☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
সাতচল্লিশ
বিমলকান্তি সেন একই সঙ্গে বিস্মিত এবং মুগ্ধ।
সাইকিয়াট্রিস্টদের সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা নেই বিমলকান্তির। বরং ‘পাগলের ডাক্তার’ হিসেবে অস্বস্তিই আছে। এর আগে এই ধরনের ডাক্তারের সঙ্গে একবারই মুখোমুখি হতে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা মোটে ভালো নয়।
তখন কলেজে পড়ছেন বিমলকান্তি। বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাই থাকতেন গ্রামে। চুপচাপ ধরনের এই ছেলের ছোটবেলা থেকেই আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। একা থাকতেই ভালোবাসত। ভিড় দেখলে সরে যেত। বনবাদড়ে ঘুরত, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত। বন্ধুরা হাসাহাসি করত, খেপাত। বলত মাথায় ‘ছিট’ আছে। বড় হওয়ার পর হঠাৎ সেই ছেলের স্বভাব বদলাল। শান্ত ছেলে হয়ে গেল ভায়োলেন্ট। পরিচিত, অপরিচিত কাউকে দেখলেই তেড়ে যেত। আক্রমণ যে কিছু করত এমন নয়, কিন্তু ‘ধর-ধর’ বলে তাড়া করতে ছাড়ত না। যেন চোরকে তাড়া করছে। উন্মাদ যুবকের ভাবটা এমন ছিল, যেন ভালো সেজে যারা চারপাশে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যেই ‘চোর ছেঁচড়’ বেশি। ধরতে হলে তাদের আগে ধরতে হবে। বাইশ-চব্বিশ বছরের একজন তাগড়াই ছেলে কাউকে ‘চোর’ সন্দেহে তেড়ে গেলে ঘটনা ভালো হয় না। এ ক্ষেত্রেও হল না। একটা সময়ের পর তাকে দেখলে পাড়ার ছেলেপিলেরা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করল। খানিকটা ভয়ে এবং বেশিটাই মজায়। দু-চারজন লাঠি দিয়েও মারল। সেই সময় পাড়াগাঁয়ে মানসিক রোগীকে লাঠি মারা কোনও অপরাধ ছিল না। বরং সেটাই নিয়ম ছিল। এখনও যে অপরাধ এমন নয়। এই গরিব, অশিক্ষিতদের দেশে আজও অনেকে মনে করে, লাঠি ছাড়া ‘উন্মাদ’ নামক অসুস্থতার আর কোনও চিকিৎসা নেই। যাই হোক, দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে গ্রাম থেকে কলকাতার সেনবাড়িতে খবরাখবর সবসময় আসত না। লাঠি দিয়ে জোর পিটুনির পর এল। কমলকান্তি সেন খুব রাগারাগি করলেন। যে মানুষটা খবর নিয়ে এসেছিল কমলকান্তি তাকে এই মারেন তো সেই মারেন।
‘আমাকে আগে বলোনি কেন? কেন বলোনি? একজন অসুস্থ মানুষকে ট্রিটমেন্ট না করে এতদিন বাড়িতে রেখে দিয়েছ। মূর্খের দল। এটা একটা অসুখ এটা বোঝো? নাকি তাও বোঝো না? জ্বর, পেট ব্যথার মতো এই অসুখেরও ট্রিটমেন্ট আছে জানো সেটা?’
গ্রামের বাড়ি থেকে আসা মানুষটা মিনমিন করে বলল, ‘পাগল তো ভালো হয় না বড়কর্তা। তবে ওঝা ডেকে এবার ঝাড়ফুঁক করানোর কথা ভাবছি।’
কমলকান্তি সেন চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে সত্যি সত্যি মারতে যান। বাকিরা আটকায়।
‘শাট আপ। কে বলল মানসিক রোগ ভালো হয় না? কে বলল তোমাদের? আজকাল কতরকম ওষুধ বেরিয়েছে। আর একবারও যদি এইসব ওঝা টোঝার কথা মুখে এনেছ, পুলিশ ডেকে ফাটকে পুরে দেব। আমি চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিলাম। পেশেন্টকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব, ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার যদি বলেন, বড় হাসপাতালে ভর্তি করাব। যতদূর যেতে হয়, যাব। তারপর ওই গ্রামে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পাঠাব।’
এই উন্মাদ চিকিৎসা সফরে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন বিমলকান্তি। বাবাই অর্ডার দিয়েছিলেন। এইরকম একটা রোগী নিয়ে ছোটাছুটি করতে তার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার ওপর ওই পাগলা কাকা নাকি তেড়ে যায়। কামড়ে, খিমচে দিলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। কিন্তু বাবার মুখের ওপর ‘যাব না’ বলবার সাহস ছিল না বিমলকান্তির। কমলকান্তি সেন মুখ দেখে ছেলের আপত্তি বুঝেছিলেন। গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনের সব দিকটাই দেখতে হয়, সামলাতে হয়। শুধু সুস্থ মানুষ নিয়ে বাঁচা যায় না, বাঁচার জন্য পাশে কিছু অসুস্থ মানুষও দরকার। এতে সত্যি বেঁচে আছি, নাকি বাঁচবার ভান করে আছি তার একটা পরীক্ষা হয়। কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গে চলো। গাড়িতে যাব। প্রথমে ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে দেখাব, সেখানে ডাক্তার যা পরামর্শ দেবে, সেই অনুযায়ী পরবর্তী স্টেপ নেব।’
অদ্ভুত ব্যাপার হল, কাকা বাবাকে দেখবার পর থেকে একবারে শান্ত হয়ে গেলেন। সদর হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে কোনও সমস্যাই হয়নি। সমস্যা হল হাসপাতালে পৌঁছে। সেখানে মানসিক রোগের ডাক্তার একজনই। খবর নিয়ে জানা গেল, বেশিরভাগ সময় তাকে পাওয়া যায় না। হয় হাসপাতালে আসেন না, নয়তো নিজের জায়গায় থাকেন না। পেশেন্টও আসে কম। অবহেলা, ওঝা, ঝাড়ফুঁক, ঘরে বেঁধে রাখা ধরনের চিকিৎসা টপকে দূর দূর গ্রামগঞ্জ থেকে কে আসবে? কেনই বা আসবে? তারপরেও কখনও কোনও পেশেন্ট এলে তার বাড়ির লোকদের ডাক্তারবাবু ভাগিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন, এসব জটিল চিকিৎসা এখানে হবে না। অন্য কোথাও পথ দেখো বাপু।
সেদিন বিমলকান্তিরা ডাক্তারকে পেয়ে গেলেন। পেশেন্ট দেখে তো তিনি রেগে আগুন। তাকে যা-ই বলা হয়, তিনি খিঁচিয়ে ওঠেন। যেন হাসপাতালে রোগী আনা খুব অন্যায় হয়েছে।
‘পেশেন্টের অবস্থা তো ভয়ঙ্কর। একে এখানে এনেছেন কেন?’
কমলকান্তিও এই ব্যবহারে মেজাজ হারালেন। বললেন, ‘হাসপাতাল বলে এনেছি। রোগীকে নিয়ে কোথায় যাব? ফুটবল মাঠে? নাকি হরিসভার কীর্তন শোনাতে?’
ডাক্তার দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘যেখানে খুশি যান। এখানে একটা এক্সরে মেশিন নেই, ব্যান্ডেজ বাঁধবার তুলো নেই… উনি এসেছেন মাথার অসুখের চিকিৎসা করাতে? ছোঃ। যান গভর্নমেন্টকে গিয়ে বলুন, আগে ব্যবস্থা, তারপর চিকিৎসা।’
বিমলকান্তি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। অবাক গলায় বললেন, ‘কাকার তো মাথার সমস্যা। এক্সরে মেশিন, ব্যান্ডেজ দিয়ে কী হবে?’
ডাক্তার হাত তুলে বললেন, ‘মুখ সামলে কথা বলবে ছোকরা। ডাক্তার তুমি না আমি? কোন অসুখে এক্সরে লাগে, কোনটায় ব্যান্ডেজ লাগে আমি তোমার থেকে অনেক বেশি জানি।’
কমলকান্তির রাগ বাড়ল। বাড়াটাই স্বাভাবিক। বললেন, ‘আপনিও মুখ সামলে কথা বলবেন। ডাক্তার হয়েছেন বলে মাথা কিনে নেননি। এখানে তো দেখছি আপনার মাইনে ছাড়া আর কিছুই নেই। সেটাই বা রেখেছেন কেন। এক্স রে মেশিনের মতো সেটাও তুলে দিন। মনে রাখবেন, মাইনেটা আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় হচ্ছে। সার্ভিস দিতে আপনি বাধ্য। যদি মনে করেন হাসপাতালে কিছু নেই, কাজ করতে পারছেন না, তাহলে মাইনে নেওয়া বন্ধ করুন।’
এবার তুলকালাম লেগে গেল। ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। জামার হাত গুটিয়ে এগিয়ে এলেন। ভিড়টিড় হয়ে একাকার কাণ্ড। এর মধ্যে আবার কাকা গেলেন খেপে। তিনি ডাক্তারের দিকে গেলেন তেড়ে। ডাক্তার কোনওরকমে গিয়ে পুলিশে ফোন করলেন। সে এক হুলুস্থূলু ব্যাপার।
কমলকান্তি সেন শেষ পর্যন্ত উদ্মাদ ভাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করেন। তবে দুঃখের কথা… থাক, সে অন্য গল্প। তবে এরপর থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট সম্পর্কে ধারণাটাই তেতো হয়ে গিয়েছিল বিমলকান্তির। যদিও এর পেছনে তেমন কোনও যুক্তি ছিল না। এই আচরণ অন্য কোনও ডাক্তারও করতে পারতেন, নাও করতে পারতেন। একজনকে দেখে সবাইকে বিচার করা উচিত নয়। অনেক ধরনের পেশেন্টই তো ওই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যায়। চিকিৎসা হয় বলেই যায়। আবার এমনটাও হতে পারে, এই ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে হয়তো সেই সময় সত্যি-সত্যি মানসিক রোগের চিকিৎসা করবার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। বেচারি ডাক্তারবাবু হয়তো বলে বলে ক্লান্ত, হতাশ। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হলেও তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছিলেন যেখানে সামান্য এক্স রে মেশিন, ব্যান্ডেজ বাঁধবার তুলো পাওয়া যায় না, সেখানে মাথার অসুখের মতো জটিল জিনিসের চিকিৎসা কী করে হবে? কথাটা নরমভাবে না বলে রেগে গিয়ে বলে ফেলেছেন। একজন ডাক্তারকে বসিয়ে রাখতে হয় তাই রেখেছে। এই সবক’টা সম্ভাবনাই আছে। হয়তো সবই সত্যি। কিন্তু তারপরেও সেই ডাক্তারের আচরণ মনের ভেতর এক ধরনের বিশ্রী ছাপ ফেলেছিল। উনি যদি ব্যবহার অন্যরকম করতেন, তা হলে হয়তো এমনটা হত না। বাবাও বুঝতেন। রোগী নিয়ে কাজ খুব জটিল জিনিস। শুধু ওষুধ বা ধমক দিয়ে হয় না।
আজ কিন্তু একেবারে উলটো ঘটনা। সামনে বসা সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোককে দেখে বিমলকান্তি সেন মুগ্ধ। বয়স তারই মতো হবে। শান্ত, সৌম্যদর্শন। মুখে হাসি। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তার ওপর ব্যবহারটি বড় মধুর। ঘরে ঢুকতে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমি ডা. মণীশ রায়। বসুন। চা বা কফি কিছু খাবেন? আমি সাজেস্ট করব চা। আমার এখানে যে ছেলেটি চা-কফি বানায়, সে কফি বিষয়টি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ নার্ভাস। তার ধারণা, এটি ইংরেজিতে কথা বলবার মতো। ভিন দেশি ব্যাপার। সে চা বানানোয় স্বচ্ছন্দ।’
কথা শেষ করে ডাক্তারবাবু ‘হো হো’ আওয়াজ করে হাসলেন।
বিমলকান্তি খুব আশ্বস্ত হলেন। ডাক্তারবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে না উনি বাইরের কেউ, মনে হচ্ছে এর সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব কি না এই বিষয়ে এতদিন মনের ভিতর যে দোলাচল ছিল, মুহূর্তে কেটে গেল। মনে হল, তিনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। এই মানুষটা তাকে সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারবে।
ডাক্তার মণীশ রায়ের সন্ধান দিয়েছে কর্ণিকা। সেক্রেটারি কাম অ্যাডভাইসার টু দ্য এম ডি। বিমলকান্তি ইচ্ছে করলে অফিসের সিনিয়র কেউ বা বাড়িতে মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে ডাক্তারের খোঁজ নিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। অফিসের বড় কাউকে জিগ্যেস করলে তারা অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাত। যত না চিন্তিত হত তার থেকে বেশি চিন্তা দেখাত।
‘স্যর কী হয়েছে? কার হয়েছে? কোনও চিন্তা করবেন না, সঙ্গে আমি থাকব। আমার মনে হয় স্যর, এখানে না দেখিয়ে স্ট্রেট নিমহান্সে চলুন। মাথার কাজে ওরা দারুণ। বাইরে কোথাও ব্যবস্থা করব? বিদেশে? স্টেটসে মেন্টাল হেলথ নিয়ে আজকাল খুব ভালো কাজ হচ্ছে। যাবেন স্যর?’
এই ঝামেলায় বিমলকান্তি পড়তে চাননি।
বাড়িতে মেঘ, বৃষ্টি বা জ্যোতিষ্ককে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে বললে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে সেনবাড়ির অবস্থা একটু নড়বড়ে হয়ে আছে। এখনও সবাই পুরো স্বাভাবিক হতে পারেনি। বিশেষ করে মণিকুন্তলা। যদিও আগের থেকে অনেকটা সামলেছে, তাও কিছুটা মনমরা তো হয়েই আছে। এই অবস্থায় এসব শুনলে আরও ডিপ্রেসড হয়ে পড়বে। তার ওপর ক’দিন আগে আরও একটা ঘটনা ঘটল। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বাড়িতে পরোক্ষভাবে তার একটা এফেক্ট পড়েছে। জ্যোতিষ্কর রাস্তা থেকে ধরে আনা বাঁশিওয়ালা খুন হয়েছে। লোকটা ডাকাত ছিল। বড় মেয়ের বাড়িতে ডাকাতি করেছিল। পুলিশ খুঁজছিল। ইন্সিডেন্টালি বারিধারা নিজের চোখে সেই খুন দেখেছে। মেয়েটার মনের জোর বেশি বলে সে কোনওরকম ট্রমার মধ্যে পড়েনি। পুলিশ জ্যোতিষ্কদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা খুনিদের একজনকে ঘটনার দিনই ডক এলাকা থেকে ধরে ফেলেছে। কপিশপের সামনে থেকে খুনিরা যখন বাইক ঘুরিয়ে পালাচ্ছিল, তখন এক ট্রাফিক সার্জেন্টের সন্দেহ হয়। সে ওয়াকিটকিতে সহকর্মীদের জানায়। পুলিশ বাইকটিকে ফলো করে। যে লোকটাকে পরে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বাঁশি-বাজিয়ে-লোকটা গ্রাম থেকে এসে কলকাতায় এক মাফিয়া দলের চক্করে পড়ে। বাড়ি, ব্যাঙ্ক, গয়নার দোকান—কোথায় চুরি, ডাকাতি করতে সুবিধে সেই খবর জোগাড় করে দিত। এদের পুলিশের ভাষায় বলা হয় ‘টিপার’। ক’দিন আগে সে আর এই কাজ করবে না বলে জানায়। মাফিয়ারা তাকে তাড়া করে এবং গুলি করে মারে। ক্রিমিনালদের দলে একবার ঢুকলে আর বেরোনো যায় না। কলকাতা শহর বাইরে থেকে যতই চকচকে, আলো ঝলমলে দেখাক না কেন, ভিতরে চাপ চাপ অন্ধকার রয়েছে। গোটা ঘটনা জানার পর বারিধারাও আপসেট। তার বিশ্বাস, বাঁশিওয়ালা লোকটা ভালোভাবে জীবন কাটাতে চেয়েছিল, পারল না। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার হালকা তর্কও হয়েছে।
‘এই ধরনের লোকের এরকমই পরিণতি হয়। হয় জেলে বাকি জীবনটা থাকতে হয়, নয় নিজের দলের হাতে খুন হতে হয়।’
বারিধারা বলেছিল, ‘সেটাই দুঃখের বাবা।’
বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘একজন ডাকাত সম্পর্কে দুঃখ না করাই ভালো বৃষ্টি। ওই লোকটা তোমার দিদি-জামাইবাবুকে মেরেও ফেলতে পারত।’
বারিধারা বলল, ‘আমি তো ডাকাতের জন্য দুঃখ করছি না, আমি একজন শিল্পীর জন্য দুঃখ করছি। তা ছাড়া আমার কী ধারণা জানো বাবা, আমার ধারণা লোকটা দিদি-জ্যোতিষ্কদাকে পছন্দ করে ফেলেছিল, সেই কারণে গোটা অপারেশনটা ওদের অ্যাবসেন্সে করে। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি।’
বিমলকান্তি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ডাকাতের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করাটা বাড়াবাড়ি হয়।’
বারিধারা অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, ‘মানুষ বড় অদ্ভুত। একই সঙ্গে তার মন ভালো এবং মন্দ। সে একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বাজাতে পারে, আবার লোকের হাত-মুখ বেঁধে ডাকাতিও করতে পারে। আমার মনে হয় বংশীবাদকের আপশোস হচ্ছিল।’
বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘হয়তো তাই, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। মন্দ লোকদের ভালো হওয়ার ইচ্ছে থাকে না, এমন নয়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেরি হয়ে যায়।’
বারিধারা বলল, ‘বাবা, আমরা তো সবাই কমবেশি মন্দ? নই?’
বিমলকান্তি থমকে গেলেন। তার ছোট মেয়েটা গোলমেলে। তর্কের সময় কখন যে কী যুক্তি টেনে আনে, তার ঠিক নেই।
‘ঠিকই, আমরাও মাঝে মাঝে মন্দ হয়ে যাই, কিন্তু ডাকাতি করি না।’
বারিধারা খানিকটা উদাসীনভাবেই বলল, ‘কী জানি? হয়তো তাও করি। ভাবি ভালো কিছু করছি।’
বিমলকান্তি এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর বেশিদূর এগোননি। তবে বুঝেছিলেন, এই অবস্থায় বাড়িতে ডাক্তার বদ্যির কথা বলা উচিত হবে না। তা ছাড়া আগে সমস্যাটা ঠিক কী, আদৌ সমস্যা কি না, সেটা জানা দরকার।
সব দিক বিচার করে কর্ণিকাকে অনেক বেশি ‘সুবিধের’ বলে মনে করেছেন বিমলকান্তি। যতদিন যাচ্ছে বিমলকান্তির মনে হচ্ছে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী এবং সিরিয়াস। সে তার বসের খবর গোপন রাখতে জানে। এখন পর্যন্ত অফিসের বড় কোনও বিষয়ে তার কাছে থেকে বিমলকান্তি পরামর্শ নেননি ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনে নেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।
চা খেতে খেতেই ডা. মণীশ রায় বললেন, ‘নিন, এবার আপনার কথা বলুন মিস্টার সেন।’
বিমলকান্তি মনে মনে সাজিয়ে এসেছিলেন কীভাবে শুরু করবেন, এখন খানিকটা গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি খানিকটা থমকেই যান। তিনি এমন একটা সমস্যা নিয়ে এসেছেন যেটা কাউকে বলাটা সঙ্কোচের। বোধহয় পাগলামির ঊর্ধ্বে।
ডা. রায় হেসে বললেন, ‘কর্ণিকা টেলিফোনে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড খানিকটা বলে রেখেছে। আপনার অফিস, আপনার ফ্যামিলি। কয়েকদিন হল আপনার পিতা গত হয়েছেন। মোটামুটি আমি আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা করে রেখেছি। বাকিটা আপনার মুখে শুনব।’
বিমলকান্তি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। কর্ণিকা কাজ এগিয়ে রেখেছে। এই কারণেই মেয়েটিকে তাঁর এতটা পছন্দ হয়। মেয়েটি সিরিয়াস। যে কাজ করে মন দিয়ে করে। পুরো কাজটা করতে চায়। এই বয়েসে বাইরের অনেক কিছু মনে নাড়া দেয়। এটাই বয়েসের ধর্ম। কাজের সময় সেটাকে সামলে রাখাটাই গুণ। বৃষ্টি, মেঘের বেলাতে এই ঘটনা উলটো। লেখাপড়া মন দিয়ে করলেও তারা বাইরের নানা বিষয়ে সহজেই ইনভলভ হয়ে পড়ে। এটা যদি না করত তাহলে ওদের কেরিয়ার অনেক ভালো হত। বড় মেয়েটা তো কেরিয়ার কিছু করলই না। বিয়ে-থা করে বাড়িতে বসে গেল। অথচ মেয়েটা অতি বুদ্ধিমতী। কলেজে পড়তে পড়তেই পাগল টাইপ ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। জ্যোতিষ্ক পাগল ছাড়া কী? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। মাঝখান থেকে মেঘের আর পড়াশোনাই হল না! বিয়ের কথা যখন হচ্ছে মেয়েকে বিমলকান্তি এ কথা বলেছিলেন।
‘বিয়ের পর তুমি লেখাপড়া করবে তো?’
মেঘ বলেছিল, ‘খেপেছ? আমি একজন সিরিয়াস বাবার সিরিয়াস মেয়ে। আমি সিরিয়াসলি সংসার করতে চাই।’
বিমলকান্তি অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘সে কী! আমি তো ভেবেছিলাম আরও লেখাপড়া করে তুমি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে জয়েন করবে!’
মেঘ বলেছিল, ‘ওরে বাবা, ব্যবসা ট্যাবসা আমার কম্ম নয়। আমি পরীক্ষায় খাতায় ঠিক আছি, তার বাইরে আমার যোগ-বিয়োগ সব ভুল হয়ে যায়। ব্যবসা দুদিনে লাটে উঠবে। আমাকে ওইসব থেকে রেহাই দাও বাবা। তোমার চিন্তা কী? বৃষ্টি তো আছে।’
বিমলকান্তি বিরক্ত হয়েছিলেন। এটা একটা সিরিয়াস কথা হল? বৃষ্টির মধ্যেও এই ব্যাপারে ঘাটতি আছে। সে তো এককাঠি বেশি। নানারকম অর্থহীন বিষয়ে জড়িয়ে পড়তে ভালোবাসে। বাবা একটা কী উদ্ভট প্রজেক্টের কথা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, কী রোদ উঠবে না কী, তাই নিয়ে লাফালাফি করছে। কোনও মানে আছে? হ্যাঁ, এটা ঠিক দুটো মেয়েই খুব ডিউটিফুল হয়েছে। কিন্তু তারা বেশিরভাগ ডিউটিই সারে খেলাচ্ছলে। হাসতে হাসতে। এটা একেবারেই পছন্দ নয় বিমলকান্তির। ডিউটিতে সিরিয়াস ভাব চাই। তাতে কাজে ভুল হলে ক্ষতি নেই। এসব দিক থেকে কর্ণিকা ভালো। আজ ওকে ঘরে ডেকেছিলেন।
‘কর্ণিকা, একটা জরুরি কাজের জন্য তোমাকে ডেকেছি।’
কর্ণিকা অবাক হল। স্যার তাকে নিশ্চয় ঘরে খোশগল্প করবার জন্য ডাকবেন না। জরুরি কাজের জন্যই ডাকবেন। এটা আলাদা করে বলবার কী আছে? এমন কথা কখনও উনি বলেনও না। স্যার, আজ কি কোনও কারণে অন্যমনস্ক? কোনও সমস্যা হয়েছে? দুদিন হল তার মনও খুব খারাপ। সে জানতে পেরেছে, অর্চিন কলকাতা থেকে বাইরে চলে গেছে। গ্রামে না কোথায় গিয়ে রাজনীতি করবে। অর্চিন তার মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। খবরটা যখন শোনে কর্ণিকা বিশ্বাস করতে পারেনি। ফেসবুকে অর্চিনের কলেজের এক বন্ধু পোস্ট দিয়েছে।
‘উই ফিল প্রাউড ফর অর্চিন। তার সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানাই।’
অর্চিনের খবরাখবর জানবার জন্য কর্ণিকা তার বন্ধুদের ফেসবুকে মাঝে মাঝে চুপচাপ উকি দেয়। কর্ণিকা থমকে গিয়েছিল। অর্চিন কী সিদ্ধান্ত নিল? নিজে কিছু জানতে যাওয়া ঠিক হবে না। অর্চিন জানতে পারলে রাগারাগি করতে পারে। একটি ছেলে তার থেকে বয়েসে খানিকটা ছোট। তারপরেও তাকে ভয় পায়! এই কারণে কর্ণিকা নিজেই কতবার অবাক হয়েছে। ভালোবাসাই পারে যাবতীয় রীতিনীতি, নিয়মকানুন গুলিয়ে দিতে। কম বয়েসের ছেলেকে যদি ভালোবাসতে পারে, তাকে মন আর শরীর দুটো দেওয়ার জন্যই উদগ্রীব হয়ে থাকতে পারে, তাহলে আর ভয় পেতে অসুবিধে কী?
কর্ণিকা ফেসবুক থেকে অর্চিনকে ফোন করে। সুইচড অফ। এর পরে আর না পেরে ফেসবুকেই ছেলেটিকে জিগ্যেস করে বসে। একটু ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে।
‘অর্চিন কে?’
‘আমাদের সহপাঠী। একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পাস করলে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার হত।’
কর্ণিকা খুব নির্লিপ্তভাবে জানতে চায়, ‘সে কী করেছে? তোমরা তার জন্য গর্ববোধ করছ কেন? ভালো রেজাল্ট করেছে?’
ছেলেটি জবাব পাঠায়, ‘না, আমাদের প্রিয় বন্ধু কেরিয়ারের লেখাপড়া ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। জীবনের লেখাপড়া শিখতে।’
কর্ণিকা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চায়, ‘মানে! চলে গেছে মানে? কী হয়েছে তার?’
জবাব আসে, ‘নিজের আদর্শ, নীতির জন্য গেছে। সে পুরোপুরি রাজনীতি করবে বলে ঠিক করেছে। আমরা তো এমন পারব না। আমাদের না আছে নীতি, না আছে আদর্শ। আমরা শুধু নিজেকে নিয়ে আর নিজের লোভ নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছি। তাই অর্চিনকে কুর্নিশ জানাই।’
এরপর কর্ণিকা ফেসবুকেই ঋষার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঋষা এড়িয়ে যায়। বরং তাকেই প্রশ্ন পাঠায়, ‘তুমি অর্চিনকে কতটা চেনো?’
এরপর থেকে কর্ণিকার মন খুব খারাপ। ছেলেটা কোথায় গেল? যাওয়ার আগে তাকে একবার বলে গেল না? সে কি এতটাই ফালতু? সে অর্চিনের সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়। তাকে বলতে চায়, ‘আমি তো তোমার কাছ থেকে কিছু চাইনি অর্চিন। তবু তুমি কেন আমাকে এত অবহেলা করো?’
এরপরেও মন খারাপ হবে না! তবে অফিসে এসে কর্ণিকা নিজের কথা ভুলে কাজ করবার চেষ্টা করে। আজও করছে। স্যর ডাকায় ঘরে এসেছে।
বিমলকান্তি টেবিলের ওপর রাখা পেপারের ওয়েটটা নাড়াচাড়া করতে করতে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আমার একটা সমস্যা হয়েছে কর্ণিকা। সমস্যার কথা কাউকে আমি কখনও বলিনি। কারণ সমস্যাটা ঠিক স্বাভাবিক সমস্যা নয়। মনের সমস্যা। মনে হচ্ছে, এবার আমার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করা উচিত।’
বস মাথার ডাক্তার খোঁজ করছেন শুনলে অন্য যে কেউ ঘাবড়ে যেত, কর্ণিকা ঘাবড়াল না। অফিসে কাজ করতে করতে এই একটা জিনিস সে অভ্যেস করে নিয়েছে। চট করে ঘাবড়ায় না।
বিমলকান্তি বললেন, ‘তোমাকে না বলে ব্যাপারটা আমি বাড়িতে বা অফিসের সিনিয়র কাউকে বলতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাতে টেনশন তৈরি হত। তার থেকেও বড় কথা, খবরটা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিকের মাথার গোলমাল হয়েছে, এই খবরটা ছড়ালে আমার কোনও ক্ষতি নেই, বিজনেসের ক্ষতি নেই। আমি সেটা চাই না। আমি জানি, তুমি কথাটা গোপন রাখতে পারবে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।’
কৃতজ্ঞতায় কর্ণিকার মন ভরে উঠল। বাবার বয়সি এই মানুষটা তাকে সত্যি সত্যি বিশ্বাস আর ভরসা করে। আর সেই কারণেই এত কম বয়েসে তাকে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পদে বসিয়েছে। বস বকাঝকাও করে খুব। মাঝে মাঝে বাথরুমে গিয়ে চোখের জল মুছতে হয়। তার পরেও মনে হয়, এই মানুষটার জন্য যদি কোনওদিন জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়, সে নেবে। কেউ আটকাতে পারবে না। জীবনটা কী অদ্ভুত, যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সেই অর্চিন তার ভালোবাসার কোনও মূল্য দিল না, অথচ একজন দূরের মানুষ তাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!
‘আমি কী করতে পারি স্যার?’
বিমলকান্তি একটু ভেবে বললেন, ‘আমাকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের অ্যাপয়েনমেন্ট করে দিতে পারো? ডাক্তার চেনাজানা হলে সুবিধে হয়। তাছাড়া আমার ঠিক এরকম কাউকে চেনা নেই। যাদের আছে তাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছি না। কর্ণিকা, আমার ডাক্তার ঠিক করে দেওয়াটা তোমার কাজ নয়। তুমি আমার অফিসের কাজ করবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্রুত সমস্যা কাটিয়ে ওঠাটা শুধু আমার জন্য নয়, আমার অফিসের জন্যও প্রায়োজন। সেটা ঠিকমতো করতে গেলে এমন কাউকে নিয়ে করতে হবে যাকে আমি বিশ্বাস করি। সেই অর্থে কাজটা খানিকটা অফিসেরও বলতে পারো। তবে তারপরেও যদি তোমার কোনও অসুবিধে হয় বলো। আই ডোন্ট মাইন্ড। বরং স্পষ্ট কথা বললে খুশি হই।’
কর্ণিকা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘স্যর, এ আপনি কী বলছেন! এটা আমার ডিউটি। তাছাড়া…তাছাড়া।’ এই পর্যন্ত থমকে গেল কর্ণিকা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার এক মামা সাইকিয়াট্রিস্ট। মণীশ রায়। খুব নাম টাম নেই, কিন্তু ডাক্তার হিসেবে দারুণ। মানুষ হিসেবেও। আপনি যদি বলেন, আমি এখনই তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারি।’
বিমলকান্তি মুহূর্তখানেক ভাবলেন। বললেন, ‘করো। উনি যদি আজ সন্ধেবেলা সময় দেন খুব ভালো হয়। যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটা আমি ক্লিয়ার করে ফেলতে চাই। এটাকে ক্যারি করতে আমার ভালো লাগছে না।’
কর্ণিকা শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। মণীশ মামার সঙ্গে আমি এখনই কথা বলছি।’
বিমলকান্তির ভালো লাগল। একেই বলে এফিসিয়েন্ট। অতিরিক্ত কথা নেই। কৌতূহল নেই। আবেগ নেই। নিঃশব্দে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া।
ডাক্তারের সঙ্গে কর্ণিকা শুধু কথা বলেনি, বিমলকান্তির পরিচয়টাও দিয়ে রেখেছে। সে বলেছিল, ‘স্যর, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?’
বিমলকান্তি ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, ‘না, তার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘যাই না।’
বিমলকান্তি সামান্য কঠিন গলায় বললেন, ‘বললাম তো প্রয়োজন নেই। আমি অফিসের কাজ ছাড়া কাউকে কোনওদিন বাইরে নিয়ে যাই না।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন মিস্টার সেন।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘কোথা থেকে শুরু করি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ডাক্তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘যেখান থেকে খুশি।’
বিমলকান্তি গলাখাকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন।
‘সপ্তাহে একদিন করে আমি বাড়িতে লোকজন মিট করি। কারও কোনও পার্সোনাল প্রবলেম থাকলে শুনি। সেদিন আমার অফিসের এক কর্মচারী, প্রহ্লাদ নাম, আমার কাছে আসে। বাড়ি বা ওই ধরনের কিছুর জন্য তার লোন দরকার। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা সময় আমার মনে হয়, আমি আর ঠিক আমি নেই, আমি প্রহ্লাদ হয়ে গিয়েছি।’
এতটা বলে থামলেন বিমলকান্তি।
ডাক্তারবাবু সোজা হয়ে বসলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপনি প্রহ্লাদ হয়ে গেছেন! সেটা ঠিক কেমন?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক কেমন আমি বলতে পারব না ডাক্তারবাবু…কিন্তু মনে হল, আমি যেন আমি নই…আমি মানুষটা বদলে গিয়েছি…।’
ডাক্তার রায় স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কি প্রহ্লাদের মনের কথা বুঝতে পারছিলেন?’
বিমলকান্তি গলা নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, পারছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমার সামনে যে বিমলকান্তি সেন মানুষটা বসে আছেন, তিনি একজন ভালো মানুষ। বাইরে রাগারাগি করলেও ভেতরে নরম। উনি আমার কথা শুনবেন। আমার টাকার ব্যবস্থা করবেন।’
ডাক্তার রায় একটু ভাবলেন। বললেন, ‘এই কথাগুলো যে ওর, আপনার নয়, সেটা বুঝলেন কী করে?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, শুধু মনের কথা নয়, আমি ওই লোকটির ব্যথা-বেদনাও অনুভব করেছি।’
ডাক্তারবাবু বড় করে শ্বাস টানলেন। চেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, ‘এরকম আপনার কতবার হয়েছে মিস্টার সেন?’
‘বেশ কয়েকবার। সামনের মানুষটার সঙ্গে আমার যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। আমার বাবার সঙ্গে পর্যন্ত হয়েছে। চিন্তার কথা হল, শুধু যে নর্মালভাবে ব্যাপারটা ঘটছে এমন নয়। গোলমালও হচ্ছে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘গোলমাল! সেটা কীরকম?’
বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘আমাদের বিজনেসে খুব সিনিয়র একজন আছেন। আমার বাবার আমলের মানুষ। মিস্টার উপাধ্যায়। কোম্পানি ক্রিটিকাল কোনও সমস্যায় পড়লে তিনি পরামর্শ দেন। কিছুদিন আগে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খুব জোর ধাক্কা খেলাম। তখনও বাবা বেঁচেছিলেন।’
‘ধাক্কা! কীরকম?’
বিমলকান্তি খানিকটা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘মনে হল, আমি যেন মিস্টার উপাধ্যায়। আমার বাবাই গোপনে আমাকে এই কোম্পানিতে রেখেছেন। যাতে তার ছেলের কোনও অসুবিধে না হয়। তার থেকে বড় কথা…বড় কথা…আমি যেন কোম্পানির বড় কোনও ক্ষতি চাইছি।’
ডাক্তার রায় বললেন, ‘আপনি আরও কয়েকটা ঘটনা মনে করে বলতে পারেন?’
বিমলকান্তি সেন বলেন, ‘পারব।’
‘তাহলে বলুন।’
পরপর প্রায় সবক’টা ঘটনা বললেন বিমলকান্তি। ডাক্তারবাবু মন দিয়ে শুনলেন। তারপর খানিকটা চুপ করে থেকে নীচু গলায় বললেন, ‘আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে একজন মানুষের দুজন হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। একে বলে স্প্লিট পার্সোনালিটি। দ্বিখণ্ডিত সত্তা। কিন্তু আপনার যা হচ্ছে তার সঙ্গে এই অসুখের ঠিক মিল নেই। আপনি পুরোপুরি অন্য একজন মানুষ হয়ে যাচ্ছেন বলে আপনার মনে হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখছেন। অন্যদের দেখছেন। এমনকী নিজেকেও দেখছেন। তাই তো?’
বিমলকান্তি মাথা নাড়লেন।
‘এই ফেজটা কতক্ষণ থাকছে মিস্টার সেন? মানে অন্য একজন হয়ে যাওয়াটা?’
বিমলকান্তি বললেন, ‘খুব অল্প সময়, কয়েক মুহূর্ত। আবার নর্মাল। আমি…আমি আবার বিমলকান্তি সেন হয়ে যাচ্ছি।’
ডাক্তার মণীশ রায় চুপ করে থেকে টেবিলের ওপর রাখা একটা পেনসিল দিয়ে টোকা দিতে লাগলেন। তিনি ভাবছেন। বললেন, ‘আমাকে একটু সময় দিতে হবে মিস্টার সেন। দুদিন পরে আপনাকে আর একবার আসতে হবে। আমি বইপত্র জার্নাল ঘেঁটে দেখব। নিজেও ভাবব। সমস্যাটা আমাকে বুঝতে হবে। তার আগে আপনাকে হালকা একটা ওষুধ দিচ্ছি। রাতে খেয়ে শোবেন। আপনার স্ট্রেস কমানো দরকার।’
বিমলকান্তি সেন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ডাক্তারবাবু আমি ভালো হয়ে যাব তো?’
মণীশ রায় সামান্য হেসে বললেন, ‘আগে আমাকে জানতে হবে, আদৌ আপনার কোনও অসুখ করেছে কিনা। এই বিষয়েও আমি নিশ্চিত নই। মানবমনের যাবতীয় অস্বাভাবিকতাই যে অসুখ এ কথা বলা যায় না। তাহলে যে মানুষ অন্য ধরনের ভাবনাচিন্তা করেন, কল্পনা করেন, যা ঘটেনি তা নিয়ে চিন্তা করেন, তাকে অসুস্থ ধরতে হয়। তা তো একেবারেই নয়। মিস্টার সেন, এটাও তেমন হতে পারে। আপনার এটা অসুখ নাও হতে পারে।’
বিমলকান্তি অস্ফুটে বলেন, ‘তবে কী?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘সেটাই তো খুঁজে বের করতে হবে। ঠিক দুদিন পর, এই সময় আসবেন। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিখে রাখলাম।’
বিমলকান্তি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হালকা বোধ করলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, এটা কোনও অসুখ নাও হতে পারে। এটা খুব ভালো কথা। ডাক্তার রায় চমৎকার একজন মানুষ। কী সুন্দর কথা বলেন। মনের চাপ অনেকটা কমিয়ে দিলেন। মনে মনে কর্ণিকাকে ধন্যবাদ দিলেন বিমলকান্তি। হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। আটটা বেজে গেছে। তাও একবার অফিসে গেলে ভালো হত। এই সপ্তাহে একটা বড় অর্ডার সামলাতে হবে। থাক, আজ যাবেন না। ক্লান্ত লাগছে।