ভক্তির সাধন

শিষ্য। এক্ষণে আপনাকে জিজ্ঞাস্য যে, আপনার নিকট যে ভক্তির ব্যাখ্যা শুনিলাম, তাহা সাধন, না সাধ্য?
গুরু। ভক্তি, সাধন ও সাধ্য। ভক্তি, মুক্তিপ্রদা, এজন্য ভক্তি সাধন। আর ভক্তি মুক্তিপ্রদা হইলেও মুক্তি বা কিছুই কামনা করে না, এজন্য ভক্তিই সাধ্য।
শিষ্য। তবে, এই ভক্তির সাধন কি, শুনিতে ইচ্ছা করি। ইহার অনুশীলন প্রথা কি? উপাসনাই ভক্তির সাধন বলিয়া চিরপ্রথিত, কিন্তু আপনার ব্যাখ্যা যদি যথার্থ হয়, তবে ইহাতে উপাসনার কোন স্থান দেখিতেছি না।
গুরু। উপাসনার যথেষ্ট স্থান আছে, কিন্তু উপাসনা কথাটা অনেক প্রকার অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, ইহাতে গোলযোগ হইতে পারে বটে। সকল বৃত্তিগুলিকে ঈশ্বরমুখী করিবার যে চেষ্টা, তাহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উপাসনা আর কি হইতে পারে? তুমি অনুদিন সমস্ত কার্য্যে ঈশ্বরকে আন্তরিক চিন্তা না করিলে কখনই তাহা পারিবে না।
শিষ্য। তথাপি হিন্দুশাস্ত্রে এই ভক্তির অনুশীলনের কি প্রথা প্রচলিত আছে, তাহা জানিতে ইচ্ছা করি। আপনি যে ভক্তিতত্ত্ব বুঝাইলেন, তাহা হিন্দুশাস্ত্রোক্ত ভক্তি হইলেও হিন্দুদিগের মধ্যে বিরল। হিন্দুর মধ্যে ভক্তি আছে; কিন্তু সে আর এক রকমের। প্রতিমা গড়িয়া, তাহার সম্মুখে যোড়হাত করিয়া পট্টবস্ত্র গলদেশে গিয়া গদ্গদভাবে অশ্রুমোচন, “হরি! হরি!” বা “মা! মা!” ইত্যাদি শব্দে উচ্চতর গোলযোগ, অথবা রোদন, এবং প্রতিমার চরণামৃত পাইলে তাহা মাথায়, মুখে চোখে, নাকে, কাণে,-
গুরু। তুমি যাহা বলিতেছ, বুঝিয়াছি। উহাও চিত্তের উন্নত অবস্থা, উহাকে উপহাস করিও না। তোমার হক্সলী, টিণ্ডল অপেক্ষা ওরূপ এক জন ভাবুক আমার শ্রদ্ধার পাত্র। তুমি গৌণ ভক্তির কথা তুলিতেছ।
শিষ্য। আপনার পূর্ব্বকার কথায় ইহাই বুঝিয়াছি যে, ইহাকে আপনি ভক্তি বলিয়া স্বীকার করেন না।
গুরু। ইহা মুখ্য ভক্তি নহে, কিন্তু গৌণ বা নিকৃষ্ট ভক্তি বটে। যে সকল হিন্দুশাস্ত্র অপেক্ষাকৃত আধুনিক, ইহাতে সে সকল পরিপূর্ণ।
শিষ্য। গীতাদি প্রাচীন শাস্ত্রে মুখ্য ভক্তিতত্ত্বেরই প্রচার থাকাতেও আধুনিক শাস্ত্রে গৌণ ভক্তি কি প্রকারে আসিল?
গুরু। ভক্তি জ্ঞানাত্মিকা, এবং কর্ম্মাত্মিকা, ভরসা করি, ইহা বুঝিয়াছ। ভক্তি উভয়াত্মিকা বলিয়া তাহার অনুশীলনে মনুষ্যের সফল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরে সমর্পিত করিতে হয়। সকল বৃত্তিগুলিকে ঈশ্বরমুখী করিতে হয়। যখন ভক্তি কর্ম্মাত্মিকা এবং কর্ম্ম সকলই ঈশ্বরে সমর্পণ করিতে হয়, তখন কাজেই কর্ম্মেন্দ্রিয় সকলই ঈশ্বরে সমর্পণ করিতে হইবে। ইহার তাৎপর্য্য আমি তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, যাহা জগতে অনুষ্ঠেয় অর্থাৎ ঈশ্বরানুমোদিত কর্ম্ম, তাহাতে শারীরিক বৃত্তির নিয়োগ হইলেই ঐ বৃত্তি ঈশ্বরমুখী হইল। কিন্তু অনেক শাস্ত্রকারেরা অন্যরূপ বুঝিয়াছেন। কি ভাবে তাঁহারা কর্ম্মেন্দ্রিয় সকল ঈশ্বরে সমর্পণ করিতে চান, তাহার উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি শ্লোক ভাগবতপুরাণ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি। হরিনামের কথা হইতেছে,-
বিলে বতোরুক্রমবিক্রমান্ যে ন শৃন্বতঃ কর্ণপুটে নরস্য।
জিহ্বাসতী দার্দ্দুরিকেব সূত নযোপগায়ত্যুরুগায় গাথাঃ ||
ভারঃ পরং পট্টকিরীটজুষ্টপ্যুত্তমাঙ্গং ন নমেন্মুকুন্দং।
শাবৌ করৌ নো কুরুতঃ সপর্য্যাং হরের্ল্লসৎকাঞ্চনকঙ্কণৌ বা ||
বর্হায়িতে তে নয়নে নরাণাং লিঙ্গানি বিষ্ণের্ননিরীক্ষতে যে।
পাদৌ নৃণাং তৌ দ্রুমজন্মভাজৌ ক্ষেত্রাণি নানুব্রজতো হরের্যৌ ||
জীবঞ্ছবো ভাগবতাঙ্ঘ্রিরেণূন্ না জাতু মর্ত্যেভিলভেত যস্তু।
শ্রীবিষ্ণুপদ্যা মনুজস্তুলস্যাঃ শ্বসঞ্ছবো যস্তু ন বেদ গন্ধং ||
তদশ্মসারং হৃদয়ং বতেদং যদ্গৃহ্যমানৈর্হরিনামধেয়ৈঃ।
ন বিক্রিয়েতাথ যদা বিকারো নেত্রে জলং গাত্ররুহেষু হর্ষঃ ||
ভাগবত, ২ স্ক, ৩ অ, ২০-২৪।
“যে মনুষ্য কর্ণপুটে হরিগুণানুবাদ শ্রবণ না করে, হায়! তাহার কর্ণ দুইটি বৃথা গর্ত্ত মাত্র। হে সূত! যে হরিগাথা গান না করে, তাহার অসতী জিহ্বা ভেকজিহ্বাতুল্যা। যাহার মস্তক মুকুন্দকে নমস্কার না করে, তাহা পট্ট-কিরীট-শোভিত হইলেও বোঝা মাত্র। যাহার হস্তদ্বয় হরির সপর্য্যয় না করে, তাহা কনককঙ্কণে শোভিত হইলেও মড়ার হাত মাত্র। মনুষ্যদিগের চক্ষুর্দ্বয় যদি বিষ্ণুমূর্ত্তি * নিরীক্ষণ না করে, তবে তাহা ময়ূরপুচ্ছ মাত্র। আর যে চরণদ্বয় হরিতীর্থে পর্য্যটন না করে, তাহার বৃক্ষজন্ম লাভ হইয়াছে মাত্র। আর যে ভগবৎপদরেণু ধারণ না করে, সে জীবদ্দশাতেই শব। বিষ্ণুপাদর্পিত তুলসীর গন্ধ যে মনুষ্য না জানিয়াছে, যে নিশ্বাস থাকিতেও শব। হায়! হরিনামকীর্ত্তনে যাহার হৃদয় বিকারপ্রাপ্ত না হয়, এবং বিকারেও যাহার চক্ষে জল ও গাত্রে রোমাঞ্চ না হয়, তাহার হৃদয় লৌহময়।”
এই শ্রেণীর ভক্তেরা এইরূপে ঈশ্বরে বাহ্যেন্দ্রিয় সমর্পণ করিতে চাহেন। কিন্তু ইহা সাকারোপাসনাসাপেক্ষ। নিরাকারে চক্ষুপাণিপাদের এরূপ নিয়োগ অঘটনীয়।
শিষ্য। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও পাই নাই। ভক্তির প্রকৃত সাধন কি?
যে তু সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ।
অনন্যনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে ||
তেষামহং সমুদ্ধর্ত্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ।
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাং ||
ময্যেব মন আধৎস্ব ময়ি বুদ্ধিং নিবেশয়।
নিবসিষ্যসি ময্যেব অত ঊর্দ্ধং ন সংশয়ঃ || ১২। ৬-৮
“হে অর্জ্জুন! যাহারা সর্ব্বকর্ম্ম আমাতে ন্যস্ত করিয়া মৎপরায়ণ হয়, এবং অন্য ভজনারহিত যে ভক্তিযোগ, তদ্দ্বারা আমার ধ্যান ও উপাসনা করে, মৃত্যুযুক্ত সংসার হইতে সেই আমাতে নিবিষ্টচেতাদিগের আমি অচিরে উদ্ধারকর্ত্তা হই। আমাতে তুমি মন স্থির কর, আমাতে বুদ্ধি নিবিষ্ট কর, তাহা হইলে তুমি দেহান্তে আমাতেই অধিষ্ঠান করিবে।”
শিষ্য। বড় কঠিন কথা। এইরূপ ঈশ্বরে চিত্ত নিবিষ্ট করিতে কয়জন পারে?
গুরু। সকলেই পারে। চেষ্টা করিলেই পারে।
শিষ্য। কি প্রকারে চেষ্টা করিতে হইবে?
গুরু। ভগবান্ তাহাও অর্জ্জুনকে বলিয়া দিতেছেন,
অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্লোষি ময়ি স্থিরম্।
অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয় || ১২।৯
“হে অর্জ্জুন! যদি আমাতে চিত্ত স্থির করিয়া রাখিতে না পার, তবে অভ্যাসযোগের দ্বারা আমাকে পাইতে ইচ্ছা কর।” অর্থাৎ যদি ঈশ্বরে চিত্ত স্থির রাখিতে না পার, তবে পুনঃ পুনঃ চেষ্টার দ্বারা সেই কার্য্য অভ্যস্ত করিবে।
শিষ্য। অভ্যাস মাত্রই কঠিন, এবং এ গুরুতর অভ্যাস আরও কঠিন। সকল পারে না। যাহারা না পারে, তাহারা কি করিবে?
গুরু। যাহারা কর্ম্ম করিতে পারে, তাহারা যে কর্ম্ম ঈশ্বরোদ্দিষ্ট বা ঈশ্বরানুমোদিত, সেই সকল কর্ম্ম সর্ব্বদা করিলে ক্রমে ঈশ্বরে মন স্থির হইবে। তাহাই ভগবান্ বলিতেছেন-
অভ্যাসেহপ্যসমর্থোহসি কর্ত্তুং মদ্‌যোগমাশ্রিতঃ।
মদর্থমপি কর্ম্মাণি কুর্ব্বন্ সিদ্ধিমবাপ্‌স্যসি।। ১২।১০
“যদি অভ্যাসেও অসমর্থ হও, থবে মৎকর্ম্মপরায়ণ হও। আমার জন্য
কর্ম্মসকল করিয়া সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে।”
শিষ্য। কিন্তু অনেকে কর্ম্মেও অপটু— বা অকর্ম্মা। তাহাদের উপায় কি?
গুরু। এই প্রশ্নের আশঙ্কায় ভগবান্ বলিতেছেন,—
অথৈতদপ্যশক্তোহসি কর্ত্তুং; মদ্‌যোগমাশ্রিতঃ।
সর্ব্বকর্ম্মফলত্যাগং ততঃ কুরু যতাত্মবান্ || ১২।১১
“যদি মদাশ্রিত কর্ম্মেও অশক্ত হও, তবে যতাত্মা হইয়া সর্ব্বকর্ম্মফল ত্যাগ কর।”
শিষ্য। সে কি? যে কর্ম্মে অক্ষম, যাহার কোন কর্ম্ম নাই, সে কর্ম্মফল ত্যাগ করিবে কি প্রকারে?
গুরু। কোন জীবই একেবারে কর্ম্মশূন্য হইতে পারে না। যে স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া কর্ম্ম না করে, ভূততাড়িত হইয়া সেও কর্ম্ম করিবে। এ বিষয়ে ভগবদুক্তি পূর্ব্বে উদ্ধৃত করিয়াছি। যে কর্ম্মই তদ্দ্বারা সম্পন্ন হয়, যদি কর্ম্মকর্ত্তা তাহার ফলাকাঙ্ক্ষা না করে, তবে অন্য কামনাভাবে, ঈশ্বরই একমাত্র কাম্য পদার্থ হইয়া দাঁড়াইলেন। তখন আপনা হইতেই চিত্ত ঈশ্বরে স্থির হইবে।
শিষ্য। এই চতুর্ব্বিধ সাধনই অতি কঠিন। আর ইহার কিছুতেই উপাসনার কোন প্রয়োজন দেখা যায় না।
গুরু। এই চতুর্ব্বিধ সধনই শ্রেষ্ঠ উপাসনা। ঈদৃশ সাধকদিগের পক্ষে অন্যবিধ উপাসনার প্রয়োজন নাই।
শিষ্য। কিন্তু অজ্ঞ, নীচবৃত্ত, কলুষিত, বালক প্রভৃতির এ সকল সাধন আয়ত্ত নহে। তাহারা কি ভক্তির অধিকারী নহে?
গুরু। এই সব স্থলে উপাসনাত্মিকা গৌণ ভক্তির প্রয়োজন। গীতায় ভগবদুক্তি আছে যে,-
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহং।
“যে যে-রূপে আমাকে আশ্রয় করে, আমি তাহাকে সেইরূপ ভজনা করি।” এবং স্থানান্তরে বলিয়াছেন,-
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতশ্নামি প্রযতাত্মনঃ ||
“যে ভক্তিপূর্ব্বক আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল, জল দেয়, তাহা প্রযতাত্মার ভক্তির উপহার বলিয়া আমি গ্রহণ করি।”
শিষ্য। তবে কি গীতায় সাকার মূর্ত্তির উপাসনা বিহিত হইয়াছে?
গুরু। ফল পুষ্পাদি প্রদান করিতে হইলে, তাহা যে প্রতিমায় অর্পণ করিতে হইবে, এমন কথা নাই। ঈশ্বর সর্ব্বত্র আছেন; যেখানে দিবে, সেইখানে তিনি পাইবেন।
শিষ্য। প্রতিমাদির পূজা বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম্মে নিষিদ্ধ, না বিহিত?
গুরু। অধিকারভেদে নিষিদ্ধ, এবং বিহিত। তদ্বিষয়ে ভাগবতপুরাণ হইতে কপিলোক্তি উদ্ধৃত করিতেছি। ভাগবতপুরাণে কপিল, ঈশ্বরের অবতার বলিয়া গণ্য। তিনি তাঁহার মাতা দেবহূতীকে নির্গুণ ভক্তিযোগের সাধন বলিতেছেন। এই সাধনের মধ্যে এক দিকে সর্ব্বভূতে ঈশ্বরচিন্তা, দয়া, মৈত্র, যম নিয়মাদি ধরিয়াছেন, আর এক দিকে প্রতিমা দর্শন, স্পর্শন, পূজাদি ধরিয়াছেন। কিন্তু বিশেষ এই বলিতেছেন,-
অহং সর্ব্বেষু ভূতেষু ভূতাত্মাবস্থিতঃ সদা।
‍‍‍‍ তমবজ্ঞায় মাং মর্ত্ত্যঃ ‍কুরুতেহর্চ্চাবিড়ম্বনং ||
যো মাং সর্ব্বেষু ভূতেষু সন্তমাত্মানমীশ্বরং।
হিত্মার্চচ্চাং ভজতে মৌঢ্যাদ্ভস্মন্যেব জুহোতি সঃ ||
৩ বস্ক। ২৯ অ। ১৭।১৮
“আমি, সর্ব্বভূতে ভূতাত্মাস্বরূপ অবস্থিত আছি। সেই আমাকে অবজ্ঞা করিয়া (অর্থাৎ সর্ব্বভূতকে অবজ্ঞা করিয়া) মনুষ্য প্রতিমাপূজা বিড়ম্বনা করিয়া থাকে। সর্ব্বভূতে আত্মাস্বরূপ ঈশ্বর আমাকে পরিত্যাগ করিয়া যে প্রতিমা ভজনা করে, সে ভস্মে ঘি ঢালে।”
পুনশ্চ,
অর্চ্চাদাবর্চ্চয়েত্তাদীশ্বরং মাং স্বকর্ম্মকৃৎ।
যাবন্ন বেদ স্বহৃদি সর্ব্বভূতেষ্ববস্থিতং || ২৯ অ।২০
যে ব্যক্তি স্বকর্ম্মে রত, সে যত দিন না আপনার হৃদয়ে সর্ব্বভূতে অবস্থিত ঈশ্বরকে জানিতে পারে, তাবৎ প্রতিমাদি পূজা করিবে।
বিধিও রহিল, নিষেধও রহিল। যাহার সর্ব্বজনে প্রীতি নাই, ঈশ্বর জ্ঞান নাই, তাহার প্রতিমাদির অর্চ্চনা বিড়ম্বনা। আর যাহার সর্ব্বজনে প্রীতি জন্মিয়াছে, ঈশ্বর জ্ঞান জন্মিয়াছে, তাহারও প্রতিমাদি পূজা নিষ্প্রয়োজনীয়। তবে যত দিন সে জ্ঞান না জন্মে, তত দিন বিষয়ী লোকের পক্ষে প্রতিমাদি পূজা অবিহিত নহে; কেন না, তদ্দ্বারা ক্রমশঃ চিত্তশুদ্ধির জন্মিতে পারে। প্রতিমাপূজা গৌণ ভক্তির মধ্যে।
শিষ্য। গৌণ ভক্তি কাহাকে বলিতেছেন, আমি ঠিক বুঝিতেছি না।

————-
* এখানে “লিঙ্গানি বিষ্ণো:” অর্থে বিষ্ণুর মূর্ত্তিসকল। অতি সঙ্গত অর্থ। তবে শিবলিঙ্গের কেবল সেই অর্থ না করিয়া, কদর্য্য উপন্যাস ও উপাসনাপদ্ধতিতে যাই কেন?
—————

গুরু। মুখ্য ভক্তির অনেক বিঘ্ন আছে। যাহা দ্বারা সেই সকল বিঘ্ন বিনষ্ট হয়, শাণ্ডিল্যসূত্রপ্রণেতা তাহারই নাম দিয়াছেন গৌণ ভক্তি। ঈশ্বরের নামকীর্ত্তন, ফল পুষ্পাদির দ্বারা তাঁহার অর্চ্চনা, বন্দনা, প্রতিমাদির পূজা-এ সকল গৌণ ভক্তির লক্ষণ। সূত্রের টীকাকার স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন যে, এই সকল অনুষ্ঠান ভক্তিজনক মাত্র; ইহার ফলান্তর নাই।*
শিষ্য। তবে আপনার মত এই বুঝিলাম যে, পূজা, হোম, যজ্ঞ, নামসঙ্কীর্ত্তন, সন্ধ্যাবন্দনাদি বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম্মের বিরোধী নহে। তবে উহাতে কোন প্রকার ঐহিক বা পারমার্থিক ফল নাই,-ঐ সকল কেবল ভক্তির সাধন মাত্র।
গুরু। তাহাও নিকৃষ্ট সাধন। উৎকৃষ্ট সাধন, যাহা তোমাকে কৃষ্ণোক্তি উদ্ধৃত করিয়া শুনাইয়াছি। যে তাহাতে অক্ষম, সেই পূজাদি করিবে। তবে স্তুতি বন্দনা প্রভৃতি সম্বন্ধে একটা বিশেষ কথা আছে। যখন কেবল ঈশ্বরচিন্তাই উহার উদ্দেশ্য, তখন উহা মুখ্য ভক্তির লক্ষণ। যথা বিপন্মুক্ত প্রহ্লাদকৃত বিষ্ণু-স্তুতি মুখ্য উক্তি। আর “আমার পাপ ক্ষালিত হউক,” “আমায় সুখে দিন যাউক,” ইত্যাদি সকাম সন্ধ্যাবন্দনা, স্তুতি বা Prayer গৌণভক্তিমধ্যে গণ্য। আমি তোমাকে পরামর্শ দিই যে, কৃষ্ণোক্তির অনুবর্ত্তী হইয়া ঈশ্বরের কর্ম্মতৎপর হও।
শিষ্য। সেও ত পূজা, হোম, যাগ যজ্ঞ-
গুরু। সে আর একটি ভ্রম। এ সকল ঈশ্বরের জন্য কর্ম্ম নহে; এ সকল সাধকের নিজ মঙ্গলোদ্দিষ্ট কর্ম্ম-সাধকের নিজের কার্য্য; ভক্তির বৃদ্ধি জন্যও যদি এ সকল কর, তথাপি তোমার নিজের জন্য হইল। ঈশ্বর জগন্ময়; জগতের কাজই তাঁহার কাজ। অতএব যাহাতে জগতের হিত হয়, সেই সকল কর্ম্মই কৃষ্ণোক্ত “মৎকর্ম্ম”; তাহার সাধনে তৎপর হও, এবং সমস্ত বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলনের দ্বারায় সে সকল সম্পাদনের যোগ্য হও। তাহা হইলে যাঁহার উদ্দিষ্ট সেই সকল কর্ম্ম, তাঁহাতে মন স্থির হইবে। তাহা হইলে ক্রমশঃ জীবন্মুক্ত হইবে। জীবন্মুক্তিই সুখ। বলিয়াছি, “সুখের উপায় ধর্ম্ম।” এই জীবন্মুক্তিসুখের উপায়ই ধর্ম্ম। রাজসম্পাদাদি কোন সম্পদেই তত সুখ নাই।
যে ইহা না পারিবে, সে গৌণ উপাসনা অর্থাৎ পূজা, নামকীর্ত্তন, সন্ধ্যাবন্দনাদির দ্বারা ভক্তির নিকৃষ্ট অনুশীলনে প্রবৃত্ত হউক। কিন্তু তাহা করিতে হইলে, অন্তরের সহিত সে সকলের অনুষ্ঠান করিবে। তদ্ব্যতীত ভক্তির কিছুমাত্র অনুশীলন হয় না। কেবল বাহ্যাড়ম্বরে বিশেষ অনিষ্ট জন্মে। উহা তখন ভক্তির সাধন না হইয়া কেবল শঠতার সাধন হইয়া পড়ে। তাহার অপেক্ষা সর্ব্বপ্রকার সাধনের অভাবেই ভাল। কিন্তু, যে কোন প্রকার সাধনে প্রবৃত্ত নহে, সে শঠ ও ভণ্ড হইতে শ্রেষ্ঠ হইলেও, তাহার সঙ্গে পশুগণের প্রভেদ অল্প।
শিষ্য। তবে, এখনকার অধিকাংশ বাঙ্গালি হয় ভণ্ড ও শঠ, নয় পশুবৎ।
গুরু। হিন্দুর অবনতির এই একটা কারণ। কিন্তু তুমি দেখিবে, শীঘ্রই বিশুদ্ধ ভক্তির প্রচারে হিন্দু নবজীবন প্রাপ্ত হইয়া, ক্রমওয়েলের সমকালিক ইংরেজের মত বা মহম্মদের সমকালিক আরবের মত অতিশয় প্রতাপান্বিত হইয়া উঠিবে।
শিষ্য। কায়মনোবাক্যে জগদীশ্বরের নিকট সেই প্রার্থনা করি।

—————–
* ভক্ত্যা কীর্ত্তনেন ভক্ত্যা দানেন পরাভক্তিং সাধয়েদিতি * * ন ফলান্তরার্থং গৌরবাদিতি।
—————-

Leave a Reply