্যাটেন করেই সে পালিয়ে আসে। খাওয়া-দাওয়াও করে না। এর মধ্যে একেবারে ঝগড়া! হতে পারে। কাজকর্ম নিয়ে তার এক ধরনের বিশ্বাস আছে। অন্যকে সেই বিশ্বাস জানাতে তার দ্বিধা নেই। অচেনা হলেও নয়। তবে ছেলেটাকে মনে পড়ছে না কেন? গোটা ঘটনাটা তো গল্পের বইয়ের মতো!

মিসেস বোস বললেন, ‘কর্ণিকা, আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সরাসরি কথা বলতে পারো। আজকের দিনে মেয়েদের এরকম হওয়াই উচিত। যে কাজই করো দায়িত্ব নিয়ে করাটাই আসল। আমার বিশ্বাস সংসারও তুমি দায়িত্ব নিয়ে করতে পারবে। তবে মনে রেখো বিদেশে কিন্তু সংসার করবার অনেক ঝামেলা। সব নিজেদের করতে হয়। কোনও হেলপিং হাত থাকে না। তাছাড়া…সব যদি ঠিকঠাক হয়…তাহলে তো তোমাকে সুস্নাতর ফার্মও সামলাতে হবে।’

রাগের সঙ্গে কর্ণিকার এবার লজ্জাও করল। মেয়েদের হল এই একটা মুশকিল। যতই নিজেদের তালেবর ভাবুক, কোনও কোনও সময় লজ্জা করে বসে। কর্ণিকা মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কী বলছেন।’

মল্লিকাদেবী তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমাদের কত বড় সৌভাগ্য।’

মিসেস বোস হেসে বললেন, ‘সৌভাগ্য আমার। এই বিয়ে হোক না হোক, ছেলের মা হিসেবে আমি একটা ভেলকি দেখালাম। পছন্দর মেয়েকে খুঁজে দিলাম। কর্ণিকা এই নাও, এটা আমার ছেলের ফোন নম্বর। আমি তাকে আজই সব জানাব। যদি অসুবিধে না হয় তোমার ফোন নম্বরটা আমাকে দাও। সে তোমাকে কল করবে। তুমি যদি চাও, তার সঙ্গে কথা না-ও বলতে পারো। তোমার কি আমাকে কিছু বলবার আছে?

মল্লিকাদেবী বললেন, ‘না না, ওর আর কী বলবার আছে? ওর তো পরম ভাগ্য। ওর বাবা এলে…?’

মিসেস বোস মল্লিকাদেবীর কথায় পাত্তা না দিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘বলো তোমার কী বলবার আছে?’

কর্ণিকা মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এখন বিয়ে করব না। এখানে আমার অনেক রেসপনসিবিলিটি আছে। অফিসে, ঘরে…। সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না।’

মিসেস বোস কর্ণিকার কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। বিদেশে থাকা ভালো পাত্র দেখে নিজের যাবতীয় দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতো মেয়ে যে তুমি নও, আমি বুঝতে পেরেছি। আমার ভেবে ভালো লাগছে যে আমার ছেলে মানুষ চিনতে ভুল করে না। আমার একটাই অনুরোধ, তুমি এই কথাটা সুস্নাতকে বলে দাও। বলে দাও, তুমি এখন বিয়ে করবে না। সে অন্তত জানুক তার মা চেষ্টা করেছে। এইটুকু অনুরোধ রাখবে কি?’

কর্ণিকা মাথা নাড়ল। মিসেস বোস চলে যাওয়ার পর, মল্লিকা মেয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন।

বেশি রাতে কর্ণিকার মোবাইলে বিদেশের নম্বর ভেসে এল। কর্ণিকা প্রথমে ভেবেছিল ধরবে না। তারপর মিসেস বোসের সুন্দর ব্যবহারের কথা মনে পড়ে গেল। তার ওপর সে কথা দিয়েছে। সে কথা রাখা উচিত। এক মিনিটের কম সময়েই ছেড়ে দেবে। কর্ণিকা ফোন কানে নিল।

সেই ফোন ছাড়তে কর্ণিকা রাত কাবার করে ফেলল। এই জন্যই বলে, মানবমন অতি রহস্যময়! এক মুহূর্ত আগেও সেই মনের খবর কেউ বুঝতে পারে না।