☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
বিয়াল্লিশ
একতলা বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। তার মানে বাড়িতে কেউ নেই। তার পরেও অর্চিন বেল টিপল। কেউ দেখতে পেলে ভাবত, ছেলেটা বিরাট বোকা। দরজায় তালা, তার পরেও বেল বাজাচ্ছে।
ঘটনা কিন্তু তা নয়। দরজায় তালা ঝোলানোর ব্যাপারটা আসলে একটা কায়দা। অচেনা কেউ এলে ভাববে বাড়িতে কেউ নেই। ঋষা আর কৃষ্ণকলি এই কায়দায় চলে। যাতে দুটো কমবয়সি মেয়ের বাড়িতে কেউ এসে জ্বালাতন না করে। সদর দরজার বাইরে থেকে তালা দিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে ওরা যাতায়াত করে। এই গুপ্তকথা ওরা কাউকেই বলেনি। বাইরের ঘরের জানলাও ওরা চট করে খোলে না। ফলে উঁকি মারবারও সুযোগ নেই। দুনিয়া যতই আধুনিক হোক, যতই অ্যাপস আর কন্ডোম আজকাল সহজলভ্য ব্যাপার হোক, মেয়েদের এখনও সাবধানে থাকতে হয়। বাড়ির বাইরে নিজেরা কোথাও থাকলে তো বটেই। সেখানে হুটপাট লোক ঢুকতে দেওয়া যায় না। অচেনা কাউকে তো নয়ই, এমনকী চেনা লোককে অ্যালাও করতে নেই। কৃষ্ণকলি বলে, চেনা লোক বেশি পাজি। তারা ক্ষতি করে বেশি। ঋষাও একমত।
গোড়াতে এই বাড়িতে ঋষা আর কৃষ্ণকলি পেয়িং গেস্ট হিসেবে এসেছিল। দোতলায় ল্যান্ডলেডি থাকেন। তিনি দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করতেন। মাসের শুরুতে টাকা দিলেই হত। রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিল না। তার থেকে বড় কথা, বাড়িতে এক ধরনের পাহারা আছে। ল্যান্ডলেডি সল্টলেকের এই ব্লকে শুধু পরিচিত মহিলা নন, ডাকসাইটেও বটে। এক সময়ে স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন। ফলে স্বামীর সঙ্গে তারও দাপট ছিল। স্বামী মারা গেলেও সেই দাপট কমেনি। আশপাশে সবাই সমীহ করে। মহিলা যে টাকা পয়সার জন্য বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রেখেছেন এমন নয়। স্বামীর পেনশন আর সঞ্চয়তেই দিব্যি চলে যায়। তার ওপর মেয়ে ডাক্তার। আমেরিকায় থাকে। সে বারবার মাকে নিয়ে গিয়ে কাছে রাখতে চেয়েছে। মহিলাই রাজি হন না। নিজের বাড়ির বিছানায় না শুলে তার নাকি ঘুম আসে না। দোতলা বাড়ি ফাঁকা পরে থাকবে? এই চিন্তাতেই পেয়িং গেস্ট রাখা। ছেলেরা থাকলে হুল্লোড় হবে। সেই কারণে দুজন মেয়েকে খুব কম টাকাতেই একতলায় থাকতে দিয়েছেন। প্রথম প্রথম রান্নার লোক দু’বেলা রান্না করে নীচে খাবার পাঠিয়ে দিত। কিন্তু পরে ঋষা, কৃষ্ণকলি দুজনেরই বাড়ি ফেরা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। কে কখন ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। বাইরেও কখনও কখনও ওরা যে যার মতো খেয়ে নিত। শেষ পর্যন্ত বাড়িউলি নিজেই খাবার পাঠানো থেকে সরে গেলেন। এখন ঋষারা রান্না করে নেয়। একেকদিন একেকজন। বাকিটা হোম ডেলিভারি।
এই বাড়িতে যে অল্প কয়েকজনের ঢোকবার অনুমতি আছে অর্চিন তাদের মধ্যে একজন। অর্চিন অবশ্য আসে খুবই কম। ন’মাসে ছ’মাসে একবার। এলে হয় ঋষার সঙ্গে আসে, নয় ফোন করে নেয়।
ঋষা ল্যান্ডলেডির সঙ্গে অর্চিনের আলাপ করিয়ে দিয়েছে। মহিলা অর্চিনকে পছন্দ করছেন। পছন্দ করবার তিন-চারটি কারণ আছে। প্রথম কারণ ছেলেটি তার বান্ধবীর কাছে বুক ফুলিয়ে আসে। কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটি শান্ত প্রকৃতির। আর সব থেকে বড় কারণ হল, তার এক আত্মীয় অর্চিনের ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। সেখান থেকে তিনি এই ছেলের সম্পর্কে খবর জোগাড় করেছেন। ছেলেটি লেখাপড়ায় অতিশয় ভালো। ল্যান্ডলেডি এই বিষয়ে ঋষাকে গার্জেনের মতো জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। মহিলাকে ঋষারাও পছন্দ করে। সম্মানও করে। তার এই ধরনের ব্যক্তিগত কৌতূহলে মজা পায়।
‘অর্চিনকে তুমি বিয়ে করবে?’
‘এখনই বলা যাচ্ছে না মাসিমা।’
‘কেন?’
‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।’
‘তোমার বাড়িতে কি জানে তুমি এই ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করো?’
‘না।’
‘সেকী! কেন!’
‘আমার বাড়িতে কঠিন পরিস্থিতি। জেঠা, কাকারা নিজে ছেলে পছন্দ করাটা মেনে নিতে পারবে বলে মনে হয় না।’
‘এটা তো ঠিক নয়। ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’
‘আপনি বলছেন মাসিমা, কিন্তু আমার বাড়িতে বলে, এতে নাকি ভুল হয়ে যায়।’
‘তা কেন হবে? ঠিক ভুল যে-কোনও ক্ষেত্রেই হতে পারে। নিজে পছন্দ করো আর বাড়ির লোক খুঁজে এনে দিক। এই দেখো না, আমি যখন তোমার মেসোমশায়ের সঙ্গে মেলামেশা করতাম, বাড়িতে বিরাট আপত্তি। পুলিশের সঙ্গে মরে গেলেও বিয়ে দেওয়া হবে না। কী কারণ? পুলিশের নাকি সামাজিক কোনও জীবন নেই। আমি কি ভুল করেছি? তা ছাড়া মানুষ জীবনসঙ্গী বেছে নেয়, ঠিক ভুলের জন্য নয়, এটা পরীক্ষা নয়। জীবনসঙ্গী হওয়া উচিত বন্ধুর মতো। এমন বন্ধু যাকে নিজের ভালো-মন্দ, দোষ গুণ সব বলা যায়। প্রকাশ্য এবং গোপন সব কথাই সে জানবে মুক্ত মনে। তাকে ভালোবেসে বিয়ে না পছন্দ করে বিয়ে তাতে কিছু এসে যায় না।’
‘দারুণ বলেছেন মাসিমা। কিন্তু আমার বাড়িতে একথা কে বোঝাবে?’
‘দরকার হলে আমি বোঝাব। আমি যাব।’
ঋষা হেসে বলে, ‘খুব ভালো হবে। সময় হলে আপনাকে নিয়ে যাব মাসিমা। তবে কী জানেন, অর্চিন যেমন ছেলে তাতে এই সময়টা চট করে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আর আমিও বিশ্বাস করি, সঙ্গী মানে বন্ধু। তাকে যে স্বামী বা স্ত্রী হতেই হবে এমন কোনও কথা নেই।’
ল্যান্ডলেডি তিন মাসের জন্য আমেরিকায় মেয়ের কাছে গেছেন। এই কারণে ঋষারা বেশি সতর্ক থাকে। মিথ্যে তালা লাগানোর কায়দা বের করেছে।
অর্চিন এই তালার কায়দাটা ধরে ফেলেছে। একদিন হুট করে চলে এসেছিল। ঋষাকে জানায়নি। দরজায় তালা দেখে প্রথমটায় একটু অবাক হয়। এই সময়টা ঋষার ঘরে থাকবার কথা। তালা দিয়ে কোথায় গেল? মোবাইল বের করে ফোন করতে যায়, তখন চোখে পড়ে দরজার সামানে ঋষার জুতো। এই জুতো পরেই সাধারণত ঋষা বেরোয়। আজ কি তবে অন্য জুতো পরে বেরিয়েছে? হতে পারে। কিন্তু দরজায় তালা দিয়ে বেরোনোর সময় এই জুতোটাই বা বাইরে থাকবে কেন? ভুল করে? নাকি ভিতরে কেউ আছে? এরপর অর্চিন দরজায় চাপ দিল। চাপ দিতেই বুঝল, দরজা ভিতর থেকেও বন্ধ। মোবাইলে ঋষার নম্বর টিপে ছিল অর্চিন।
‘দরজা খোল ঋষা।’
ঋষা অবাক গলাায় বলে, ‘তুই! তুই কোথায় অর্চিন?’
অর্চিন বলে, ‘এই তো, তোদের তালা দেওয়া দরজার বাইরে।’
ঋষা পরে বলেছিল, ‘তুই বুঝলি কী করে আমি ভিতরে আছি?’
অর্চিন বলল, ‘তোর বোকামির কারণে। দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়েছিস, কিন্তু পরবার জুতোটা সরিয়ে রেখেছিস দরজার বাইরে।’
ঋষা জিব কেটে বলেছিল, ইস ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু জুতো তো আমার একটা নয়।’
অর্চিন অবহেলা করে বলেছিল, ‘সেই জন্যই দরজায় ঠেলা দিলাম। দিয়ে বুঝলাম, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। তখন ফোন করলাম। যাক, ভবিষ্যতে এই বোকামি কোরো না।’
এই কারণেই আজ তালা দেখেও বেল টিপল অর্চিন। তবে শুধু বেল টিপল না, মোবাইল থেকে ঋষাকে টেক্সট পাঠাল।’
‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।’
বেলের আওয়াজ শুনে অন্য কেউ এসেছে ভেবে যদি দরজা না খোলে সেই কারণে টেক্সট।
এ বাড়িতে ঋষা আর কৃষ্ণকলির ঘর আলাদা। তবে এতক্ষণ দুজনে ঋষার ঘরেই ছিল। খাটের ওপর বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঋষা ল্যাপটপ ঘাঁটছিল। সে একটা হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরে আছে। হাফ প্যান্ট নয়, হট প্যান্ট। দৈর্ঘ্যে ছোট। বাইরে চেনা কেউ এই পোশাকে ঋষাকে দেখলে চমকে উঠবে। বাইরে বেরোলে ঋষা কখনওই খোলামেলা পোশাক পরে না। ঋষার টি শার্টের রং কালো। বুকের ওপর সাদায় লেখা—’আমি উড়ে বেড়াই, আমি ঘুরে বেড়াই।’ শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন। কবিতার নাম ‘তুমি’।
কৃষ্ণকলি পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। সে পরেছে পালাজোব আর কুর্তি। হাতে পেপারব্যাক। সে হল থ্রিলারের ভক্ত। গল্পের বইতে খুন-জখম সেক্স না থাকলে তার চলে না। বাংলা বই ছুঁয়েও দেখে না কৃষ্ণকলি। ঋষারা যে লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে লাফালাফি করে সে বিষয়ে তার তীব্র আপত্তি। যদিও প্রতি সংখ্যার জন্যই সে ঋষাকে চাঁদা দেয়। আবার ঝগড়াও করে। আজও করেছিল।
‘এই সব ছেলেমানুষি এবার বন্ধ কর ঋষা। লিটিল ম্যাগাজিন ব্যাপারটাই উঠে গেছে। ও সব আজ থেকে বিশ-তিরিশ বছর আগের কনসেপ্ট। প্রাণের আবেগে লেখালেখি বলে এমন কিছু হয় না। লিখব কিন্তু বাজারে তার কোনও দাম পাব না, একথা এখন অর্থহীন। এভরিথিং ইজ মার্কেট। সেক্স কমোডিটি টু পোয়েট্রি।’
ঋষা পায়ের ওপর পা তুলে রেখেছে। তার ছিপছিপে ফর্সা পা দুটো খুবই সুন্দর। সুন্দর পা নাড়তে নাড়তে মেয়েটা বলল, ‘যা বুঝিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না কলি। লিটল ম্যাগাজিনের দাম কেনা বেচা দিয়ে হিসেব করা যায় না। এরপর তো বলবি, কবিতা বলে কিছু হয় না। কবিতার কোনও বিক্রি নেই। কবিতা না লিখে ব্রেস্ট অয়েলের বিজ্ঞাপন লেখা উচিত। এক শিশি ব্যবহার করুন, দেখবেন পুরুষ আর চোখ ফেরাতে পারছে না। অথবা ইটস ইওর লাস্ট চান্স। তাই তো? লিটিল ম্যাগাজিন কত ভালো ভালো কল্পনা, ভাবনা, গবেষণার আঁতুরঘর জানিস?’
কৃষ্ণকলি হাই তুলে বলে, ‘বেশি লেখালিখিটাই তো মুশকিল। যে পারছে লিখছে। এত লেখক হওয়ার কারণেই বাংলা গল্প-কবিতার সর্বনাশ হয়েছে।’
ঋষা বলল, ‘আবার না জেনে কথা। হালকা গোয়েন্দা গল্প পড়ছিস তাই পড়। কত বড় বড় কবি, গল্পকাররা লিটিল ম্যাগে লিখেছে তার ঠিক নেই।’
কৃষ্ণকলি বলে, ‘সে লিখতে পারে। কিন্তু সে সব পাস্ট। পুরোনো ইতিহাস। যত বড় কবি গল্পকাররা লিখেছে, তার থেকে অনেক বেশি লিখেছে ফালতুরা। অপাঠ্য লেখা সব।’
ঋষা এবার জোর রেগে গেল। বলল, ‘কে বলল ভালো লেখা সব অতীতে লেখা হত? তুই ক’টা ম্যাগাজিন পড়িস? আমি আনলে উলটে রেখে দিস। এখনও কত ভালো ভালো ম্যাগাজিন বের হয়। নাম বলব?’
কৃষ্ণকলি হেসে বলল, ‘সেসব আর লিটল নেই বাছা, বিগ হয়ে গেছে। তারা লিটলের ফায়দা নেয় আবার বিগের মার্কেট ধরবার চেষ্টা করে।’
ঋষা বলল, ‘তোর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য আর তোকে চাঁদা দিতে হবে না। তুই সি গ্রেডের থ্রিলারগুলো নিয়ে পরে থাক। ওগুলো লিটারেচার? সফট পর্নো। তোর চাঁদায় ম্যাগাজিন বের করলে ম্যাগাজিনের অসম্মান হবে।’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘বাঁচালি। আর পয়সা নষ্ট হবে না। তুইও ও-সব থেকে বেরিয়ে আয়। সময় নষ্ট করিস না।’
ঋষা বলল, ‘তোকে ভাবতে হবে না। আমি বুঝব। তুই চুপ কর, আমায় কাজ করতে দে। মেল থেকে কয়েকটা লেখা ডাউনলোড করব।’
এমন সময় বেল বাজল। ঋষা ভুরু কোঁচকাল। কে এল? কৃষ্ণকলি উঠে বসল। এক মুহূর্তের মধ্যেই অর্চিনের ফোন—’আমি দাঁড়িয়ে আছি।’
ঋষা অবাক হয়ে বলল, ‘অর্চিন! এই সময় অর্চিন কেন?’
কৃষ্ণকলি মুচকি হেসে বলল, ‘মনে হয়, প্রেম জেগেছে। দাঁড়া আমি খুলে দিচ্ছি।’
ঋষা কোল থেকে ল্যাপটপ নামাল। খাট থেকে নেমে হাফ প্যান্টের ওপরই একটা পায়জামা গলিয়ে নিল। আয়নার সামনে গিয়ে হাত দিয়ে চুলটা গুছিয়ে নিল। তারপর ড্রইংরুমে গেল। ড্রইংরুমটা সাজানো। সোফা, টেবিল, শোকেস সবই আছে। ল্যান্ডলেডিই সাজিয়ে রেখেছেন। উনি বলেছিলেন, এই ঘরটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করবেন। প্রথম দিকে দু-একবার লোকজন এলে বসেওছিলেন। কিন্তু সে কয়েকদিন মাত্র। এখন কেউ এলে ওপরে চলে যায়। অর্চিন সোফায় বসে কৃষ্ণকলির সঙ্গে কথা বলছিল।
‘কী ব্যাপার এবারও তো ফার্স্ট হলে, কই খাওয়ালে না তো?’
অর্চিন শুকনো হেসে বলল, ‘ফার্স্ট হলে খাওয়ানোর কী আছে?’
কৃষ্ণকলি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বাঃ, তুমি খুশি হয়েছ, খুশি হলে তো মানুষ খাওয়ায়।’
অর্চিন বলল, ‘কে বলল আমি খুশি হয়েছি?’
‘তা হলে কি দুঃখ পেয়েছ?’
অর্চিন বলল, ‘খুশি, দুঃখ কিছুই হয়নি। পরীক্ষা দিয়েছিলাম। নম্বর পেয়েছি। বাই চান্স সেই নম্বর অন্যদের থেকে বেশি। ব্যস। এটা নিয়ে লাফালাফি করবার মতো কিছু হয়নি।’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘গুডবয়দের এই ঢপবাজিগুলো আমার খুব জানা আছে। এরপর তো ক্যাম্পাসিং-এ বেস্ট অফারটা পেয়ে যাবে। তার পরেই হুস। সে যাও। বড় চাকরি করো। আমাকে খাওয়ালেই হবে।’
অর্চিন হেসে বলল, ‘সে তোমাকে এমনি খাওয়াতে পারি।’
ঋষা ঘরে ঢুকতে কৃষ্ণকলি তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অ্যাই ঋষা, এক সপ্তাহের মধ্যে অর্চিন আমাকে ভালো রেস্তোরাঁয় যদি না খাওয়াতে নিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু আমি একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। দেখব এ বাড়ির দরজা কে খোলে।’
কৃষ্ণকলি হাসতে হাসতে ঘর ছাড়বার পর ঋষা অর্চিনের উলটো দিকে বসল।
‘কী হয়েছে? হঠাৎ এলি যে?’
অর্চিন বলল, ‘কেন হঠাৎ আসতে পারি না?’
ঋষা তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, ‘তা পারবি না কেন? হাজার ডাকলেও তো আসিস না, তাই বলছি।’
অর্চিন চুপ করে রইল। ঋষা বলল, ‘তোকে টায়ার্ড লাগছে।’
অর্চিন অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘একটু টায়ার্ড। সকাল থেকে ছোটাছুটি গেছে।’
‘খেয়েছিস?’
অর্চিন বলল, ‘হ্যাঁ, শেখরদার বাড়ি।’
ঋষা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোকে দেখে ভালো লাগছে না। ডাক্তার দেখিয়েছিস?’
অর্চিন অবাক হয়ে বলল, ‘ডাক্তার দেখাব না কেন?’
এই কথার মাঝখানেই কৃষ্ণকলি আবার ঢুকল। এবার সে জিনস টপ পরে সেজেছে। কাঁধে ব্যাগ। হাত নেড়ে বলল, ‘হাই গাইস। আমি মুভি দেখতে চললাম। তোমরা রিল্যাক্স করো। এই যে শ্রীমতী কবিতারাণী, এই গুডবয়টির ঠিকমতো যত্নআত্তি করবেন। তার আগে দয়া করে দরজাটায় তালা লাগিয়ে নিন।’
কৃষ্ণকলি মুখ ফিরিয়ে ঋষার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। নতুন নয়, এই কাণ্ড কৃষ্ণকলি আগেও করেছে। অর্চিন এলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পরে ঋষা ধন্যবাদ জানাতে গেলে গম্ভীরভাবে বলেছে, ‘ধন্যবাদ জানানোর মতো কিছু করিনি। এটাই নিয়ম। উইদাউট সেক্স প্রেম হয় না। নেকামি হয়। ছুকছুকানি হয়। আমি এসব পছন্দ করি না। তোদের চান্স করে দেওয়াটা আমার ডিউটি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকতে পারতাম। কিন্তু সেটা রিস্কি। ঘর থেকে বেরিয়ে হয়তো দেখলাম, তোরা ড্রইংরুমের সোফায় জামাকাপড় বিসর্জন দিয়ে জড়াজড়ি করে আছিস। সেই দৃশ্য আমার জন্য ঠিক হবে না। তাই বেরিয়ে যাওয়াই বুদ্ধির। খালি বাড়িতে তোরা কীভাবে থাকবি তোদের ব্যাপার।’
ঋষা বাইরে থেকে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে ড্রইংরুমে এসে দেখল, অর্চিন সোফার পিঠে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে। কী হয়েছে ছেলেটার? শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু? কেমন যেন একটা অস্থির হয়ে আছে। চোখ বুঁজে থাকবার মধ্যেও সেই ভাবটা রয়েছে।
‘চল ঘরে গিয়ে শুবি।’
অর্চিন চোখ খুলল। ঋষা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল।
‘আয়।’
অর্চিন ঋষাকে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেল। ঋষা হাত ছাড়িয়ে বলল, ‘এখানে নয়, আগে ঘরে আয়।’