» » পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

বর্ণাকার

কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য (private trade)

বস্তুতপক্ষে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও সংকটের জন্য নয়। ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য বা শক্তি কাজ করছিল তা হল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস। কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা দেখা গেছে ১৭২০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৭৩০-এর দশকের শেষাশেষি পর্যন্ত। কিন্তু তারপর বিশেষ করে ১৭৪০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিক অবধি এই ব্যবসা-বাণিজ্য তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। এ সময় একদিকে ফরাসি কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায় এবং এদের সঙ্গে খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলির আর্মানি বণিকরা হাত মেলায়। এই ফরাসি-আর্মানি জোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজরা পেরে উঠছিল না এবং তার ফলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে।1 তাই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও পূর্বতন আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন এবং নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ। সিরাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ইংরেজদের অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের অপব্যবহার মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। তাই কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের (sub-imperialism) শিকার হতে হল ফরাসিদের এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে।

তবে এখানে মনে রাখা দরকার, লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি রাজ্যজয়ের কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অবশ্য পাঠায়নি। ব্যবসার মুনাফাই যেহেতু তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই তারা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে রাজ্যজয়ে অতটা আগ্রহান্বিত ছিল না, পাছে এতে কোম্পানির খরচ বেড়ে যায় এবং মুনাফার ঘাটতি পড়ে। তাদের প্রকৃত মনোভাব ছিল—রাজ্যজয় যদি ব্যয়বহুল না হয়, যদি সস্তায় বা বিনাব্যয়ে তা সম্ভব হয়, তাতে কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, বরং তারা এরকম সম্ভাবনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা পরিচালক সমিতির এরকম মনোভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। তাই কোম্পানির স্থানীয় আর্থিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অর্থাৎ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ প্রয়োগ করে প্রধানত তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থে বাংলা জয় করে। লন্ডনে বাংলা জয়ের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি খুবই উৎফুল্ল হয়। এতে ভবিষ্যতে কোম্পানির কী প্রচুর পরিমাণ লাভ হবে তা ভেবে পরিচালক সমিতি অত্যন্ত পুলকিত হয়ে ওঠে। বাংলায় তাদের কর্মচারীদের উচ্ছ্বসিত সাধুবাদ জানানো হয় লন্ডন থেকে।

আসলে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই রাজ্যবিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ করা যায় এবং তা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই। সপ্তদশ শতকের শেষে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপনের পরে কলকাতা ধীরে ধীরে আন্তঃএশীয় সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এবং এ-বাণিজ্যের প্রায় সম্পূর্ণটাই ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত, ব্যবসা-বাণিজ্য। ১৭২০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত কলকাতা থেকে ইংরেজদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের ছিল স্বর্ণযুগ। কিন্তু ১৭৪০-এর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৭৫০-এর প্রথমার্ধে তা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর প্রধান কারণ, তুলনামূলকভাবে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসার অভাবনীয় অগ্রগতি হওয়ায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৩০-এর দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। কিন্তু ১৭৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে গভর্নর ডুপ্লের নেতৃত্বে তা বাড়তে থাকে এবং চল্লিশের দশকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দেয় হুগলিতে অবস্থিত খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে আর্মানি বণিকরা। এদের সম্মিলিত প্রয়াসে ইংরেজদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে এ সময় বাংলার বন্দরগুলিতে বিভিন্ন কোম্পানির ইউরোপীয়দের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের এবং এশীয় বণিকদের বাণিজ্যতরীগুলির আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।2

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেও, বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্রে, চল্লিশের দশকের শেষদিকে ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের দ্রুত অবনতিতে ইংরেজদের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার পরিচয় স্পষ্ট। রবার্ট ওরমের ১৭৫১ সালের চিঠিতে দেখা যায় কলকাতায় ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ওপর দেয় শুল্কের (consulage) পরিমাণ ভীষণভাবে কমে গেছে।3 কলকাতার তৎকালীন এক বাসিন্দা, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Captain Fenwick) ১৭৫২ সালে লিখছেন: ‘ফরাসিরা এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের শীর্ষতম পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এ-সবের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে ডাচ কোম্পানির রেকর্ডসে জাহাজের তালিকায়। ১৭৫৪ সালে যে-সব ইংরেজ জাহাজ কলকাতায় এসেছিল তার মোট সংখ্যা কুড়ি। এর মধ্যে বারোটি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র আটটি ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজ। সেক্ষেত্রে ওই বছরই ফরাসি জাহাজ এসেছে সাতাশটি—তার মধ্যে বাইশটিই ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল, বাকি পাঁচটি জাহাজ মাত্র কোম্পানির বাণিজ্যে নিযুক্ত। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার। আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন—এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।4 এই পরিসংখ্যানগত তথ্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

তাই কোম্পানির কর্মচারীদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ফরাসিদের বিতাড়ন ও রাজ্যজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ঘটেছিল। তাতে শুধু যে আন্তঃএশীয় ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যবসার সংকট দূর করা সম্ভব হত তা নয়—উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, সওদাগর ব্যবসায়ী, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ-কথা যে শুধু পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hind sight) ধরা পড়ছে তা নয়। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা, ফ্রাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে ইংরেজ বাণিজ্যের বিশেষ করে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির বেচাকেনায় দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখখা মনোভাব—এ-সবই ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তারই নির্দেশক। কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধের ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলীতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল।’5 এ-সব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় জাহাজ আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।
  2. VOC2469, ff. 10078; 2489, ff. 291-9lvo, 293; 2504, ff. 1065-66; 2518, f. 15; 2556, ff. 2575-76; তা ছাড়া আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ৩১৫, সারণি, ১১.১।
  3. BPC, Range 1, vol. 15, f. 327, 7 Oct. 1742; Orme Mss, OV. 12. f. 83; Eur G 37, Box. 21, 1st Sept, 1753; Ome Mss, India, VI, f. livo. মিঃ রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, One Mss.ov. 12, f. 83.
  4. ক্যাপ্টেন ফেনউইকের চিঠি, ১৭৫২, Ome Mss, India, VI, f. lllvo; ক্লাইভকে লেখা ম্যানিংহাম (Manningham) ও ফ্র্যাঙ্কল্যান্ডের (Frankland) চিঠি, ১ সেপ্টেম্বর, ১৭৫৩, Eur. G. 37,Box 21.পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে উদ্ধার করে তারপর টানেজের হিসেব বার করা হয়েছে।
  5. Bengal letters Recd., vol 24, f. 236, 20 May 1757.