» » পঞ্চম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

ছেচল্লিশ

ঋষা বলল, ‘কী খাবে?’

বারিধারা বলল, ‘কিছু খাব না, শুধু কফি।’

ঋষা বলল, ‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, খিদে পেয়েছে।’

বারিধারা সামান্য হেসে বলল, ‘সত্যি খিদে পেয়েছে।’

ঋষা টেবিল থেকে উঠে কাউন্টারের কাছে গেল। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কফি আর স্যান্ডুইচ বলল। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে বসতে চেয়েছিল বারিধারা। ঋষাই রাজি হয়নি।

‘বড্ড ভিড়। চলো পাশেই কফিশপ। ওখানে গিয়ে বসি। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।’

একসময় কলকাতায় কফির দোকান বলতে কফিহাউসই বোঝাত। একটা কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর জায়গা। কবিতা, গল্প, লিটল ম্যাগাজিন, ডকুমেন্টারি, বিপ্লব কী নেই সেখানে! সেইসঙ্গে পকৌড়া, টোস্ট, কবিরাজি। কিছু না নিলেও চলে। এমনি বসে থাকা যায়। সর্বক্ষণ একট গমগম আওয়াজ। সিগারেটের ধোঁয়া। একটা বয়স পর্যন্ত ঘোরের মতো লাগে। এখন গোটা শহরে নামিদামি কফিশপ ছড়িয়ে পড়েছে। এয়ার কন্ডিশন ঘরে, নরম সোফায় বসে কফি খাওয়া যায়। এসব জায়গায় অনেক ধরনের বিজনেস মিটিংও হয়। শহরের চেহারাটা বাইরে থেকে নানাভাবে পালটে যাচ্ছে।

বারিধারা ও ঋষা মুখোমুখি বসেছে। কফিশপটা প্রায় ফাঁকা। এক কোণে সোফায় দুজন ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। নীচু গলায় গল্প করছে। তাদের প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বারিধারা, ঋষা বসেছে মাঝখানের একটা টেবিলে। দুই সুন্দরীর জন্য কফিশপটা যেন ঝলমল করছে।

ঋষা বলল, ‘তোমার দাদুর মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লেগেছিল।’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘উনি বিরাট পণ্ডিত বা দার্শনিক ছিলেন না। তেল, সাবান, শ্যাম্পুর ব্যবসা করলে তো এসব হওয়া যায় না। তারপরেও দাদু ছিলেন একজন গ্রেট মানুষ। ওনার যাবতীয় পাঠ জীবন থেকে। জীবন তাঁকে শুধু বাঁচাতে শেখায়নি, ভালোভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। অন্যকেও তিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন।’

ঋষা বলল, ‘খাঁটি মানুষরা এমনই হয়। তোমরা খুব লাকি বারিধারা এমন একজন মানুষকে পরিবারে পেয়েছিলে।’

বারিধারা বলল, ‘এখনও উনি আমাদের সঙ্গেই আছেন।’

ঋষা বলল, ‘অবশ্যই। এই সব মানুষদের মৃত্যু হয় না।’

কফি এসে গেলে দুজনে চিনি মিশিয়ে মগ হাতে তুলে নিল। বারিধারা মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ঋষা, অর্চিনদার ব্যাপারটা কী? সত্যি সে গ্রামে চলে গেছে?’

ঋষা বলল, ‘আমি যতদূর জানি গেছে। আজ সকালেই রওনা হয়ে গেছে। নোনাজল।’

‘নোনাজল! সেটা কোথায়?’

ঋষা বলল, ‘সুন্দরবনে। সজনেখালি থেকে আরও ঘণ্টাখানেক যেতে হয়।’

বারিধারা চুপ করে খানিকক্ষণ কফি খেল। ন্যাপকিন তুলে মুখ মুছে বলল, ‘অর্চিনদা আর লেখাপড়া করবে না?’

ঋষা বলল, ‘আমাকে তো সেরকমই বলেছে।’

‘মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে।’

ঋষা বলল, ‘স্বাভাবিক। ওনারা অর্চিনের জন্য যা করেছেন, তাতে…’

বারিধারা বলল, ‘একটা কথা বলব ঋষা?’

ঋষা হেসে বলল, ‘এ আবার কেমন কথা? বলবে না কেন?’

বারিধারা তারপরেও একটু চুপ করে রইল। চামচ নিয়ে কফি মগে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘তুমি অর্চিনদাকে আটকালে না কেন?’

ঋষা হাসল। বলল, ‘আমার সে জোর কই?’

বারিধারা নরম গলায় বলল, ‘এটা কি ঠিক কথা হল?’

‘হ্যাঁ, ঠিক কথাই হল। বারিধারা, তুমি তো জানো কিছু সম্পর্কে জোর থাকে না। ভালোবাসলেই জোর খাটানো যায় না।’

বারিধারা বলল, ‘অর্চিনদা তো জোরই খাটাল। কারও বারণ না শুনে চলে গেল।’

ঋষা অস্ফুটে বলল, ‘আমি বারণ করিনি, আবার হ্যাঁ-ও বলিনি।’

বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন করোনি? লেখাপড়ায় ইতি টেনে অর্চিনদার মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট ছেলের চলে যাওয়াকে তুমি আটকাবে না!’

ঋষা শান্তভাবে বলল, ‘সবাই সব পারে না বারিধারা। মানুষ বকাবকি করলে বা দুর্বল ভাবলেও পারে না।’

বারিধারা লজ্জা পেল। ঋষাকে এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। ও ভাবল, ওকে দুর্বল ভাবা হচ্ছে। বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে সবাই তার মতো প্রজেসিভ হবে এমন মনে করবার কারণ নেই। সে যেভাবে শ্রবণকে কন্ট্রোল করে, ঋষা তা নাও পারে। নিজের মতো করে সবাইকে ভাবা যেমন ঠিক নয়, অর্চিনদা আর শ্রবণকে একরকম ভাবাটাও ঠিক নয়। রাজনীতি করা মানুষরা অন্যরকম হয়। শিল্পীরাও অন্যরকম হয়। দুটো অন্যরকম মানুষের মধ্যে যেমন তুলনা চলে না, তাদের সঙ্গে ব্যবহারও একরকম হবে না। বারিধারা হাত বাড়িয়ে ঋষার হাতের ওপর হাত রাখল।

‘সরি, আমি তোমাকে ওভাবে বলতে চাইনি। বুঝতেই তো পারছ, অর্চিনদার ঘটনাটা নিয়ে আমরা ডিসটার্বড। তাছাড়া দোষ তো আমাদেরও। অর্চিনদা তো আমাদের বাড়ির লোক। আমরাও তো বুঝতে পারিনি, সে এতদূর ভেবে ফেলেছে। জানাতে পারলে মা নিশ্চয় আটকাত। তুমি কিছু মনে করো না। আমার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। তোমার মনের অবস্থা আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি আবার দুঃখ প্রকাশ করছি।’

ঋষা বলল, ‘ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। তোমাদের উৎকণ্ঠা আমি বুঝতে পারছি।’

বারিধারা এবার ঝুঁকে পড়ে, গলা নামিয়ে বলল, ‘ঋষা, আমরা যদি ওই নোনাজল গ্রামে গিয়ে অর্চিনদাকে চেপে ধরি? জোর করি? ফিরে আসবে না? চলো না, একবার চেষ্টা করি।’

ঋষা হাসল। বলল, ‘লাভ হবে না বারিধারা। আমি যতদূর জানি, অর্চিন মন শক্ত করেই গেছে। লাভ হলে তো আমিই তাকে আগে আটকাতে পারতাম।’

বারিধারা বলল, ‘তাও একবার চেষ্টা করতে অসুবিধে কী? চলো কালই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মা-ও যাবে।’

ঋষা এবার মুখ কঠিন করে বলল, ‘না বারিধারা। আমি যাব না।’

বারিধারা সোজা হয়ে বসল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন? যাবে না কেন?’

ঋষা বলল, ‘আমি তাকে জোর করবার বিপক্ষে। সে ছোট নয়, বোকাও নয়। ঠিক ভুলের পার্থক্য সে জানে। তাছাড়া…তাছাড়া… তার কাছে রাজনীতি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সেখান থেকে তাকে সরে আসতে বলবার কে বারিধারা? আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না বলে? কেউ যদি এখন আমাকে বলে কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন সব ছেড়ে দিতে, কোনও দাম নেই এসবের, আমি ছেড়ে দেব? সরি, বারিধারা। অর্চিন শুধু তার লেখাপড়া, রেজাল্ট নিয়েই অর্চিন নয়, তার বিশ্বাস, আদর্শ নিয়েই সে অর্চিন। আমি গোটা অর্চিনকেই ভালোবাসি। এতে আমার ক্ষতি হলে মেনে নিতে হবে। তাকে তার পথে চলতে দেওয়াই উচিত।’

বারিধারা চুপ করে রইল। সে মুগ্ধ। ঋষা এতটা পরিণত! সত্যি তো সে যা বলছে, সবক’টা কথাই যুক্তিযুক্ত। অর্চিনদা নিজের বিশ্বাসমতো জীবন কাটাতে চাইছে। তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে কেন? শ্রবণের কাজ নিয়েও তো তার বাড়ি থেকে আপত্তি আছে। তার মানে শ্রবণকে আঁকাজোকা ছেড়েছুড়ে সাধারণ একটা চাকরি নিতে হবে? এবারও সে ভুল কথা বলে ফেলল। বারিধারার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে আবার ঋষার জন্য গর্বও হচ্ছে। ঠিক মেয়েই অর্চিনদা পছন্দ করেছে।

বারিধারা বলল, ‘ঠিকই বলেছ ঋষা। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। আসলে আমার মা এমনভাবে বলল… বলল… দেখ না, অর্চিনের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে যদি ওর খোঁজ পাওয়া যায়… আমরা গিয়ে একবার… এখন বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হবে না…।’

ঋষা হেসে বলল, ‘মায়েদের মন তো এমনই হবে।’

বারিধারা হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল। বলল, ‘চলো ওঠা যাক।’

দুজনেই উঠে দাঁড়াল, আর তখনই একজন লোক কাচের দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে কফিশপের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কাউন্টারের কাছে প্রায় ছুটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে।’

কফিশপ এখন পুরো ফাঁকা। কোণে বসা দুজন ছেলেমেয়ে কখন উঠে গেছে।

বারিধারা চমকে লোকটার দিকে তাকাল। মলিন, বিধ্বস্ত জামাকাপড়ের একজন ভয় পাওয়া মানুষ। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। কাঁধের ঝোলাটা কোনওরকমে চেপে ধরে আছে। এই চকচকে কফিশপের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। কাউন্টারে একজন কমবয়সি মেয়ে আর একজন ছেলে। দুজনেই ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ানোই স্বাভাবিক। দিনদুপুরে এ কী ঘটনা! লোকটা কোথা থেকে এল?

বারিধারা ঘুরে তাকাল। কাউন্টারের ছেলেটি বলল, ‘আপনি কে? কী চান এখানে?’

বিধ্বস্ত লোকটা কাচের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘প্লিজ, আমাকে একটা লুকোনোর জায়গা করে দিন। পায়ে পড়ি আপনাদের।’

কাউন্টারের মেয়েটি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কে আপনি? চলে যান, চলে যান বলছি। এসব এখানে হয় না।’

লোকটার চোখমুখ আরও কুঁকড়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘না না, আমি যাব না। ওরা আমাকে বাসস্ট্যান্ড থেকে তাড়া করেছে, এক্ষুনি এখানে এসে ঢুকবে। বাথরুমটা কোনদিকে?’

বারিধারা এগোতে গেলে ঋষা ওর কাঁধ চেপে ধরল। আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘যেও না।’

বারিধারা কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু হবে না।’

বারিধারা কয়েক পা এগিয়ে পিছন থেকে বলল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে আপনার? কারা আপনাকে তাড়া করেছে?’

 লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। চমকে উঠল বারিধারা। তার শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বংশীবাদক! এই সেই বংশীবাদক লোকটা। দিদির বাড়ির থেকে সব চুরি করে পালিয়েছে।

‘আপনি!’

বংশীবাদকের চেহারা অনেক বদলেছে। চোখমুখের ঢুলু ঢুলু ভাবটা নেই। বরং একমুখ খোঁচা দাড়িতে চোয়াড়ে মার্কা ভাব। চুল এলোমেলো। পোশাকও অন্যরকম। পায়জামা, কুর্তির বদলে ফতুয়া। কাঁধের ব্যাগটাই যা একরকম আছে। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে।

বারিধারা এগিয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ডান হাত তুলে বলল, ‘আপনি সেই বাঁশিবাজিয়ে না? আপনিই তো। দিদির বাড়িতে ডাকাতি করেছেন।’

ঋষা প্রায় ছুটে এসে বারিধারাকে চেপে ধরে। বারিধারা ঝটকা মেরে ঋষাকে সরিয়ে দেয়। কাউন্টারের ছেলেমেয়ে দুটো ফোন করবার চেষ্টা করছে। সম্ভবত পুলিশকে। মনে হয় নম্বর মনে করতে পারছে না।

বংশীবাদক পিছোতে গিয়ে একটা চেয়ারে ধাক্কা খেল। চেয়ারটা উলটে পড়ল।

‘কী বলছেন দিদি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কেন বাঁশি বাজাতে যাব! কী বলছেন!’

বারিধারা দাঁত মুখ শক্ত করে বলল, ‘কী বলছি বুঝতে পারছ না? তুমি সে-ই বাঁশিওয়ালা। দিদির বাড়িতে ডাকাতি করেছ। দাঁড়াও সব মনে করাচ্ছি।’

বংশীবাদক বলল, ‘আপনি ভুল করছেন দিদি…আমি বাঁশি বাজাই না…।’

বারিধারা মোবাইলটা তুলে বলল, ‘দাঁড়াও আমি দেখাচ্ছি, তুমি বাঁশি বাজাও কিনা।’

এবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যা ঘটল সেটা শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়। অথবা এই ধরনের ঘটনা বাস্তবেও এমনটাই হয়। কেউই তার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

বংশীবাদক একটা লাফ দিল। হাত ছুড়ল এমনভাবে যাতে বারিধারা মুখে আঘাত পায়। ঋষা টেনে না সরিয়ে নিলে বিপদ হত। বংশীবাদক একটা টেবিল উলটে ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে বেরিয়েই পড়ল রাস্তায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোটরবাইক এসে দরজার বাইরে দাঁড়াল। দুটো লোকের মাথায় মুখঢাকা হেলমেট। পেছনের লোকটা বাঁ হাত তুলল। হাতে রিভলভার। বংশীবাদক ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাঁ হাত তোলা লোকটা গুলি চালাল, চাপা আওয়াজ, আগুনের ঝলকানি। আবার গুলি।

নিমেষে মোটরবাইক মুখ ঘুরিয়ে উলটোদিকে চলে গেল ঝড়ের বেগে।

গায়ে দু’বার গুলি লাগবার পরও বংশীবাদক উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। পারে না। মুখ থুমড়ে পড়ে।

কাচের দরজার ভেতর থেকে গোটা ঘটনা দেখে বারিধারা আর ঋষা। ঋষা চেপে ধরে আছে বারিধারাকে। সে ভয়ে কাঁদছে।

বারিধারা ফিসফিস করে বলল, ‘ডাকাত হলেও, লোকটা গুণী ছিল। বড় ভালো বাঁশি বাজাত।’