» » দ্বিতীয় অধ্যায় : সুখ কি?

বর্ণাকার

শিষ্য। কাল আপনার কথায় এই পাইলাম যে, আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি সকলের সম্যক্ অনুশীলনের অভাবই আমাদের দুঃখের কারণ। বটে?
গুরু। তার পর?
শিষ্য। বলিয়াছি যে, বাচস্পতির নির্ব্বাসনের একটি কারণ এই যে, তাঁহার ঘর পুড়িয়া গিয়াছে। আগুন কাহার দোষে কি প্রকারে লাগিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না-কিন্তু বাচস্পতির নিজ দোষে নহে, ইহা এক প্রকার নিশ্চিত। তাঁহার কোন্ অনুশীলনের অভাবে গৃহ দগ্ধ হইল?
গুরু। অনুশীলনতত্ত্বটা না বুঝিয়াই আগে হইতে কি প্রকারে সে কথা বুঝিবে? সুখদুঃখ মানসিক অবস্থা মাত্র-সুখদুঃখের কোন বাহ্যিক অস্তিত্ব নাই। মানসিক অবস্থা মাত্রেই যে সম্পূর্ণরূপে অনুশীলনের অধীন, তাহা তুমি স্বীকার করিবে। এবং ইহাও বুঝিতে পারিবে যে, মানসিক শক্তি সকলের যথাবিহিত অনুশীলন হইলে গৃহদাহ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হইবে না।
শিষ্য। অর্থাৎ বৈরাগ্য উপস্থিত হইলে হইবে না। কি ভয়ানক!
গুরু। সচরাচর যাহাকে বৈরাগ্য বলে, তাহা ভয়ানক ব্যাপার হইলে হইতে পারে। কিন্তু তাহার কথা হইতেছে কি?
শিষ্য। হইতেছে বৈ কি? হিন্দুধর্ম্মের টান সেই দিকে। সাংখ্যকার বলেন, তিন প্রকার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি পরমপুরুষার্থ। তার পর আর একস্থানে বলেন যে, সুখ এত অল্প যে, তাহাও দুঃখ পক্ষে নিক্ষেপ করিবে। অর্থাৎ সুখ দুঃখ সব ত্যাগ করিয়া, জড়পিণ্ডে পরিণত হও।আপনার গীতোক্ত ধর্ম্মও তাই বলেন। শীতোষ্ণ সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব সকল তুল্য জ্ঞান করিবে। যদি সুখে সুখী না হইবে-তবে জীবনে কাজ কি? যদি ধর্ম্মের উদ্দেশ্য সুখ পরিত্যাগ, তবে আমি সেই ধর্ম্ম চাই না। বরং অনুশীলনতত্ত্বের উদ্দেশ্য যদি ঈদৃশ ধর্ম্মই হয়, তবে আমি অনুশীলনতত্ত্ব শুনিতে চাই না।
গুরু। অত রাগের কথা কিছু নাই-আমার এই অনুশীলনতত্ত্বে তোমার দুইটা মিঠাই খাওয়ার পক্ষে কোন আপত্তি হইবে না-বরং বিধিই থাকিবে। সাংখ্যদর্শনকে তোমাকে ধর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিতে বলিতেছি না। শীতোষ্ণসুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব সম্বন্ধীয় যে উপদেশ, তাহারও এমন অর্থ নহে যে, মনুষ্যের সুখভোগ করা কর্ত্তব্য নহে। উহার অর্থ কি, তাহার কথায় এখন কাজ নাই। তুমি কাল বলিয়াছিলে যে, বিলাতী অনুশীলনের উদ্দেশ্য সুখ, ভারতবর্ষীয় অনুশীলনের উদ্দেশ্য মুক্তি। আমি তদুত্তরে বলি, মুক্তি সুখের অবস্থাবিশেষ। সুখের পূর্ণমাত্রা এবং চরমোৎকর্ষ। যদি এ কথা ঠিক হয়, তাহা হইলে ভারতবর্ষীয় অনুশীলনের উদ্দেশ্যও সুখ।
শিষ্য। অর্থাৎ ইহকালে দুঃখ ও পরকালে সুখ।
গুরু। না, ইহকালে সুখ ও পরকালে সুখ।
শিষ্য। কিন্তু আমার আপত্তির উত্তর হয় নাই-আমি ত বলিয়াছিলাম যে, জীব মুক্ত হইলে সে সুখদুঃখের অতীত হয়। সুখশূন্য যে অবস্থা, তাহাকে সুখ বলিব কেন?
গুরু। এই আপত্তি খণ্ডন জন্য, সুখ কি ও মুক্তি কি, তাহা বুঝা প্রয়োজন। এখন, মুক্তির কথা থাক। আগে সুখ কি, তাহা বুঝিয়া দেখা যাক।
শিষ্য। বলুন।
গুরু। তুমি কাল বলিয়াছিলে যে, দুইটা মিঠাই খাইতে পাইলে তুমি সুখী হও। কেন সুখী হও, তাহা বুঝিতে পার?
শিষ্য। আমার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়।
গুরু। এক মুঠা শুকনা চাউল খাইলেও তাহা হয়-মিঠাই খাইলে ও শুকনা চাল খাইলে কি তুমি তুল্য সুখী হও?
শিষ্য। না। মিঠাই খাইলে অধিক সুখ সন্দেহ নাই।
গুরু। তাহার কারণ কি?
শিষ্য। মিঠাইয়ের উপাদানের সঙ্গে মনুষ্য-রসনার এরূপ কোন নিত্য সম্বন্ধ আছে যে, সেই সম্বন্ধ জন্যই মিষ্ট লাগে।
গুরু। মিষ্ট লাগে সে জন্য বটে, কিন্তু তাহা ত জিজ্ঞাসা করি নাই। মিঠাই খাওয়ায় তোমার সুখ কি জন্য? মিষ্টতায় সকলের সুখ নাই। তুমি একজন আসল বিলাতি সাহেবকে একটা বড়বাজারের সন্দেশ কি মিহিদানা সহজে খাওয়াইতে পারিবে না। পক্ষান্তরে তুমি এক টুকরা রোষ্ট বীফ খাইয়া সুখী হইবে না। ‘রবিন্সন ক্রুশো’ গ্রন্থের ফ্রাইডে নামক বর্ব্বরকে মনে পড়ে? সেই আমমাংসভোজী বর্ব্বরের মুখে সলবণ সুসিদ্ধ মাংস ভাল লাগিত না। এই সকল বৈচিত্র্য দেখিয়া বুঝিতে পারিবে যে, তোমার মিঠাই খাওয়ার যে সুখ, তাহার রসনার সঙ্গে ঘৃতশর্করাদির নিত্য সম্বন্ধবশতঃ নহে। তবে কি?
শিষ্য। অভ্যাস।
গুরু। তাহা না বলিয়া অনুশীলন বল।
শিষ্য। অভ্যাস আর অনুশীলন কি এক?
গুরু। এক নহে বলিয়াই বলিতেছি যে, অভ্যাস না বলিয়া অনুশীলনই বল।
শিষ্য। উভয়ে প্রভেদ কি?
গুরু। এখন তাহা বুঝাইবার সময় নহে। অনুশীলনতত্ত্ব ভাল না করিয়া বুঝিলে তাহা বুঝিতে পারিবে না। তবে কিছু শুনিয়া রাখ। যে প্রত্যহ কুইনাইন খায়, তাহার কুইনাইনের স্বাদ কেমন লাগে? কখন সুখদ হয় কি?
শিষ্য। বোধ করি কখন সুখদ হয় না, কিন্তু ক্রমে তিক্ত সহ্য হইয়া যায়।
গুরু। সেইটুকু অভ্যাসের ফল। অনুশীলন, শক্তির অনুকূল; অভ্যাস, শক্তির প্রতিকূল। অনুশীলনের ফল শক্তির বিকাশ, অভ্যাসের ফল শক্তির বিকার। অনুশীলনের পরিণাম সুখ, অভ্যাসের পরিণাম সহিষ্ণুতা। এক্ষণে মিঠাই খাওয়ার কথাটা মনে কর। এখানে তোমার চেষ্টা স্বাভাবিকী রসাস্বিদিনী শক্তির অনুকূল, এ জন্য তোমার সে শক্তি অনুশীলিত হইয়াছে-মিঠাই খাইয়া তুমি সুখী হও। ঐরূপ অনুশীলনবলে তুমি রোষ্ট বীফ খাইয়াও সুখী হইতে পার। অন্যান্য ভক্ষ্য পেয় সম্বন্ধেও সেইরূপ।
এ গেল একটা ইন্দ্রিয়ের সুখের কথা। আমাদের আর আর ইন্দ্রিয় আছে, সেই সকল ইন্দ্রিয়ের অনুশীলনেও ঐরুপ সুখোৎপত্তি।
কতকগুলি শারীরিক শক্তিবিশেষের নাম দেওয়া হইয়াছে ইন্দ্রিয়। আরও অনেকগুলি শারীরিক শক্তি আছে। যথা, গীতবাদ্যের তাল বোধ হয় যে শক্তি অনুশীলনে, তাহাও শারীরিক শক্তি। সাহাবরা তাহার নাম দিয়াছেন muscular sense। এইরূপ আর আর শারীরিক শক্তি আছে। এ সকলের অনুশীলনেও ঐরূপ সুখ।
তা ছাড়া, আমাদের কতকগুলি মানসিক শক্তি আছে। সেগুলির অনুশীলনের যে ফল, তাহাও সুখ। ইহাই সুখ, ইহা ভিন্ন অন্য কোন সুখ নাই। ইহার অভাব দুঃখ। বুঝিলে?
শিষ্য। না। প্রথমতঃ শক্তি কথাটাতেই গোল পড়িতেছে। মনে করুন, দয়া আমাদিগের মনের একটি অবস্থা। তাহার অনুশীলনে সুখ আছে। কিন্তু আমি কি বলিব যে দয়া শক্তির অনুশীলন করিতে হইবে?
গুরু। শক্তি কথাটা গোলের বটে। তৎপরিবর্ত্তে অন্য শব্দের আদেশ করার প্রতি আমার কোন আপত্তি নাই। আগে জিনিসটা বুঝ, তার পর যাহা বলিবে, তাহাতেই বুঝা যাইবে। শরীর এক ও মন এক বটে, তথাপি ইহাদিগের বিশেষ বিশেষ ক্রিয়া আছে; এবং কাজেই সেই সকল বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সম্পাদনকারী বিশেষ বিশেষ শক্তি কল্পনা করা অবৈজ্ঞানিক হয় না। কেন না, আদৌ এই সকল শক্তির মূল এক হইলেও, কার্য্যতঃ ইহাদিগের পার্থক্য দেখিতে পাই। যে অন্ধ, সে দেখিতে পায় না, কিন্তু শব্দ শুনিতে পায়; যে বধির, সে শব্দ শুনিতে পায় না, কিন্তু চক্ষে দেখিতে পায়। কেহ কিছু স্মরণ রাখিতে পারে না, কিন্তু সে হয়ত সুকল্পনাবিশিষ্ট কবি; আবার কেহ কল্পনায় অক্ষম, কিন্তু বড় মেধাবী। কেহ ঈশ্বরে ভক্তিশূন্য, কিন্তু লোককে দয়া করে; আবার নির্দ্দয় লোককেও ঈশ্বরে কিঞ্চিৎ ভক্তিবিশিষ্ট দেখা গিয়াছে।* সুতরাং দেহ ও মনের ভিন্ন ভিন্ন শক্তি স্বীকার করা যাইতে পারে। তবে কতকগুলি শক্তি-যথা স্নেহ, দয়া ইত্যাদিকে শক্তি বলা ভাল শুনায় না। কিন্তু অন্য ব্যবহার্য্য শব্দ কি আছে?
শিষ্য। ইংরাজি শব্দটা faculty, অনেক বাঙ্গালি লেখক বৃত্তি শব্দের দ্বারা তাহার অনুবাদ করিয়াছেন।
গুরু। পাতঞ্জল প্রভৃতি দর্শনশাস্ত্রে বৃত্তি শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
শিষ্য। কিন্তু এক্ষণে সে অর্থ বাঙ্গালা ভাষায় অপ্রচলিত। বৃত্তি শব্দ চলিয়াছে।
গুরু। তবে বৃত্তিই চালাও। বুঝিলেই হইল। যখন তোমরা morals অর্থে “নীতি” শব্দ চালাইয়াছ, Science অর্থে “বিজ্ঞান” চালাইয়াছ, তখন faculty অর্থে “বৃত্তি” শব্দ চালাইলে দোষ ধরিব না।
শিষ্য। তার পর আমার দ্বিতীয় আপত্তি। আপনি বলিলেন, বৃত্তির অনুশীলন সুখ-কিন্তু জল বিনা তৃষ্ণার অনুশীলনে দুঃখ।
গুরু। রও। বৃত্তির অনুশীলনের ফল ক্রমশঃ স্ফূর্ত্তি, চরমে পরিণতাবস্থা, তার পর উদ্দিষ্ট বস্তুর সম্মিলনে পরিতৃপ্তি। এই স্ফূর্ত্তি এবং পরিতৃপ্তি উভয়ই সুখের পক্ষে আবশ্যক।
শিষ্য। ইহা যদি সুখ হয়, তবে বোধ হয়, এরূপ সুখ মনুষ্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে।
গুরু। কেন?
শিষ্য। ইন্দ্রিয়পর ব্যক্তির ইন্দ্রিয়বৃত্তির অনুশীলনে পরিতৃপ্তিতে সুখ। তাই কি তাহার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত?
গুরু। না। তাহা নহে। তাহা হইলেই ইন্দ্রিয় প্রবলতাহেতু মানসিক বৃত্তি সকলের অস্ফূর্ত্তি এবং ক্রমশঃ বিলোপ হইবার সম্ভাবনা। এ বিষয়ে স্থূল নিয়ম হইতেছে সামঞ্জস্যই। ইন্দ্রিয় সকলেরও এককালীন বিলোপ ধর্ম্মানুমত নহে। তাহাদের সামঞ্জস্যই ধর্ম্মানুমত। বিলোপে ও সংযমে অনেক প্রভেদ। সে কথা পশ্চাৎ বুঝাইব। এখন স্থূল কথাটা বুঝিয়া রাখ যে, বৃত্তি সকলের অনুশীলনের স্থূল নিয়ম পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্য। এই সামঞ্জস্য কি, তাহা সবিস্তারে একদিন বুঝাইব। এখন কথাটা এই বুঝাইতেছি যে, সুখের উপাদান কি?
প্রথম। শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি সকলের অনুশীলন। তজ্জনিত স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি।
দ্বিতীয়। সেই সকলের পরস্পর সামঞ্জস্য।
তৃতীয়। তাদৃশ অবস্থায় সেই সকলের পরিতৃপ্তি।
ইহা ভিন্ন আর কোন জাতীয় সুখ নাই। আমি সময়ান্তরে তোমাকে বুঝাইতে পারি, যোগীর যোগজনিত যে সুখ, তাহাও ইহার অন্তর্গত। ইহার অভাবই দুঃখ। সময়ান্তরে আমি তোমাকে বুঝাইতে পারি যে, বাচস্পতির গৃহদাহজনিত যে দুঃখ, অথবা তদপেক্ষাও হতভাগ্য ব্যক্তির পুত্রশোকজনিত যে দুঃখ, তাহাও এই দুঃখ আমার অবশিষ্ট কথাগুলি শুনিলে তুমি আপনি তাহা বুঝিতে পারিবে, আমাকে বুঝাইতে হইবে না।
শিষ্য। মনে করুন, তাহা যেন বুঝিলাম, তথাপি প্রধান কথাটা এখনও বুঝিলাম না। কথাটা এই হইতেছিল যে, আমি বলিয়াছিলাম যে, বাচস্পতি ধার্ম্মিক ব্যক্তি, তথাপি দুঃখী; আপনি বলিলেন যে, যখন সে দুঃখী, তখন সে কখনও ধার্ম্মিক নহে। আপনার কথা প্রমাণ করিবার জন্য, আপনি সুখ কি, তাহা বুঝাইলেন; এবং সুখ বুঝাতে বুঝিলাম যে, দুঃখ কি। ভাল, তাহাতে যেন বুঝিলাম যে, বাচস্পতি যথার্থ দুঃখী নহেন, অথবা তাঁহাকে যদি দুঃখী বলা যায়, তবে তিনি নিজের দোষে, অর্থাৎ নিজ শারীরিক বা মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের ত্রুটি করাতে এই দুঃখ পাইতেছেন। কিন্তু তাহাতে এমন কিছুই বুঝা গেল না যে, তিনি অধার্ম্মিক। এ অনুশীলনতত্ত্বের সঙ্গে ধর্ম্মাধর্ম্মের সম্বন্ধ কি, তাহা ত কিছুই বুঝা গেল না। যদি কিছু বুঝিয়া থাকি, তবে সে এই যে, অনুশীলনই ধর্ম্ম।
গুরু। এক্ষণে তাই মনে করিতে পার। তাহা ছাড়া আরও একটা গুরুতর কথা আছে, তাহা না বুঝাইলে অনুশীলনের সঙ্গে ধর্ম্মের কি সম্বন্ধ, তাহা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু সেটা আমাকে সর্ব্বশেষে বলিতে হইবে; কেন না, অনুশীলন কি, তাহা ভাল করিয়া না বুঝিলে সে তত্ত্ব তুমি গ্রহণ করিতে পারিবে না।
শিষ্য। অনুশীলন আবার ধর্ম্ম! এ সকল নূতন কথা।
গুরু। নূতন নহে। পুরাতনের সংস্কার মাত্র।

—————-
* উদাহরণ-বিলাতের সপ্তদশ শতাব্দীর Puritan সম্প্রদায়। অপিচ, Inquisition অধ্যক্ষেরা।

Leave a Reply