২। পূজাবাড়ীর ভিক্ষা[১]

নবমী পূজার দিন বাবাজিকে খুঁজিয়া পাইলাম না। অবশ্য ইহা সম্ভব যে, তিনি পূজাবাড়ীতে হরিনাম করিয়া বেড়াইতেছেন। ইহাও অসম্ভব নহে যে, সেই অমূল্য অমৃতময় নামের বিনিময়ে তিনি সন্দেশাদি লোষ্ট্র গ্রহণপূর্ব্বক, বৈষ্ণবদিগের বদান্যতা এবং মাহাত্ম্য সপ্রমাণ করিবেন। এক মুঠা চাউল লইয়া যে হরিনাম শুনায়, তার চেয়ে আর দাতা কে? এই সকল কথার সবিশেষ আলোচনা মনে মনে করিয়া, আমি পূজ্যপাদ গৌরদাস বাবাজির সন্ধানে নিষ্ক্রান্ত হইলাম। যেখানে পূজাবাড়ীতে দ্বারদেশে ভিক্ষুকশ্রেণী দাঁড়াইয়া আছে, সেইখানেই সন্ধানে করিলাম, সে পাকা দাড়ির নিশান উড়িতে ত কোথাও দেখিলাম না। পরিশেষে এক বাড়ীতে দেখিলাম, বাবাজি ভোজনে বসিয়া আছেন।

দেখিয়া বড় সন্তোষ লাভ করিলাম না। বৈষ্ণব হইয়া শক্তির প্রসাদ ভক্ষণ তেমন প্রশস্ত মনে করিলাম না। নিকটে গিয়া বাবাজিকে বলিলাম, “প্রভু! ক্ষুধায় ধর্ম্মের উদারতা বৃদ্ধি করিয়া থাকে, বোধ হয়।”

বাবাজি বলিলেন, “তাহা হইলে চোরের ধর্ম্ম বড় উদার। একথা কেন হে বাপু?”

আমি। শক্তি প্রসাদে বৈষ্ণবের সেবা!

বাবাজি। দোষটা কি?

আমি। আমরা কৃষ্ণের উপাসক—শক্তির প্রসাদ খাইব কেন?

বাবাজি। শক্তিটা কি হে বাপু?

আমি। দেবতার শক্তি, দেবতার স্ত্রীকে বলে। যেমন নারায়ণের শক্তি লক্ষ্মী, শিবের শক্তি দুর্গা, ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী, এই রকম।

বাবাজি। দূর হ! পাপিষ্ঠ! উঠিয়া যা! তোর মুখ দেখিয়া আহার করিলে আহারও পণ্ড হয়। দেবতা কি তোর মত বৈষ্ণবী কাড়িয়া ঘরকন্না করে নাকি? দূর হ।

আমি। তবে শক্তি কি?

বাবাজি। এই জলের ঘটিটা তোল দেখি।

আমি জলপূর্ণ ঘটিটা তুলিলাম।

বাবাজি একটা জলের জালা দেখাইয়া বলিলেন, “এটা তোল দেখি!”

আমি। তাও কি পারা যায়?

বাবাজি। তোমার ঘটিটা তুলিবার শক্তি আছে, জালাটা তুলিবার শক্তি নাই। ভাত খাইতে পার?

আমি। কেন পারিব না? রোজ খাই।

বাবাজি। এই জ্বলন্ত কাঠখানা খাইতে পার?

আমি। তাও কি পারা যায়?

বাবাজি। তোমার ভাত খাইবার শক্তি আছে, আগুন খাইবার শক্তি নাই। এখন বুঝিলে দেবতার শক্তি কি?

আমি। না।

বাবাজি। দেবতা আপন ক্ষমতার দ্বারা আপনার করণীয় কাজ নির্ব্বাহ করেন, সেই ক্ষমতার নাম শক্তি। অগ্নির দাহ করিবার ক্ষমতাই তাঁর শক্তি, তাহার নাম স্বাহা। ইন্দ্র বৃষ্টি করেন, বৃষ্টিকারিণী শক্তির নাম ইন্দ্রাণী। পবন বায়ু-দেবতা, বহনশক্তির নাম পবনানী। রুদ্র সংহারকারী দেবতা, তাঁহার সংহারশক্তির নাম রুদ্রাণী।

আমি। এ সব কি কথা? যে শক্তিতে আমি ঘটি তুলিলাম বা ভাত খাই, তাহা আমি ত চক্ষে কখন দেখি না। কই, আমার সে শক্তি এই দুর্গাঠাকুরাণীর মত সাজিয়া গুছিয়া গহনা পরিয়া আমার কাছে আসিয়া বসুক দেখি? আমার বৈষ্ণবী তাহা করিয়া থাকে, সুতরাং আমার বৈষ্ণবীকেই আমার শক্তি বলিতে পারি।

বাবাজি। গণ্ডমূর্খেরা তাই ভাবে। তুমি শরীরী, তোমার শক্তি তোমার শরীরে আছে। তাহা ছাড়া তোমার শক্তি কোথাও থাকিতে পারে না।

আমি। দেবতারা কে? শরীরী? তবে তাহাদিগের শক্তিও নিরাকার?

বাবাজি। শরীরী এবং অশরীরী, তবে স্বর্গের সিংহাসনে বসিয়া অপ্সরাদিগের নৃত্যগীত দেখে কে?

বাবাজি। এ সকল রূপক। তাহার গূঢ়ার্থ না হয় আর একদিন বুঝাইব। এখন বুঝ, যাহা হইতে বৃষ্টি হয়, তাহাই ইন্দ্র। যাহা দাহ করে, তাহাই অগ্নি। যাহা হইতে জীবের বা বস্তুর ধ্বংস হয় তাহাই রুদ্র।

আমি। বুঝিলাম না। কেহ ব্যামোতে মরে, কেহ পুড়িয়া মরে, কেহ পড়িয়া মরে, কেহ কাটিয়া মরে। কোন জীব কাহাকে খাইয়া ফেলে, কেহ কাহাকে মারিয়া ফেলে, কোন বস্তু গলিয়া ধ্বংস হয়, কোন বস্তু শুকাইয়া ধ্বংস হয়, কোন বস্তু গুঁড়া হইয়া যায়, কেহ শুষিয়া যায়। ইহার মধ্যে কে রুদ্র?

বাবাজি। সকলের সমষ্টিভাব অর্থাৎ সব একত্রে ভাবিলে যাহা ভাবি, তাই রুদ্র।

আমি। তবে রুদ্র একজন, না অনেক?

বাবাজি। এক। যেমন এই ঘটিতে যে জল আছে, আর এই জালায় যে জল আছে, আর গঙ্গায় যে জল আছে, সব একই জল। তেমন যেখানেই ধ্বংসকারীকে দেখিবে, সর্ব্বত্রই একই রুদ্র জানিবে।

আমি। তিনি অশরীরী?

বাবাজী। তা ত বলিলাম।

আমি। তবে মহাদেবমূর্ত্তি গড়িয়া তাঁহাকে উপাসনা করি কেন? সে কি তাঁর রূপ নয়?

বাবাজি। উপাসনার জন্য উপাস্যের স্বরূপ চিন্তা চাই, নহিলে মনোনিবেশ হয় না। তুমি এই নিরাকার বিশ্বব্যাপী রুদ্রের স্বরূপ চিন্তা করিতে পার?

আমি চেষ্টা করিলাম—পারিলাম না। সে কথা স্বীকার করিলাম। বাবাজি বলিলেন, “যাহারা সেরূপ চিন্তা করিতে শিখিয়াছে, তাহারা পারে। কিন্তু তার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু যাহার জ্ঞান নাই, সে কি উপাসনা করিতে বিরত হইবে? তাহা উচিত নহে। যাহার জ্ঞান নাই, সে যেরূপে রুদ্রকে চিন্তা করিতে পারে, সেরূপ করিয়া উপাসনা করিবে। এসব স্থলে রূপ কল্পনা করিয়া চিন্তা করা, সহজ উপায়। তুমি যদি এমন একটা মূর্ত্তি কল্পনা কর যে, তদ্দ্বারা সংহারকারিতার আদর্শ বুঝায়, তবে তাহাকে রুদ্রের মূর্ত্তি বলিতে পার। তাই রুদ্রের কালভৈরব রূপ কল্পনা। নচেৎ রুদ্রের কোন রূপ নাই।

আমি। আমি এ ত বুঝিলাম। কিন্তু যেমন আমার শক্তি আমাতেই আছে, রুদ্রের শক্তি অর্থাৎ রুদ্রাণী রুদ্রেই আছে। শিব দুর্গা পৃথক্ পৃথক্ করিয়া গড়িয়া পূজা করে কেন?

বাবাজি। তোমাকে ভাবিলেই তোমার শক্তি জানিলাম না। অগ্নিতে যে কখন হাত দেয় নাই, সে অগ্নি দেখিলেই বুঝিতে পারে না যে, অগ্নিতে হাত পুড়িয়া যাইবে। পাঁজা পুড়িতেছে দেখিয়া, যে আর কখন অগ্নি দেখে নাই, সে বুঝিতে পারে না যে, আগুনের আলো করিবার শক্তি আছে। অতএব শক্তি এবং শক্তির আলোচনা পৃথক্ করিয়া না করিলে শক্তিকে বুঝিতে পারিবে না। রুদ্রও নিরাকার, শক্তিও নিরাকার। যে অজ্ঞান এবং নিরাকারের স্বরূপচিন্তায় অক্ষম, তাহাকে উপাসনার্থ উভয়েরই রূপ কল্পনা করিতে হয়।

আমি। কিন্তু বৈষ্ণব বিষ্ণুরই উপাসনা করিয়া থাকে, রুদ্রের উপাসনা করে না। অতএব রুদ্রাণীর প্রসাদ ভোজন আপনার পক্ষে অকর্ত্তব্য।

বাবাজি। বিষ্ণু আমাকে যে উদর দিয়াছেন, রুদ্রাণীর প্রসাদে যে তাহা পূরিবে না, এমন আদেশ কিছু করেন নাই। কিন্তু সে কথা থাক। রুদ্রাণী বিষ্ণুরই শক্তি।

আমি। সে কি? রুদ্রাণী ত রুদ্রের শক্তি?

বাবাজি। বিষ্ণুই রুদ্র।

আমি। এ সব অতি অশ্রদ্ধেয় কথা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা রুদ্র, তিন জন পৃথক্। একজন সৃষ্টি করেন, একজন পালন করেন, একজন লয় করেন। তবে বিষ্ণু রুদ্র হইলেন কি প্রকারে?

বাবাজি। যে বাবুর বাড়ী বসিয়া ভোজন করিতেছি, ইনি করেন কি জান?

আমি। জানি। ইনি জমিদারি করেন।

বাবাজি। আর কিছু করেন না?

আমি। পাটের ব্যবসাও আছে।

বাবাজি। আর কিছু করেন?

আমি। টাকা ধার দিয়া সুদ খান।

বাবাজি। ভাল। এখন আমি যদি বাহিরে গিয়া রামকে বলি যে, আমি আজ একজন জমিদার বাড়ী খাইতেছি, শ্যামকে বলি যে, আমি একজন ব্যবসাদারের বাড়ী খাইয়াছি, আর গোপালকে বলি যে, আমি একজন মহাজনের বাড়ী খাইয়াছি, তাহা হইলে তিন জনের কথা বলা হইবে? না একজনেরই কথা বলা হইবে।

আমি। একজনেরই কথা। তিন একই।

বাবাজি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর তিনই এক। একজনই সৃষ্টিকর্ত্তা, পালনকর্ত্তা এবং সংহারকর্ত্তা। হিন্দুধর্ম্মে এক ঈশ্বর ভিন্ন তিন ঈশ্বর নাই।

আমি। তবে তিন জনকে পৃথক্ পৃথক্ উপাসনা করে কেন?

বাবাজি। তুমি যদি এই বাবুকে বিশেষ করিয়া জানিতে চাও, তবে তাঁর সকল কাজগুলি পৃথক্ পৃথক্ করিয়া বুঝিতে হইবে। তিনি জমিদার হইয়া কিরূপে জমিদারি করেন, তাহা বুঝিতে হইবে, তিনি ব্যবসাদার হইয়া কি প্রণালীতে ব্যবসা করেন, তাহা বুঝিতে হইবে, আর তিনি মহাজনীতে কি করেন, তাহাও বুঝিতে হইবে। তেমনি ঈশ্বরোপাসনায় তাঁহার কৃত সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় পৃথক্ পৃথক্ বুঝিতে হইবে। এই জন্য ত্রিদেবের উপাসনা। এক জনেরই কার্য্যানুসারে তিনটি নাম দেওয়া হইয়াছে। তিন জনের তিনটি নাম নহে।

আমি। বুঝিলাম। কিন্তু গোল মিটিতেছে না। বৃষ্টি হইল, তাহাতে শস্য জন্মিল, খাইয়া সবাই বাঁচিলাম। বাঁচাইল কে—পালনকর্ত্তা বিষ্ণু—না বৃষ্টিকর্ত্তা ইন্দ্র?

বাবাজি। যাহা বলিয়াছি, তাহা যদি বুঝিয়া থাক, তবে অবশ্য বুঝিয়াছ যে, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ প্রভৃতি নামে কোন স্বতন্ত্র দেবতা নাই। যিনি সৃষ্টি করেন, তিনিই যেমন পালন করেন, ও ধ্বংস করেন, তিনিই আবার বৃষ্টি করেন, তিনিই দাহ করেন, তিনিই ঝড় বাতাস করেন, তিনিই আলো করেন, তিনিই অন্ধকার করেন। যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, তিনিই ইন্দ্র, তিনিই অগ্নি, তিনিই সর্ব্বদেবতা। তবে যেমন আমাদের বুঝিবার সৌকার্য্যার্থ এক জলকে কোথাও নদী বলি, কোথাও সমুদ্র বলি, কোথাও বিল বলি, কোথাও পুকুর বলি, কোথাও ডোবা বলি, কোথাও গোষ্পদ বলি, তেমনি উপাসনার জন্য তাঁহাকে কখন ইন্দ্র, কখন অগ্নি, কখন ব্রহ্মা, কখন বিষ্ণু ইত্যাদি নানা নাম দিই।

আমি। তবে তাঁহার যথার্থ নাম কি?

বাবাজি। তাঁহাকে দুই ভাবে চিন্তা করা যায়। যখন তাঁহাকে অব্যক্ত, অচিন্ত্য, নির্গুণ, এবং সর্ব্ব-জগতের আধার বলিয়া চিন্তা করি, তখন তাঁহার নাম ব্রহ্ম বা পরব্রহ্ম বা পরমাত্মা। আর যখন তাঁহাকে ব্যক্ত, উপাস্য, সেই জন্য চিন্তনীয়, সগুণ, এবং সমস্ত জগতের সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্তাস্বরূপ চিন্তা করি, তখন তাঁহার নাম সাধারণ কথায় ঈশ্বর, বেদে প্রজাপতি, পুরাণেতিহাসে বিষ্ণু বা শিব। আর যখন এককালীন তাঁহার উভয়বিধ লক্ষণ চিন্তা করিতে পারি, অর্থাৎ যখন তিনি আমার হৃদয়ে সম্পূর্ণ স্বরূপে উদিত হন, তখন তাঁহার নাম শ্রীকৃষ্ণ।

আমি। কেন, তখনই শ্রীকৃষ্ণ নাম কেন?

বাবাজি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ আপনাকে এই উভয় লক্ষণযুক্ত স্বরূপে ধ্যেয় বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন, এ জন্য আমি তাঁহার দাসানুদাস, সেই নামেই তাঁহাকে অভিহিত করি। একবার তোমরা কৃষ্ণনাম কর!! বল কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! হরি! হরি!

বাবাজি তখন হরিবোল দিয়া উঠিলেন। এক ব্রাহ্মণ পরিবেশন করিতেছিল, সে হরিবোল শুনিয়া বলিল, “বাবাজি! অত হরিবোলের ধূম কেন? পাঁটাটা রান্না বড় ভাল হয়েছে, বটে!”

তাই ত! সর্ব্বনাশ! এতক্ষণ কথাবার্ত্তায় অন্যমনা ছিলাম, দেখি নাই যে, বাবাজি এক রাশি ছাগমাংস উদরসাৎ করিয়া দ্বিতীয় তৈমুরলঙ্গের ন্যায় অস্থির স্তূপ সাজাইয়া রাখিয়াছেন! ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলাম, “বাবাজি! এই তোমার হরিবোল! এই তোমার বৈষ্ণবধর্ম্ম! তুমি কণ্ঠী ছিঁড়িয়া ফেল। আমরা কেহ তোমার সঙ্গে আহারাদি করিব না।”

বাবাজি। কেন, কি হয়েছে বাপু?

আমি। আমার মাথা হয়েছে! তুমি বৈষ্ণব ধর্ম্মের কলঙ্ক! এক রাশ, যাহার নাম করিতে নাই, তাই খেয়ে পার করিলে, আবার জিজ্ঞাসা কর কি হয়েছে?

বাবাজি। পাঁটা খেয়েছি? বাপু, ভগবান, কোথায় বলেছেন যে, পাঁটা খাইও না? যদি পুরাণ ইতিহাসের দোহাই দিতে চাও, তবে পদ্মপুরাণ খোল, দেখাইব যে, মাংস দিয়া বিষ্ণুর ভোগ দিবার ব্যবস্থা আছে। ভগবান্ স্বয়ং ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া, অন্যান্য ক্ষত্রিয়ের ন্যায় মাংসেই নিত্যসেবা করিতেন। তিনি পাপাচরণের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বটে? তুই বেটা আবার বৈষ্ণব?

আমি। তবে অহিংসা পরম ধর্ম্ম বলে কেন?

বাবাজি। অহিংসা যথার্থ বৈষ্ণব কন্যা বটে, কিন্তু কুলত্যাগ করিয়া বৌদ্ধঘরে গিয়া জাত হারাইয়াছে।

আমি ছেঁদো কথা বুঝিতে পারি না।

বাবাজি। দেখ, বাপু! বৈষ্ণব নাম গ্রহণ করিবার আগে বৈষ্ণব ধর্ম্ম কি, বোঝ। তোমার কণ্ঠীতে বৈষ্ণব হয় না, কুঁড়োজালিতেও নয়, নিরামিষেও নয়, পঞ্চসংস্কারেও নয়, দেড় কাহন বৈষ্ণবীতেও নয়। জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কে বল দেখি?

আমি। নারদ, ধ্রুব, প্রহ্লাদ।

বাবাজি। প্রহ্লাদই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। প্রহ্লাদ বৈষ্ণবধর্ম্মের কি ব্যাখ্যা করিয়াছেন, শুন,

সর্ব্বত্র দৈত্যাঃ সমতামুপেত

সমত্বমারাধনমচ্যুতস্য।

অর্থাৎ “হে দৈত্যগণ! তোমরা সর্ব্বত্র সমদর্শী হও। সমত্ব, অর্থাৎ সকলকে আত্মবৎ জ্ঞান করাই বিষ্ণুর যথার্থ উপাসনা।” কণ্ঠী, কুঁড়োজালি, কি দেখাস্ রে মূর্খ! এই যে সমদর্শিতা, ইহাই সেই অহিংসা-ধর্ম্মের যথার্থ তাৎপর্য্য। সমদর্শী হইলে আর হিংসা থাকে না। এই সমদর্শিতা থাকিলেই মনুষ্য, বিষ্ণুনাম জানুক না জানুক, যথার্থ বৈষ্ণব হইল। যে খ্রীষ্টীয়ান, কি মুসলমান, মনুষ্যমাত্রকে আপনার মত দেখিতে শিখিয়াছে, সে যিশুরই পূজা করুক আর পীর প্যাগম্বরেরই পূজা করুক, সে-ই পরম বৈষ্ণব। আর তোমার কণ্ঠী কুঁড়োজালির নিরামিষের দলে, যাহারা তাহা শিখে নাই, তাহারা কেহই বৈষ্ণব নহে।

আমি। মাছ পাঁটা খেয়ে কি তবে বৈষ্ণব হওয়া যায়?

বাবাজি। মূর্খ! তোকে বুঝাইলাম কি?

আমি। তবে আমাকেও একখানা পাতা দিতে বলুন।

তখন পাতা, এবং কিঞ্চিৎ অন্ন এবং মহাপ্রসাদ পাইয়া আমিও ভোজনে বসিলাম। পাকের কার্য্যটা অতি পরিপাটিরূপ হইয়াছিল। ছাগমাংস ভোজনে আমার ক্ষুধা বৃদ্ধির লক্ষণ দেখিয়া বাবাজি বলিলেন, “বাপু হে! কল্পনা করিয়াছি, পরামর্শ দিয়া আগামী বৎসর কছিমদ্দী সেখকে দিয়া দুর্গোৎসব করাইব!”

আমি। ফল কি?

বাবাজি। ছাগমাংস কিছু গুরুপাক। মুরগী বড় লঘুপাক, অতএব বৈষ্ণবের পক্ষে বিশেষ উপযোগী।

আমি। মুসলমানের বাড়ী খাইতে আছে?

বাবাজি। এ কাণ দিয়ে শুনিস্ ও কাণ দিয়ে ভুলিস্? যখন সর্ব্বত্র সমান জ্ঞান, সকলকে আত্মবৎ জ্ঞানই বৈষ্ণবধর্ম্ম, তখন হিন্দু ও মুসলমান, এ ছোট জাতি, ও বড় জাতি, এরূপ ভেদ-জ্ঞান করিতে নাই। যে এরূপ ভেদ-জ্ঞান করে, সে বৈষ্ণব নহে।

আজ তোমাকে বৈষ্ণবধর্ম্ম কিছু বুঝাইলাম। আর একদিন তোমাকে ব্রহ্মোপাসনা এবং কৃষ্ণোপাসনা বুঝাইব। ধর্ম্মের প্রথম সোপান, বহু দেবের উপাসনা; দ্বিতীয় সোপান, সকাম ঈশ্বরোপাসনা; তৃতীয় সোপান, নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনা বা বৈষ্ণবধর্ম্ম অথবা জ্ঞানমুক্ত ব্রহ্মোপাসনা। ধর্ম্মের চরম কৃষ্ণোপাসনা।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. প্রচার, ১২৯২, বৈশাখ।

Leave a Reply