» » ষষ্ঠ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

ছাপান্ন

‘…প্রিয়তমা,

দেখেছি তোমার স্বপ্নাহত কৃশ পা, আমার

স্বপ্ন বুঝি মনে হয় কারণ এবার

অসময়ে নৈশ-বিরতির ঘণ্টা বেজে ওঠে—

সান্ধ্য ক্লাস ছুটি হয়ে যায়।’

বই বন্ধ করে শেখর সিগারেট ধরাল। সত্যি কি প্রিয়তমা আজ স্বপ্নাহত? অসময়ে নৈশ-বিরতির ঘণ্টা বেজেছে? ছুটি হয়ে গেছে ক্লাস?

বহুদিনের পর শেখরের মন খারাপ। কবিতা পড়ে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। রাত দশটা এখন। খানিক আগে পার্টি অফিস থেকে ফিরেছে শেখর। দশটায় বাড়ি ফেরা মানে তাড়াতাড়িই হল। এক সময় বাড়ি ফিরতে রাত একটাও বেজে যেত। অপেক্ষা করে করে তমসা ঘুমিয়ে পড়ত। সেসব অতীতের কথা। নিশুতি রাতে বাড়ি ফেরবার সময় মনে হত, ইস, অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল। জেলা কমিটিকে চিঠি লেখবার ছিল, দুটো লোকালে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার ছিল, এখনও পার্টি পত্রিকার এ মাসের হিসেব হয়নি, যুবর ছেলেদের নিয়ে বসা বাকি, মহিলা সমিতিতে একটা ফ্যাচাং চলছে, ভোটার লিস্ট স্ক্রুটিনি নিয়ে মিটিং না করলে পরে চাপ পড়ে যাবে, কলেজের ছাত্রদের ইনভলব করবার জন্য ওদের নিয়ে এখনই বসতে হবে। এরকম হাজার কাজের কথা মনে পড়ে যেত। সেই সময় রাতে বাড়ি ফেরাটা কোনও উদ্বেগের ছিল না। এলাকা ছিল হাতের মুঠোয়। ভদ্রলোক তো বটেই চোর-ডাকাতরাও পার্টির লোকদের সমীহ করত। লোকাল থানার টহলদারি ভ্যান পার্টি অফিসের দূরে দাঁড়িয়ে নজর রাখত, নেতাদের যাতে সমস্যা না হয়। পর পর দু’বার ভোটে হারবার পর সবটাই উলটে গেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয়বার পরাজয় জোর ধাক্কা হিসেবে এসেছে। এই ধাক্কা শুধু পরাজয়ের নয়, পরিকাঠামোগত অনেক সমস্যা তৈরি করেছে। ভোটের আগে পার্টি তাও অনেক নড়েচড়ে বসেছিল। কর্মী-সমর্থকরা পথে বের হচ্ছিল, পার্টি অফিসে ভিড় করছিল। ক্ষমতায় ফেরবার আশায় এই উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল। সেই উদ্দীপনা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। এখন বেশি রাত পর্যন্ত পার্টির কাজ করবার প্রশ্নই ওঠে না। সেফ নয়। রাতে পার্টি অফিসে বসে মিটিং করবার সময় সতর্ক থাকতে হয়। কে কখন বোমা মেরে, আগুন ধরিয়ে দিয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। অনেক জায়গায় ব্রাঞ্চ, লোকাল অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুখে বলে দেওয়া হয়েছে, অফিসে বসে কাজকর্ম দিনের বেলায় সেরে ফেলতে হবে। সরাসরি কনফ্রনটেশনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পুলিশ, পাড়ার লোক কেউই এখন পাহারা দেবে না। সমস্যা হল, শুধুই অন্য দলের লোক হামলা চালাচ্ছে না, কোনও কোনও এলাকায় দলের পুরোনো বিক্ষুব্ধ সমর্থকরাও সুযোগ নিচ্ছে। তারাও অন্য দলের নামে হামলা করে যাচ্ছে বলে খবর আসছে। বড় সমস্যা হল আক্রমণ ঠেকাবার মতো লোক নেই। দলে লোক কমছে। কলকাতার বাইরে এরকম কয়েকটা ঘটনা ঘটছে। শেখর কিন্তু নিজের এলাকার পার্টি অফিস সন্ধের পরেও খুলছে। এই নিয়ে অন্য নেতাদের সঙ্গে তার মতের পার্থক্যও হয়েছে। কেউ কেউ আপত্তি করেছিল।

‘শেখরের এত সাহস দেখানোর কিছু হয়নি। পরিস্থিতি যেমন বলছে, তেমনভাবেই চলা উচিত। পার্টির লোকেরা মরলে এখন আর কেউ শহিদ বলবে না। সামনে ভোটও নেই। বরং যে দু-পাঁচজন সঙ্গে আছে, তারাও ঘাবড়ে যাবে।’

শেখর এ কথা শোনেনি।

‘মার খেতে হলে খেতে হবে। তার জন্য শহিদ সাজাবার দরকার নেই। কাউকে ধরবারও প্রয়োজন নেই। নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে মার খাব। পার্টি অফিসটা আমাদের, সেটা শুধু একটা ঘর নয়, ক্লাবের মতো গুলতানি দেওয়ার জায়গা নয়। তার সঙ্গে ভাবনাচিন্তা, নীতি, আদর্শ জড়িয়ে আছে। সেখান থেকে কেউ সরাতে গেলে অত সহজে সরব কেন? ভেঙে দিলে, পুড়িয়ে দিলে কী এসে যায়? আদর্শ-নীতি তো ভাঙা যায় না, পোড়ানো যায় না।’

‘শেখর, এ সব জ্বালাময়ী ভাষণ ভোটের সময় ভালো লাগে। রাতের অন্ধকারে এসে মারধোর করবে, তখন ভালো লাগবে না। হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হব নাকি?’

শেখর রেখে গিয়ে বলেছে, ‘হাসপাতালে যেতে হলে যেতে হবে। যার ইচ্ছে সে আসবে। যার নীতি-আদর্শ ভেঙে যাওয়ার থেকে হাত-পা ভেঙে যাওয়ার বেশি ভয়, সে আসবে না। বলতে লজ্জা নেই, একদল নেতা, কর্মী, সমর্থক একসময় পার্টি অফিসটাকে পাড়ার ক্লাবের মতো ব্যবহার করতেন। সন্ধেবেলা অফিস সেরে, স্নান করে, পাউডার মেখে আড্ডা দিতে আসতেন। পাওয়ারের সঙ্গে খানিকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গেলাম। পাড়ায় একটা সুবিধে হবে, অফিসে ট্রান্সফার আটকানো যাবে, ছেলেমেয়েকে এমএলএ, এমপি ধরে ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি করা যাবে। গত পাঁচ বছর ধরে সে সুবিধে না থাকায় আসা-যাওয়া কমে গিয়েছিল। ভোটের আগে আবার খানিকটা জমেছিল। যদি ক্ষমতা ফিরে আসে, এখন আবার কমেছে। এদের পার্টি অফিসে এসে ভিড় না করাই মঙ্গল। সরি, আমি এইসব কর্মী-সমর্থকদের জন্য পার্টি অফিসে তালা দিতে পারব না।’

কেউ কেউ মাথা নামিয়ে বলেছে, ‘শুধু অন্য দলের লোক নয়, আমাদের ওপর খেপে থাকা পাবলিকও পেটাবে।’

মুখে এত কথা বললেও রাত করা বন্ধ করে দিয়েছে শেখর। সত্যি যদি কোনও হামলার ঘটনা ঘটে আর তাতে কেউ আহত হয়, তা হলে দায়িত্ব তার ঘাড়েই পড়বে। যদিও হামলা দিনের আলোতেও হতে পারে। তাও এই পরিস্থিতিতে সাবধানে থাকাই উচিত।

এখন কি এক কাপ চা খাবে? না থাক, তমসা ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। শান্তর কাল পরীক্ষা। শান্ত সে ঠিকমতো স্কুল যাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, এটাই যথেষ্ট। তমসাও স্কুলে যাচ্ছে। ভোটের ফল ঘোষণার সময় মনে হয়েছিল, পাড়াছাড়া হতে হবে। সেসব হয়নি। স্কুলে তমসাকে একটু বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে এইটুকু যা। জিওগ্রাফির টিচার সুচরিতা নাগ বলেছেন, ‘কী তমসা, তোমরা যে বললে এত মহিলা রোজ রেপড হচ্ছেন? মেয়েরা পথে বেরোতে পারছেন না। সে সবের কী হল? তাঁরা কাকে ভোট দিলেন?’

তমসা উত্তর দিয়েছিল, ‘ভোটে জিতলেই ঘটনা মিথ্যে হয়ে যায় না সুচরিতাদি। মেয়েদের প্রতি অসম্মান, অন্যায়, অত্যাচার হয়েছে সেগুলো সবসময়ই সত্যি হয়ে থাকবে।’

সুচরিতাদি বললেন, ‘আহা, আমি তা বলিনি তমসা। আমি বলিনি, মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়নি। আমি বলছি, তারপরেও মহিলারা ভোটটা কাকে দিল?’

তমসা কথা বাড়ায়নি। বাড়িতে এসে শেখরকে বলতে সে বলল, ‘গায়ে মেখো না।’

তমসা চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘সুচরিতার বিদ্রুপ যতটা অপমানের তার থেকে বেশি অপমানের কথাটার ঠিক মতো জবাব দিতে না পারা। সত্যি যদি মহিলাদের প্রতি অপমান, অসম্মান বেশি হয়, তা হলে মহিলারা কেন বিরুদ্ধে ভোট দিল না?’

শেখর চিন্তিতভাবে বলল, ‘পার্টি নিশ্চয় বিষয়টা নিয়ে ভাববে। আমরা কি মানুষকে বোঝাতে পারলাম না? নাকি মানুষ আমাদের কথা বুঝতে চাইলও না? আবার এমনটাও হতে পারে, আমরা বেশি প্রচার করেছি। মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যা মেলেনি। এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রচারের আগে দশবার ভাবা উচিত, কতটা যাব। এরপর যখন সত্যি ঘটনাগুলো ঘটবে তখন আর মানুষ আমাদের বিশ্বাস করবে না। বুঝতে চাইবে না।’

তমসা বলল, ‘কেউ বোঝেনি বললে কী করে হবে? অনেক মানুষ তো বুঝেছেও।’

শেখর বলল, ‘তারপরেও বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।’

না, এখন আর চা নয়। তমসাকে করতে হবে। শেখর কবিতার বইটা আবার টেনে নিল।

ছিল বটে সেই সব দিন।

বুদ্ধি ছিল প্রতিবন্ধ,

ছিল ফুলহীন পুষ্পগন্ধ—

ঐতিহ্য নবীন।

তমসা ঘরে ঢুকল। বরের কাছে এসে বলল, ‘কী পড়ছ?’

শেখর বই উলটে দেখাল। বলল, ‘পড়ে দেখো, ভালো লাগবে।’

তমসা বলল, ‘আচ্ছা পড়ব।’

শেখর বলল, ‘না, থাক। খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।’

তমসা শেখরের কাঁধে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’

শেখর বলল, ‘না, একটু টায়ার্ড ফিল করছি। লম্বা মিটিং ছিল।’

তমসা গলায় সামন্য বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এবার এ সব কমাও। আমিও সব কমিয়ে দেব ঠিক করেছি।’

শেখর মুখ ঘুরিয়ে বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন? পার্টি ভোটে হেরে গেছে বলে?’

তমসা বলল, ‘ঠিক উলটো। হেরে গেছে বলে পার্টির হা হুতাশ দেখে ঘেন্না হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই পার্টির জন্ম হয়েছিল, শুধু ইলেকশনের জন্য। পার্টির যার সঙ্গে দেখা হয়, সেই মুখ শুকিয়ে বলে, কী হল বলো তো। যেন পার্টির নীতি-আদর্শ সব বরবাদ হয়ে গেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’

শেখর অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘বড় আঘাত তো বটেই।’

তমসা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ তোমার কী হয়েছে বলো তো। মিটিংয়ে ঝগড়া হয়েছে।’

শেখর শান্ত ভাবে বলল, ‘কিছু হয়নি। মিটিংয়ে তর্ক-বিতর্ক তো লেগেই থাকে। কমিউনিস্ট পার্টিতে তর্ক-বিতর্কটাই আসল।’

শেখর মুখে যাই বলুক, আজকের তর্ক অন্য দিনের মতো নয়। সে যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু আজ তার মন ভেঙেছে। মিটিংয়ে তর্ক শুরু হয়েছিল বিজয়ের সঙ্গে, পরে সৌমাল্য, ঋত্বিক, প্রশান্তদা জয়েন করে। মিটিংয়ে স্থানীয় ভাবে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছিল। কেন এই এলাকার পার্টি এত কম ভোট পেল তাই নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছে জেলা কমিটি। ভোটের প্রচারে স্থানীয় ইস্যুতে কোনও ফাঁক ছিল কি না, মানুষের মন বুঝতে কোথাও অসুবিধে হয়েছে কি না, পার্টির কর্মীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল কি না। শেষ পর্যন্ত শেখরকে সবাই মিলে আক্রমণ করল। এমনকী এতদিন তার গোষ্ঠীতে যারা ছিল তারাও ছেড়ে কথা বলেনি। তমসার স্কুলের সুচরিতাদির প্রশ্নের মতো অনেক প্রশ্নের উত্তর শেখরও দিতে পারেনি।

বিজয় বলল, ‘পার্টির কর্মী-সমর্থকরা মানুষের মন বোঝবার থেকে আজও অনেক বেশি করে লিডারের মন বুঝতে ব্যস্ত থাকে। লিডার কী চাইছে, লিডার কী বলছে। লিডারের মন জুগিয়ে চললে পার্টিতে পজিশন থাকবে। গত পরাজয় থেকে কর্মীরা কোনও শিক্ষাই নেয়নি। আমাদের এখানেও তাই হয়েছে। শেখর বলে দিয়েছিল, ভোটের প্রচারের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের মন বুঝতে হবে। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। মানুষের মন বুঝতে পারিনি। কিন্তু শেখরকে রিপোর্ট করেছি উলটো। তাকে খুশি রাখতে হবে যে।’

শেখর বলে, ‘এটা যে করেছে সে পার্টি বিরুদ্ধ কাজ করেছে। আমাকে নয়, পার্টিকে মিসগাইড করেছে।’

বিজয় বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘এ সব বইয়ের কথা এবার বাদ দাও শেখর। এখানে পার্টি কে? পার্টি তো তুমি। আমরা যদি এসে বলতাম, মানুষের মন বুঝতে পারিনি, তুমি খুশি হতে?’

শেখর বলে, ‘আমি সত্যিটা জানতে পারলাম না। গতবারের মতো এবারও জেলাকে ভুল রিপোর্ট দিয়েছি। বলেছি, জিতব। সেটা আপনাদের ভুল রিপোর্টের জন্য হল।’

সৌমাল্য তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘বাঃ, এটা তো মন্দ নয়। সব আমাদের দোষ শেখরদা? আর আপনি সেক্রেটারি হয়ে কোনও দায় নেবেন না?’

শেখর বলল, ‘অবশ্যই নিচ্ছি। আলটিমেট তো সেক্রেটারির রেসপন্সিবিলিটি।’

প্রশান্তদা দুম করে বলল, ‘এ সব অনেক শুনেছি, গতবার থেকেই শুনছি। ভুল রিপোর্ট পাঠানোর জন্য কোন নেতার শাস্তি হয়েছে বলো তো শেখর? পার্টি খারাপ রেজাল্ট করলে, সেক্রেটারির শাস্তি হবে না কেন? সে কে? কেন তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে না?’

শেখর চুপ করে রইল। এ সব তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। ঋত্বিক বলল, ‘কজন সেক্রেটারিকে সরানো হবে? সর্বত্র তো হার হয়েছে।’

প্রশান্তদা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘যারা ভুল রিপোর্ট দিয়েছে তাদের সবাইকে সরানো উচিত। নেতা হওয়ার তো কারও পৈতৃক অধিকার নয়। পার্টি তো কারও জমিদারি নয়। তুমি পারোনি, একবার নয়, বারবার পারোনি। তা হলে তুমি সরে যাও। আর একজনকে সুযোগ দাও। এরা পার্টির হিরো নয়, ভিলেন?’

শেখর কড়া গলায় বলল, ‘আপনি কিন্তু বেশি মাত্রায় উত্তেজিত হচ্ছেন প্রশান্তদা। এ ভাবে পার্টিতে মিটিং হয় না। একটা ডিসিপ্লিন আছে।’

বিজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘রাখো তোমার ছড়ি ঘোরানো ডিসিপ্লিন। পার্টির নেতা মানে বস নয়। সাধারণ মানুষ আর কর্মীদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর নাম ডিসিপ্লিন? এই জন্যই তো এই হাল। নেতাদের উচিত ছিল নিজে থেকেই সরে যাওয়া।’

শেখর বলল, ‘এই মিটিং লোকাল কমিটির সেক্রেটারি সরানোর জন্য ডাকা হয়নি।’

প্রশান্তদা বলল, ‘পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলোচনা করতে হলে নেতার ব্যর্থতা নিয়েও বলতে দিতে হবে। অনেক সহ্য করেছি, আর করব না। পার্টি কারও পিতৃদেবের নয়।’

সৌমাল্য বলল, ‘তুমি একা কেন শেখরদা, দায় আমরাও নেব। বোঝাতে পারিনি, মানুষকে বোঝাতে পারিনি তাহলে আর কেন পার্টি করছি? শুধু অন্য দলকে গাল দিয়েছি। দিয়ে খুশি থেকেছি। নিজেদের পায়ের তলার মাটি নিয়ে ভাবিনি।’

বিজয় বলল, ‘আসলে পার্টির ক্লাস ক্যারেকটারটাই বদলে গেছে। তারাই এখন পার্টিকে সাপোর্ট করছে যাদের মোটা মাইনের চাকরি আছে, বড় লাভের বিজনেস আছে। বাড়িতে ফ্রিজ, এ সি আছে। গাড়ি আছে। তারা সব আমাদের পার্টির লোক। তারাই আমাদের কাছে এসেছে যারা নিজেদের ডি এ, এ টি, বোনাস নিয়ে ব্যস্ত। আরও চাই, আরও চাই। লাখ টাকার রোজগারিরা আমাদের এবারও ভোট দিয়েছে। অথচ কমিউনিস্ট পার্টিটা তৈরি হয়েছিল গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। যার কিছু নেই তারা ছিল পার্টির নেতা।’

শেখর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বলে বসল, ‘আমারও কিছু নেই। আমি একজন হোলটাইমার।’

বিজয় ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘এটা কী বলছ শেখর! তোমার স্ত্রী একজন সরকারি স্কুল শিক্ষক। কত টাকা বেতন পান তুমিই ভালো করে জানো। এরপরেও নিজেকে সর্বহারা বলে চালাও, গরিব মানুষরা হাসবে।’

শেখর কঠিন গলায় বলল, ‘তমসা নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে।’

বিজয় বলল, ‘আমি তো বলিনি, তাকে কেউ চাকরি করে দিয়েছে। সে নিজের যোগ্যতাতেই লেখাপড়া শিখে কাজ পেয়েছে, আমি বলছি, দয়া করে তুমি নিজেকে দরিদ্র বলো না শেখর। পরিবারের উপার্জনটা মাথায় রেখে নিজের শ্রেণি চরিত্র বিচার করো। এটাই নিয়ম।’

শেখর বলল, ‘তা হলে দরিদ্র না হলে তাকে নেতাই করা যাবে না।’

বিজয় বলল, ‘জানি না করা যাবে কি না, কিন্তু একজন জমিহারা কৃষক, একজন বন্ধ হাওয়া কারখানার শ্রমিক নেতৃত্বে না থাকলে গরিব মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবে কেন? নেইও। তারা উলটো দিকে চলে গেছে। যে দলকে কোনও লাখপতি সমর্থন করছে, তাকে কিছুতেই কপর্দকহীন একজন মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। পার্টি চরিত্র হারাচ্ছে। এটা আগে বোঝো শেখর।’

মিটিং এখানেই বন্ধ করে দিতে হয় শেখরকে। স্পষ্ট তার বিরুদ্ধে অনাস্থা। অনাস্থা হবে নাই বা কেন? সত্যি তো তার নিজের দায়িত্ব সবথেকে বেশি। বড় বড় কথা শুধু দলের কর্মীদের বলেছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেনি। আর করলেও বা কী হত? হয়তো ভোটে জিতত। কিন্তু ক্লাস ক্যারেকটার? তার উত্তর কী?

রাতে শোওয়ার পর তমসা কাছে এল। শেখরের পাশে বসে জামা খুলতে খুলতে গাঢ় গলায় বলল, ‘এসো। আজ তুমি খুব অস্থির। আমার কাছে এসে শান্ত হও।’

শেখর তমসার নগ্ন বুকে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না তমসা।’

তমসা শেখরের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘চলো, কদিন কোথাও ঘুরে আসি। ফিরে এসে ভুল শুধরে আবার কাজ শুরু করবে। করতেই হবে।’