৩। রাধাকৃষ্ণ[১]

আমি একটা প্রাচীন গীত আপন মনে গায়িতেছিলাম।

“ব্রজ তেজে যেও না, নাথ,—”

এইটুকু গাহিতে না গায়িতে, বাবাজি “অহঃ” বলিয়া, একেবারে কাঁদিয়া অজ্ঞান। আমি থাকিতে পারিলাম না, হাসিয়া ফেলিলাম। ক্রুদ্ধ হইয়া বাবাজি বলিলেন, “হাসিলি কেন রে বেটা?”

আমি বলিলাম, “তুমি হাঁ কর্‌তেই কাঁদ, তাই আমি হাসি।”

বাবাজি। হাঁ করে বলেছিস্, সে কথাটা কিছু বুঝেছিস্? না শালিক পাখির মত কিচির কিচির করিস্?

আমি। বুঝ্‌ব না কেন? রাধা কৃষ্ণকে বল্‌ছেন যে, তুমি আমাদের ব্রজ ছেড়ে যেও না।

বাবাজি। ব্রজ কি বল্ দেখি?

আমি। কৃষ্ণ যেখানে গোরু চরাতেন আর গোপীদের নিয়া বাঁশী বাজাতেন।

বাবাজি। অধঃপাতে যাও। ‘ব্রজ’ ধাতু কি অর্থে বল্ দেখি?

আমি। ব্রজ ধাতু! অষ্ট ধাতুই ত জানি। আবার ব্রজ ধাতু কি?

বাবাজি। ব্রজ গমনে। ব্রজ, অর্থাৎ যা যায়।

আমি। যা যায়, তাই ব্রজ? গোরু যায়, বাছুর যায়, আমি যাই, তুমি যাও—সব ব্রজ?

বাবাজি। সব ব্রজ। জগৎ কাকে বলে, বল্ দেখি?

আমি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জগৎ।

বাবাজি। ‘জগৎ’ কোন্ ধাতু হইতে হইয়াছে?

আমি। ধাতু ছাড়া যা জিজ্ঞাসা করিবেন বলিব, ও কথাটা শুনিলেই কেমন ভয় করে।

বাবাজি। গম ধাতু হইতে জগৎ শব্দ হইয়াছে। যা যায়, তাই জগৎ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নশ্বর, তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জগৎ। ব্রজ শব্দ আর জগৎ শব্দ একার্থবাচক।

আমি। ব্রজ তবে একটা জায়গা নয়? আমি বলি, বৃন্দাবনই ব্রজ।

বাবাজি। বৃন্দাবন নামে যে শহর এখন আছে, তাহা বাঙ্গালার বৈষ্ণব ঠাকুরেরা তৈয়ার করিয়াছেন।

আমি। তবে পুরাণে বৃন্দাবন কাকে বলিয়াছে?

বাবাজি। “বৃন্দা যত্র তপস্তেপে তত্তু বৃন্দাবনং স্মৃতম্” যে স্থানে বৃন্দা তপস্যা করিয়াছিলেন (‘করেন’ বলিলেই ঠিক হয়), সেই বৃন্দাবন।

আমি। বৃন্দা কে?

বাবাজি।

রাধাষোড়শনাম্নাং চ বৃন্দা নাম শ্রুতৌ শ্রুতম্।

তস্যাঃ ক্রীড়াবনং রম্যং তেন বৃন্দাবনং স্মৃতম্॥

রাধাই বৃন্দা।

আমি। রাধা কে?

বাবাজি। রাধ ধাতু—

আমি। ধাতু ছাড় বাবাজি।

বাবাজি। রাধ ধাতু সাধনে, প্রাপ্তৌ, তোষে, পূজায়াং বা। যে ঈশ্বরের সাধন করে, যে তাঁহাকে পায়, যে তাঁহার পূজা (বা আরাধনা) করে, সেই রাধা। ঈশ্বরভক্ত মাত্রেই রাধা। তুমি ঈশ্বরভক্ত হইলে রাধা হইবে।

আমি। তবে তিনি গোপিনীবিশেষ নন?

বাবাজি। গোপিনী শব্দ হয় না—গোপী শব্দ। কাকে বলে?

আমি। গোপের স্ত্রী গোপী।

বাবাজি। গো শব্দে পৃথিবী। যাঁহারা ধর্ম্মাহারাই পৃথিবীর রক্ষক। তাঁহারাই গোপ। স্ত্রীলিঙ্গে তাঁহারা গোপী।

আমি। গোলোক কি তবে।

বাবাজি। এই পৃথিবীগোলোক—ভূলোক।

আমি। আপনি সব গোল বাধাইলেন। ভাল, সবই যদি রূপক হইল, তবে নন্দ কি?

বাবাজি। নন্দ ধাতু হর্ষে, আনন্দে। আমরা উপসর্গ ভিন্ন কথা ব্যবহার করি না, এই একটা উপসর্গ। যাহাকে আনন্দ বলি, তাই নন্দ।

আমি। ভগবান্ কি আনন্দে জন্মেন যে, তিনি নন্দনন্দন?

বাবাজি। কৃষ্ণ যে নন্দপুত্র, এ কথা কেহ বলে না। তিনি বসুদেবের পুত্র, নন্দালয়ে ছিলেন, এই মাত্র।

আমি। সে কথারই বা অর্থ কি?

বাবাজি। পরমানন্দ-ধামই ঈশ্বরের বাস। অর্থাৎ তিনি আনন্দেই বিদ্যমান।

আমি। তবে যশোদা কোথায় যায়? যশোদা যে কৃষ্ণকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন, তাহার তাৎপর্য্য কি?

বাবাজি। ঈশ্বরের যশঃ অর্থাৎ মহিমা কীর্ত্তন দ্বারা তাঁহাকে হৃদয়ে পরিবর্দ্ধিত করিতে হয়।

আমি। সবই রূপক দেখিতেছি। কৃষ্ণও কি রূপক নন?

বাবাজি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, জগদীশ্বর সশরীরে ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়া জগতে ধর্ম্ম স্থাপন করিয়াছিলেন। তিনি রূপক নহেন। কিন্তু পুরাণকার তাঁহাকে মাঝখানে স্থাপিত করিয়া, এই ধর্ম্মার্থক রূপকটি গঠন করিয়াছিলেন। কৃষ্ণের নামের আর একটা অর্থ আছে, তাহাতে ইহার একটা সুবিধা হইয়াছিল। কৃষ্ণ ধাতু কর্ষণে বা আকর্ষণে। যিনি মনুষ্যের চিত্ত কর্ষণ বা আকর্ষণ করেন, তিনি কৃষ্ণ।

আমি। এটা বাবাজি কষ্টকল্পনা।

বাবাজি। তা’ত বটেই। কৃষ্ণ রূপক নহেন। কাজেই এ অর্থ কষ্টকল্পে ঘটাতে হয়। তিনি শরীরী, অন্যান্য মনুষ্যের সঙ্গে কর্ম্মক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিলেন। এবং তিনি অশরীরী জগদীশ্বর। তাঁহাকে নমস্কার কর।

আমি। কিন্তু রূপকের কি হইবে? রাধা কৃষ্ণের উপাসনা করিব কি?

বাবাজি। জগদীশ্বরের সঙ্গে তাঁহার ভক্তের উপাসনা করিবে। কেন, ভক্ত তন্ময়, ভক্তও ঈশ্বরের অংশত্ব পাইয়াছে। জগৎ ঈশ্বর-ভক্ত। জগৎ ঈশ্বরময়। জগতের ঈশ্বরের সঙ্গে জগতেরও উপাসনা করিবে। অতএব বল, শ্রীরাধাবল্লভায় নমো নমঃ।

আমি। শ্রীরাধাবল্লভায় নমো নমঃ।

শ্রীহরিদাস বৈরাগী।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. প্রচার, ১২৯২, আষাঢ়।

Leave a Reply