» » পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

বর্ণাকার

ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদ?

আমরা আগেই বলেছি এবং যা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সম্বন্ধে উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জাঁ ল’ ও কর্নেল স্কট বর্ণিত বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত রূপ তাঁদের কষ্টকল্পনা, এবং তা ইউরোপীয়দের বাংলা বিজয়ের একটা অজুহাত মাত্র। ১৭৫৭-র আগেই যে ইংরেজদের বাংলা সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট না হলেও অস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল, তা সহজেই দেখানো যেতে পারে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালক সমিতি এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্যরা মাঝেমধ্যেই বাংলা বিজয়ের বাসনা সদর্পে ঘোষণা করত। অবশ্য তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা হয়তো মাথায় ছিল না। তবে ভারতবর্ষের একটি ভূখণ্ডে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন একটা প্রচেষ্টা ছিল। এর বাহ্যিক উদ্দেশ্য ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করা। ইংরেজ বাণিজ্য বলতে শুধু কোম্পানির বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেই ছিল কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ও আগ্রহ। তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন কাটানো। আর নতুন দেশে তারা ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থেকে বহুদূরে—যেখানে জাহাজে করে চিঠিপত্র/নির্দেশনামা আসতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কিছুটা জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কোম্পানির কর্মচারীদের নিজদায়িত্বে (লন্ডনের অনুমতির অপেক্ষা না করে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মানসিকতার জন্ম হয়, যাকে স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ (sub- imperialism) বলে অভিহিত করা যায়। কোম্পানির সাংগঠনিক যে কাঠামো তাতে এ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ ‘সাম্রাজ্যর মধ্যে সাম্রাজ্যের মতো আরেকটি স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।1

ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের উৎস সম্ভবত কোম্পানির সুরাট কুঠির প্রধান ও পরে বোম্বাই-এর গভর্নরূ্ (১৬৬৯) জেরাল্ড অঙ্গিয়ারের শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য (peaceful trade) থেকে ‘সশস্ত্র বাণিজ্যে’ (armed trade) পরিবর্তন করার আহ্বান। তিনি ইংরেজ বাণিজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলিষ্ঠ ও আক্রমণাত্মক নীতি প্রয়োগের সুপারিশ করেন। লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে তিনি ১৬৭৭ সালে লেখেন, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং প্রয়োজন অনুসারে কোম্পানির এখন “যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’’ নীতি প্রয়োগ করতে হবে। এখন এদেশে বাণিজ্য করতে গেলে অস্ত্রহাতেই তা করতে হবে।2 অঙ্গিয়ারের বক্তব্য কোম্পানির মনে ধরল। স্যার জোসাইয়া চাইল্ডের (Sir Josiah Child) নেতৃত্বে কোম্পানি ভারতবর্ষে ‘আগ্রাসী নীতি’ (for-ward policy) অনুসরণ করা স্থির করল।3 এদিকে বাংলা থেকে কোম্পানির এজেন্ট রবার্ট হেজেজ (Robert Hedges) ও সুরাট থেকে সেখানকার কোম্পানির কর্ণধার স্যার জন চাইল্ড (Sir John Child) কয়েক বছর ধরে ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য কোম্পানিকে প্ররোচিত করছিলেন।4

বস্তুতপক্ষে ১৬৮০-র দশকে মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সশস্ত্র সংঘর্ষের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় একটি সুসংহত উপনিবেশ (fortified settlement) স্থাপন করা। ১৬৮৭ সালে লন্ডন থেকে পরিচালক সমিতি মাদ্রাজে যে নির্দেশ পাঠায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: 5

That which we promise ourselves in a most especial manner from our new President and Council is that they will establish such a politie of Civil and Military power, and create and secure such a large revenue to maintain both at that place; as may be the foundation of a large, well-grounded, sure English dominion in India for all time to come.

ভারতবর্ষে সুরক্ষিত, স্থায়ী ও বৃহৎ ইংরেজ ‘ডোমিনিয়ন’ স্থাপনের এই যে স্বপ্ন, যা তখন সম্পূর্ণ অবাস্তব ছিল, তাই-ই সত্তর বছরের মধ্যে কিন্তু বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজরা পর্যুদস্ত হয় বটে এবং ফলে বাংলায় বা অন্যত্র সুসংহত ইংরেজ ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয়নি। কিন্তু সুরক্ষিত উপনিবেশের চিন্তা ইংরেজদের মানসিকতায় বরাবরের মতো ঢুকে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে আকস্মিক এক ঘটনার জের হিসেবে তা সম্ভবও হয়ে গেল।।

সুতরাং বলা যেতে পারে, ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্য বণিক অভিযাত্রীরা (merchant adventurers) প্রকাশ্যেই ঐশ্বর্যশালী বাংলা বিজয়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে যে-সব জল্পনা-কল্পনা করছিল, তা মোটেই কাকতালীয় নয়। এ-সব ইউরোপীয়দের মধ্যে অনেকেই মনে করত যে বাংলা বিজয় খুব সহজসাধ্য হবে। তাই তারা সবাই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখত। তখনকার নথিপত্রেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ডুপ্লে (Dupleix), ১৭৩০-এর দশকে যিনি বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ছিলেন, কর্নেল বসিকে (Bussy) লিখছেন (১৫ জুন ১৭৫১): ‘আমি বাংলা থেকে খবর পেলাম যে বাংলার নবাব আমাদের কাছ থেকে কোনও কারণ বা যুক্তি ছাড়াই টাকা আদায় করছেন। এ-ব্যাপারে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে এমন নির্দেশ বার করা কি সম্ভব, নবাব যেন আমাদের বিরক্ত না করেন? তা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে আমাদের বাধ্য হয়ে তাকে তাড়াতে হবে।6 এর ক’দিন পরেই তিনি আবার জানাচ্ছেন (১৬ জুলাই ১৭৫১): ‘ঐ ভদ্রলোকের [নবাব আলিবর্দি খান] দম্ভকে চূর্ণ করা খুবই সহজ। ওঁর সৈন্যবাহিনী একেবারেই অপদার্থ, যা আপনি অন্যত্র দেখেছেন।….একটু সতর্কতার সঙ্গে এগুলে আমরা সহজেই হুগলি দখল করে নিতে পারব।7 আবার কিছুদিন পরে (১১ সেপ্টেম্বর ১৭৫১) তাঁর শেষ মতামত জানিয়ে লিখছেন: ‘নবাবের অত্যাচারের জন্য সবাই তাকে ঘৃণা করে। বর্তমানে নবাব সরকারের নিপীড়নে দেশের যা অবস্থা তাতে এই দেশ জয় করা আপনার মতো শক্তিমানের পক্ষে সহজেই সম্ভব।8 অনুরূপভাবে, ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্য কর্নেল মিল (Colonel Mill) লিখেছেন: ‘স্পেনীয়রা যেভাবে উলঙ্গ রেড ইন্ডিয়ানদের অতি সহজেই পরাস্ত করেছিল, তেমনি এদেশ জয় করাও অত্যন্ত সহজ হবে। পনেরোশো থেকে দু’হাজার সৈন্যসহ তিনটে জাহাজ পাঠালেই একাজ সম্পন্ন করা যাবে।9

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম মাদ্রাজে ক্লাইভকে লিখেছিলেন (১৭৫২): “বাংলা থেকে এ বুড়ো কুকুরটিকে [নবাব আলিবর্দি] তাড়াতে পারলে একটা উত্তম কাজ করা হবে। ভাল করে চিন্তা না করে আমি এ-কথা বলছি না। ব্যাপারটা নিয়ে কোম্পানির বিশেষ চিন্তাভাবনা করা উচিত। তা না হলে বাংলায় বাণিজ্য করা কোম্পানির পক্ষে মোটেই লাভজনক হবে না।’10 বস্তুতপক্ষে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কট পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বাংলা বিজয়ের এক বিশদ পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাতে এই ‘গৌরবজনক ঘটনায়’ কোম্পানি কী পরিমাণ লাভবান হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। স্কট এটাও জোর দিয়ে বলেছিলেন: ‘বাংলা জয় করতে পারলে ইংরেজ জাতির প্রভুত লাভ হবে’ এবং এ রাজ্যজয়ের ফলে ‘শুধু যে আমাদের সুনাম ও খ্যাতি পুনরুদ্ধার হবে তা নয়…এতে আমাদের বিপুল জাতীয় ঋণ শোধ করাও সম্ভব হবে।11 সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে ইংরেজদের একটা প্রচ্ছন্ন, যদিও তখনও পর্যন্ত তা খুব স্পষ্ট হয়তো নয়, এবং কিছুটা অপরিণত পরিকল্পনা ছিল। তাই পলাশির আগে তাদের বাংলা বিজয়ের কোনও ইচ্ছা বা মতলব ছিল না, আকস্মিকভাবে তারা এতে জড়িয়ে পড়ে এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ সংকটই তাদের বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে—এ-সব বক্তব্য মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Sub-Imperialism বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ কথাটি এ প্রসঙ্গে প্রথম ব্যবহার করেন J. D. Nichol, তাঁর কেমব্রিজ থিসিসে, ‘The British in India, 1740-63, A Study of Imperial Expansion into Bengal’, ১৯৭৬ (অপ্রকাশিত)। তারপর P. J. Marshall-ও এটি ব্যবহার করেন তার Bengal—the British Bridgehead গ্রন্থে, ১৯৮৭।
  2. O.C., no. 4258, 22 Jan. 1677, vol. 37, f. ৪.
  3. D. B., vol. 90, para 25, f. 58, 15 Jan. 1681.
  4. Diary of William Hedges, vol. I, pp. 133-34.
  5. D. B., vol. 91, para 25, f. 37, 14 Jan. 1686; vol. 91, f. 466, 12 Dec. 1687. আমিই জোর দিয়েছি।
  6. কর্নেল বসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, Brijen K. Gupta, Sirajuddiullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।
  7. ব্যুসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, পৃ. ৩৬।
  8. ঐ।
  9. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।
  10. ক্লাইভকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ২৫ আগস্ট ১৭৫২, Orme Mss., 0.v. 19, ff. 1-2.
  11. One Mss., India, ff. 1487-91; Orme Mss.. 0.v. 12, ff. 140-43.