» » ষষ্ঠ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

বাহান্ন

কিছু কিছু মানুষকে বয়েস লুকোতে হয় না। বয়স নিজে থেকেই লুকিয়ে থাকে।

সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট-এর নিখিলেশ উপাধ্যায় সেরকম একজন। তাঁকে দেখে কে বলবে মানুষটার বয়স সত্তর বছর ছুঁই-ছুঁই? ফিটফাট চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখে সবসময়েই একধরনের হাসি লেগে আছে। হাসি ঠিক নয়, হাসির ছায়া। সেই ছায়ায় একইসঙ্গে প্রশ্রয় আছে, আবার ‘বস’ সুলভ কাঠিন্যও রয়েছে। কাছে টানবে, আবার দূরেও ঠেলবে। এটা সহজ ব্যাপার নয়। কর্মক্ষেত্রের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রপ্ত করা সম্ভব। সবাই পারে না, কেউ কেউ পারে। কাজের জায়গায় ব্যক্তিত্ব মানে শুধু গাম্ভীর্য নয়, এটা বুঝতে সময় এবং বুদ্ধি লাগে। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের দুটোই আছে।

মানুষটা এই কোম্পানিতে আছেন প্রায় গোড়া থেকে। কমলকান্তি সেন নিয়েছিলেন। নেওয়ার পিছনে মজার কারণ ছিল।

সেই সময় অনেকেই কাজের জন্য কমলকান্তি সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। চাকরি চাই। অফিসে সারাদিন, বাড়িতে সকালের দরবারে প্রচুর আবেদন। রোজই কেউ না কেউ আসছে। তাদের বেশিরভাগই সঙ্কুচিত। যোগ্যতা থাকলেও কাঁচুমাচু। চাকরির জন্য চেষ্টা করাকে বাঙালি জাতি অতি নিম্নস্তরের একটা জিনিস বলে মনে করে। যেন কাজ খোঁজাটা খুবই লজ্জার একটা বিষয়। ভিক্ষে চাইতে বেরিয়েছে। যে কাজ খোঁজে সে সবসময় মাথা নীচু করে থাকে, হাত কচলায়। ভাবটা হল, বিরাট অপরাধ করে বসেছে। এই অপরাধের জন্য তার নরকে স্থান হওয়া উচিত। নেহাত হাতের কাছে নরক নেই তাই বাঁচোয়া। বাঙালি চাকরিপ্রার্থী চিরকুণ্ঠিত, চির অনবত। এর জন্য দায়ী যারা কাজ দিতে পারে তারা। সে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীই হোন, বড় কোম্পানি কর্তাব্যক্তিই হোন, ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বারই হোন, পাড়ার মাতব্বরই হোন, ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বড়মামা, মেজোকাকাই হোন। এঁরা সকলেই চাকরীপ্রার্থীকে হেয়জ্ঞান করেন। গরিব দেশে যার হাতে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা আছে, সে হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের হাবভাব হল, বিরাট করুণা দেখাচ্ছে। অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে, তবে তা নগন্য। হিসেবের মধ্যে আসে না। যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলেও তাকে বিবিধ অপমানের মধ্যে পড়তে হয়। চাকরিদাতার জমিদারসুলভ মনোভাব বাঙালি চাকরিপ্রার্থীকে হীনমন্যতায় ভুগতে শিখিয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে এই জিনিস চলে আসছে। নিজেকে ‘ছোট’ ভাবা বাঙালি কর্মপ্রার্থীদের রক্তে ঢুকে গেছে। তুমি খেটে উপার্জন করতে চাও? তবে মাথা নামিয়ে থাকো। এটাই রীতি। এমনকী যোগ্যতার পরীক্ষা দিলেও এমনটা ঘটে। বাঙালি একটা কথা জেনে গেছে—

‘পরীক্ষা, ইন্টারভিউতে পাস করেছ বাপু, কিন্তু ধরা করা না করলে কিছু হবে না।’

এই আশঙ্কা যে সবসময় সত্যি এমন নয়। কোনও কোনও সময় যোগ্যতার পরীক্ষা থেকেও কাজকর্ম জুটে যায়, অতিরিক্ত ‘কারিকুরি’ লাগে না। কিন্তু তাতে বাঙালির ধারণা পালটায়নি। পালটানোর কথাও নয়। বাঙালি কর্মপ্রার্থীর হাল কেন এমন হয়েছে? এর জন্য দায়ী কে? যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তারা? নাকি সামাজিক ব্যবস্থাটাই এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে? যাতে কাজ জোটানোর সময় বাঙালির মেরুদণ্ড থাকে বেঁকে। এটা গবেষণার বিষয়। হয়তো কোনওদিন গবেষণা হবেও। এই দেশে অনেকরকম ‘সেন্টার’ আছে। তাদের গালভরা সব নাম। স্টাডি সেন্টার, সোশ্যাল সেন্টার, রিসার্চ সেন্টার। সেখানে বেশিরভাগ সময়েই ‘গবেষণা গবেষণা’ খেলা খেলে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সা ওড়ানো হয়। রাজ্য সরকারের বরাদ্দ, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান, বিদেশের গ্রান্ট—কতরকমের পথে যে এসব জায়গায় টাকা আসে! এসব সেন্টারে নানা বিষয়ে বছরের পর বছর গবেষণা চলে। সেই গবেষণার সময়সীমা অনন্ত। মহাকাশের মতো অসীম। যার শেষ নেই। উচ্চশিক্ষিত ছাত্রছাত্রী, যারা মূলত চাকরিবাকরি পায় না বা করতে চায় না অথবা চাকরির থেকে গবেষণাকে বেশি লাভজনক প্রাোজেক্ট বলে মনে করে, তারা এইসব গবেষণায় যুক্ত হয়ে পড়ে।  বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য সব বিষয়ে সুযোগ আছে। কে গবেষণায় সুযোগ পাবে তাও মূলত নির্ভর করে হাত কচলানোর ওপর। এখানেও ব্যতিক্রম আছে। অবশ্যই কিছু ভালো ছেলেমেয়ে সুযোগ পেয়ে যায়। তারা সিরিয়াসলি কাজও করে। কিন্তু সেটাও ব্যক্তিক্রম। এমনকী ভালোদের মধ্যে ‘ধরা করা’ থাকে। দুজন ভালোর মধ্যেও কে চান্স পাবে, তাই নিয়ে তদ্বির-তদারকি করতে হয়। দুনিয়ায় কত দুর্নীতি নিয়েই না তদন্ত হয়, কিন্তু গবেষণা দুর্নীতি নিয়ে কখনও তদন্ত হয় না। এসব সেন্টারে কারা ঢোকে, কে ঢোকায়, তারা কী কাজ করে, সেই কাজ দেশ দশের কোন কম্মে লাগে—সে-সব নিয়ে কখনও তদন্ত হয় না। এটা একটা ভালো দিক। রাজনীতির লোক ‘চোর’ হলে সমস্যা নেই। শিক্ষিত বা শিক্ষার উচ্চপদে আসীন কেউ ‘চোর’ হলে বিচ্ছিরি।

যা হোক, বাঙালি কেন চাকরি, প্রাোমোশন বদলির জন্য মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেল সে সম্পর্কে একদিন হয়তো এরকম কোনও স্টাডি সেন্টারে গবেষণা হবে। প্রাোজেক্টের নাম হবে ‘বাঙালি কর্মপ্রার্থীর হাত কচলানোর আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত।’ দশ বছরের কাজ। অর্থ বরাদ্দ সাড়ে সাত লাখ টাকা। দু’বার বিদেশে ভ্রমণ। একবার গবেষকের, একবার গাইডের।

আনন্দের কথা, সময় বদলাচ্ছে। কয়েক বছর হল, তরুণ বাঙালি কর্মপ্রার্থীরা মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছে। ছোটবড় কাজ নিয়ে ছুঁৎমার্গ ত্যাগ করেছে। চাকরি দিতে পারে এমন ‘ফুটো জমিদার’দের কাঁচকলা দেখিয়ে হয় বাইরের কোম্পানি, নয় ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। সেখানে নিজের যোগ্যতা নিয়ে কাজ করছে। বাঙালি প্রতিষ্ঠানগুলি হয় একটা পর একটা উঠে যাচ্ছে, নয় সুনাম তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। অন্য সবকিছুর মতো এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে। সে-ও হাতে গোনা গুটিকয়েক। বুক ফুলিয়ে থাকবার মতো বাঙালি প্রতিষ্ঠান ক’টাই বা অবশিষ্ট রয়েছে?

কমলকান্তি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস তৈরির সময় ঠিক করেছিলেন, এমন কোনও ব্যবহার করবেন না যাতে কর্মপ্রার্থীরা অসম্মানিত হয়। যোগ্যতা এবং প্রয়োজন না মিললে প্রার্থীকে নেওয়া হবে না ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে জমিদারসুলভ কোনও বদ আচরণ করা হবে না। তিনি সকলকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। ‘কোনও চাকরিপ্রার্থী আমাদের কোম্পানির জন্য অপ্রয়োজনীয় হতে পারে তার মানে এই নয়, সে একজন অযোগ্য মানুষ। তার সঙ্গে এমন কোনও ব্যবহার করা যাবে না, যাতে সে অপমানিত বোধ করে।’

কমলকান্তি সেনের এই সিদ্ধান্তে সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। বহু হাবিজাবি লোক চাকরির জন্য ভিড় করতে থাকে। চাকরি চাইতে গেলে বাবা বাছা করা হবে—এ সুযোগ কোথায় পাওয়া যাবে?

এরকমই দেখা করতে এসেছিলেন নিখিলেশ উপাধ্যায়। সেদিন কমলকান্তি খানিকটা বিরক্তই ছিলেন। সকাল থেকে লোক এসেই চলেছে। কিন্তু নিজেই তো নিয়ম করেছেন বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। নিখিলেশ উপাধ্যায় টেবিলের উলটোদিকে বসলে তিনি দ্রুত কথাবার্তা শেষ করতে চাইলেন। বায়োডাটার কাগজ উলটোনোর পর হাতে-গোনা দুটো প্রশ্ন করলেন।

‘আপনাকে এই সংস্থায় নেওয়া হবে কেন?’

নিলিলেশ উপাধ্যায় কোনওরকম দ্বিধা না করে বললেন, ‘আপনার কোম্পানি একজন যোগ্য ব্যক্তিকে পেয়ে লাভবান এবং গর্বিত হবে বলে।’

থমকে গেলেন কমলকান্তি। বললেন, ‘আর যদি কাজটা না পান?’

নিখিলেশ বলেছিলেন, ‘তাতে একটু অসুবিধে হবে। আমি যেখানে চাকরি করতাম, অফিসটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু বেশি বয়সে বেকার হয়ে পড়েছি। তবে সেটা কোনও বিষয় নয়। সাময়িক সমস্যা মাত্র। আপনার এখানে কাজ না পেলেও আমার অন্য কোথা থেকে অবশ্যই সুযোগ আসবে। সে যোগ্যতা আমার আছে। কিন্তু আমার মতো একজন কর্মচারী পাওয়ার সুযোগ আপনার আর না-ও আসতে পারে।’

কমলকান্তি এই কনফিডেন্সে খুবই খুশি হন। এই তো সাচ্চা বাঙালি! যে মিনমিন করে না, যে মাথা উঁচু করে চলে, মাথা উঁচু করে কথা বলে।

এরপর নিখিলেশ উপাধ্যায়কে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি কমলকান্তি। ছোট পদ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অনেক বড় জায়গায় চলে যান উপাধ্যায়। এমনকী নিজে সংস্থা থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেকে যখন দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝিয়ে দেন, তখনও মানুষটাকে ছাড়েননি কমলকান্তি। গোপন দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। কোনও কারণে বিমলকান্তি সমস্যায় পড়লে তাঁকে সাহায্য করতে হবে। অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হয়েছিলেন উপাধ্যায়। কৃতজ্ঞতার কারণেই রাজি হয়েছিলেন। নিখিলেশ উপাধ্যায় একটা সময় পর্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালনও করেছেন। বহু জটিলতা থেকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে উনি রক্ষা করছেন। বিমলকান্তি জানতেও পারেননি, উপাধ্যায় আসলে তাঁর বাবার প্রতিনিধি। বাবার চোখ এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করে চলেছেন।

কিন্তু মানুষের মন বড় গোলমেলে। সে শুধু সাদা বা কালো নয়, ধূসরও। সেই ধূসর রং কখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা কেউ বলতে পারে না। নিখিলেশ উপাধ্যায়ের বেলাতে এত বেশি বয়েসে তাই ঘটেছে।

তিনি লোভে পড়েছেন। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন। প্যাঁচে ফেলে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসতে চাইছেন যেখান থেকে বেরোনোর জন্য বিমলকান্তি সেন হাবুডাবু খাবে। কমলকান্তি সেন তাকে খবর পাঠাবে, এই জটিলতা থেকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে বের করে আনতে হবে। তিনি তাই করবেন। কিন্তু খুব বড় দাঁও মারবেন। আর সেটাই হবে এখানে তার শেষ কাজ।

নিখিলেশ উপাধ্যায় পরিকল্পনা করেছেন। কোম্পানির কারণেই আণ্ডারওয়ার্ল্ডের কিছু লোকের সঙ্গে তার চেনাজানা ছিল। ব্যবসার জন্য ভালো লোককে যেমন হাতে রাখতে হয়, খারাপকেও রাখতে হয়। তিনি এডি নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই এডি বৈশাখী সান্যালকে পাঠিয়েছে। এই মহিলা ঠকজোচ্চুরির কাজে নাকি খুবই পাকা। বহু জটিল কাজ করেছে। পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। এডি জানিয়েছে মহিলা কাজের ব্যাপারে পেশাদার। অ্যাসাইনমেন্ট নিলে কাজ শেষ করে। উপাধ্যায় বয়েসের কথা জিগ্যেস করেছিলেন।

‘বয়স কেমন?’

এডি বলেছে, ‘একটু বেশির দিকে।’

উপাধ্যায় নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘আমি বেশি বয়সই চাই।’

এই মুহূর্তে ভবানীপুরের কাছে একটা পুরোনো রেস্টুরেন্টে উপাধ্যায় এবং বৈশাখী মুখোমুখি বসে আছেন। চা, চপ-কাটলেটের রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টে উপাধ্যায়ের বিশেষ পরিচিতি। রেস্টুরেন্ট তৈরির সময় মালিককে টাকা দিয়েছিলেন। মালিক সেই টাকার পুরোটা শোধ করতে পারেনি। রেস্টুরেন্ট সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের বদলায়নি। এখনও সেই হলুদ আলো, পরদাটানা কেবিন। জায়গাটা উপাধ্যায়ের পছন্দ। প্রাইভেসি আছে। কর্মীরা নিখিলেশকে আলাদা গুরুত্ব দেয়। গোলমেলে কাজের কথা বলতে গেলে নিখিলেশ এখানে লোক ডেকে নেন। বড় কোম্পানি চালাতে গেলে গোলমেলে কথা বলতেই হয়। এখন একটু কমেছে এই যা। পেছনের দিকে একটা কেবিন বেছে নিয়েছেন নিখিলেশ। এখন দুপুরবেলা। তারপরেও কেবিনে আলো জ্বালাতে হয়েছে। রেস্টুরেন্টে লোকজনও নেই। একজন মাত্র বেয়ারা গোছের লোক সার্ভিসের জন্য রয়েছে। নিখিলেশ উপাধ্যায় তাকে বলে দিয়েছেন, বাইরে নজর রাখতে। না ডাকলে যেন কেউ কেবিনে না আসে। লোকটি ঘাড় কাত করে।

নিখিলেশ উপাধ্যায় বললেন, ‘কী খাবেন?’

‘কিছু খাব না। কাজের কথা বলুন।’

উপাধ্যায় বলেন, ‘আপনি নিশ্চয় পরিশ্রান্ত। এক কাপ চা বলি?’

বৈশাখী এবার যেন একটু কঠিন গলায় বললেন, ‘বললাম তো কিছু খাব না। কাজের কথা বলুন। আমাকে দুর্গাপুর ফিরতে হবে।’

নিখিলেশ উপাধ্যায়ের পছন্দ হল। কড়া মহিলা। কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না।

‘আপনি দুর্গাপুর থাকেন?’

বৈশাখী চোখ তুলে বলেন, ‘আমার পেশায় কোথাও থাকা যায় না।’

উপাধ্যায় নিজেকে সামলে বললেন, ‘সরি।’

‘এবার বলুন।’

উপাধ্যায় বললেন, ‘যে কোম্পানিতে আপনাকে কাজ করতে হবে, সেখানে মালিক কড়া। একজন সিরিয়াস লোক। তাকে চট করে টলানো কঠিন। আপনাকে টলাতে হবে।’

বৈশাখী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘টলানো বলতে আপনি কী বলছেন? যদি সেক্স ধরনের কিছু হয় আমাকে দিয়ে হবে না। শরীর দিয়ে পুরুষমানুষকে বশ করবার মতো বয়স আমার নয়। আপনি নিশ্চয় দেখে বুঝতে পারছেন। অবশ্য বয়স থাকলেও ওই ধরনের ছেঁদো কাজ আমি কখনও করিনি। তার জন্য আলাদা পার্টি আছে। তারপরেও যদি বলেন, তাহলে আপনারা ভুল করেছেন। এডি কিন্তু এমন কথা আমাকে বলেনি।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না, না, আমি সে কথা বলছি না। এই লোককে আপনাকে অন্যভাবে টলাতে হবে।’

‘কীরকম?’

উপাধ্যায় একবার কেবিনের পরদার দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আপনি কোম্পানির মালিকানা দাবি করবেন।’

বৈশাখী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মানে! মালিকানা দাবি করব কীভাবে?’

উপাধ্যায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনাকে সবরকম কাগজপত্র আমি হাতে তুলে দেব। আপনি সেই কাগজ দেখিয়ে বলবেন, এই কোম্পানিতে আপনারও শেয়ার আছে।’

বৈশাখী বললেন, ‘কোম্পানির শেয়ার আছে! কাগজপত্র পাব কোথা থেকে?’

নিখিলেশ উপাধ্যায় হাসলেন। বললেন, ‘জাল কাগজপত্র বানানোর দায়িত্ব আমার। আপনাকে শুধু চেপে বসে থাকতে হবে। মালিককে টলমল করে দিতে হবে। সে হয়তো থানা-পুলিশ করবে, কোর্টে মামলা করবার ভয় দেখাবে, আপনি হাল ছাড়বেন না।’

বৈশাখী চুপ করে রইলেন। কিছু একটা ভাবলেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কতক্ষণ হাল ছাড়ব না?’

নিখিলেশ উপাধ্যায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ না আমি বলব।’

বৈশাখী মাথা নামিয়ে বসে রইলেন। উপাধ্যায় চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’

বৈশাখী এ কথার জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার রুমালটা কোথায় গেল? কোথায় রাখলাম?’ বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বিড়বিড় করতে করতেই সামনে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগের চেন খুলে জিনিসপত্র হাতড়াতে থাকেন। একটা একটা করে জিনিস বের করে টেবিলে রাখছেন। রুমালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজে না পেয়ে মহিলা ব্যস্ত। বাকি সব ভুলে গেছেন। উপাধ্যায় একটু অবাকই হলেন। সামান্য একটা রুমালের জন্য এত! বৈশাখী টেবিলে রেখেছেন চশমার খাপ, জলের বোতল, ছোট নোটবুক, মাথার ক্লিপ একটা। একইভাবে একটা রিভলভার বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

রিভলভারের নলের সঙ্গে জড়ানো অবস্থায় রুমালও পাওয়া গেল। বৈশাখী সেই রুমাল দিয়ে ভালো করে মুখ মুছলেন।