☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
আটান্ন
বারিধারা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে অস্ফুটে বলল, ‘বাবা, তুমি কি পুলিশের কথা বিশ্বাস করছ?’
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, করছি। ওরা আমাকে কাগজপত্র দেখিয়েছে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের ব্যাগ থেকে সেই সব কাগজপত্র পাওয়া গেছে।’
বারিধারা বলল, ‘কী আছে, সেই কাগজে?’
বিমলকান্তি একটু থমকে বললেন, ‘থাক। তোর শুনলে খারাপ লাগবে।’
বারিধারা মালিন হেসে বলল, ‘লাগুক, তারপরেও শুনব। সবটাই তো খারাপ।’
বিমলকান্তি ঠিক করেছিলেন, আজকের ঘটনায় কাউকেই কিছু বলবেন না। অফিসে বাড়িতে কোথাও নয়। এখন ছোট মেয়ের অফিসে চলে আসবার পর নিজেকে সামলাতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, কাউকে বলা দরকার। মনটা হালকা হবে।
থানা থেকে আজ বিমলকান্তিবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। বিমলকান্তিবাবু তখন সবে অফিসে এসেছেন। গুছিয়ে বসাও হয়নি। জরুরি ডেলিভারির ব্যাপার আছে। যে বিরাট আর্ডার একসময় দেরির কারণে বাতিল হয়ে যেতে বসেছিল সেটা ছাড়া হবে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের পরামর্শ মতো চিঠি লিখেই অর্ডারটা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কী অদ্ভুত। সেই মানুষটার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে পুলিশ ডাকছে! বিমলবাবু সময় চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিকেলের দিকে যদি যাওয়া যায়। থানার অফিসার বললেন, না, এখনই আসতে হবে। বিষয়টা খুবই জরুরি। দেরি করা যাবে না। থানায় যাওয়ার পর অফিসার খাতির করে বসালেন।
‘চা খাবেন মিস্টার সেন?’
বিমলকান্তি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘না’।
অফিসার বললেন, ‘সরি মিস্টার সেন, আপনাকে জোর করে ডেকে পাঠালাম। বুঝতে পারছি, এখন আপনাদের ব্যস্ততার সময়।’
বিমলকান্তি শুকনো হেসে বললেন, ‘এতে সরির কী আছে? আপনার ডিউটি। করতে তো হবে।’
অফিসার বললেন, ‘কোনও কোনও ডিউটি পরেও করা যায়, কিন্তু এটা করা যাবে না। মনে হচ্ছে, নিখিলেশ উপাধ্যায়ের মার্ডার কেস সলভ করা গেছে।’
বিমলকান্তি আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘তাই? সব জানা গেছে?’
অফিসার একটু হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে। এবার আপনার কাছ থেকে ছোটখাটো দু-একটা কনফার্মেশনের প্রয়োজন। সেটা পেলেই আমরা কেসটা ফ্রেম করতে পারব। কাল ওই মহিলার কোর্ট প্রাোডাকশন রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে যেতে না পারলে সমস্যা আছে। আমরা ওকে আমাদের হেফাজতে নিতে চাইছি। মহিলার নামে বহু পুরোনো কেস আছে। মনে হচ্ছে মার্ডার কেসও আছে। স্বামীর সঙ্গে মিলে করেছিলেন। আপনার সাহায্য দরকার। সেই কারণে তাড়াতাড়ি আপনাকে ডেকে পাঠালাম।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘বলুন আমাকে কী করতে হবে।’
অফিসার কাগজপত্র বের করতে করতে বলেন, ‘কাল রাতে ইন্টারগেশনের সময় মহিলা সব বলেছেন। কেন তিনি নিখিলেশ উপাধ্যায়কে খুন করেছেন।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘কেন?’
অফিসার বললেন, ‘দুটো পার্ট আছে। তার মধ্যে একটা হল, আপনাদের কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা নেওয়া।’
বিমলকান্তি অবাক হয়ে বললেন, ‘ব্ল্যাকমেল! আমাদের কোম্পানিকে? সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে? কী বলছেন অফিসার! ওই মহিলাকে কীভাবে ব্ল্যাকমেল করবে?’
অফিসার সামান্য হেসে বললেন, ‘ওই মহিলা মিস্টার সেন, ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল নিখিলেশ উপাধ্যায়। এই কাজে বৈশাখী রাজি হননি। এই নিয়ে দু’জনের ঝগড়া হয়।’
বিমলকান্তিবাবু এতক্ষণ সোজা হয়ে বসে অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। বিড়বিড় করে বলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
অফিসার এবার সংক্ষেপে গোটা ঘটনা জানান। নিখিলেশ উপাধ্যায় কীভাবে জাল কাগজপত্র তৈরি করেছিল, প্রফেশনাল ব্ল্যাকমেলার হিসেবে বৈশাখীকে অ্যাপয়েন্ট করেছিল, কীভাবে ঝগড়া লাগে—সব।
এরপর ফাইল থেকে কাগজপত্র বের করে বিমলকান্তিকে হাতে দেয়।
বারিধারা বলল, ‘কীসের কাগজ?’
বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘কোর্টের জাল কাগজ। সেখানে তোর দাদুর সঙ্গে এক মহিলাকে জড়ানো হয়েছে। আমার মা ছাড়াও উনি নাকি একজনকে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। ওই মহিলা নাকি তার মেয়ে। সে এসে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ চাইবে।’
বারিধারার হাত-পা কেমন যেন অবশ লাগছে। ভয়ও করছে। দাদু-বাবাকে ঘিরে এত বড় চক্রান্তের জাল ছড়ানো হয়েছিল!
‘এতে নিখিলেশ দাদুর কী লাভ হত?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘জানি না। ওই মহিলা বলেছেন, নিখিলেশ উপাধ্যায় নাকি মাঝখানে এসে বিষয়টা ধামাচাপা দেবে বলে ঠিক করেছিলেন। আমাকে পারিবারিক কেলেঙ্কারির ভয় দেখিয়ে খুব বড় একটা অ্যামাউন্ট মহিলাকে দিতেন! সেখান থেকে ভাগ পেতেন।’
বারিধারা অস্ফুটে বলল, ‘কী ভয়ঙ্কর!’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। পুলিশ অফিসার কাগজপত্র দেখাতে বুঝতে পারলাম, ঠিক। ওরা আমার কাছ থেকে নাম, ঠিকানা কনফার্ম করল। আমার এত খারাপ লাগছিল…।’
বারিধারা বুঝতে পারছিল, আজ বাবার মন এত খারাপ কেন। বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃতজ্ঞতাই মানুষের সবথেকে বড় অপরাধ। অথচ কত অনায়াসে মানুষ সহজ স্বাভাবিকভাবে এই অপরাধ করে চলে। বুক ফুলিয়ে থাকে। নিখিলেশদাদুকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কী দেয়নি! কবে অবসরের বয়স হয়ে গেছে। তারপরেও মাথায় তুলে রেখেছে। বারিধারার চিরকালই মনে হত, কোথাও যেন দাদুর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। কিন্তু ওই মহিলা এতদূর এগিয়েও কাজটা করলেন না কেন? টাকা-পয়সার দরদাম দিয়ে পোষাচ্ছিল না?
বিমলকান্তি মুখ তুলে মেয়ের চোখে চোখ রাখলেন।
‘ঘটনার দ্বিতীয় অংশটা আরও মারাত্মক বৃষ্টি।’
বারিধারা বলল, ‘বলো।’
বিমলকান্তিবাবু মাথা নামিয়ে টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে খানিকটা আঁকিবুকি কাটলেন। কীভাবে বারিধারাকে কথাটা বলবেন?’
বারিধারা আবার বলল, ‘কী হয়েছে বাবা?’ সে হাত বাড়িয়ে বাবার হাতটা স্পর্শ করল।
বিমলকান্তি মাথা নামিয়েই বললেন, ‘ওই মহিলা…বৈশাখী…উনি অর্চিনের মা।’
বারিধারা বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কী বলছ বাবা? উনি অর্চিনের মা!’
বিমলকান্তি মুখ তুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, বৃষ্টি। পুলিশকে উনি নিজের সব পরিচয় জানিয়েছেন। আমার ধারণা জানাতে বাধ্য হয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওরা নিশ্চয় চাপ দিয়েছিল। পুলিশ জানে কীভাবে কথা বের করতে হয়।’
বারিধারা-মেঘবতীরা অর্চিনের পরিচয় খুব গভীরে গিয়ে জানত না। মামার বাড়ির দিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কলকাতায় তাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে, ব্যস এইটুকুই। এ ব্যাপারে মেয়েরা তাদের মাকে খুঁচিয়ে জিগ্যেস করেনি কখনও। প্রয়োজন হয়নি। ছেলেটা এত ভালো, কিছু নিয়ে কখনওই বেশি কৌতূহল তৈরি হয়নি। তার ভদ্র আচরণে সবাই খুশি ছিল। এই ছেলের মা ওই খুনি মহিলা!
বিমলকান্তিবাবু নীচু স্বরে বললেন, ‘আমরা জানতাম মহিলা একজন প্রফেশনাল ফ্রড। ইমপস্টার। বিয়ের পর অভাবে এই পথ বেছে নিয়েছিলেন। স্বামী একজন ক্রিমিনাল ছিল। বউকেও সেই পথে নিয়ে যায়। বেরোনোর কোনও উপায় ছিল না মহিলার। নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। অর্চিন জন্মানোর পর তাকে নিজের মায়ের কাছে রেখে আসে। তার মা শর্ত দেন। কোনওদিন ছেলেকে নিজের পরিচয় জানাতে পারবে না। বৈশাখীও চাননি, অর্চিন আর মায়ের পরিচয় জানুক। সে জানত মা মরে গেছে। দাদু-দিদার কাছে মানুষ। কলকাতায় পড়বার কথা উঠতে, তোর মা-ই প্রস্তাব দিয়েছিল, ছেলেটা আমাদের বাড়িতে এসে থাকুক। ছেলেটার প্রতি আমাদের দুর্বলতা ছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, ছেলেটার পরিবারিক ভালোবাসা প্রয়োজন। তোর দাদুকে সব বলেই আমরা অর্চিনকে এ বাড়িতে দিয়েছিলাম। তোর দাদু, মণিকুন্তলাকে দু-হাত তুলে সমর্থন করেছিলেন।’
বিমলকান্তি চুপ করলেন।
বারিধারা ফিসফিস করে বললেন, ‘মা-দাদু ঠিক করেছিলেন। অর্চিনদার কোন দোষ ছিল না।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘অর্চিনের মা তার প্রতিদান দিলেন।’
বারিধারা অবাক হয়ে বলল, ‘প্রতিদান! কী প্রতিদান?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘পুলিশকে উনি সব জানিয়েছেন। যখন শুনলেন তাকে এমন মানুষদের ব্ল্যাকমেল করবার জন্য ভাড়া করা হয়েছে যাদের বাড়িতে তার ছেলে ছিল, তিনি কাজটা নিতে অস্বীকার করলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায় পরিচয় না জেনেই অর্চিনের বিরুদ্ধে কিছু বলেন। সে গ্রামে চলে গেছে রাজনীতি করতে, তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন এই ধরনের কিছু। বৈশাখী যদি সেন বাড়ির বিরুদ্ধে কাজ না করে তা হলে তাকেও পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এরপরেই নিখিলেশ উপাধ্যায়কে খুন করেন এই মহিলা।’
বিমলকান্তি একটু থমকে বাকিটাও মেয়েকে বলেন।
পুলিশ অফিসার তাকে বলেছেন, খুনের কায়দাটা ছিল প্রাচীন। প্রথমে ঘাড়ে মারে, তারপর গলায় ফাঁস। এই কায়দা দেখে পুলিশের সন্দেহ হচ্ছে, মহিলা আরও খুন করেছেন। রেস্তোরাঁ থেকে খবর পেয়েই শিয়ালদা, হাওড়া স্টেশন, বিভিন্ন বাস টার্মিনাসকে অ্যালার্ট করে পুলিশ। এই ধরনের ঘটনার পর মার্ডারার সাধারণত শহর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। কমন হ্যাবিট। প্লেস অফ অকারেন্স থেকে যতটা দূরে সরে যাওয়া যায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ফিরে আসে। খানিকক্ষণের মধ্যে পুলিশের কাছে খবর আসে, এক মহিলা শিয়ালদা স্টেশনে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেস্তোরাঁর এক কর্মীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে আইডেন্টিফাই করা হয়, কিন্তু তখনই তাকে ধরা হয় না। অপেক্ষা করা হয়, তার জন্য কোনও সঙ্গী আছে কি না জানার জন্য। শেষ পর্যন্ত ক্যানিংয়ের নদী পেরনোর সময় অ্যারেস্ট করা হয়। মহিলা পুলিশকে জানিয়েছেন, উনি নাকি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। ছেলের গ্রামের নাম নিখিলেশ উপাধ্যায়ই তাকে জানিয়েছিলেন। সুন্দরবনের গ্রাম। নাম নোনাজল। পুলিশকে খবর দেবেন বলে নিখিলেশ উপাধ্যায় এ সব তথ্য গোপনে জোগাড় করেছিলেন।
বারিধারা শান্ত গলায় বলল, ‘মহিলার সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেল বাবা।’
বিমলকান্তি নীচু গলায় বললেন, ‘আমারও।’
বারিধারা বলল, ‘বাবা, এবার বাড়ি চলো। সবাই চিন্তা করছে।’
বিমলকান্তি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ভালোই হল তুই এসেছিস। বাড়িতে এত কথা বলার সুযোগ হত না।’
বারিধারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেন হত না?’
বিমলকান্তিবাবু বলল, ‘তোর মা জেনে যেত।’
বারিধারা বলল, ‘জানতে তো হবেই বাবা। মাকেও সব জানতে হবে।’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘মণিকুন্তলা খুব দুঃখ পাবে।’
বারিধারা সামান্য হেসে বলল, ‘মাকে এত দুর্বল ভাবছ কেন বাবা? মেয়েরা বেশিরভাগ সময়েই ছেলেদের থেকে অনেক বেশি স্ট্রং। ওই বৈশাখী নামের মহিলাকে দেখে তুমি বুঝতে পারছ না? মা দুঃখ পাবে না। বরং, ওই মহিলার জন্য গর্ব বোধ করবে। আমি যেমন করছি। উনি শুধু একজন বিশ্বাসঘাতককে চরম শাস্তি দেননি, উনি তোমাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন, উনি নিজের সন্তানকে দূর থেকে হলেও রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন। এনার জন্য আমাদের সবার গর্ব করা উচিত। মাকে, দিদিকে সব বলব। এমনকী তোমার উচিত অফিসেও সবাইকে এই ঘটনা জানানো। বিশ্বাসঘাতকতাই শেষ নয়।’
বারিধারার কথা শুনে বুক ভরে গেল বিমলকান্তিবাবুর। এই মেয়ে সিরিয়াস নয় বলে, হালকা রসিকতার জীবন কাটায় বলে কত চিন্তাই না করেছেন। এখন বুঝতে পারছেন, না, মেয়েটা মানুষ হয়েছে। অনেকের থেকে বড় মানুষ হয়েছে। বেঁচে থাকবার আসল সত্যিটা বুঝতে পারাই ‘মানুষ’ হওয়া। সেটা হাসতে হাসতে হলেও কোনও ক্ষতি নেই।
মেয়েকে নিয়ে যখন গাড়িতে উঠলেন বিমলকান্তি তখন তিনি অনেকটা হালকা বোধ করলেন। বুক থেকে ভার নেমে গেছে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শ্রবণকে ফোন করল বারিধারা।
‘খুব ভালো করেছিস বারি, তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’
বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমাকে না বলেছি, সকালে কখনও ফোন করবে না। তুমি সকালে ফোন করা মানে গোটা দিনটা গোলমাল হয়ে যাওয়া।’
শ্রবণ বলল, ‘সরি ধারা, কিন্তু আমি তো তোমাকে ফোন করিনি, করব করব ভাবছিলাম।’
বারিধারা বলল, ‘তোমার ভাবনা এখন সরিয়ে আমার কথা শোন।’
শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘কাল একটা কেলো করেছি।’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী করেছ?’
শ্রবণ বলল, ‘বলতে ভয় করছে।’
বারিধারা বলল, ‘তা হলে বলবে না। কবে মুম্বই যাচ্ছ?’
শ্রবণ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘তোমার পরীক্ষা কবে শেষ হচ্ছে বারি? এ মাসের আঠাশ তারিখ না?’
বারিধারা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কেন? তুমি কী করবে? আমার হয়ে পরীক্ষা দেবে?’
শ্রবণ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওরা আবার মেল পাঠিয়েছে। সামনের মাসের দু-তারিখে ওদের ফাংশান। চার তারিখ ওরা আমার সঙ্গে বসতে চায়। চাকরির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলবে। চার তারিখ রাতের প্লেনে ফিরে আসতে পারব। এক তারিখ বিকেলে যাব, চারে ফিরব।’
বারিধারা আরও বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে এ সব জানাচ্ছ কেন? আমি কি ফুলের তোড়া নিয়ে তোমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাব? বোকার মতো কথা বলবে না।’
শ্রবণ টেলিফোনের ওপাশে বিড়বিড় করে কিছু বলল। তার পুরোটা শোনা গেল না।
‘না, তোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে…।’
বারিধারা এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে কথা বলছিল। ঘরের দরজা বন্ধ। সে একটা শার্ট পরে আছে। বেশিরভাগ সময়ে এটাই তার রাত পোশাক। টি শার্টের বুকে শ্রবণ ডিজাইন করে দিয়েছে। একটা গাছ। গাছটা পুরো সত্যি নয়। খানিকটা রিয়েল, খানিকটা কল্পনার। ডালপালা মেলে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে। বারিধারা উঠে বসল। ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘বার বার আমার পরীক্ষার রুটিন নিয়ে কথা বলছ কেন?’
ওদিক থেকে শ্রবণ থতমতো খেয়ে বলল, ‘আর বলব না বারি। কিন্তু ধারা…।’
বারিধারা বলল, ‘চুপ করো। একটা কথাও বলবে না। আজ আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে। আমাদের গাড়িতে যাব। আজই ফিরে আসব। যত রাত হোক।’
শ্রবণ একটু থেমে বলল, ‘কোথায়?’
বারিধারা বলল, ‘তোমার জেনে কী হবে? তৈরি হয়ে নাও। এক ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে যাব। আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’
শ্রবণ বলল, ‘বারি তোমার আজ পরীক্ষা নেই?’
বারিধারা বলল, ‘না, তিনদিন অফ। পরীক্ষা থাকলেও তোমাকে একা পাঠাতাম।’
শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘কোথায় জানতে চাইছি না।’
বারিধারা ফোন কেটে দিল। বাবাকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। বাবা কথা দিয়েছে, এখন কাউকে বলবে না। মা, দিদি শুনলে টেনশন করবে। বাবা সঙ্গে লোক পাঠাতে চেয়েছিল। বারিধারা রাজি হয়নি। শ্রবণ তো থাকছেই। গাড়িতে নোনাজল গ্রাম খুব কিছু দূরে নয়। ঘণ্টা তিনেকের বেশি লাগবে না।