» » পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

বর্ণাকার

বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’?

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যে সংকট দেখা দেয় তার ফলেই ইংরেজরা বাংলা জয় করতে এগিয়ে আসে। আগে এ সংকট’কে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা হত কিন্তু ইদানীং বলা হচ্ছে, এটা ‘অর্থনৈতিক সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী, জমিদার ও সামরিক অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে—অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্প-বাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণীর আর্থিক দুর্গতি, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ-সবগুলিকে ১৭৪০-এর দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।1

ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইদানীং প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজের যে সংঘর্ষ বাধে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে নতুন শ্রেণীবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজের সময় একেবারে ভেঙে পড়ে এবং সেজন্যই এ বিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত। এ-বক্তব্যে বলা হচ্ছে, সিরাজ তাঁর ব্যবহারে ওই সব শ্রেণীর লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর সমর্থনে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকরা প্রায় সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ ও বাছাই করা সমসাময়িক কিছু ইউরোপীয়-ইংরেজ পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য পেশ করছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ফারসি গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই এ-সব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’র নির্দেশে বা পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত এবং স্বভাবতই এতে ‘মনিবদের’ খুশি করার প্রবণতা থাকবে। আবার ইউরোপীয়-ইংরেজদের লেখা বাজারের ‘গসিপে’ ভরতি। তাই তাদের তথ্য সঠিক বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ-সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর বাংলায় “নতুন শ্রেণী জোটবদ্ধতায়” ছেদ পড়ে এবং তার ফলেই বাংলায় রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়।2 এই সংকট থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই ইংরেজরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায় অন্যমনস্কভাবে বাংলা জয় করে। এরকম ব্যাখ্যা গ্রাহ্য হলে, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের প্রকৃত যে ভূমিকা তা নিতান্তই গৌণ হয়ে যায় এবং সিরাজদ্দৌল্লাই ‘ভিলেন’ হয়ে পড়েন। অবশ্য এরকম বক্তব্য একেবারে নতুন কিছু নয়। এগুলি হিলের পুরনো বক্তব্যেরই নতুন কলেবরে পরিবেশন।

এটা ঠিকই যে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন আঞ্চলিক গোষ্ঠীর (new regional group) উদ্ভব হয়। এই নতুন শক্তিজোটের (power block) অংশীদার—সামরিক অভিজাতবর্গ, জমিদার ও ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্ৰেণী। কিন্তু এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসঙ্ঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। আমরা আগেও বলেছি, এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এসময় বাংলার ক্ষমতাবিন্যাসে একটি পিরামিডসদৃশ কাঠামো তৈরি হয়েছিল—যার শীর্ষে ছিলেন নবাব, আর তলদেশে শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরা যাদের ক্ষমতার একমাত্র উৎস ছিলেন নবাব। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণী নির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেয়ার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়—এটা মুর্শিদকুলির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। এবং আমরা যা আগেও বলেছি, নবাবের সঙ্গে ব্যবসায়ী শ্ৰেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে জোটবন্ধন তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একেবারেই শ্রেণীভিত্তিক নয়। ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। এ সমঝোতা যে নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ— জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে এরা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠে। আবার এই সমঝোতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির ক্ষেত্রে। এঁরা কেউই প্রথমে জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না—ভাগ্যান্বেষী এই দুই ভাই শুধুমাত্র নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।3

আবার এই শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিচ্ছিদ্র কোনও সংগঠন নয়। বারে বারে এর মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। সরফরাজ নবাব হয়ে তাঁর পিতার আমলের কর্মচারীদের পদোন্নতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাজি আহমেদ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ—এই ত্রয়ীর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে দরবারের অমাত্যদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। উক্ত ত্রয়ীর—যারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল, কোনও শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষা যাদের উদ্দেশ্য ছিল না—ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৭৩৯-৪০-এর বিপ্লব সংগঠিত হল, সরফরাজকে হঠিয়ে আলিবর্দি মসনদ দখল করলেন।4 সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রণোদিত চক্রান্তে (কোনও শ্রেণীগত স্বার্থে নয়) এই বিপ্লব, নতুন শ্রেণীগত সমঝোতার সম্মিলিত প্রয়াসে নয়। গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হন ঠিকই কিন্তু এ যুদ্ধে সরফরাজের পক্ষে প্রভাবশালী মনসবদার ও জমিদারদের একটি গোষ্ঠী, ঘাউস খান, মীর শরফউদ্দিন, মীর মহম্মদ বকীর খান, বিজয় সিং, রাজা গন্ধরাব সিং প্রমুখের নেতৃত্বে সরফরাজের পক্ষে যুদ্ধ করে। এদেরই অন্য একটি গোষ্ঠী আলিবর্দির দলে যোগ দেয়। এ-ঘটনা থেকেই স্পষ্ট, মনসবদার-জমিদার গোষ্ঠীর যে জোটবদ্ধতা, তা ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য বিচারবিবেচনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এটা শ্ৰেণীগত সমঝোতা নয়।5 সুতরাং সিরাজদ্দৌল্লা আসার পর নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে বাংলায় রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়—এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।

তা ছাড়া এটাও বলা হচ্ছে, মারাঠা আক্রমণের ফলে এবং সওদাগর/ব্যাঙ্কার গোষ্ঠীর ওপর অর্থ আদায়ের জন্য নবাব আলিবর্দি যে নিগ্রহ শুরু করেন তার জন্য তারা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেজন্য ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানি রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য মধ্যস্বত্বভোগী (merchant middlemen) সওদাগর/ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে সোজাসুজি কোম্পানির বেতনভুক গোমস্তার মাধ্যমে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে।6 এ-বক্তব্যও কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি7 যে, ডাচ কোম্পানি শুধুমাত্র একটি জায়গায় বা আড়ং-এ (শান্তিপুর) তিন বছরের জন্য (১৭৪৭ থেকে ১৭৪৯) এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল কারণ সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছিল বলে তাদের কাছে খবর ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, তিন বছর পরেই, ১৭৫০ সাল থেকে কোম্পানি আবার আগের মতো মধ্যস্বত্বভোগী দাদনি বণিকদের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। আমরা অন্যত্র এটাও বিশদভাবে দেখিয়েছি8 যে ইংরেজ কোম্পানি ১৭৫৩ সালে দাদনি ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গোমস্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল বাংলায় বণিকসম্প্রদায়ের আর্থিক দুরবস্থার জন্য নয়। এ পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য যে সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তার নিরসনের জন্য। দাদনি বণিকদের কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না কারণ এরা নিজেরাই বড় বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর। কোম্পানির পণ্যসরবরাহ ছাড়াও এদের নিজস্ব প্রভূত ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ফলে এদের ওপর দাপট খাটিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধে করা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে গোমস্তারা যেহেতু কোম্পানির বেতনভুক কর্মচারী, তাদের দিয়ে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যবৃদ্ধি অনেক সহজ ও সুবিধেজনক। এজন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে। তার সঙ্গে দাদনি বণিকদের আর্থিক দুর্গতির কোনও সম্পর্কই ছিল না।

মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার শিল্পবাণিজ্য যে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তার যে দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব এতে পড়েনি, তার প্রমাণ মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় এবং এশীয় বণিকদের বিপুল রফতানির পরিমাণ। ১৭৪০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে সর্বাধিক। তবে এটা ঠিক যে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজদের রফতানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইউরোপীয়দের সামগ্রিক রফতানির পরিমাণ কিন্তু এ সময় কিছুমাত্র কমেনি। ইংরেজদের রফতানিতে যে ঘাটতি তা পূরণ হয়ে যায় ডাচদের রফতানি বৃদ্ধিতে। তা ছাড়া, ইংরেজদের বাণিজ্যহ্রাসের কারণ বাংলার আর্থিক সংকট নয়। এর জন্য দায়ী তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যা আর গোমস্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যসংগ্রহের নতুন পদ্ধতি। আবার এ সময় বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ উল্লেখযোগ্য। সুতরাং ইউরোপীয়দের এবং এশীয় ব্যবসায়ীদের রফতানির মোট মূল্য যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে প্রাক্-পলাশি যুগে শিল্প বাণিজ্যের অবক্ষয় হয়েছিল এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ তা হলে বাংলা থেকে এত বিপুল পরিমাণ রফতানি কিছুতেই সম্ভব হত না।9

অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন এবং দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় মূল্যস্তর বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে বস্ত্র, রেশম এবং চালের দাম, অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল।10 এই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭২০ থেকে, বিশেষ করে ১৭৪০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বিস্তৃত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যত্র11 দেখিয়েছি যে কাপড়, সিল্ক এবং চালের দাম তেমন কিছু বাড়েনি, যাতে এ মূল্যবৃদ্ধিকে ‘লক্ষণীয় ও ক্রমাগত’ (‘marked and sustained’) বৃদ্ধি বলা যায়। আসলে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ12 পরিসংখ্যান ও অর্থনীতির বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এলেও, তাঁদের বিশ্লেষণে বেশ কিছু ত্রুটি থেকে গেছে, যার জন্য তাঁদের বক্তব্যে এ মূল্যবৃদ্ধি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। যেমন বস্ত্র বা কাঁচা রেশমের মূল্য নির্ধারণ ও যাচাই করার সময় তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস (যার ওপর বস্তু বা রেশমের সঠিক মূল্য নির্ভর করে) সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এর ফলে তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে, ভুলের মাত্রাও (margin of error) গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

প্রথমে বস্ত্র বা কাপড়ের কথা ধরা যাক। কাপড়ের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন মান দেখা যেত—যেমন মসলিন, মিহি সুতীবস্ত্র, মোটা ও সস্তা কাপড়, রেশম বস্ত্র, সুতী ও রেশম মিশ্রিত কাপড়, ইত্যাদি। আবার প্রত্যেক প্রকার (catagory) কাপড়ের মধ্যে (যেমন মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) নানা রকম প্রকারভেদ (types) ছিল যেমন মসলিনের মধ্যে খাসা, মলমল, ইত্যাদি)। আবার প্রত্যেক রকমের কাপড়ের (যেমন খাসা) দাম নির্ভর করত কয়েকটি জিনিসের ওপর যেমন, কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (size), উৎকর্ষ (quality) এবং কোন আড়ং বা জায়গায় এগুলি তৈরি— এ-সবের ওপর। রেশম বা সিল্কের ক্ষেত্রেও রকমভেদের ওপর মূল্য নির্ভর করত। যেমন কোন ধরনের সিল্ক (‘গুজরাট’, ‘কুমারখালি’, ‘কাশিমবাজার’ ইত্যাদি), তার উৎকর্ষ (fineness) এবং বছরের কোন সময় তা উৎপন্ন (bund ‘বুন্দ’, যেমন নভেম্বর বৃন্দ, জুলাই বুন্দ, ইত্যাদি) এ-সবের ওপরই সিল্কের সঠিক দাম নির্ভর করত। তাই কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার সময় এ-সব জিনিস সতর্কতার সঙ্গে বিচার না করে যদি শুধু মোট ক্রয়মূল্যকে মোট রফতানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য হিসেব করা হয়, তাতে বিরাট ত্রুটি থেকে যায় এবং ফলে এরকম ক্ষেত্রে ওইসব পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য দেখা গেলে তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। তাই উপরোক্ত ঐতিহাসিকরা যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে।

সঠিকভাবে কাপড়ের মূল্য নির্ণয় করতে গেলে এবং তাতে লক্ষণীয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হচ্ছে কি না তা নির্ধারণ করতে হলে খুব সতর্কতার সঙ্গে কোনও বিশেষ রকমের কাপড়ের (মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) মোট পরিমাণ, এ-সব কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, কোন আড়ং-এ তৈরি হয়েছে এবং কাপড়ের উৎকর্ষ quality-মিহি, মোটা) ইত্যাদি যাচাই করে দেখা দরকার এবং তারপর কত দামে কোন রকমের কত কাপড় কেনা হয়েছে তা থেকেই একমাত্র মূল্যস্তরের সঠিক হদিস পাওয়া সম্ভব। যেমন, খাসার (এক প্রকারের মসলিন) দাম বার করতে গেলে কত পরিমাণ খাসা কত দামে কেনা হয়েছে শুধু এ থেকে খাসার সঠিক মূল্য বার করলে ভুল হতে বাধ্য। আমাদের জানতে হবে এ খাসা সাধারণ না মিহি, না অতি মিহি (মানে খাসার উৎকর্ষ—quality), এই খাসা ৪০ কোঃ13 × ৩ কোঃ, না ৪০ কোঃ × ২১/২, কোঃ, বা ৪০ কোঃ × ২ কোঃ (মানে সঠিক মাপ বা সাইজ), এ খাসা কোথায় তৈরি—জগন্নাথপুরে না কাগমারিতে না ওরুয়াতে (মানে কোন আড়ং-এ) ইত্যাদি। যেহেতু এ—সবের ওপরেই খাসার দাম নির্ভর করছে, তাই এইসবগুলি সতর্কভাবে বিচার করে দাম বার করলে তবেই খাসার সঠিক দাম পাওয়া যাবে।

কিন্তু এ ধরনের বিস্তৃত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রফতানির তালিকায় শুধু মোট খাসার পরিমাণ এবং তার মোট মূল্যই দেওয়া আছে—তাদের প্রকারভেদ, উৎকর্য, সাইজ বা আড়ং-এর নাম ইত্যাদি কিছুই নেই। আবার কোম্পানি যে পরিমাণ কাপড় রফতানি করছে এবং তার জন্য যে মোট মূল্য দিচ্ছে তা থেকে যদি প্রত্যেকটি কাপড়ের দাম বার করা হয়, তাতে বিরাট গলদ থেকে যাবে। কারণ কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন দামের কাপড় রফতানি করত। যেমন মসলিন, মিহি সুতী কাপড়, মোটা সস্তা সুতী কাপড়, ইত্যাদি। এই সবগুলি একসঙ্গে যোগ করে মোট কাপড়ের পরিমাণ বার করতে গেলে মুড়ি মুড়কির মধ্যে তফাতটা গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া এতে কোম্পানি যে ধরনের কাপড় রফতানি করছে এবং তাতে বছর বছর যে তারতম্য হচ্ছে তাও ধরা পড়ে না। ফলে কাপড়ের দামের হিসেবে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হতে বাধ্য। ইংরেজ কোম্পানির বস্ত্র রফতানি থেকে তাই ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়ভাবে যে মূল্যবৃদ্ধি ঐতিহাসিকরা দেখাবার চেষ্টা করেছেন তার প্রধান একটি ত্রুটি হচ্ছে যে কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে বেশি করে সস্তা, মোটা সুতী কাপড় রফতানি করেছে, দামি মসলিন কম। আবার ১৭৪০-এর দশকে বস্ত্র রফতানির প্যাটার্নে পরিবর্তন হয়—কোম্পানি সস্তা, মোটা কাপড় পাঠাচ্ছে কম, দামি মসলিন বেশি। পঞ্চাশের দশকেও তাই।14 এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হিসেবের মধ্যে না নেওয়াতেই কাপড়ের একক মূল্যে (unit price) ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা যায়, যা কিন্তু আদৌ সত্য নয়।

কাপড়ের দাম বাড়ছে বা কমছে কিনা তার হদিস পাওয়া যায় একমাত্র কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের পণ্য সরবরাহের জন্য প্রতিবছর যে চুক্তি হত, তা থেকে। কাপড়ের দাম সম্বন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি—যেমন কাপড়ের প্রকারভেদ, সাইজ, উৎকর্ষ বা মান ও আড়ং-এর বিস্তৃত বিবরণ ও প্রত্যেক কাপড়ের আনুমানিক মূল্য ইত্যাদি এ চুক্তিগুলিতেই শুধু পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলি দাম নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডার পর দাদনি বণিকদের সঙ্গে যথাসময়ে কাপড় সরবরাহের জন্য এই চুক্তিগুলি করত। ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের এই চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি, 15 প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় কাপড়ের দাম এমন কিছুই বাড়েনি যাকে ‘ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়’ মূল্যবৃদ্ধি বলা যেতে পারে। বরং এটা দেখা গেছে যে উক্ত সময় অর্থাৎ ১৭৫১-৫৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মসলিনের দাম—বিশেষ করে খাসা এবং মলমল, যেগুলো ইউরোপীয় কোম্পানিরা প্রচুর পরিমাণে রফতানি করত—১৭৩২ থেকে ১৭৩৮-এর (মানে মারাঠা আক্রমণের পূর্বেকার) দামের তুলনায় কিছুটা কমেই গেছে। মসলিনের মধ্যে শুধু নাদোনায় তৈরি খাসার (এটা সস্তা দামের মসলিন) দাম কিছুটা বেড়েছিল। তবে সস্তা, মোটা কিছু কাপড়ের দাম প্রাক্-পলাশি যুগে কিছুটা বেড়েছিল সন্দেহ নেই—এগুলি প্রধানত বর্ধমান এবং বাঁকুড়া অঞ্চলে তৈরি হত এবং এই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে প্রাক্-পলাশি যুগে কাপড়ের দাম অস্বাভাবিক কিছু বাড়েনি। তেমনিভাবে কাঁচা রেশম বা সিল্ক ও চালের দাম বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি16 যে এক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশি-পূর্ব সময়ে অর্থনৈতিক কোনও ‘সংকট’ ছিল না এবং তাই এ সংকটের ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়, এ-বক্তব্য অসার হয়ে যায়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এখানে আমার যে বক্তব্য ও যে-সব তথ্য পেশ করা হয়েছে, তা মূলত আমার প্রবন্ধ “Was there a ‘Crisis’ in mid-Eighteenth Century Bengal’ থেকে নেওয়া। এ প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলাম ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে, “Workshop on the Eighteenth Century”, University of Virginia, Charlottesville-এ। আমার বই From Prosperity to Decline থেকেও এখানে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
  2. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67-68; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 12, 14.
  3. রিয়াজ, পৃ. ২৯৪-৯৫।
  4. ঐ, পৃ. ৩২০।
  5. ঐ, পৃ. ৩১১, ৩১৪-১৫, ৩১৯-২০।
  6. P. J. Marshall, Bengal, p. 73; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 310-12.
  7. আমার বই, From Prosperity to Decline, পৃ. ১০২-১০৫।
  8. ঐ, পৃ. ১০২-১০৮।
  9. এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়, ‘ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়’ দ্রষ্টব্য।
  10. যেমন K. K. Datta, Bengal Suba, pp. 463-69; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 33; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 99-108; P. J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 35; Bengal, pp. 73, 142-43, 163-64, 170.
  11. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ২৭৮-৩০৫।
  12. যেমন K. N.Chaudhuri, Trading World.
  13. কোঃ হচ্ছে কোবিদ, যে একক দিয়ে তখন কাপড় মাপা হত। এ কোবিদ সাধারণত ১৮ ইঞ্চি হিসেবে ধরা হত।
  14. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১৯২, সারণি ৭.৭; পৃ, ২১৩, ফিগার ৭.৪।
  15. ঐ, পৃঃ ২৭৯-৯৩
  16. ঐ, পৃঃ ২৯৩-৯৯