☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
চুয়াল্লিশ
মণিকুন্তলা ঘরে ঢুকে স্বামীর দিকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। লম্বা কাগজ। বিমলকান্তি বললেন, ‘কী এটা?’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘পড়ে দেখো।’
বিমলকান্তি কাগজের ভাঁজ খুললেন। চোখ ওপর থেকে নীচে নামালেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মণিকুন্তলা চুপ করে রইলেন।
কমলকান্তি সেনের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ির সকলেই মোটামুটি সামলে নিয়েছে। মণিকুন্তলার সময় লাগছে। পুরোটা স্বাভাবিক হতে পারছেন না। ঘুরেফিরে মানুষটার কথা মনে পড়ে। কমলকান্তি সেন শুধু তাঁর শ্বশুরমশাই ছিলেন না, বন্ধু ছিলেন। তার থেকে বেশিও হতে পারে। মেয়েরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
বারিধারা বলে, ‘মা, দাদু কিন্তু মুখ গোমড়া করে থাকা মোটে পছন্দ করত না। দাদু যদি বেঁচে থাকত, তোমাকে ধমক দিত।’
মণিকুন্তলা হেসে বললেন, ‘আমি মুখ গোমড়া করে আছি কোথায়? এই তো হাসছি।’
মেঘবতী বলে, ‘এটা তোমার আসল হাসি নয়, নকল হাসি।’
মণিকুন্তলা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসেন। বলেন, ‘দুর হাসি হাসি-ই। তার আবার আসল নকল কী? আমি কি অভিনয় করি যে, বানিয়ে হাসব?’
বারিধারা বলে, ‘দাদুর চলে যাওয়া আমরা কেউ মেনে নিতে পারি না, কিন্তু এটা তো ইনএভিটেবল ছিল।’
মেঘবতী বলল, ‘সত্যি কথা বলতে, মানুষটা সুস্থ শরীরে যেতে পারলেন, এটাও একটা ভালো কথা। কত মানুষ তো রোগে দীর্ঘ দিন কষ্ট পায়। সেটা আমাদের সকলের জন্য বেশি খারাপ হত।’
বারিধারা বলল, ‘দাদু শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছে। একটু পরে রোদ উঠবে-র প্রাোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই বয়সে অমন একটা রিপোর্ট তৈরির কথা ভাবা যায়! সবদিক খেয়াল রেখেছে।’
মেঘবতী বলল, ‘মা, এবার তুমি মন শক্ত করো।’
বারিধারা বলল, ‘হ্যাঁ, এবার ঠিক না হলে মুশকিল। একটু পরে রোদ উঠবে-র কাজ শুরু করতে হবে না? তোমাকে মেজর দায়িত্ব নিতে হবে মা।’
মেঘবতী বলল, ‘জ্যোতিষ্ক বলেছে চাকরি ছেড়ে দেবে। তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে।’
বারিধারা বলল, ‘একটু পরে রোদ উঠবে প্রাোজেক্টের মধ্যে দিয়ে দাদু আবার বেঁচে উঠবে।’
মণিকুন্তলা সামান্য হাসলেন। মেয়েরা তাঁর মন ভালো করার চেষ্টা করছে। জোর করে হবে না। সময় লাগবে। ওরা জানে না, কমলকান্তি সেন কী ভয়ঙ্কর একটা সময় তাদের মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জানলে বুঝত, এখনও কেন মানুষটাকে মন থেকে সরাতে পারছেন না। মেয়েরা এই জিনিস জানবেও না। মায়ের অতীত প্রেমের কথা মেয়েদের জানার দরকার নেই। জেনেছিলেন কমলকান্তি সেন। জানার পর অত বড় কোম্পানির মালিক, অমন দাপটের একজন মানুষ পরম মমতা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মাথায় হাত রেখেছিলেন। এই সমর্থন না পেলে মণিকুন্তলাকে সেদিন হয় আত্মহত্যা করতে হত, নয়তো এই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হত। আধুনিক চিন্তা, যুক্তি, মানুষকে বুঝতে পারার গভীর ক্ষমতা দিয়ে কমলকান্তি সেদিন পুত্রবধূকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাকে বুঝিয়েছিলেন, যা ঘটেছে তাতে কোনও অপরাধ নেই। মণিকুন্তলার মনে হয়, আজ যারা আধুনিকতার বড়াই করে, তাদের সেই ঘটনা জানা উচিত। বোঝা উচিত, আধুনিকতা মানে জামাকাপড় খুলে ঘুরে বেড়ানো নয়, আধুনিকতা মানে মনের ভেতর থেকে সত্যকে উপলব্ধি করা।
তখন বিয়ের সবে এক বছর হয়েছে। একদিন দুপুরে খেতে বসে কমলকান্তি সেন বললেন, ‘কী হয়েছে মা? এত চিন্তা কীসের?’
মণিকুন্তলা শুকনো মুখে বলেছিলেন, ‘কিছু হয়নি।’
কমলকান্তি স্বাভাবিক গলায় বলেছিলেন, ‘কিছু না হওয়া ভালো না। মাঝে মাঝে কিছু হলে তবেই বোঝা যায় বেঁচে আছি। সেটা ভালোও হবে। মন্দও হবে।’
মণিকুন্তলা চুপ করে রইলেন। তিন দিন স্বামী তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন না। না বলার কারণ আছে। শনিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে গিয়েছিলেন মণিকুন্তলা। বাড়ির কাউকে বলেননি। তিনি গিয়েছিলেন কৌরবকে দেখতে। কৌরব অসুস্থ হয়ে সেখানে ভর্তি আছে। তার কঠিন ধরনের জন্ডিস হয়েছে। কৌরব এক বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল।
‘বাঁচব কি না ঠিক নেই, মণি যদি একবার আসে।’
যাব না, যাব না, এখন আর যেতে নেই। বারবার ভেবেছিলেন মণিকুন্তলা। তার পরও শনিবার বিকেল চারটের সময় তৈরি হয়ে নিলেন। নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন একরকম চুপিচুপিই। অতটা চুপিচুপির দরকার ছিল না। কাজের লোকজন, দারোয়ান ছাড়া এই সময় সেনবাড়িতে কেউ থাকে না। মণিকুন্তলা ট্যাক্সিতে উঠে বুঝতে পারেন, কাজটা ঠিক হল না। এখন তিনি বিবাহিত। সেনবাড়ির বউ। কৌরব এখন আর তাঁর কেউ নয়। এক সময় ভালোবেসেছিলেন এটা সত্য, তার বেশি নয়। ট্যাক্সি কি ঘুরিয়ে নেবেন? তাই উচিত।
এই পর্যন্ত ভেবেও ট্যাক্সি ঘুরিয়ে নিতে পারেননি মণিকুন্তলা। শান্ত, নিস্তরঙ্গ, শুকিয়ে আসা ছোট নদীতে চোরা টান তৈরি হয়। সেই টান ওপর থেকে বোঝা যায় না। নদীও পারে না। সর্বনাশের টান। যা অমোঘ, অবশ্যম্ভাবী। মানুষ বা প্রকৃতিকে এই আকর্ষণ অস্বীকার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এর কাছে আত্মসমর্পণই একমাত্র উপায়।
কৌরবের বেডের সামনে গিয়ে মণিকুন্তলা বুঝতে পেরেছিলেন, ভালোবাসা কখনও পুরোনো হয় না। সে ভুলে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে। সে হারিয়ে যায়, কিন্তু টিকে থাকে। বেডের সঙ্গে মিশে যাওয়া কৌরবের একটা হাত চেপে ধরেছিলেন মণিকুন্তলা। তাঁর চোখে জল এসেছিল। সেই জলের খেয়াল ছিল না, মণিকুন্তলা এখন আর কলেজে পড়া, বিনুনি ঝোলানো মেয়ে নন। তিনি কলকাতা শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের বউও। সেদিন নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগেছিল মণিকুন্তলার। তিনি জানতে পারেননি, একটু দূরেই তাঁর স্বামী বিমলকান্তি বিস্মিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনিও নার্সিংহোমে এসেছিলেন এক পরিচিত রোগীকে দেখতে। এসেছিলেন অফিসের ফাঁকে। নববিবাহিত স্ত্রীকে এভাবে একজন অপরিচিত যুবকের হাত ধরে কাঁদতে দেখে তিনি এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন যে, ডাকার কথাও মনে পড়েনি। সম্ভবত তাঁর ভেতর থেকে কেউ বারণ করে—ডেকো না, এই সময় ডাকতে নেই।
নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে মণিকুন্তলার সংবিৎ ফিরে আসে। তিনি যেমন নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করেন, তেমন ভয় পান। কেউ দেখে ফেলল না তো? দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে থাকেন। জানতেও পারেন না, রাস্তার ওপরই সেনবাড়ির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে বিমলকান্তি বলেছিলেন, ‘লোকটা কে?’
মণিকুন্তলা চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘কোন লোক?’
‘সাউথ পার্ক নার্সিংহোমে আজ যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে, সেই লোকটা কে?’
মণিকুন্তলা চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘তুমি কী করে জানলে?’
বিমলকান্তি আরও গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘আমিও তখন ওখানে ছিলাম। তোমার থেকে খানকতক বেড দূরেই ছিলাম।’
মণিকুন্তলার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি ঢোঁক গিলে বললেন, ‘কই দেখতে পাইনি তো!’
বিমলকান্তি ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘দেখবে কী করে? যেভাবে পেশেন্টের হাত ধরে ছিলে এবং কাঁদছিলে, তাতে স্বামীকে দেখতে পাওয়া যায় না।’
‘ডাকলে না কেন?’
‘ডাকব কী করে? প্রায় ছুটেই তো বেরিয়ে গেলে। আমি পিছু পিছু গিয়ে দেখলাম, রাস্তা পার হয়ে লাফ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লে। যেন বিরাট অন্যায় কিছু করেছ।’
মণিকুন্তলা এবার কঠিন গলায় বললেন, ‘অন্যায়! অন্যায় করব কেন! তুমি কী বলতে চাইছ?’
বিমলকান্তি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘কিছুই না। শুধু জানতে চাইছি, লোকটা কে? বলতে ইচ্ছে না করলে বোলো না।’
মণিকুন্তলা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার পরিচিত। বিয়ের আগে থেকে পরিচয়। অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।’
বিমলকান্তি হাতের চায়ের কাপ নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘এতে লুকোচুরির কী আছে? বাড়ির গাড়ি নিয়ে গেলেই পারতে। বিয়ের আগে যার সঙ্গে পরিচয়, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে স্বামীর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না, এমন কোনও নিয়ম নেই। মণিকুন্তলা, তুমি বোধহয় এতদিনে জেনে গেছ, আমি সব কাজেই সিরিয়াসনেস পছন্দ করি। সেটা অন্যায়, অনুচিত হলেও।’
ব্যস, এইটুকু বলেই বিমলকান্তি চুপ করে যান। কমলকান্তি সেন পুত্রবধূর মুখ দেখে আঁচ করেছিলেন।
‘বুঝলে মণিকুন্তলা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ভালো লক্ষণ। এতে সংসারের জোর বাড়ে। ভয়টা কী জানো মা, আমার গাধা ছেলেটা আবার সবকিছু অতিরিক্তি সিরিয়াসভাবে নেয়। এতেই সমস্যা।’
মণিকুন্তলা একটু চুপ করে রইলেন। তিন দিন ধরে অসম্ভব মনঃকষ্টে ভুগছেন। পাপবোধ মনের ভেতর বড় হচ্ছে। দৈত্যের আকার নিচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিরাট একটা অন্যায় হয়ে গেছে। বিমলকান্তি নিশ্চয় এতক্ষণে সব জেনে গেছেন। জেনে গেছেন, তাঁর স্ত্রী প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে দেখা করতে গিয়েছিল। ছি ছি। এর পরিণতি কী? সেনবাড়ি ছাড়তে হবে? তা হলে তো গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না। এই কথা শ্বশুরমশাইকে কি বলা যায়? যায় না। কিছুতেই যায় না। তার পরেও মনে হচ্ছে, এই মানুষটাই তাঁর শেষ সম্বল।
মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা, একটা অন্যায় করে ফেলেছি। খুব বড় অন্যায়।’
কমলকান্তি মুখ তুলে পুত্রবধূর দিকে তাকালেন। মেয়েটার চোখ ছলছল করছে।
‘খাওয়া শেষ করি। তার পর তোমার অন্যায় শুনব মা। তরকারিটা আজ বড্ড চমৎকার হয়েছে। ভাগ্যিস বয়স হয়েছে, আর সেই ছুতোয় অফিস থেকে লাঞ্চ করতে বাড়ি আসতে পারি। বয়স কম ছিল যখন, তখন তো পারতাম না। হাবিজাবি খেতে হত। বিমলের এখন যা অবস্থা। বেটা ক্যান্টিনের ছাইভস্ম খায়, আর বাবাকে হিংসে করে।’
কথাটা বলে গলা তুলে হেসে উঠলেন কমলকান্তি। মণিকুন্তলা বুঝতে পারলেন, এই চমৎকার মানুষটা ইচ্ছে করে খাওয়ার প্রসঙ্গ আনছেন। ভাবটা এমন, যেন পুত্রবধূর অন্যায়ের থেকে তরকারি তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষটা খাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তাই করেন না, যা দেওয়া হয় তা-ই চুপ করে খেয়ে নেন, তিনি তরকারি নিয়ে এত ভাববেন কেন?
চোখ বুজে ঘটনা শুনলেন কমলকান্তি।
‘মণিকুন্তলা, তোমাকে ক’টা কথা জিগ্যেস করব। তুমি কি মা সঠিক উত্তর দেবে?’
মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বললেন, ‘দেব।’
‘তুমি কি আমাকে বন্ধু বলে মনে করো?’
মণিকুন্তলা কান্না চেপে বললেন, ‘করি বাবা, করি বলেই তো আপনাকে ঘটনাটা বলতে পারলাম। এটা কি শ্বশুরমশাইকে বলার মতো?’
কমলকান্তি বললেন, ‘তোমাকে কি বিমলের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে?’
মণিকুন্তলা মুখ তুলে বললেন, ‘না! ওই ছেলেটি বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। তা ছাড়া ওর সংসার করার মতো অর্থিক সামর্থ্য নেই। তার পরেও আমি বলেছিলাম। ও রাজি হয়নি। আমি সম্পর্ক ত্যাগ করি।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তুমি কি ওই ছেলেটিকে এখনও ভালোবাসো?’
মণিকুন্তলা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাসি। তবে তার প্রাপ্য যেটুকু সেটুকুই বাসি। কোনও যোগাযোগ রাখি না। অসুখের খবর শুনে তাকে দেখতে চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি স্বীকার করছি, আমার অন্যায় হয়েছে। আমি কি আপনার ছেলেকে এ কথা বলব?’
কমলকান্তি এবার সোজা হয়ে বসলেন। গলায় জোর এনে বললেন, ‘আলবাত ঠিক হয়েছে। বেশ করেছ তাকে দেখতে গেছ। কীসের অন্যায়? অন্যায় কে ঠিক করবে? ভালোবাসা কি অন্যায়?’
মণিকুন্তলা চমকে উঠেছিলেন। মানুষটা এসব কী কথা বলছেন!
‘বাবা, এ আপনি কী বলছেন?’
কমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক বলছি। তোমার বিয়ে হয়েছে বলে, তোমার যাবতীয় সুখ-দুঃখ-ভালোবাসা-কষ্ট রাস্তায় ফেলে দিয়ে এ বাড়িতে ঢুকতে হবে নাকি? তুমি ওই ছেলেটাকে ভালোবাসো, এর মধ্যে কোনও অপরাধ নেই। পরিস্থিতি বদলেছে। তুমি আর আগের মণিকুন্তলা নেই। তুমি এখন এ বাড়ির বউ, গৃহকর্ত্রী। আগে যে আচরণ তুমি করতে পারতে, এখন তা পারো না। অনেক লিমিটেশন আছে। তার মানে এই নয়, তুমি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। বাইরের মানুষকে তো তুমি তোমার ঘরে এনে তুলছ না। তার ঘরেও তুমি যাচ্ছ না। তাকে তার মতো করে ভালোবাসছ। বেশ করেছ। আমার তো তোমাকে হিংসে হচ্ছে মা। ইস, আমার কোনও ভালোবাসার মানুষ নেই কেন?’
মণিকুন্তলা আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, ‘আপনি ঠিক বলছেন বাবা? আমি কৌরবকে নার্সিংহোমে দেখতে গিয়ে কোনও ভুল করিনি?’
‘ভুল! কে বলে ভুল করেছ? আমার গাধা পুত্র বলে না, সব কাজ সিরিয়াসভাবে করতে হবে? বলে না সে? তুমি তো সিরিয়াস মনোভাবই দেখালে। বন্ধুর অসুস্থতার খবরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছ।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘অত কিছু নয় বাবা, শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলাম। আমার বাড়িতে যদি জানে…আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।’
কমলকান্তি বললেন, ‘সামলাবে কেন? কার ভয়ে?’
‘না আমার ওভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।’
কমলকান্তি প্রায় গর্জে উঠলেন। বললেন, ‘আবার যাবে। শুধু যাবে-ই না, কাউকে কৈফিয়তও দেবে না। বিমল কার কাছে কখন যায়, তার ফিরিস্তি তোমাকে দেয়? তুমি কেন দেবে?’
মণিকুন্তলা মাথা নামিয়ে বললেন, ‘উনি তো গোপনে যান না।’
কমলকান্তি বিরক্তভাবে বললেন, ‘গোপনে গেলে খারাপ মানুষের কাছে যাওয়া হয়, এই যুক্তি তুমি কোথা থেকে শিখলে? যাই হোক, আমি তোমার পাশে আছি মা। আমি তোমাকে সমর্থন করি। তোমাকে এ বাড়িতে এনেছি মানে তোমার মনটাকে কিনে ফেলেছি, এমন নয়। কেনা যায়ও না। মন বড় রহস্যময়। সেই কারণে সুন্দর। সে শুধু একজনকে ভালোবাসবে, একজনকে ঘৃণা করবে—এমন কোনও নিয়ম নেই। তার নিজের জগৎ থাকে। সেখানে হাসি থাকে, কান্না থাকে। সবই তার নিজের। তুমি নিজেও তার খবর রাখো না। বিমলের প্রতি তোমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা যদি যথার্থ হয়, তা হলে তা এমনিই হবে। তাকে যেমন জোর করে আনা যায় না, আবার জোর করে আটকানোও যায় না। আমি বিমলের সঙ্গে কথা বলব। সে তোমার সঙ্গে যে আচরণ করছে, সেটাই অন্যায়। লজ্জারও। শিক্ষা মানুষের বোধবুদ্ধি তৈরি করে। যে বোধবুদ্ধি পাশের জনকে বুঝতে শেখায়। গাধাটার উচিত তোমাকে বোঝা। তোমার ভালোবাসাকে সম্মান না করলে সে নিজে ভালোবাসা পাবে কী করে?’
মণিকুন্তলা সেদিন উঠে গিয়ে কমলকান্তির পায়ে হাত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন।
কৌরবের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। বিমলকান্তিকে তাঁর বাবা ডেকে কী বলেছিলেন, তা-ও মণিকুন্তলা জানেন না, তবে সেদিন রাতেই বিমলকান্তি তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। যে ঘটনা ভয়ঙ্কর পরিণতিতে শেষ হতে পারত, তা খুব মসৃণভাবে হারিয়ে গেল। বিমলকান্তি কোনওদিনও এ প্রসঙ্গ তোলেননি। সম্ভবত তিনি তাঁর বাবার কথা বুঝতে পেরেছিলেন।
এই ঘটনা বারিধারা, মেঘবতীরা জানবে কী করে?