» » চতুর্ব্বিংশতিতম অধ্যায়-স্বদেশপ্রীতি

গুরু। অনুশীলনের উদ্দেশ্য, সমস্ত বৃত্তিগুলিকে স্ফুরিত ও পরিণত করিয়া ঈশ্বরমুখী করা। ইহার সাধন, কর্ম্মীর পক্ষে, ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন, এজন্য সমস্ত জগৎ আত্মবৎ প্রীতির আধার হওয়া উচিত। জাগতিক প্রীতির ইহার মূল। এই মৌলিকতা দেখিতে পাইতেছ, ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্মের। সমস্ত জগৎ কেন আপনার মত ভাল বাসিব? ইহা ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম বলিয়া। তবে, যদি এমন কাজ দেখি যে, তাহাও ঈশ্বরোদ্দিষ্ট, কিন্তু এই জাগতিক প্রীতির বিরোধী, তবে আমাদের কি করা কর্ত্তব্য? যদি দুই দিক্ বজায় না রাখা যায়, তবে কোন্ দিক্ অবলম্বন করা কর্ত্তব্য?
শিষ্য। সে স্থলে বিচার করা কর্ত্তব্য। বিচারে যে দিক্ গুরু হইবে, সেই দিক অবলম্বন করা কর্ত্তব্য।
গুরু। তবে, যাহা বলি, তাহা শুনিয়া বিচার কর। দম্পতিপ্রীতি-তত্ত্ব বুঝাইবার সময়ে বুঝাইয়াছি যে, সমাজের বাহিরে মনুষ্যের কেবল পশুজীবন আছে মাত্র, সমাজের ভিতরে ভিন্ন মনুষ্যের ধর্ম্মজীবন নাই। সমাজের ভিতরে ভিন্ন কোন প্রকার মঙ্গল নাই বলিলও অত্যুক্তি হয় না। সমাজধ্বংস সমস্ত মনুষ্যের ধর্ম্মধ্বংস। এবং সমস্ত মনুষ্যের সকলপ্রকার মঙ্গলধ্বংস। তোমার ন্যায় সুশিক্ষিতকে কষ্ট পাইয়া এ কথাটা বোধ করি বুঝাইতে হইবে না।
শিষ্য। নিষ্প্রয়োজন। বাচস্পতি মহাশয় দেশে থাকিলে এ সকল বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত করার ভার তাঁরে দিতাম।
গুরু। যদি তাহাই হইল, যদি সমাজধ্বংস ধর্ম্মধ্বংস এবং মনুষ্যের সমস্ত মঙ্গলের ধ্বংস, তবে সব রাখিয়া আগে সমাজ রক্ষা করিতে হয়। এই জন্য হর্বর্ট স্পেন্সর বলিয়াছেন, “The life of the social organism must, as an end, rank above the lives of its units.” অর্থাৎ আত্মরক্ষার অপেক্ষাও দেশরক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম। এবং এই জন্যই সহস্র সহস্র ব্যক্তি আত্মপ্রাণ বিসর্জ্জন করিয়াও দেশরক্ষার চেষ্টা করিয়াছেন।
যে কারণে আত্মরক্ষার অপেক্ষা দেশরক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম, সেই কারণেই ইহা স্বজনরক্ষার অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম। কেন না, তোমার পরিবারবর্গ সমাজের সামান্য অংশ মাত্র, সমুদায়ের জন্য অংশ মাত্রকে পরিত্যাগ বিধেয়।
আত্মরক্ষার ন্যায় ও স্বজনরক্ষার ন্যায় স্বদেশরক্ষা ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম; কেন না, ইহা সমস্ত জগতের হিতের উপায়। পরস্পরের আক্রমণে সমস্ত বিনষ্ট বা অধঃপতিত হইয়া কোন পরস্বলোলুপ পাপিষ্ঠ জাতির অধিকারভুক্ত হইলে, পৃথিবী হইতে ধর্ম্ম ও উন্নতি বিলুপ্ত হইবে। এইজন্য সর্ব্বভূতের হিতের জন্য সকলেরই স্বদেশরক্ষণ কর্ত্তব্য।
যদি স্বদেশরক্ষাও আত্মরক্ষা ও স্বজনরক্ষার ন্যায় ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম হয়, তবে ইহাও নিষ্কাম কর্ম্মে পরিণত হইতে পারে। ইহা যে আত্মরক্ষা ও স্বজনরক্ষার অপেক্ষা সহজে নিষ্কাম কর্ম্মে পরিণত হইতে পারে ও হইয়া থাকে, তাহা বোধ করি কষ্ট পাইয়া বুঝাইতে হইবে না।
শিষ্য। প্রশ্নটা উত্থাপিত করিয়া আপনি বলিয়াছিলেন, “বিচার কর।” এক্ষণে বিচারে কি নিষ্পন্ন হইল?
গুরু। বিচারে এই নিষ্পন্ন হইতেছে যে, সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টি যাদৃশ আমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম, আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা এবং দেশরক্ষা আমার তাদৃশ অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। উভয়েরও অনুষ্ঠান করিতে হইবে। যখন উভয়ে পরস্পরবিরোধী হইবে, তখন কোন্ দিক্ গুরু, তাহাই দেখিবে। আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা দেশরক্ষা-জগৎরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়, অতএব সেই দিক্ অবলম্বনীয়।
কিন্তু বস্তুতঃ জাগতিক প্রীতির সঙ্গে, আত্মপ্রীতি বা স্বজনপ্রীতি বা দেশপ্রীতির কোন বিরোধ নাই। যে আক্রমণকারী, তাহা হইতে আত্মরক্ষা করিব, কিন্তু তাহার প্রতি প্রীতিশূন্য কেন হইব? ক্ষুধার্ত্ত চোরের উদাহরণের দ্বারা ইহা তোমাকে পূর্ব্বে বুঝাইয়াছি। আর ইহাও বুঝাইয়াছি যে, জাগতিক প্রীতি এবং সর্ব্বত্র সমদর্শনের এমন তাৎপর্য্য নহে যে, পড়িয়া মার খাইতে হইবে। ইহার তাৎপর্য্য এই যে, যখন সকলেই আমার তুল্য, তখন আমি কখন কাহারও অনিষ্ট করিব না। কোন মনুষ্যেরও করিব না এবং কোন সমাজেরও করিব না।আপনার সমাজের যেমন সাধ্যানুসারে ইষ্ট সাধন করিব, সাধ্যানুসারে পর-সমাজেরও তেমনি ইষ্ট সাধন করিব। সাধ্যানুসারে-কেন না, কোন সমাজের অনিষ্ট করিয়া অন্য কোন সমাজের ইষ্ট সাধন করিব না। পর-সমাজের অনিষ্ট সাধন করিয়া, আমার সমাজের ইষ্ট সাধন করিব না, এবং আমার সমাজের অনিষ্ট সাধন করিয়া কাহারেও আপনার সমাজের ইষ্ট সাধন করিতে দিব না। ইহাই যথার্থ সমদর্শন এবং ইহাই জাগতিক প্রীতি ও দেশপ্রীতির সামঞ্জস্য। কয় দিন পূর্ব্বে তুমি যে প্রশ্ন করিয়াছিলে, এক্ষণে তাহার উত্তর পাইলে। বোধ করি, তোমার মনে ইউরোপীয় Patritiosim ধর্ম্মের কথা জাগিতেছিল, তাই তুমি এ প্রশ্ন করিয়াছিলে। আমি তোমাকে যে দেশপ্রীতি বুঝাইলাম, তাহা ইউরোপীয় Patriotism নহে। ইউরোপীয় Patriotism একটা ঘোরতর পৈশাচিক পাপ! ইউরোপীয় Patriotism ধর্ম্মের তাৎপর্য্য এই যে, পর-সমাজের কাড়িয়া ঘরের সমাজে আনিব। স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি করিব, কিন্তু অন্য সমস্ত জাতির সর্ব্বনাশ করিয়া তাহা করিতে হইবে। এই দুরন্ত Patriotism প্রভাবে আমেরিকার আদিম জাতিসকল পৃথিবী হইতে বিলুপ্ত হইল। জগদীশ্বর ভারতবর্ষে যেন ভারতবর্ষীয়ের কপালে এরূপ দেশবাৎসল্য ধর্ম্ম না লিখেন। এখন বল, প্রীতিতত্ত্বের স্থূল তত্ত্ব কি বুঝিলে?
শিষ্য। বুঝিয়াছি যে, মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলি অনুশীলিত হইয়া যখন ঈশ্বরানুবর্ত্তিনী হইবে, মনের সেই অবস্থাই ভক্তি।
এই ভক্তির ফল, জাগতিক প্রীতি। কেন না, ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন।
এই জাগতিক প্রীতির সঙ্গে আত্মপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি এবং স্বদেশপ্রীতির প্রকৃত পক্ষে কোন বিরোধ নাই। আপাততঃ যে বিরোধ আমরা অনুভব করি, সেটা এই সকল বৃত্তিকে নিষ্কামতায় পরিণত করিতে আমরা যত্ন করি না, এই জন্য। অর্থাৎ সমুচিত অনুশীলনের অভাবে।
আরও বুঝিয়াছি, আত্মরক্ষা হইতে স্বজনরক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম, স্বজনরক্ষা হইতে দেশরক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম। যখন ঈশ্বরে ভক্তি এবং সর্ব্বলোকে প্রীতি এক, তখন বলা যাইতে পারে যে, ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন, দেশপ্রীতি সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম।
গুরু। ইহাতে ভারতবর্ষীয়দিগের সামাজিক ও ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় অবনতির কারণ পাইলে। ভারতবর্ষীয়দিগের ঈশ্বরে ভক্তি ও সর্ব্বলোকে সমদৃষ্টি ছিল। কিন্তু তাঁহারা দেশপ্রীতি সেই সার্ব্বলৌকিক প্রীতিতে ডুবাইয়া দিয়াছিলেন। ইহা প্রীতিবৃত্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুশীলন নহে। দেশপ্রীতি ও সার্ব্বলৌকিক প্রীতি, উভয়ের অনুশীলন ও পরস্পর সামঞ্জস্য চাই। তাহা ঘটিলে, ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির আসন গ্রহণ করিতে পারিবে।
শিষ্য। ভারতবর্ষ আপনার ব্যাখ্যাত অনুশীলনতত্ত্ব বুঝিতে পারিলে ও কার্য্যে পরিণত করিলে পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জাতির আসন গ্রহণ করিবে, তদ্বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নাই।

Leave a Reply