» » দ্বাবিংশতিতম অধ্যায়-আত্মপ্রীতি

বর্ণাকার

শিষ্য। আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, নিষ্কাম আত্মরক্ষা কি রকম? আপনি বলিয়াছিলেন, “কাল উত্তর দিব।” সেই উত্তর এক্ষণে শুনিব ইচ্ছা করি।
গুরু। আমার এই ভক্তিবাদ সমর্থনার্থ কোন জড়বাদীর সহায়তা গ্রহণ করিব, তুমি এমন প্রত্যাশা কর না। তথাপি হর্বর্ট স্পেন্সরের একটি কথা তোমাকে পড়াইয়া শুনাইব।
“A creature must live before it can act. From this it is a corollary that the acts by which each maintain his own life must, speaking generally, precede in imperativeness all other acts of which he is capable. For if it be asserted that these other acts must precede in imperativeness the acts which maintain life; and if this, accepted as a general law of conduct, is conformed to by all; then by postponing the acts which maintain life to the other acts which life makes it possible, all must lost their lives… The acts required for conditioned self-preservation, including the enjoyment of benefits achieved by such acts, are the first requisites to universal welfare. Unless each duly cares for himself, his care for all others is ended by death; and if each thus dies, there remain no others to be cared for.” *
অতএব জগদীশ্বরের সৃষ্টিরক্ষার্থ আত্মরক্ষার্থ নিতান্ত প্রয়োজনীয়। জগদীশ্বরের সৃষ্টিরক্ষার্থ প্রয়োজনীয় বলিয়া ইহা ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম। ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম, এজন্য আত্মরক্ষাকেও নিষ্কাম কর্ম্মে পরিণত করা যাইতে পারে ও করাই কর্ত্তব্য।
এক্ষণে পরহিত ও পররক্ষার সঙ্গে এই আত্মরক্ষার তুলনা করিয়া দেখ। পরহিত ধর্ম্মাপেক্ষা আত্মরক্ষা ধর্ম্মের গৌরব অধিক। যদি জগতে লোকে পরস্পরের হিত না করে, পরস্পরের রক্ষা না করে, তাহাতে জগৎ মনুষ্যশূন্য হইবে না। অসভ্য সমাজ সকল ইহার উদাহরণ। কিন্তু সকলে আত্মরক্ষায় বিরত হইলে, সভ্য কি অসভ্য, কোন সমাজ কোন প্রকার মনুষ্য বা জীব জগতে থাকিবে না। অতএব পরহিতের আগে আপনার প্রাণরক্ষা।
শিষ্য। এ সকল অতি অশ্রদ্ধেয় কথা বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। মনে করুন, পরকে না দিয়া আপনি খাইব?
গুরু। তুমি যাহা কিছু আহার্য্য সংগ্রহ কর, তাহা যদি সমস্তই প্রত্যহ অন্যকে বিলাইয়া দাও, তবে পাঁচ-সাত দিনে তোমার দানধর্ম্মের শেষ হইবে। কেন না, তুমি নিজে না খাইয়া মরিয়া যাইবে। পরকে দিবে, কিন্তু পরকে দিয়া আপনি খাইবে। যদি পরকে দিতে না কুলায়, তবে কাজেই আহারের জন্য প্রত্যহ তিনটা পাঁঠা, দেড় কুড়ি মাছের প্রাণ সংহার হয়, তাঁর কাজেই পরকে দিতে কুলায় না। যে সর্ব্বভূতে সমান দেখে, আপনাতে ও পরে সমান দেখে, সে পরকে যেমন দিতে পারে, আপনি তেমনই খায়। ইহাই ধর্ম্ম-আপনি উপবাস করিয়া পরকে দেওয়া ধর্ম্ম নহে। কেন না, আপনাতে ও পরে সমান করিতে হইবে।
শিষ্য। ভাল, আমার প্রযুক্ত উদাহরণটা না হয়, অনুপযুক্ত হইয়াছে। কিন্তু কখন কি পরোপকারার্থ আপনার প্রাণ বিসর্জ্জন করা কর্ত্তব্য নহে?
গুরু। অনেক সময়ে তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য। না করাই অধর্ম্ম।
শিষ্য। তাহার দুই একটা উদাহরণ শুনিতে ইচ্ছা করি।
গুরু। যে মাতা পিতার নিকট তুমি প্রাণ পাইয়াছ, যাঁহাদিগের যত্নে তুমি কর্ম্মক্ষম ও ধর্ম্মক্ষম হইয়াছ, তাঁহাদিগের রক্ষার্থ প্রয়োজনমতে আপনার প্রাণ বিসর্জ্জনই ধর্ম্ম, না করা অধর্ম্ম।
সেইরূপ প্রাণদানাদি উপকার যদি তুমি অন্যের কাছে পাইয়া থাক, তবে তাহার জন্যও ঐরূপ আত্মপ্রাণ বিসর্জ্জনীয়।
যাহাদের তুমি রক্ষক, তাহাদের জন্য আত্মপ্রাণ ঐরূপে বিসর্জ্জনীয়। এখন বিবেচনা করিয়া দেখ, তুমি রক্ষক কাহার। তুমি রক্ষক, (১) স্ত্রীপুত্রাদি পরিবারবর্গের, (২) স্বদেশের, (৩) প্রভুর, অর্থাৎ যে তোমাকে রক্ষার্থ বেতন দিয়া নিযুক্ত করিয়াছে, তাহার; (৪) শরণাগতের। অতএব স্ত্রীপুত্রাদি, স্বদেশ, প্রভু, এবং শরণাগত, এই সকলের রক্ষার্থ আপনার প্রাণ পরিত্যাগ করা ধর্ম্ম।
যাহারা আপনাদের রক্ষায় অক্ষম, মনুষ্য মাত্রেই তাঁহাদের রক্ষক। স্ত্রীলোক, বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত, অন্ধ খঞ্জাদি অঙ্গহীন, ইহারা আত্মরক্ষায় অক্ষম। ইহাদের রক্ষার্থ প্রাণ পরিত্যাগ ধর্ম্ম।
এইরূপ আরও অনেক স্থান আছে। সকলগুলি গণনা করিয়া উঠা যায় না। প্রয়োজনও নাই। যাহার জ্ঞানার্জ্জনী ও কার্য্যকারিণী বৃত্তি অনুশীলিত ও সামঞ্জস্য প্রাপ্ত হইয়াছে, সে সকল অবস্থাতেই বুঝিতে পারিবে যে, এই স্থলে প্রাণ পরিত্যাগ ধর্ম্ম, এই স্থলে অধর্ম্ম।
শিষ্য। আপনার কথার তাৎপর্য্য এই বুঝিলাম যে, আত্মপ্রীতি প্রীতিবৃত্তির বিরোধী হইলেও, ঘৃণার যোগ্য নহে। উপযুক্ত নিয়মে উহার সীমাবদ্ধ করিয়া উহারও সম্যক্ অনুশীলন কর্ত্তব্য। বটে?
গুরু। বস্তুতঃ যদি আত্ম-পর সমান হইল, তবে আত্মপ্রীতি ও জাগতিক প্রীতি, ভিন্ন বিবেচনা করাও উচিত নহে। উপযুক্তরূপে উভয়ে অনুশীলিত ও সামঞ্জস্যবিশিষ্ট হইলে আত্মপ্রীতি জাগতিক প্রীতির অন্তর্গত হইয়া দাঁড়ায়। কেন না, আমি ত জগতের বাহিরে নই। ধর্ম্মের, বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম্মের মূল একমাত্র ঈশ্বর। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন; এজন্য সর্ব্বভূতের হিতসাধন আমাদের ধর্ম্ম, কেন না, বলিয়াছি যে-সকল বৃত্তিকে ঈশ্বরমুখী করাই মনুষ্যজন্মের চরম উদ্দেশ্য। যদি সর্ব্বভূতের হিতসাধন ধর্ম্ম হয়, তবে পরেরও হিতসাধন যেমন আমার ধর্ম্ম, তেমনি আমার নিজেরও হিতসাধন আমার ধর্ম্ম। কারণ, আমিও সর্ব্বভূতের অন্তর্গত; ঈশ্বর যেমন অপর ভূতে আছেন, তেমনি আমাতেও আছেন। অতএব পরেরও রক্ষাদি আমার ধর্ম্ম এবং আপনারও রক্ষাদি আমার ধর্ম্ম। আত্মপ্রীতি ও জাগতিক প্রীতি এক।
শিষ্য। কিন্তু কথাটার গোলযোগ এই যে, যখন আত্মহিত এবং পরহিত পরস্পর বিরোধী তখন আপনার হিত করিব, না পরের হিত করিব? পূর্ব্বগামী ধর্ম্মবেত্তৃগণের মত এই যে, আত্মহিতে ও পরহিতে পরস্পর বিরোধ হইলে, পরহিত সাধনই ধর্ম্ম।
গুরু। ঠিক এমন কথাটা কোন ধর্ম্মে আছে, তাহা আমি বুঝি না। খ্রীষ্টধর্ম্মের উক্তি যে, “পরের তোমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার তুমি বাসনা কর, তুমি পরের প্রতি সেইরূপ ব্যবহার করিবে।” এ উক্তিতে পরহিতকে প্রাধান্য দেওয়া হইতেছে না, পরহিত ও আত্মহিতকে তুল্য করা হইতেছে। কিন্তু সে কথা থাক্, কেন না, আমাকেও এই অনুশীলনতত্ত্বে পরহিতকেই স্থলবিশেষে প্রাধান্য দিতে হইবে। কিন্তু তুমি যে কথা তুলিলে, তাহারও সুমীমাংসা আছে। সেই মীমাংসার প্রথম এবং প্রধান নিয়ম এই যে, পরের অনিষ্টমাত্রই অধর্ম্ম। পরের অনিষ্ট করিয়া আপনার হিতসাধন করিবার কাহারও অধিকার নাই। ইহা হিন্দুধর্ম্মেও বলে, খ্রীষ্ট বৌদ্ধাদি অপর ধর্ম্মেরও এই মত, এবং আধুনিক দার্শনিক বা নীতিবেত্তাদিগেরও মত। অনুশীলনতত্ত্ব যদি বুঝিয়া থাক, তবে অবশ্য বুঝিয়াছ, পরের অনিষ্ট, ভক্তি প্রীতি প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ বৃত্তিসকলের সমুচিত অনুশীলনের বিরোধী ও বিঘ্নকর এবং যে সাম্যজ্ঞান ভক্তি ও প্রীতির লক্ষণ, তাহার উচ্ছেদক। পরের অনিষ্ট, ভক্তি প্রীতি দয়াদির অনুশীলনের বিরোধী, এজন্য যেখানে পরের অনিষ্ট ঘটে, সেখানে তদ্দ্বারা আপনার হিতসাধন করিবে না, ইহা অনুশীলনধর্ম্মের এবং হিন্দুধর্ম্মের আজ্ঞা। আত্মপ্রীতি-তত্ত্বের ইহাই প্রথম নিয়ম।
শিষ্য। নিয়মটা কি প্রকারে খাটে-দেখা যাউক। এক ব্যক্তি চোর, সে সপরিবারে খাইতে পায় না, উপবাস করিয়া আছে। এরূপ যে চোরের সর্ব্বদা ঘটে, তাহা বলা বাহুল্য। সে, রাত্রে আমার ঘরে সিঁধ দিয়াছে-অভিপ্রায়, কিছু চুরি করিয়া আপনার ও পরিবারবর্গের আহার সংগ্রহ করে। তাহাকে আমি ধৃত করিয়া বিহিত দণ্ডবিধান করিব, না উপহারস্বরূপ কিছু অর্থ দিয়া বিদায় করিব?
গুরু। তাহাকে ধৃত করিয়া বিহিত দণ্ডবিধান করিবে।
শিষ্য। তাহা হইলে আমার সম্পত্তিরক্ষা-রূপ ইষ্টসাধন হইল বটে, কিন্তু চোরের এবং তাহার নিরপরাধী স্ত্রীপুত্রগণের ঘোরতর অনিষ্ট হইল। আপনার সূত্রটি খাটে?
গুরু। চোরের নিরপরাধী স্ত্রী-পুত্রাদি যদি অনাহারে মরে, তুমি তাহাদের আহারার্থ কিছু দান করিতে পার। চোরও যদি না খাইয়া মরে, তবে তাহাকেও খাইতে দিতে পার। কিন্তু চুরির দণ্ড দিতে হইবে। কেন না, না দিলে, কেবল তোমার অনিষ্ট নহে, সমস্ত লোকের অনিষ্ট। চোরের প্রশ্রয়ে চৌর্য্যবৃদ্ধি, চৌর্য্যবৃদ্ধিতে সমাজের অনিষ্ট।
শিষ্য। এ ত বিলাতী হিতবাদীর কথা-আপনার মতে “Greatest good of the greatest number” এখানে অবলম্বনীয়।
গুরু। হিতবাদ মতটা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার বস্তু নহে। হিতবাদীদিগের ভ্রম এই যে, তাঁহারা বিবেচনা করেন যে, সমস্ত ধর্ম্মতত্ত্বটা এই হিতবাদ মতের ভিতরই আছে। তাহা না হইয়া, ইহা ধর্ম্মতত্ত্বের সামান্য অংশ মাত্র। আমি যেখানে উহাকে স্থান দিলাম, তাহা আমার ব্যাখ্যাত অনুশীলনতত্ত্বের একটি কোণের কোণ মাত্র। তত্ত্বটা সত্যমূলক, কিন্তু ধর্ম্মতত্ত্বের সমস্ত ক্ষেত্র আবৃত করে না। ধর্ম্ম ভক্তিতে, সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টিতে। সেই মহাশিখর হইতে যে সহস্র সহস্র নির্ঝরিণী নামিয়াছে-হিতবাদ ইহা তাহার একটি ক্ষুদ্রতম স্রোতঃ। ক্ষুদ্রতম হউক-ইহার জল পবিত্র। হিতবাদ ধর্ম্ম-অধর্ম্ম নহে।

—————
* Data of Ethics, Chap. XI [p. 187.] Italic যে যে শব্দে দেওয়া হইল, তাহা আমার দেওয়া।
—————

স্থূল কথা, অনুশীলন ধর্ম্মে “Greatest good of the greatest number,” গণিততত্ত্ব ভিন্ন আর কিছুই নহে। যদি ভূতমাত্রের হিতসাধন ধর্ম্ম হয়, তবে এক জনের হিতসাধন ধর্ম্ম, আবার এক জনের হিতসাধন অপেক্ষা দশ জনের তুল্য হিতসাধন অবশ্য দশগুণ ধর্ম্ম। যদি এক দিকে এক জনের হিতসাধন ও আর এক দিকে দশ জনের তুল্য হিতসাধন পরস্পর বিরুদ্ধ কর্ম্ম হয়, তবে এক জনের হিত পরিত্যাগ করিয়া দশ জনের তুল্য হিতসাধনই ধর্ম্ম; এবং দশ জনের হিত পরিত্যাগ করিয়া এক জনের তুল্য হিতসাধন করা অধর্ম্ম।* এখানে “Good of the greatest number.”
পক্ষান্তরে, এক জনের অল্প হিত, আর এক দিকে আর এক জনের বেশী হিত পরস্পর বিরোধী, সেখানে অল্প হিত পরিত্যাগ করিয়া বেশী হিত সাধন করাই ধর্ম্ম, তদ্বিপরীতই অধর্ম্ম। এখানে কথাটা “Greatest Good.”
শিষ্য। সে ত স্পষ্ট কথা।
গুরু। যত স্পষ্ট এখন বোধ হইতেছে, কার্য্যকালে তত স্পষ্ট হয় না। এক দিকে শ্যামু ঠাকুর, কুলীন, ব্রাহ্মণ, কন্যাভারগ্রস্ত, অর্থাভাবে মেয়েটি স্বঘরে দিতে পারিতেছেন না; আর এক দিকে রামা ডোম, কতকগুলি অপোগণ্ডভারগ্রস্ত, সপরিবারে খাইতে পায় না, প্রাণ যায়। এখানে “Greatest good” রামার দিকে, কিন্তু উভয়েই তোমার নিকট যাচ্‌ঞা করিতে আসিলে, তুমি বোধ করি শ্যামু ঠাকুরকে পাঁচটি টাকা দিয়াও কুণ্ঠিত হইবে, মনে করিবে কম হইল, আর রামাকে চারিটা পয়সা দিতে পারিলেই আপনারে দাতা ব্যক্তি মধ্যে গণ্য করিবে। অন্ততঃ অনেক বাঙ্গালিই এইরূপ। বাঙ্গালি কেন, সকল জাতীয় লোক সম্বন্ধে এইরূপ সহস্র উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে।
শিষ্য। সে কথা যাক্। সর্ব্বভূতে যদি সমান, তবে অল্পের অপেক্ষা বেশী লোকের হিতসাধন ধর্ম্ম, এবং এক জনের অল্প হিতের অপেক্ষায় এক জনের বেশী হিতসাধন ধর্ম্ম। কিন্তু যেখানে এ জনের বেশী হিত একদিকে, আর দশ জনের অল্প হিত (তুল্য হিত নহে) আর একদিকে, সেখানে ধর্ম্ম কি?
গুরু। সেখানে অঙ্ক কষিবে। মনে কর, এক দিকে এক জনের যে পরিমাণ হিত সাধিত হইতে পারে, অন্য দিকে শত জনের প্রত্যেকের চতুর্থাংশের এক অংশ সাধিত হইতে পারে। এ স্থলে এই শত জনের হিতের অঙ্ক ‍১০০/৪ = ২৫ এখানে এক জনের বেশী হিত পরিত্যাগ করিয়া শত জনের অল্প হিতসাধন করাই ধর্ম্ম। পক্ষান্তরে, যদি এই শত জনের প্রত্যেকের হিতের মাত্রা চতুর্থাংশ না হইয়া সহস্রাংশ হইত, তাহা হইলে ইহাদিগের সুখের মাত্রার সমষ্টি এক জনের ১/১০ মাত্র। সুতরাং এ স্থলে সে শত ব্যক্তির হিত পরিত্যাগ করিয়া এক ব্যক্তি হিতসাধন করাই ধর্ম্ম।
শিষ্য। হিতের কি এরূপ ওজন হয়? মাপকাঠিতে মাপ হয়, এত গজ এত ইঞ্চি?
গুরু। ইহার সদুত্তর কেবল অনুশীলনবাদীই দিতে পারেন। যাঁহার সকল বৃত্তি, বিশেষ জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সম্যক্ অনুশীলিত ও স্ফূর্ত্তিপ্রাপ্ত হইয়াছে। হিতাহিত মাত্রা ঠিক বুঝিতে তিনি সক্ষম। যাঁহার সেরূপ অনুশীলন হয় নাই, তাঁহার পক্ষে ইহা অনেক সময় দুঃসাধ্য, কিন্তু তাঁহার পক্ষে সর্ব্বপ্রকার ধর্ম্মই দুঃসাধ্য, ইহা বোধ করি বুঝাইয়াছি। তথাপি ইহা দেখিবে যে, সচরাচর মনুষ্য অনেক স্থানেই এরূপ কার্য্য করিতে পারে। ইউরোপীয় হিতবাদীরা ইহা বিশেষ করিয়া বুঝাইয়াছেন, সুতরাং আমার আর সে সকল কথা তুলিবার প্রয়োজন নাই। হিতবাদের কতটুকু বুঝাইবার আমার উদ্দেশ্য এই যে, তুমি বুঝ যে, অনুশীলনতত্ত্বে হিতবাদের স্থান কোথায়।
শিষ্য। স্থান কোথায়?

————–
* ভরসা করি, কেহই এমন অর্থ বুঝিবেন না যে দশ জনের হিতের জন্য এক জনের অনিষ্ট করিবে। তাহা করা ধর্ম্মবিরুদ্ধ, ইহা বলা বাহুল্য।
————–

গুরু। প্রীতিবৃত্তির সামঞ্জস্যে। সর্ব্বভূতে সমান, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের হিত পরস্পর বিরোধী হইয়া থাকে, সে স্থলে ওজন করিয়া বা অঙ্ক কষিয়া দেখিবে। অর্থাৎ “Greatest good of the greatest number” আমি যে অর্থে বুঝাইলাম, তাহাই অবলম্বন করিবে। যখন পরহিতে এইরূপ বিরোধ, তখন কি প্রকারে এই বিচার কর্ত্তব্য, তাহাই বুঝাইয়াছি। কিন্তু পরহিতে পরহিতে বিরোধের অপেক্ষা, আত্মহিতে পরহিতে বিবাদ আরও সাধারণ এবং গুরুতর ব্যাপার। সেখানেও সামঞ্জস্যের সেই নিয়ম। অর্থাৎ-
(১) যখন এক দিকে তোমার হিত, অপর দিকে একাধিক সংখ্যক লোকের তুল্য হিত সেখানে আত্মহিত ত্যাজ্য এবং পরহিতই অনুষ্ঠেয়।
(২) যেখানে এক দিকে আত্মহিত, অন্য দিকে অপর এক জনের অধিক হিত, সেখানে পরের হিত অনুষ্ঠেয়।
(৩) যেখানে তোমার বেশী হিত এক দিকে, অন্যের অল্প হিত এক দিকে, সেখানে কোন্ দিকের মোট মাত্রা বেশী, তাহা দেখিবে। তোমার দিক্ বেশী হয়, আপনার হিত সাধিত করিবে; পরের দিক্ বেশী হয়, পরের হিত খুঁজিবে।
শিষ্য। (৪) আর যেখানে দুইখানে দুই দিক্ সমান?
গুরু। সেখানে পরের হিত অনুষ্ঠেয়।
শিষ্য। কেন? সর্ব্বভূত যখন সমান, তখন আপনি পর ত সমান।
গুরু। অনুশীলনতত্ত্বে ইহার উত্তর পাওয়া যায়। প্রীতিবৃত্তি পরানুরাগিণী। কেবল আত্মানুরাগিণী প্রীতি প্রীতি নহে। আপনার হিতসাধনে প্রীতির অনুশীলন, স্ফূরণ বা চরিতার্থ হয় না। পরহিতসাধনে তাহা হইবে। এই জন্য এ স্থলে পরপক্ষ অবলম্বনীয়। কেন না, তাহাতে পরহিতও সাধিত হয় এবং প্রীতিবৃত্তির অনুশীলন ও চরিতার্থতা জন্য তোমার যে নিজের হিত, তাহাও সাধিত হয়। অতএব মোটের উপর পরপেক্ষ বেশী হিত সাধিত হয়।
অতএব, আত্মপ্রীতির সামঞ্জস্য সম্বন্ধে আমি যে প্রথম নিয়ম বলিয়াছি, অর্থাৎ যেখানে পরের অনিষ্ট হয়, সেখানে আত্মহিত পরিত্যাজ্য, তাহার সম্প্রসারণ ও সীমাবন্ধন স্বরূপ হিতবাদীদিগের এই নিয়ম দ্বিতীয় নিয়মের স্বরূপ গ্রহণ করিতে পার।
আর একটি তৃতীয় নিয়ম আছে। অনেক সময় আমার আত্মহিত যত দূর আমার আয়ত্ত, পরের হিত তাদৃশ নহে। উদাহরণস্বরূপ দেখ, আমরা যত সহজে আপনার মানসিক উন্নতি সাধিত করিতে পারি, পরের তত সহজে পারি না। এ স্থলে অগ্রে আপনার মানসিক উন্নতির সাধনই কর্ত্তব্য; কেন না, সিদ্ধির সম্ভাবনা বেশী। পুনশ্চ, অনেক স্থলে আপনার হিত আগে সাধিত না করিলে পরের হিত সাধিত করিতে পারা যায় না। এ স্থলেও পরপেক্ষ অপেক্ষা আত্মপক্ষই অবলম্বনীয়। আমার মানসিক উন্নতি না হইলে, আমি তোমার মানসিক উন্নতি সাধিত করিতে পারিব না; অতএব এখানে আগে আপনার হিত অবলম্বনীয়। যদি তোমাকে আমাকে এককালে শত্রুতে আক্রমণ করে, তবে আগে আপনার রক্ষা না করিলে, আমি তোমাকে রক্ষা করিতে পারিব না। চিকিৎসক নিজে রুগ্নশয্যাশায়ী হইলে, আগে আপনার আরোগ্যসাধন না করিলে, পরকে আরোগ্য দিতে পারেন না। এ সকল স্থানেও আত্মহিতই আগে সাধনীয়।
এক্ষণে, তোমাকে যাহা বুঝাইয়াছিলাম, তাহা আবার স্মরণ কর।
প্রথম, আত্মপর অভেদজ্ঞানই, যথার্থ প্রীতির অনুশীলন।
দ্বিতীয়, তদ্দ্বারা আত্মপ্রীতির সমুচিত ও সীমাবদ্ধ অনুশীলন নিষিদ্ধ হইতেছে না, কেন না, আমিও সর্ব্বভূতের অন্তর্গত।
তৃতীয়, বৃত্তির অনুশীলনের চরম উদ্দেশ্য-সকল বৃত্তিগুলিকে ঈশ্বরমুখী করা। অতএব যাহা ঈশ্বরাদ্দিষ্ট কর্ম্ম, তাহাই অনুষ্ঠেয়। ঈদৃশ অনুষ্ঠেয় কর্ম্মের অনুবর্ত্তনে কখন অবস্থাবিশেষে আত্মহিত, কখন অবস্থাবিশেষে পরহিতকে প্রাধান্য দিতে হয়।
তাহাতে হিন্দুধর্ম্মোক্ত সাম্যজ্ঞানের বিঘ্ন হয় না। তুমি যেখানে আত্মরক্ষার অধিকারী, পরেও সেইখানে সেইরূপ আত্মরক্ষার অধিকারী। যেখানে তুমি পরের জন্য আত্মবিসর্জ্জনে বাধ্য, পরেও সেইখানে তোমার জন্য আত্মবিসর্জ্জনে বাধ্য। এই জ্ঞানই সাম্যজ্ঞান। অতএব আমি যে সকল বর্জ্জিত কথা বলিলাম, তদ্দ্বারা গীতোক্ত সাম্যজ্ঞানের কোন হানি হইতেছে না।
শিষ্য। কিন্তু আমি ইতিপূর্ব্বে যে প্রশ্ন করিয়াছিলাম, তাহার কোন সমুচিত উত্তর হয় নাই। আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, হিন্দুর পারমার্থিক প্রীতির সঙ্গে জাতীয় উন্নতির কিরূপে সামঞ্জস্য হইতে পারে।
গুরু। উত্তরের প্রথম সূত্র সংস্থাপিত হইল। এক্ষণে ক্রমশঃ উত্তর দিতেছি।

Leave a Reply