» » পঞ্চম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

তেতাল্লিশ

ঋষা গাঢ় স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে?’

অর্চিন বলল, ‘কী হয়েছে নয়, কী হবে তাই ভাবছি।’

ঋষা ঝুঁকে পড়ে অর্চিনের কপালের ভাঁজে চুমু গেল। অস্ফুটে বলল, ‘তোর ভাবনায় চুমু দিলাম।’ তারপর হেসে বলল, ‘খালি ভাবনা আর ভাবনা। এই ভাবুক ছেলেটার প্রেমে পড়ে যত মুশকিল হল আমার।’

অর্চিন চোখ বুজে বলল, ‘তোকে প্রেমে পড়তে কে বলেছে? চারপাশে কত না-ভাবনার ছেলে আছে, তাদের কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে পারতিস।’

ঋষা বাঁ হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ডান হাত দিয়ে অর্চিনের নাক নেড়ে আদুরে গলায় বলল, ‘তুই বলেছিস। তুই দায়ী। আমার কি প্রেমিক পেতে কোনও অসুবিধে ছিল? প্রেম-টেম নয়, কত ছেলে চাইত আমি একবার শুধু মুখ ফিরিয়ে তাকাই।’

অর্চিন চোখ বোজা অবস্থাতেই পা নাড়াতে নাড়াতে বলল ‘তাকালি না কেন?’

‘তুই তাকাতে দিলি কই?’

অর্চিন চোখ খুলে ঋষার মুখের দিকে তাকাল। বলল, ‘এবার দেব।’

ঋষা মুখ নামিয়ে দিল অর্চিনের মুখের ওপর। নিজের নাক দিয়ে অর্চিনের মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, ‘বয়ে গেছে।’

পৃথিবীর যাবতীয় প্রেম তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে দেখতে প্রধানত হাস্যকর। প্রেম দেখে কেউ মুচকি হাসেনি, এমন লোক পাওয়া মুশকিল। মুখে না হাসলেও মনে মনে হাসে তো বটেই। সিনেমা, থিয়েটার, গল্পের বইয়ের প্রেমের কথা ধরলে চলবে না। সেসব প্রেম ড্রইংরুমে রাখা বইয়ের তাকের মতো সাজানো গোছানো। কথার সঙ্গে কথা মিলিয়ে কথা, মিলনের সঙ্গে মানানসই করে গান, বিরহের সঙ্গে চোখের জল। আসল প্রেমে এইসব কারসাজি চলে না। কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা দাবি করতে পারবে না, তারা ভেবেচিন্তে, কথা বা আচরণ সাজিয়ে প্রেম করতে পারে। হয়তো ভেবে আসে বিস্তর, এমনকী বাড়িতে রিহার্সালও দেয়, কিন্তু আসল সময় সব ভেস্তে যায়। সত্যি প্রেম সবসময়ই এলোমেলো, উলটোপালটা, অসঙ্গতিতে ভরা। তাই দুজনের কাছে মধুর, তিন নম্বর মানুষের কাছে হাসির। প্রেমরত দুজনকে দেখলে মনে হয়, মন দিয়ে বোকার অভিনয় করছে। পাল্লা দিচ্ছে, কার অভিনয় কত ভালো হয়। এই মুখে হাসি, তো এই মুখগোমড়া। এই চোখে মুগ্ধতা, তো এই চোখ কটমট। এই ঠোঁটে আহ্বান, তো এই ঠোঁট ফোলানো। পাহাড়ের আকাশ যেন। সর্বক্ষণ রোদ আর কুয়াশার মারামারি চলছে। প্রেমিক-প্রেমিকার আহ্লাদের কথা কানে এলে তো কথাই নেই। পেট গুড়গুড়িয়ে হাসি আসে। মনে হয়, দুজন মানুষ এমন কিছু কথা একটানা বলে যাচ্ছে, যার কোনও অর্থ নেই। পরম্পরা নেই। এরা পাগল নাকি! আর প্রেমের সঙ্গে যদি সেক্স থাকে, তা হলে মজার ষোলকলা পূর্ণ। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রেমোন্মাদ দুই নরনারীর যৌনতা দেখলে সেখানে শুধুই হিউমার। সময় বিশেষে মানুষ যে কতটা অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করতে পারে তার বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। শুধু অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, অবাস্তব। আর সেই কারণেই তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই ঘটনা হাস্যকর। বুদ্ধিমান দুজনের বেলায় হাসির সঙ্গে খানিকটা বিস্ময়েরও। সর্বদা যারা ভেবেচিন্তে, আগুপিছু হিসেব কষে, যুক্তি শিক্ষা বোধের ফিতে মেপে চলে, প্রেমের সময় তারাও এ কী কাণ্ড করছে! বুদ্ধিমানের আবেগও নিয়ন্ত্রিত থাকে। এরা যে সেই আবেগকেও জলাঞ্জলি দিয়েছে। শুধু শরীরের নয়, মনেরও যাবতীয় আগল খুলে ফেলেছে। হাসি না পেয়ে উপায় আছে?

মজার কথা হল, যারা প্রেম করে, তারা তৃতীয় ব্যক্তির হাসি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না। কে কী ভাবল, কে কী বুঝল, তাতে ভালোবাসায় মেতে থাকা নরনারীর কিছু যায় আসে না। তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, বোধ তাদেরকে বলে, ‘তোমরা শুধু ভালোবাসো, শুধু ভালোবাসো এবং শুধু ভালোবাসো’। সেই ভালোবাসা, তাকে সাজানো বইয়ের থেকে টেবিলে উজাড় করে রাখা অগোছালো বইপত্তর হতে বেশি মজা পায়। যেখানে একচোটে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাসি, রাগ, অভিমান কিচ্ছু না। হাতড়াতে হবে, উলটোপালটে, টেনেহিঁচড়ে, ফেলে-ছড়িয়ে দেখতে হবে। ধীরে ধীরে সব পাওয়া যাবে। যা চেয়েছিল, যা চাওনি সব। কখনও কখনও চরম মুহূর্তে মনের সঙ্গে শরীরও আসবে।

ঋষা আর অর্চিন এইমাত্র শরীরের ভালোবাসা শেষ করেছে। এখন তার ঘোর নিয়ে বসে আছে। দুজনের জামাকাপড় খাটের পাশে, মেঝেতে পড়ে আছে। অর্চিন ঋষার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। তার বুক পর্যন্ত চাদর। সেই চাদরের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে ঋষা। চাদর এবং অর্চিনে কোমর পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। কিন্তু বাকি শরীর তার উন্মুক্ত। মাথার চুল মাঝে মাঝে কাঁধ, বুক, পিঠের সামান্য অংশ ঢাকছে। না ঢাকবারই মতো। সেদিকে খেয়াল নেই ঋষার। সে এখন শরীরে আদরের ক্লান্তি নিয়ে অর্চিনের সঙ্গে আবেগ-আহ্লাদের খুনসুটি করছে। তার চোখে মুখে চুলে হাত বুলিয়ে, চুমু খেয়ে আদর করছে। মেয়েরা অপ্রিয় মানুষের কাছে মন ও শরীর দুটোই শক্ত করে নিতে জানে। মনে বর্ম বেঁধে নেয়, শরীরে লাগিয়ে নেয় কাঁটা। সেই বর্ম ও কাঁটা ভেদ করা অসম্ভব হয়। যদি কোনও পুরুষ জোর করে, সে হয় কিছুই পায় না, তারপরেও প্রেমিক, স্বামী বা ধর্ষক হিসেবে জোর করে কিছু আদায় করে তা হয় ক্ষতবিক্ষত। এই মেয়েই আবার প্রিয় মানুষের জন্য সব বর্ম খুলে ফেলে, উপড়ে ফেলে কাঁটা।

ঋষাকে এখন দেখলে তেমনটাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে শরীর আর মনের সব বাধা ছুড়ে ফেলে অর্চিনের কাছে পরম ভরসা, ভালোবাসায় নিজেকে সর্মপণ করে বসে আছে।

অর্চিন চেয়েছিল। আদর চেয়েছিল ঋষার। অস্থির মন নিয়ে শেখরদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে বুঝেছিল, শুধু মন নয়, শরীর থেকেও অস্থিরতা দূর করতে হবে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঋষা অর্চিনকে বুঝতে পেরেছিল। ড্রইংরুম থেকে ঘরে নিয়ে। আজ প্রথম নয়, এর আগেও একবার শরীরে মিলেছে তারা। সেটা ছিল একেবারেই হঠাৎ করে। পরের পিরিয়ড পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে ছিল। তারপর থেকে ঋষা সাবধান থাকে। নিজের কাছে ‘ব্যবস্থা’ রাখে। কৃষ্ণকলি শিখিয়েছে।

‘এরপর থেকে প্রাোটেকশন সঙ্গে রাখবি।’

ঋষা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘দুর, ও একবার হয়ে গিয়েছিল।’

কৃষ্ণকলি সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল, ‘আবার একবার হতে পারে।’

ঋষা বলেছিল, ‘তুই বাজে বকা থামা তো। বেশি গার্জেনগিরি ফলাস না।’

কৃষ্ণকলি বলেছিল, ‘এখন বাজে বলছিস, পরে কাজের বলবি। যা বলছি কর। গার্জেনরা বারণ করে, বন্ধুরা উৎসাহ দেয়। যাতে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারে।’ এই পর্যন্ত বলে কৃষ্ণকলি নাটকীয় ভঙ্গিতে গান ধরেছিল।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি যেন না করি ভয়…।’

ঋষা হেসে বলেছিল, ‘তুই থামবি? নাকি মার খাবি? আমার কিচ্ছু লাগবে না।’

কৃষ্ণকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, ‘বাঙালি মেয়েদের এই হল সমস্যা। হয় মন মন বলে হেদিয়ে পড়ল, নয় প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে রইল। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই। শরীর ব্যাপারটা জানতেই পারে না। ভোগ করতে পারা তো দূরের। আর পারল না বলে, বানিয়ে বানিয়ে নানা ধরনের সোশ্যাল মরাল ট্যাবু তৈরি করল। সবাই মিলে ঘাড়ে চেপেও বসল। বাঙালি ললনারা নিজের শরীরকে যদি ঠিকমতো উপভোগ করতে দিত, তারা সত্যি দাম বুঝত, পুরুষমানুষদের এত নোংরামি, দাপট থাকত না। ওরা মানসিকভাবেই সিঁটিয়ে থাকত। ভোগ করার কথাই ভাবতে পারত না।’

ঋষা হেসে বলল, ‘বাপরে, কী লেকচার। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, প্রাোটেকশনই বাঙালির মেয়েদের শক্তির হাতিয়ার।’

কৃষ্ণকলি বলেছিল, ‘হাসতে পারিস, কিন্তু ঘটনা সত্যি। প্রাোটেকেশন এখানে সিম্বলের মতো। সমাজ, রাষ্ট্র, নারীবাদীরা আমাকে কি পাহারা দেবে? আমি কি অবলা? আমার প্রাোটেকশন আমার কাছে?’

ঋষা হাততালি দিয়ে বলেছিল, ‘খুব হয়েছে। এবার আপনি থামুন ম্যাডাম।’

মুখে যাই বলুক, তারপর থেকে ঋষা নিজের কাছে ‘ব্যবস্থা’ রাখে। নিজেকে সবলা প্রমাণ করবার জন্য নয়, গোলমাল থেকে বাঁচতে। আজও ছিল। অর্চিনের আদর করবার কায়দাটা বড় সুন্দর। তার নিজের চরিত্রের মতো। বাইরেটা ধীরস্থির, নরমসরম। ভিতরে কঠিন। আগের বারের মতোই অনেকটা সময় নিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ব্যাকুল করে তুলেছে ঋষাকে। সবশেষে শরীরে তৃপ্তি আর ক্লান্তি নিয়ে এই গল্প করাটাও দারুণ লাগে। মনে হয়, এখনও অর্চিনের আদর শেষ হয়নি। ঋষাকে অর্চিনই প্রথম পছন্দ করে বসে। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের ফাংশন ছিল। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকবার কারণে, অর্চিন সেই ফাংশানের ব্যবস্থাপনায় ছিল। স্টেজের দায়িত্ব ছিল তার। কারণ, কী হবে, কতক্ষণ থাকবে—এইসব। ফার্স্ট ইয়ারে একটি রোগাপাতলা চেহারার মেয়ে স্টেজে আবৃত্তি করতে উঠল।

‘আমি একটি মেয়েকে জানি

যে তার বেকার প্রেমিককে ছেড়ে যেতে পারেনি এখনও

আমি এক কিশোরকে জানি

পাঁচ গোল খাওয়া দলের যে হচ্ছে একজন সমর্থক

আমি এক যুবাকে চিনি

বৃদ্ধ পিতাকে যে আজ পৌঁছে দিতে পারেনি বৃদ্ধাশ্রম

আমি এক প্রৌঢ়াকে জানি

নির্বাচনে গোহারা হেরে যাওয়া দলের পতাকা

তিনি কাঁধ থেকে নামাতে পারেননি এখনও…।’

থমকে গিয়েছিল অর্চিন। সে কবিতা-টবিতা শোনবার লোক নয়। তার পরেও মেয়েটির আবৃত্তি তাকে থমকে দেয়। অর্চিন ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে উইংসের পাশে। মেয়েটির কী নাম যেন ঘোষণা হল?

পরদিনই মেয়েটিকে ধরে অর্চিন।

‘আমি তোমার নাম জানতে পারি?’

‘অবশ্যই পারেন। আমার নাম ঋষা। ঋষা রায়।’

অর্চিন বলে, ‘কাল নবীনবরণ অনুষ্ঠানে তুমি যে কবিতাটি পড়লে, সেটা তুমি কবে লিখেছ?’

ঋষা তাড়াতাড়ি বলে, ‘না না, ওটা আমার নয়। কবিতাটি অংশুমান করের লেখা। অংশুমানবাবু অনেক ভালো ভালো কবিতা লিখেছেন।’

অর্চিন মনে হয় একটু আশাহত হল। সম্ভবত সে ভেবেছিল কবিতাটি মেয়েটির লেখা। ফলে তার সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে একটু চিড় খেল। অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘ও।’

ঋষা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অংশুমান করের আরও অনেক ভালো ভালো কবিতা আছে।’

অর্চিন নিরুৎসাহ গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’

ঋষা এত সহজে ছাড়তে চাইল না। তার পছন্দের কবি সম্পর্কে এই সুন্দর ছেলেটিকে আরও দু-কথা শোনাতে চাইল।

অর্চিনের হালকা কৌতূহল হল। মেয়েটি নতুন ইউনিভার্সিটিতে এলেও আড়ষ্টতা নেই। অচেনা সিনিয়রের সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে।

‘আমি একটা অন্য কবিতা বলতে চেয়েছিলাম।’

‘বললে না কেন?’

ঋষা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কবিতাটা একটু বড়। বড় কবিতা বলব শুনে ইলেকট্রনিক্স না মেকানিক্যালের এক দিদি কড়া গলায় বলল, বলা যাবে না। বেশি সময় লাগবে। অনেকে আছে। সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। বারণ আছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম, কে বারণ করেছে? সে তখন অর্চিন না কী যেন একটা নাম বলল। সে কে? পরে শুনলাম, ওই অর্চিন নাকি এখানে পলিটিক্স করে। মজার কথা কী বলুন তো, যারা রাজনীতি করে তারা কবিতাকে বিচার করে লেন্থ দিয়ে। কবিতা দিয়ে নয়। এরকম একটা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে যে এমন বোকা ছেলে আছে, আমার জানা ছিল না।’

অর্চিনের খুব মজা লাগল। সে হেসে ফেলল। বলল, ‘খুব রেগে আছ মনে হচ্ছে।’

ঋষা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘রাগব না! আমার ভালো লাগার কবিতা বলতে পারলাম না। না হয় দুটো কবিতাই বলতাম।’

অর্চিন বলল, ‘আচ্ছা অর্চিনের সঙ্গে দেখা হলে আমি তাকে বলে দেব, ভবিষ্যতে এরকম বোকামি যেন সে না করে। অবশ্য জানি না, সে শুনবে কিনা। বোকারা শুধু কবিতা নয়, কথাও শুনতে চায় না।’

অর্চিন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। মেয়েটি ইন্টারেস্টিং। একে রাজনীতিতে আনতে হবে।

ঋষা বলল, ‘আমার আবৃত্তি ভালো লাগবার জন্য ধন্যবাদ।’

অর্চিন থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সরি। তোমার বলা আমার ভালো লাগেনি ঋষা। এমন একটা জোরালো কবিতা, অমন মিনমিন করে বলা উচিত নয়। কবিতা ভালো লাগলেই হয় না, তাকে বিশ্বাস করতে হয়। নইলে ঠিকভাবে বলা যায় না।’

সুন্দরী ঋষার মুখ শুকিয়ে গেল।

‘আপনি আবৃত্তি করেন?’

অর্চিন হেসে বলল, ‘কখনওই নয়। আমি কবিতাও পড়ি না। তেমন পছন্দও করি না।’ একটু থমকে হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলল, ‘যাই ক্লাস আছে।’

ঋষা মুখ লাল করে বলেছিল, ‘আপনি কবিতা পড়েন না, পছন্দ করেন না, তার পরেও আবৃত্তি নিয়ে বলছেন। আশ্চর্য! আপনার নামটা কি জানতে পারি।’

অর্চিন হেসে বলেছিল, ‘অবশ্যই পারেন। অর্চিন। ইলেক্ট�নিক্স সেকেন্ড ইয়ার। চলি তাহলে?’

ঋষার রাগ অপমান প্রেমে বদলে যেতে বেশি দেরি হয়নি। তবে সে কিছুতেই রাজনীতিতে ঢোকেনি। লেখাপড়া ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে থেকেছে। অর্চিন প্রথম দিকে দু-একবার বলেছিল। প্রথম প্রথম ‘আপনি’, ‘তুমি’ সম্বোধনে পরিচিতি পর্ব চললেও, বয়েসের ছোট-বড়র বাধা বিভিন্ন। ছোট-বড়র বাধা ডিঙিয়ে দুজনেই খুব দ্রুত ‘তুই’-এর সম্পর্কে সহজ হয়েছে।’

ঋষা চুল সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই ছেলে, তোর কী হয়েছে?’

অর্চিন স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ঋষা, আমি চলে যাব।’

ঋষা সোজা হয়ে বসল, অর্চিনের গলার এই জোর সে চেনে।

‘কোথায় যাবি?’

‘আমি গ্রামে চলে যাব। গ্রামে গিয়ে রাজনীতি করব।’

ঋষা বলল, ‘তুই কি পাগল? পড়া শেষ করলেই তো কত ভালো চাকরি তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর তো মোটে একটা বছর। একটা বছর পরে এসব ভাবলে হত না?’

এসব কথা শুনলই না অর্চিন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শেখরদারা পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে। আমরা সবাই ভয় পেলে কী করে হবে ঋষা? হবে না। আমি গ্রামে যাব। সেখানে সংগঠন করব। রক্তিম, বন্দনারা তো গেছে। ওরা যদি পারে, আমি পারব না কেন? এখানে থাকলে আমি শেষ হয়ে যাব। বড় চাকরি, বড় উপার্জন আমাকে সিস্টেমের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার যাবতীয় বিশ্বাস নীতি আদর্শকে ছিবড়ে করে দেবে। ছিবড়ে করতে না পারলে আমাকে ভয় দেখাবে, মিথ্যে অভিযোগে জেলে পুরে দেবে। এই সিস্টেম থেকে পালাতে হবে। এই বয়েসে যদি না পারি, এই সময়ে যদি না পারি, আর কবে পারব?’

ঋষা চুপ করে বসে রইল। সে বুঝতে পারছে, অর্চিনকে আটকানো যাবে না। সবাইকে আটকানো যায় না। লোভ, ভয়, ভালোবাসা কিছু দিয়েই আটকানো যায় না। আটকাতে নেই।

একসময় অর্চিন হাত বাড়িয়ে ঋষার গাল ছুঁল।

‘আমি যাই ঋষা? তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?’

ঋষা অর্চিনের মুখের ওপর মুখ নামাতে নামাতে বলল, ‘যাও। আমি অপেক্ষা করব।’

পরম শান্তি আর ভালোবাসায় অর্চিনবাবু ঋষাকে বুকের ওপর টেনে নিল।