» » পঞ্চম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

ঊনপঞ্চাশ

‘আমার ভয় করছে বারি। আমি কি পারব?’

বারিধারা বলল, ‘ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি একজন বোকা মানুষ। বোকা মানুষরা অনেক কিছু পারে। তুমিও পারবে।’

শ্রবণ অসহায় গলায় বলল, ‘এরকম একটা সিরিয়াস সময়ে ঠাট্টা কোরো না ধারা।’

বারিধারা হাত বাড়িয়ে শ্রবণের নাক নেড়ে বলল, ‘ঠাট্টা করব না তো কী করব? প্রাইজ পেয়ে একজনকে এত নার্ভাস হতে কেউ কখনও দেখেছে! বোকা একটা।’

শ্রবণ আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, বারি কেউ আমার সঙ্গে রসিকতা করছে না তো? আমাদের কোনও বন্ধু?’

বারিধারা বলল, ‘আমি তোমার ওই কম্পিটিশনওলাদের সাইট চেক করে সব দেখে নিয়েছি। তুমি দেখবে? মোবাইলে খুলব?’

শ্রবণ তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলল, ‘না না, আমাকে আর দেখাতে হবে না। আমিও ওদের সাইটে ঢুকে দেখে নিয়েছি। আমার নাম আছে। আমার বাবার নাম আছে। আমার বাড়ির ঠিকানা আছে। ভুল হওয়ার কোনও উপায় নেই। তারপরেও ভাবছিলাম…যাক আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ধারা…তার ওপর দ্বিতীয় মেইলটা…বাপরে…মাথা ঘুরছে…।’

শ্রবণ আর বারিধারা বসে আছে বালিগঞ্জের এক আইসক্রিমের দোকানে। বড় কোম্পানির দোকান। দোকান না বলে আউটলেট বলা ভালো। কাচে ঘেরা এই আউটলেটের নাম ‘বি কুল’। যার মোটামুটি একটা বাংলা হল ‘ঠাণ্ডা হও’। ভিতরে নরম আলো। একটা আবছা ভাব।

শ্রবণকে ‘ঠাণ্ডা’ করতে বারিধারা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু শ্রবণ ঠাণ্ডা হচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, তার অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়াটাই স্বভাবিক। তার ওপর দিয়ে আজ একটার পর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঝড় সাধারণত হয় ক্ষতির। শ্রবণের এই ঝড় সৌভাগ্যের ঝড়। দুপুরবেলা মুম্বই থেকে আবার যে খবর এসেছে সেটা দেখে শ্রবণের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে সে বারিধারাকে টেলিফোন করল।

‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই বারি এবং সেটা এখনই চাই।’

বারিধারা শ্রবণের এই ধরনের কথায় অভ্যস্ত। ছেলেটা খাঁটি, তাই নার্ভাস। নিজের সাফল্য সামলাতে পারছে না। বেচারি, এতদিন কাজের তো তেমন কোনও স্বীকৃতি জোটেনি। শিল্পী মানুষের এটাই হয়। অনেক অবহেলার মধ্যে থাকতে হয়। তারপর যেদিন সবাই হাততালি দেয় তখন বিশ্বাস হয় না।

বারিধারা বলল, ‘এখনই কেন?’

শ্রবণ বলল, ‘মনে হচ্ছে, এটা আমাদের শেষ দেখা হবে ধারা।’

বারিধারা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, ‘এরকম মনে হওয়ার কারণ?’

শ্রবণ অসহায় গলায় বলল, ‘আমার সম্ভবত একটু পরেই হার্ট অ্যাটাক হবে। আমি মারা যাব। সম্ভবত সেটা হয়ে গেছে।’

বারিধারা ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘ও তাহলে তো তুমি এখন ভূত। তোমাকে ভূতেদের ভাষাতে বলি, আই লাঁভ ইঁউ শ্রঁবণ।’

শ্রবণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ধারা, ঠাট্টা ভালো লাগছে না। সত্যি মনে হচ্ছে, আমি মরে যাব।’

বারিধারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রাইজ নিয়ে মারা যাবে? নাকি প্রাইজ না নিয়ে মারা যাবে? মারা যাবার পর প্রাইজ নট ব্যাড। মরণোত্তর পুরস্কারে দাম বেশি।’

শ্রবণ কাঁপা বলল, ‘প্রাইজ নয় বারিধারা, মুম্বই থেকে আবার একটা মেইল এসেছে।’

বারিধারা এবার হালকা চিন্তিত হল। বলল, ‘আবার মেইল! কী বলেছে, প্রাইজ ক্যানসেল? সেকেন্ড থটে বাদ পড়েছ?’

শ্রবণ বলল, ‘না তা নয়। তাহলে তো বেঁচে যেতাম। এবার মেইলে…আগে বলো কোথায় দেখা করবে, মুখোমুখি বলতে চাই।’

বারিধারা একটু চিন্তা করে বলল, ‘তোমার অবস্থা খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে, শ্রবণ। আগে তোমার মাথা ঠাণ্ডা হওয়া দরকার। এমন একটা জায়গায় তোমাকে নিয়ে যেতে হবে যেখানে তোমার মাথা ঠাণ্ডা হয়।’

তারপরই বারিধারা এই ‘বি কুল’-এ আসবার কথা বলছে। শ্রবণ একটু দেরি করেছে। বারিধারা এসেছে ওলা ক্যাব ডেকে। ছেলেটা যখন এতটা ঘাবড়ে ডাকাডাকি করছে তখন সিরিয়াসভাবেই নেওয়া উচিত। আজ দেখা করতই। এমন একটা খুশির দিন। তবে হয়তো খানিকটা পরে যেত। যাক, খাতাবই সরিয়ে বারিধারা বেরিয়ে পড়েছে। বেরোনোর সময় মণিকুন্তলা বললেন, ‘কী রে আবার কোথায় যাচ্ছিস? এই তো বললি আজ বাড়িতে বসে পড়ব, আমাকে বিরক্ত কোরো না। বললি না?’

বারিধারা গম্ভীরভাবে বলল, ‘না বেরিয়ে উপায় নেই মা। আমাকে বেরোতেই হবে।’

মেয়ে বড় হয়েছে, কোথায় যাচ্ছে সবসময় জিগ্যেস করা ঠিক নয়। তারপরেও মণিকুন্তলা সবসময় ‘মাতৃ টেনশন’ সামলাতে পারে না।

‘কোথায় বেরোচ্ছিস?’

বারিধারা ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘মুম্বই।’

মণিকুন্তলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মুম্বই! কী বলছিস?’

বারিধারা বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি মুম্বই চলে যাচ্ছি।’

মণিকুন্তলার হাত নিশপিশ করে উঠল। ফাজলামির অপরাধে এখনই তার ছোট মেয়ের কান দুটো ভালো করে মুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাহলে এই মেয়ের কান দিনে যে ক’বার মুলতে হবে তার ঠিক নেই। মুশকিলের হল, বারিধারা ফাজলামি করতে করতে নানারকম কঠিন কাজ করতে পারে। এমন সব কঠিন কাজ যে অন্যরা করবার কথা ভাবতেও পারবে না। তার বাবা জীবনটাকে সিরিয়াস রাখবার যে ব্রত নিয়ে চলে, মেয়েটা তার উলটো।

এই তো কিছুদিন আগেই বারিধারা তার একটা ঝামেলা সামলে দিয়েছে। মণিকুন্তলার এক পিসতুতো দাদা, মাঝে মাঝে এসে টাকাপয়সা নিয়ে যেত। এক-একদিন এক-একটা বাহানা। কোনওদিন বলত, মেয়ের শরীর খারাপ, কোনওদিন বলত বাড়ি ভাড়া বাকি, কোনওদিন বলত, ব্যবসায় লাগবে। মণিকুন্তলা পাঁচশো, হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করতেন। কাউকে বলতেন না। ভাবতেন, আহা রে দরিদ্র মানুষ। যতই হোক আত্মীয় তো। বছরখানেক এভাবে চলার পর, সেই দাদাটি টাকার অ্যামাউন্ট বাড়াতে বলল। পাঁচশো, হাজারে আর সে সন্তুষ্ট নয়।

‘মণি, তোর বরের কাছ থেকে হাজার বিশেক টাকা জোগাড় করে দে। ব্যবসার ধার শোধ করব। নইলে ঘটিবাটি সব যাবে।’

প্রমাদ গুনলেন মণিকুন্তলা। তিনি বললেন, ‘অত টাকা কোথা থেকে পাব!’

সেই দাদা ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, ‘মজা করছিস মণি? বিশ হাজারকে বলছিস অত টাকা! এত বড় একটা কোম্পানির মালিক। বিশ হাজার কেন, বিশ লাখও কোনও ব্যাপার নয়।’

মণিকুন্তলা প্রমাদ গুনলেন। তিনি বুঝলেন, এই লোককে টাকা দিয়ে দিয়ে মাথায় তিনিই তুলেছেন। তিনি কড়া হলেন।

‘আমার কাছে এত টাকা নেই। আর থাকলেও দিতে পারব না।’

‘দিতে পারবে না বললে কী করে হবে মাই সিস্টার? টাকা তো আমার চাই।’

‘বললাম তো পারব না।’

‘ঠিক আছে, তাহলে আমি বিমলকান্তির সঙ্গে দেখা করে, তার থেকে চাই। তার তো টাকা আছে। নাকি সে-ও আমার মতো ভিখিরি।’

মণিকুন্তলা বুঝলেন, এটা একটা বিপদের কথা। স্বামীর কাছে যাওয়া মানেই সে সব জানবে। বিরাট রাগারাগি শুরু করবে। সে টাকাপয়সা বিলোনোর সাহায্য মোটে পছন্দ করে না। তার শ্বশুরমশাইও এসবের বিরুদ্ধে। মেয়েরা শুনলেও ছাড়বে না। তাহলে কী করা যাবে? মণিকুন্তলা তার সেই দাদাটিকে বললেন, ‘দুদিন পরে ফোন করে  যোগাযোগ করো, দেখছি।’

‘ফোন নয়। আমি দুদিন পরে নিজেই চলে আসব।’

রাতে বারিধারাকে কাঁচুমাচু মুখে সব বলেছিলেন মণিকুন্তলা।

‘কাজটা ভুল হয়ে গেছে। আসলে এমনভাবে এসে বলত…।’

বারিধারা মুখের সামনে থেকে মুখ না সরিয়েই বলেছিল, ‘ভুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অমন কাঁচুমাচু হবার মতো কিছু ভুল হয়নি মা।’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘তোর বাবা শুনলে খুব রাগারাগি করবে।’

বারিধারা বলল, ‘রাগারাগি করলে সেটাও ভুল হবে। একজন আত্মীয় অসহায়তার কথা বলে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, এর জন্য বাবার রাগ করবার কী আছে? একেকজনের সাহায্য করবার প্যাটার্ন এক-একরকম। বাবা মানুষকে সাহায্য করে। বুধবার সকালে বাড়িতে যে দরবার খুলে বসে সেখানে কী করে? তবে বাবার কায়দাটা অন্য। টাকা বিলোনোর নয়। বুদ্ধিমানের। তোমারটা বোকামির। তার মানে অন্যায় নয়।’

মণিকুন্তলা চিন্তিত গলায় বললেন, ‘লেকচার থামা। এখন কী করব সেটা বল। তোর বাবাকে সব বলে দিই।’

বারিধারা বলল, ‘কোনও দরকার নেই। বাবা কী করবে? আমি ব্যবস্থা করব। তুমি ওনার ফোন নম্বরটা দাও।’

মণিকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই! তুই কী করবি বৃষ্টি?’

বারিধারা মুচকি হেসে বলল, ‘মামা যাতে আর তোমাকে টাকা চেয়ে বিরক্ত না করে তার ব্যবস্থা করব।’

মণিকুন্তলা ভয় পেয়ে বললেন, ‘গালমন্দ করবি নাকি?’

বারিধারা হাই তুলে বলল, ‘তাই করা উচিত। গালমন্দ তেমন নয়, হালকা থ্রেট করলেই কাজ হয়ে যাবে। এই ধরো বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে দেখলে পা ভেঙে দেব গোছের কিছু। কিন্তু সেটা করা যাবে না। এতদিন ধরে তুমি তাকে যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছ, তার সঙ্গে পা ভেঙে দেবার ব্যাপারটা যাবে না। তাছাড়া ভাগ্নি হয়ে মামার পা ভেঙে দেওয়াটা ঠিকও নয়। অন্য পথে যেতে হবে।’

মণিকুন্তলা বলল, ‘সেটা কী?’

বারিধারা হাত বাড়িয়ে মণিকুন্তলার গায়ে হাত রাখল। হেসে বলল, ‘চিন্তা কোরো না। মেয়ে তোমার বড় হয়ে গেছে মা। মাকে প্রাোটেক্ট করবার মতো জোর তার আছে। তুমি ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে কেটে পড়ো, আমাকে পড়তে দাও। বাবাকে এসব বলে আর বিরক্ত কোরো না। যাও এবার।’

সেই ‘দাদা’ মণিকুন্তলার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। মণিকুন্তলা মেয়েকে চেপে ধরে ঘটনা জানতে পেরেছে।

বারিধারা হেসে বলেছিল, ‘একে বলে অ্যাকশন উইদাউট ব্লাড শেড। তোমার দাদাকে ফোন করে থিয়েটার করলাম। গলায় টেনশন আর ফিসফিসানি নিয়ে বললাম, বড়মামা, আমি বৃষ্টি বলছি। একটা বিরাট বিপদে পড়ে তোমায় ফোন করেছি। আগামী শনিবার আমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছি। তুমি তো জানো বড়মামা এসব আমাদের বাড়িতে চলে না। বাবা শুনলে গুলি করে মারবে। মা শুনলে ঝুলঝাড়া পেটা করবে। যাকে বিয়ে করছি, সেই ছেলের বাড়ি আরও কড়া। বাড়ির এক মাইলের মধ্যে ঘেঁষতে পারবে না। তাই আমি ঠিক করেছি, বিয়ে করে আমি আর আমার বর তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠব। ওখানেই বাসর, বউভাত, ফুলশয্যা করব। এসব তো বন্ধুদের বাড়িতে হয় না, গার্জেন লাগে। তুমি আর বড়মামি আমাদের গার্জেন হবে। মনে রাখবে মামা, মা যেন ঘুণাক্ষরে জানতে না পারে। তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমার বয়ফ্রেন্ড আবার পার্টি পলিটিক্সের লোক। রগচটা গুণ্ডা একটা। দু’বার জেল খেটে এসেছে। কিন্তু ছেলে খুবই ভালো। বড়মামা, শনিবার বিকেলে তাহলে তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠছি। তাই তো? পরে একবার ফোন করে টাইমটা ফাইনাল করে নেব। দেখো, বড়মামা আমাকে তুমি ডুবিও না। আমার বয়ফ্রেন্ড আবার গদ্দারি একেবারে মেনে নিতে পারে না। হিন্দি সিনেমার ভিলেনদের মতো। ব্যস, তারপর থেকে তোমার দাদা ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি সিওর উনি আপাতত কয়েক মাস তোমার ধারেকাছে ঘেঁষবে না।’

কথা শেষ করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। এই মেয়েকে শুধু ফাজিল বলা যায়?

মুম্বই যাবার রসিকতা শুনে মণিকুন্তলা মেয়ের ওপর রাগ দেখিয়ে চটি ফটফটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বারিধারা কাউন্টার থেকে দুটো ককটেল আইসক্রিম নিয়ে এল। এরা বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম মিলিয়ে মিশিয়ে দারুণ ককটেল বানায়। দিদির সঙ্গে মাঝে মাঝে এসে খেয়ে যায় বারিধারা। মেঘবতীর আইসক্রিম সহ্য হয় না। খেলেই গলা ধরে। তারপরেও খায়।

বারিধারা খানিকটা আইসক্রিম মুখে দিয়ে বলল, ‘নাও এবার বলো, দ্বিতীয় মেইলে কী এসেছে?’

শ্রবণ হাত বাড়িয়ে বারিধারার হাতটা ধরল। বারিধারাকে আজ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। সে একটা সবুজ রঙের পালাজো পরেছে। সঙ্গে স্লিভলেস টপ। সেটাও সবুজ। তবে অন্য একটা শেড।

শ্রবণ কাঁপা গলায়, ‘বারিধারা, ওরা আমাকে চাকরি অফার করেছে।’

বারিধারা বলল, ‘চাকরি! কারা?’

শ্রবণ বলল, ‘যারা এই কম্পিটিশনটা করে তারা। অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানি।’

বারিধারা শ্রবণের হাত চেপে ধরে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন! কনগ্রাচুলেশন শ্রবণ!’

শ্রবণ বলল, বারি, রাখো তোমার কনগ্রাচুলেশন। ধারা, আগে তুমি মোবাইলে আমার মেইলটা খুলে চিঠি পড়ো।’

বারিধারা দ্রুত হাতে নিজের মোবাইল ঘাঁটতে লাগল। মেইলটা বের করে নিমেষে পড়েও ফেলল। অল্প কথায় যা লেখা আছে তার মানে হল—

‘…আমরা এর আগেও এই কম্পিটিশনের টপারদের আমাদের সংস্থায় যোগ দেবার জন্য অফার করেছি। কেউ এসেছেন, কেউ পারেননি। যাদের কাজ দেখে আমাদের অতিরিক্ত ইনোভেটিভ বলে মনে হয়, তাদেরই ডাকি। আপনাকেও ডাকছি। আপনি যদি আমাদের সংস্থার ‘কনসেপ্ট অ্যান্ড ডিজাইন’ ডিভিশনে যোগ দেন আমরা খুশি হব।’

এর সঙ্গে বেতন, গাড়ি, ভাসিতে কোম্পানির ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধের কথা বলা আছে। বারিধারা মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে শ্রবণের দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকাল।

শ্রবণ মনে মনে লজ্জা পেল। একটু হাসল। বলল, ‘সামান্য একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া…তাতে ওরা যে কী পেল…।’

বারিধারা বলল, ‘একেই বলে প্রফেশনাল। হীরে চেনবার চোখ। সাধে সবাই ওসব জায়গায় গিয়ে কাজ করতে চায়? গুণী মানুষকে বাইরে রাখতে চায় না। আমাদের এখানে উলটো হয়। গুনী মানুষকে সবাই মিলে ঠোকরায়। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাতে উঠতে না পারে। তোমাদের মতো প্রতিভাধরদের ছোট চোখে দেখাটা বাঙালির একটা অভ্যেস। গুণের বিচারে বেশিরভাগ সময়েই হয় না। বুঝতেও পারে না ছাই। মিডিওক্রেসির যুগ। তারাই সবক্ষেত্রে মাথার ওপর বসে থাকে। যে পয়সাওলাকে আর ক্ষমতাওলাকে ম্যানেজ করতে পারবে সে-ই বাংলায় সব থেকে গুণী।’

শ্রবণ গলা নামিয়ে বলল, ‘বারি, তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো?’

বারিধারা ভেজা চোখে বলল, ‘কোথায়?’

‘কেন, যেখানে আমি চাকরি করতে যাব। মুম্বইতে? তুমি না গেলে আমি কিন্তু কিছু পারব না।’

বারিধারার শরীরের ভিতর ঝিমঝিম করে উঠল। আজই মাকে বলে এসেছে না সে মুম্বই যাচ্ছে! একেই বলে কোইনসিডেন্স।

বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘হ্যাঁ, যাব, কিন্তু তার আগে আমি একটা কাজ করব।’

শ্রবণ বলল, ‘কী কাজ?’

বারিধারা উঁচু চেয়ার থেকে ঝুঁকে পড়ে শ্রবণের মুখটা দুহাত দিয়ে টেনে আনল নিজের কাছে। তারপর আইসক্রিম ভেজা ঠোঁটে লম্বা চুমু খেল।

বারিধারা আর শ্রবণ দুজনেই বুঝতে পারল, প্রকাশ্যে হলেও এই চুম্বনে কোনও লজ্জা নেই। কারণ তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। গভীর ভালোবাসা তাদের আব্রু হয়ে ঘিরে আছে। কেউ সেখানে উকি মারবে তার সাধ্যি কী?