» » ষষ্ঠ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

তিপ্পান্ন

কর্ণিকার মন খারাপ।

সে আজ অফিসে রেজিগনেশন লেটার জমা দেবে। এই চাকরিতে সে যে বহুদিন জয়েন করেছে এমন নয়। বরং সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের বেশিরভাগ কর্মীই তার থেকে সিনিয়ার। তার পরেও কোম্পানি তাকে গুরুত্ব দিয়ে উঁচু পদে বসিয়েছে। অফিসে কাজের পরিবেশও ভালো। কাজের এমন পরিবেশ আর কোথাও পেত না। পাবে না। সুদূর আমেরিকায় বসে সুস্নাত এই মনখারাপের কথা শুনে অবাক হয়েছে।

‘কোম্পানি ছাড়ছ বলে তুমি আপসেট হয়ে পড়েছ কনি।’

দ্বিতীয় দিন থেকে সুস্নাত তাকে ‘কনি’ ডাকছে। এত দ্রুত ‘কনি’ ডাকে লজ্জা লজ্জা করছে, আবার ভালোও লাগছে। ‘এই অফিসটা আমার খুব ভালো লাগে।’

সুস্নাত বলেছে, ‘অফিস ভালো লাগা মন্দ লাগার কী আছে। অফিস ইজ অফিস।’

কর্ণিকা বলেছে, ‘বাঃ যেখানে কাজ করি সেই জায়গাটা ভালো না লাগলে কাজ করব কী করে?’

সুস্নাত হেসে বলে, ‘এখানে তোমার আরও ভালো লাগবে। নিজের জায়গায় কাজ করবে। আমার ফার্ম মানে তো তোমার ফার্ম।’

কর্ণিকা এই কথাতেও লজ্জা পায়। মানুষটার সঙ্গে তার ভালো করে পরিচয়ই হয়নি, শুধু টেলিফোনেই যা কথা হয়েছে, অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন বিয়ে হয়ে গেছে। হয়তো এরকমই হয়। যখন ভালো লাগার তখন অতি অল্প আয়েসেই ভালো লেগে যায়।

প্রথম ফোনালাপের পরদিনই মিসেস বোস কর্ণিকার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ছেলের বিয়ের বিষয়টা দ্রুত শেষ করতে চাইছেন। সব ঠিক থাকলে পরের মাসেই সুস্নাত আসবে। রেজিস্ট্রি করে বউকে নিয়ে চলে যাবে। এর মাঝখানে কর্ণিকাকে পাসপোর্ট ভিসার জন্য ছোটাছুটি করতে হবে। এসব জায়গায় মিসেস বোসের চেনাজানা আছে। তৎকালে অ্যাপ্লাই করতে হবে।

ভিসার জন্য ওদেশ থেকে সুস্নাত কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবে। এই কাজের জন্য সময় দিতে হবে। অফিসে, পুলিশের দপ্তরে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে। কর্ণিকা ভেবেছিল অফিস ছুটি নেবে। মিসেস বোস এ ব্যাপারে তাকে অন্য পরামর্শ দেন।

‘ছুটির কী দরকার কর্ণিকা? তুমি রিজাইন কর।’

কর্ণিকা আকাশ থেকে পড়েছিল।

‘চাকরি ছেড়ে দেব।’

মিসেস বোস বলেছিলেন, ‘আজ না হোক, কাল তো ছেড়ে দিতেই হবে। এখনই বরং চিঠি দিয়ে দাও। দিয়ে পাওনা ছুটি নিয়ে নাও।’

কর্ণিকা বলেছিল, ‘যে ক’টা দিন পারি করি…।’

মিসেস বোস শাশুড়িসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিলেন, ‘সেটা তোমার ব্যাপার। তবে উচিত হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখ। তুমি একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে আছ। তোমার বদলে অফিস সেখানে একজনকে আনবে। তাদের সময় লাগবে। সেই সময়টা তাদের দেওয়া উচিত। তা ছাড়া…তা ছাড়া…বিয়েটা যখন ফাইনাল হয়ে গেছে, এখন রোজ অফিসে না গিয়ে তোমার উচিত বাড়ির সবার সঙ্গে সময় কাটানো। শুধু তো বিয়ে নয়, তুমি অনেকটা দূরেও চলে যাচ্ছ। আমার বিয়ের পর আমারও এরকম একটা ফিলিংস হয়েছিল। আপশোস বলতে পার। মনে হয়েছিল, ইস, ক’টা দিন যদি শুধু বাড়িতে থাকতাম। যাক, তুমি ভেবে নাও।’ কথা থামিয়ে হেসে মিসেস বোস বলেছিলেন, ‘তবে আমাকে ক’টা দিন সময় দিতে হবে কিন্তু। না বললে চলবে না। তোমাকে নিয়ে কেনাকাটা আছে। কয়েকজন আত্মীয়ও তোমাকে দেখতে আসবেন।’

মিসেস বোস চলে যাওয়ার পর মাও মেয়েকে বোঝাল। অফিসে জানিয়ে দেওয়াই ভালো। ‘বুঝব না, বুঝব না’ ভেবেও শেষ পর্যন্ত কর্ণিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ না হোক, কাল তো ছাড়তেই হবে। মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

সে কাল রাতে রেজিগনেশন লেটার লিখেছে। অফিসিয়াল হয়নি। অনেকটাই ব্যক্তিগত ছোঁয়া রয়ে গেছে। প্রথমে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেও দু-এক লাইন পরেই সেই চিঠি বাতিল করে কর্ণিকা। বাংলায় লেখে।

‘শ্রী বিমলকান্তি সেন

ম্যানেজিং ডিরেক্টর

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।

মাননীয় মহাশয়

আগামী মাস থেকে আমি আর আপনার সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছি না। আমাকে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যেতে হচ্ছে। নতুন কোনও চাকরির জন্য নয়, একান্তই ব্যক্তিগত কারণে যাচ্ছি। আমার এই চিঠি পদত্যাগপত্র হিসেবে গ্রহণ করলে বাধিত হব। আপনি যদি অনুমতি দেন, এই সপ্তাহ থেকেই আমি ছুটিতে চলে যেতে পারি। বিদেশে যাওয়ার জন্য জরুরি কিছু কাজ আমাকে করতে হবে। ছুটি পেলে সেই কাজগুলি করব। তার আগে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব, বকেয়া কাজ সেরে ফেলতে। জানি, আরও আগে আপনাদের জানালে ভালো হত, কিন্তু আমার বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি হঠাৎই ঠিক হয়েছে। আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না।

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ছেড়ে চলে গেলেও আমি সেই সংস্থাকে কোনওদিন ভুলতে পারব না। আপনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তার জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি। এই কোম্পানির সঙ্গে আমি মনের দিক থেকেও জড়িয়ে পড়েছি। এখানে আমি আর আসব না, কিন্তু আমার মন এখানেই থাকবে। আপনার অধীনে কাজ করবার মতো যোগ্যতা আমার ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আপনার পরিচালনা, নির্দেশ এবং স্নেহে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগছে। তারপরেও আমাকে যেতে হচ্ছে। জীবনের এক একটা বাঁকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা এড়ানোর উপায় থাকে না।

আপনি ভালো থাকবেন। আমার প্রণাম জানবেন।’

এই চিঠি শেষ করে কর্ণিকা আরও একটি চিঠি লিখতে বসল। অন্ধকার ঘরে টেবিল ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, সাদা পাতায় কেউ খানিকটা সোনালি রং ঢেলে দিয়েছে।

‘অর্চিন, কেমন আছ? নিশ্চয় ভালো আছ।

আসলে, সকলেই ভালো থাকবার জন্য নিজের মতো পথ বেছে নিতে চায়। কেউ পারে, কেউ পারে না। তুমি পেরেছ। ভালো থাকবার জন্যই পছন্দের পথ বেছে নিয়েছ। কেরিয়ার ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে, শহর ছেড়ে চলে গেছ গ্রামে। যতদূর জানি, তোমাদের মতো মানুষ বিশ্বাস করে, ভালো শুধু নিজে থাকলে হয় না, অন্যদেরও ভালো রাখতে হয়। তাই তো? কথাটা কি বেশি সরল হয়ে গেল? হোক গে। আমি একটা বোকা মেয়ে। আমার কথায় গা কোরো না। কী বলতে কী বলে ফেলি তার ঠিক নেই। অবশ্য আমি জানি তুমি গা করবেও না। কখনও তুমি আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি। শুধু কথা কেন? আমাকেও গুরুত্ব দাওনি। প্রথম প্রথম দুঃখ পেতাম। যে মেয়েটি তোমাকে পেয়েছে, তার ওপর হিংসে হত। তোমার ওপর রাগ হত। তারপর ধীরে ধীরে বুঝলাম, ঠিকই হয়েছে। তোমার মতো মেধাবী ছেলের জন্য আমি নই। শুধু বই পড়া বিদ্যে নয়, চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কেও তোমার ধারণা স্পষ্ট। আর পাঁচটা ‘গুড বয়’-এর মতো তুমি স্বার্থপর নও। তোমার সঙ্গে আমাকে কখনওই মানাত না। আমি খুবই সাধারণ। তোমার থেকে বয়েসে একটু বড় হয়েও, একটু বোকা। তাই আমি হিংসে, রাগ সবই ধাপে ধাপে ভুলতে থাকি। মনে মনে নিজেকেও তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছি। তারপরেও কখনও কখনও পারিনি। কখনও কখনও ভালোমন্দ কিছু হলে ইচ্ছে করেছে তোমাকে জানাই। দুম করে ফোন করে বসেছি। সাধারণ বলেই করেছি। অবশ্য তুমি তখনও গুরুত্ব দাওনি। ঠিকই করেছ। আবার বলছি, আমি তোমার গুরুত্ব পাবার যোগ্য নই।

অর্চিন, আমি রাজনীতি বুঝি না। আরও কঠিন করে বলতে গেলে, রাজনীতি আমার ভালোও লাগে না। এর থেকেও যদি কঠিন কথা বলতে হয়, তাহলে বলব রাজনীতি যারা করে তাদেরও পছন্দ করি না। মনে হয়, তারা হয় ভণ্ড, নয় তারা ভুল পথে হাঁটছে। মানুষকে মিথ্যে কথা বলে, বোকা বানিয়ে তারা নিজেদের আখের গোছায়। আমাদের দেশে রাজনীতির পবিত্রতা অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে, তা ব্যতিক্রমই মাত্র। আমার বড়মামা কলেজ জীবনে ছিলেন কড়া বিপ্লবী। ছেলেমেয়েদের নেতা ছিলেন। পুলিশের ধরপাকড় থেকে বাঁচতে আমার দাদুর সাহায্য নিয়ে বিদেশে পালালেন। আর যাদের খেপিয়েছিলেন, তারা কলকাতার অলিগলিতে হয় পুলিশের গুলিতে মরল, নয় ধরা পড়ে জেল খেটে জীবন নষ্ট করল। আমার বড়মামা কয়েক বছর আগে তার মেমসাহেব বউ আর আধা বাঙালি ছেলেমেয়ে রেখে বিদেশেই মারা গেছেন। আর রেখে গেছেন বিপুল সম্পত্তি। মৃত্যুর পর কারও সম্পর্কে নিন্দে করতে নেই। নিজের আত্মীয়স্বজনকে তো নয়ই, কিন্তু এই মামাকে ভণ্ড ছাড়া আর কী বলতে পারি অর্চিন? আমার মনে হয়, রাজনীতি মানুষকে ভুল পথে চলতে শেখায়। শেখায় নিজের দায়িত্ব পালন না করে, নিজের কাজ না করে শুধু দলাদলি করতে। পাশের মানুষকে শত্রু ভাবতে শেখায়। নয়তো আদর্শ, বিশ্বাসের নামে কোনও দল আর কিছু নেতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বলে। সেই দলের, নেতার হাজার ভুল থাকলেও মুখ ফুটে বলবার অধিকার থাকে না।

অর্চিন, এসব কথা পড়ে তুমি নিশ্চয় খুব অবাক হচ্ছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, আমার মতো একটা সাধারণ, বোকা, কেরিয়াসর্বস্ব একটা মেয়ে এত কথা শিখল কোথা থেকে! তাই তো? আমিও অবাক হচ্ছি। কোথা থেকে এসব বড় কথা আমি শিখলাম তার জন্য অবাক হচ্ছি না, অবাক হচ্ছি, তোমাকে বলবার সাহস কোথা থেকে পেলাম সেটা ভেবে।

অর্চিন, সাধারণ মানুষ একেবারে কিছু বোঝে না, কিছু ভাবে না এমনটা মনে করা ঠিক নয়। তাদেরও একটা মত আছে। ধরতে পারো সেটুকু জানাবার জন্যই তোমাকে এসব বললাম।

আশা করি, তুমি ভুল বুঝবে না। তোমার যে জীবন তুমি বেছে নিয়েছ তাকে আমি ছোট করছি না। হয়তো তুমি আমার মতো বহু সাধারণ মানুষের ধারণা ভেঙে দেবে। প্রমাণ করবে, রাজনীতি মানে ভাণ্ডামি নয়, রাজনীতি মানে ভুল পথে চলা নয়, রাজনীতি মানে নিজের আখের গোছানো নয়। রাজনীতি, মানে অনেক বড় কিছু। আমি সেই কামনা করি। আশা করি, এমনটা হবে না যে-কোনও একদিন তুমিও বুঝবে, ভুল হয়ে গেছে। সব ছেড়ে চলে যাওয়া নয়, নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করলেও মানুষের জন্য কিছু করা যায়। আমি যে একটা কোম্পানিতে এতদিন ম্যানেজারের কাজ করেছি সেটা কি কিছু করা নয়? কোম্পানির সঙ্গে কত মানুষ জড়িত। কোম্পানি ঠিকমতো চলার ওপর তাদের জীবন, তাদের সংসার নির্ভর করে। শুধু অফিসে চাকরি নয়, যে গরিব মালবাহক আমাদের প্রাোডাক্ট ঘাড়ে করে ট্রেনে তুলে দেয়, জাহাজে তুলে দেয়, তার জন্য কি খুব দূর থেকে আমি কোনও দায়িত্ব পালন করিনি? সবটাই কি কেরিয়ারসর্বস্ব আর সাধারণ মানুষ বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়?

যাক, খানিকটা রেগে গিয়েই হয়তো তোমার জগৎ, তোমার বিশ্বাসকে তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ করে বসলাম। কিছু মনে কর না। রাগ নাকি অভিমান? তোমার ওপর অভিমান করবার মতো অধিকার কি আমার আছে? কী জানি।

দেখছ, তোমাকে চিঠি লিখতে বসে রাগের বশে কত হাবিজাবি কথা লিখে ফেললাম? বাদ দাও এসব। ভুলে যাও। তোমার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটা কি তোমার মনে আছে অর্চিন? আমার মনে আছে। শুনবে?

জোর বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। যাদবপুরের এইট বি বাসস্ট্যান্ডে একটা অটোতে বসেছিলাম। অটো দাঁড়িয়ে ছিল ট্রাফিক আলোয়। বৃষ্টির ছাঁদে ভিজেও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে তুমি ছুটে এসে, রাস্তা পার হয়ে অটোতে উঠতে গেলে। ভিজে একশা। আমি খুব কড়া গলায় বললাম, এখানে কোথায় বসবেন? দেখছেন না, আমরা কীভাবে চেপেচুপে বসে আছি? তুমি হকচকিয়ে গেলে। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। তোমার মাথায় ছাতাও ছিল না। একটা ব্যাগের মতো কী যেন মাথার ওপর ধরে ছিলে। তুমি খানিকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চশমার কাচ মুছতে মুছতে রাস্তার পাশে চলে গেলে। ট্রাফিকের সবুজ আলো পেয়ে অটো আবার ছুটতে শুরু করল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অতি অবহেলায় তোমাকে একবার দেখতে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি ভিজছ। দু-পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। তোমাকে বৃষ্টিধোয়া শহরের রাস্তায় কী যে অমলিন লাগল! মুহূর্তের মধ্যে আমার কী যেন হল! মনে হল, বিরাট একটা অন্যায় করেছি। আমি একটু সরে বসলেই একজন রোগাসোগা ছেলের জায়গা হয়ে যেত। হয়তো হত না। আমি আর দেরি করিনি। অটো থামিয়ে নেমে পড়ি। কোনওরকমে ছাতা খুলে তোমার কাছে পৌঁছেও যাই। তুমি তখন রাস্তার পাশে পৌঁছেছ। আমাকে দেখে চিনতে পারলে না। আমি বললাম, সরি। তুমি অবাক হয়ে তাকালে। সেই চোখ আজও আমি দেখতে পাই। মনে পড়ছে অর্চিন? আমরা ভিজতে ভিজতে অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম। যা ছিল গল্পের থেকেও অসম্ভব। এই জন্যই বলে জীবন গল্প উপন্যাসের থেকেও বিস্ময়কর, আকস্মিক।

অর্চিন, কোনওদিন বলিনি, আমি সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারিনি, নির্লজ্জের মতো তোমার মোবাইল ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছিলাম।

তুমি আমাকে কোনওদিনই ভালোবাসনি, অর্চিন, অবহেলাই করেছ শুধু, অপমান করেছ। তারপরেও তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। কেন? আমি জানি না। আমার ধারণা, কোনও ভালোবাসার পেছনেই কারণ থাকে না। থাকে না বলেই ভালোবাসা এত সুন্দর। আমার ভালোবাসাও সুন্দর।

অর্চিন, আমি বিয়ে করছি। বিয়ে করে বিদেশে চলে যাচ্ছি। আমার যে বর হতে চলেছে সেই ছেলেটি খুব ভালো। ভীষণ ব্রাইট। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে সে তার কেরিয়ার তৈরি করেছে। আমার সঙ্গে ক’টা কথা বলেই সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। আমার রূপের নয়, আমার কাজের। এখন অবশ্য অন্য কথা। আমাকে ফোন না করলে ছটফট করে। ছেলেটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে এখনও ভালোবাসতে পারিনি। সম্ভবত ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অনাগ্রহ, অবহেলা পেয়ে আমার বিচ্ছিরি অভ্যেস হয়ে গেছে। অভ্যেস বদলাতে হবে। মনে হয় পেরে যাব। তোমার কী মনে হয়? খুব ভালো থাক। তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক। যদি পার ঋষাকেও তোমার স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে নাও। মেয়েটা তোমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমার থেকে অনেক অনেক বেশি। সে তোমার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করবে। আমার মতো দামি বর পেয়ে গলায় ঝুলে পড়বে না। ঋষা সাধারণ নয়।

টা টা।’

চিঠি  লেখা শেষ করে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়েছিল কর্ণিকা। তারপর দীর্ঘক্ষণ সেই চিঠির পাতা গালে চেপে ধরে নিঃশব্দে কেঁদেছে। চোখের জল আর চিঠির লেখা মাখামাখি হয়ে গেছে।

শেষরাতে চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে চোখ মুছেছে কর্ণিকা।