অনুবাদকের আরয
আল্লাহ পাকের অশেষ হ়াম্দ ও শুকরিয়া। অবশেষে তাঁরই অপার অনুগ্রহে মেজর জেনারেল আকবর খান লিখিত ও গুনাহ্গার কর্তৃক অনূদিত “মুহাম্মদ বিন কাসিম” প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। জেনারেল আকবর লিখিত এটি আমার তৃতীয় অনূদিত গ্রন্থ। এর পূর্বে তাঁর “হাদীছে দেফা” ও “সায়ফুল্লাহ খালিদ” শীর্ষক দু’টি গ্রন্থ যথাক্রমে “ইসলামে প্রতিরক্ষা কৌশল” ও “খালিদ বিন ওয়ালীদ” নামে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকেই প্রকাশিত হয়েছে।
উপ-মহাদেশের যে কয়েকটি চরিত্র সর্বস্তরের মানুষের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা লাভ করতে পেরেছে, যে কয়েকজন ব্যক্তিত্ব সাধারণ মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান লাভে সক্ষম হয়েছেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁদের শীর্ষে। মাত্র সতের বছরের এই তরুণ কোন্ যাদু মন্ত্র বলে সিন্ধুর আপামর মানুষকে বশীভূত করলেন তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এত অল্প বয়সে এই তরুণ এতগুলো গুণ কি করে আত্মস্থ করতে পারলেন—কেবল আত্মস্থই নয়, সে সবের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে শুধু সিন্ধুর নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম হিরো হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তা অভাবনীয় বৈকি! কী বীরত্বে, কী উদার মহানুভবতায়, আর কী আনুগত্যে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। এটা কোন আবেগ-উচ্ছ্বাসের কথা নয়; বরং ইতিহাসের রায়ও তাই।
গ্রীক বীর দিগ্বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের কথাই ধরুন। উপ-মহাদেশের প্রতি তাঁর লোভ মোটেই কম ছিল না। এটাকে করায়ত্ত করবার জন্যে তিনি চেষ্টারও কোন ত্রুটি করেন নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একরাশ ব্যর্থতা নিয়েই ভারতের দোর গোড়া থেকে ফিরে যেতে হ’ল তাঁকে। অগণিত লোক ক্ষয়, প্রচুর সম্পদ বিনষ্ট, সর্বোপরি বিরাট ঝুঁকি ও ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে তিনি যে সব দেশ জয় করলেন — সেখানেও তিনি কোন স্থায়ী কীর্তি রেখে যেতে পারেন নি, পারেন নি তাঁর পিতার হাতে গড়া সেনাবাহিনীকেও কোন প্রেরণাদায়ক আদর্শে উজ্জীবিত করে তুলতে। আর এই না পারার ব্যর্থতা নিয়েই ভগ্ন হৃদয়ে তিনি স্বদেশের বুকে পাড়ি জমালেন এবং পরিণতিতে অকালে মৃত্যু বরণ করলেন। আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই বিজিত বিশাল সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতই ধসে পড়ল।
কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয় এধরনের কোন দিগ্বিজয়ীর বিজয় ছিল না, ছিল না পররাজ্য লোভী স্বৈরশাসকের অধীনস্থ কোন মহাবীরের অভিযান। প্রথমত, তিনি তাঁর স্বজাতির কতিপয় বন্দী ও বন্দিনীর আর্ত চীৎকারে সাড়া দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। আর তাদেরকে মুক্ত করতে এসেই দেখতে পেলেন রক্ত, বর্ণ ও কৌলিন্যবাদের যুপকাষ্ঠে উত্তরাধিকার সূত্রে বন্দী সিন্ধুর তথা উপমহাদেশের আপামর মানুষকে। তারা বন্দী বিদেশী কোন শক্তির হাতে নয়, ভিনদেশী কোন স্বৈরশাসকের হাতেও নয়; বন্দী তাদেরই স্বদেশী রক্ত ও বর্ণের দাবীতে আভিজাত্য গর্বিত স্বৈরাচারী একদল মানুষের হাতে। সিন্ধুর রাজা দাহির এদেরই প্রতিনিধি হিসাবে আপন দেশবাসী হিন্দু, বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকল মানুষকে নির্মমভাবে শাসন ও শোষণ করে যাচ্ছিলেন। সিন্ধু তথা উপমহাদেশের শাসিত ও শোষিত মানুষের চোখের নীরব আর্তি পাঠ করলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং মানুষের হাতে গড়া শাসন ও শোষণের লৌহ জিঞ্জীর ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে আল্লাহ্র খেলাফত ও রবূবিয়ত কায়েম করতে চাইলেন। সিন্ধুর মানুষ অবাক বিস্ময়ে ইবনে কাসিমের জনকল্যাণমুখী ব্যবস্থার বাস্তব নজীরটি শুধু প্রত্যক্ষই করল না, তারা একে নিজেদের জীবনেও গ্রহণ করল। তারা নিবেদিত-প্রাণ কর্মী হিসেবে একে সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করবার দুর্জয় শপথ গ্রহণ করল এবং এ অভিযানের অগ্রসৈনিক মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে হাত মেলাল। মুহাম্মদ বিন কাসিম মাত্র ছয় হাজার সৈনিক নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিলেন, অথচ বছর দুয়েকেরও কম সময়ের ভেতর সিন্ধু থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে তাঁর সঙ্গে ছিল লক্ষাধিক সৈনিক যারা তাদের সেনাপতির অঙ্গুলী হেলনে অবলীলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিল। স্বভাবতই অনুমান করা চলে এই অতিরিক্ত জনশক্তি ছিল কারা, কোন্ মন্ত্র তাদেরকে এই ভিনদেশী তরুণের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল এবং কে তাদেরকে তাঁর পেছনে সংঘবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সন্দেহ নেই, মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে তলোয়ার ছিল। কিন্তু সে তলোয়ার ছিল তাদের উদ্দেশ্যে কোষমুক্ত যারা আল্লাহ্র সৃষ্ট স্বাধীন মানুষকে মানুষের বল্গাহীন খেয়াল-খুশীর গোলামে পরিণত করেছিল। অপরদিকে তিনি বন্দী শাসিত ও শোষিত মানুষগুলোর জন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন স্নেহ ও ভালবাসায় পূর্ণ দরদী একটি মন আর আল্লাহ্র দেয়া নে’মত ইসলাম—যে ইসলাম মানবীয় সার্বভৌমত্বের বদলে আল্লাহ্র খিলাফত কায়েম করতে চায়, শাসন-শোষণের পরিবর্তে চায় মানুষকে সন্তান স্নেহে পালন করতে, যার অপর নাম রবূবিয়ত। সিন্ধুর শোষিত ও অত্যাচারিত সাধারণ মানুষ মুহাম্মদ বিন কাসিমের নিরহংকারী চরিত্র ও ব্যবহার দৃষ্টে এবং তাঁর অপার দরদী মনের পরশে অভিভূত হয় এবং দলে দলে মুসলমান হতে থাকে। আর যারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে অবিচল থেকে যায় তারাও এই তরুণটির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারেনি। তারা তাঁকে দেবতা হিসাবে তাদের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছে, তাঁর অকাল মৃত্যুতে তাঁরই মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করেছে। সর্বশেষ সাফল্য হ’ল, তাঁরই পদস্পর্শে ধন্য সিন্ধু, মুলতান ও তৎসন্নিহিত এলাকা চিরকালের মত কুফরীর আবর্জনা মুক্ত হয়ে “দারু’ল-ইসলাম” হবার সৌভাগ্য লাভ করেছে। এরপরও কি তাঁকে পররাজ্য গ্রাসী কোন বীরের সঙ্গে তুলনা করা চলে?
মুহাম্মদ বিন কাসিমের অপর প্রশংসনীয় দিক ইসলামের প্রতি তাঁর তুলনাহীন আনুগত্য। এক্ষেত্রে কারো সাথে যদি তাঁর তুলনা করতেই হয় তবে সে তুলনা কেবলমাত্র তাঁর পূর্ব-সুরি সায়ফুল্লাহ খালিদ (রা)-এর সঙ্গেই করা চলে। কিন্তু তবুও কথা থেকে যায়। খালিদ (রা)-কে তো একধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাত্ৰ — সেনাপতি থেকে সেনানায়কে। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁকে করা হ’ল সরাসরি পদচ্যুত। তদুপরি খালিদ (রা)-এর জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে আশঙ্কার কিছু ছিল না। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের সে আশঙ্কা ছিল ষোল আনা। তাঁর সৈনিক ও সেনা-নায়কগণ সে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে তাঁর দিকে তাদের সাহায্য ও আনুগত্যের হস্তও সম্প্রসারিত করেছিল। খলীফা সুলায়মান কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ী এই বীরকে তাঁর আরব্ধ বিজয় অসম্পূর্ণ রেখেই তলব করার পেছনে এক বিরাট ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে তারা অনুমান করেছিল। তাদের আশঙ্কা ও অনুমান যে কষ্টকল্পিত ও অমুলক ছিল না —খলীফার পরবর্তী কার্যক্রম তার সাক্ষী। মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজেও যে পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি তা নয়। কিন্তু তবুও তিনি কেন খলীফার এই অবিবেচক সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন? কেন তিনি তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী সৈনিক ও সেনানায়কদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করলেন।
এর উত্তর খ্যাতনামা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক নাসীম হিজাযী মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুখ দিয়ে যেভাবে বলিয়েছেন আমরা নিম্নে তা উদ্ধৃত করলাম। মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর অন্যতম সেনানায়ক রাজা ভীম সিংহ ও তদীয় সঙ্গীগণ কর্তৃক তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য ও সমর্থন ঘোষণার জবাবে বলেছিলেন :
“আমার প্রত্যেক সৈনিকের জীবনকে আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে করি।…আমার ব্যক্তিত্বকে তোমরা আমার উদ্দেশ্যের উপরে স্থান দিয়েছ। তোমরা জানো যে মহান আদর্শের জন্য গত এক শতাব্দী যাবত লক্ষ লক্ষ বীর স্বীয় রক্তদান করেছেন, খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অর্থ সেই আদর্শের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করা। এই এক লক্ষ সৈন্য সারা ভারতবর্ষ জয়ের জন্য যথেষ্ট। আমার জীবন এত মূল্যবান নয় যে, আমি তার জন্য এই এক লক্ষ তরবারিকে মুসলিম জগতের এক লক্ষ তরবারির সঙ্গে সংঘর্ষ বাধাবার অনুমতি দেব। এরূপ সংঘাতে আমার জয় হলেও তা মুসলমানের বিপুল পরাজয়ের সমার্থক হবে। তুর্কিস্তান ও স্পেনে আমাদের যে সব সৈন্য জিহাদে ব্যস্ত, সিন্ধুর সৈন্যাধ্যক্ষ স্বীয় প্রাণভয়ে মুসলিম জগতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে বলে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হোক—এরূপ ব্যবস্থা কি আমি কখনো পসন্দ করতে পারি? এটা সুলায়মান ও আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন হলে আমি হয়ত তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতুম না। কিন্তু যে জাতি সুলায়মানকে নিজেদের খলীফা মেনে নিয়েছে, আমি সেই জাতির কাছে আত্মসমর্পণ করছি। আমার মৃত্যু যদি মুসলিম জাতিকে এরূপ একটি সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তা হলে সেটা আমার সৌভাগ্য বলে গণ্য করব। তোমরা বলেছ যে, আমার ইঙ্গিতে তোমরা প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছ। আমি তোমাদের কাছে কোন প্রকার ত্যাগ দাবী করার অধিকারী নই। কিন্তু তোমরা যদি চাও যে, সিন্ধু থেকে বিদায় নেবার কালে আমার মনে কোন ক্ষোভ না থাকে এবং আমি সিন্ধুতে কোন আরব্ধ কাজ অসমাপ্ত রেখে যাই নি—এরূপ মনে শান্তি নিয়ে যাই, তা হলে যে ধর্মকে তোমরা কার্যক্ষেত্রে গ্রহণ করেছ—তাকে মুখেও ঘোষণা করে দাও। আমার যেসব বন্ধু এখানে উপস্থিত—তাদের সকলের জন্যই আমার এই আহ্বান। তোমাদের মত লোক ইসলাম গ্রহণ করলে সিন্ধু কোন মুহম্মদ ইবনে কাসিমের মুখাপেক্ষী থাকবে না। যে পথিক দীর্ঘ ভ্রমণের পর অভীষ্ট স্থানে পৌঁছেই শুয়ে পড়তে চায়, আজ আমার অবস্থা তারই মত।…আমার ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আপনারা এ মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন, আমার অভিপ্রায় তা নয়। কিন্তু আন্তরিকভাবে যদি আপনারা ইসলামের সৌন্দর্যসমূহ স্বীকার করে থাকেন, তা’হলে আপনাদের ঘোষণা শুনে আমার আধ্যাত্মিক আনন্দ হবে” (দ্র. এ. এফ. এম. আবদুল হক ফরিদী অনূদিত ‘মুহম্মদ ইব্ন কাসিম’— ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত)।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, তাঁর এই আবেদন নিষ্ফল হয় নি। রাজা ভীম সিংহ সহ এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিন্ধুবাসী তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের অকাল মৃত্যুতে কারা লাভবান হয়েছিল? —তারাই, যারা হযরত ‘উছমান (রা) ও হযরত ‘আলী (রা)-এর শাহাদতে লাভবান হয়েছিল, যারা মু‘আবিয়া ইবনে য়াযীদ ও ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা)-এর পতনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হয়েই ইসলামের দুশমনরা ‘আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ‘আবদুল্লাহ বিন সাবার ন্যায় কপট মুসলিম সেজে ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত হয় এবং একের পর এক হযরত ‘উছমান (রা)-কে হত্যা, জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফীন, হযরত ‘আলী (রা)-এর শাহাদত, ইমাম হাসান (রা)-কে বিষ প্রয়োগ, কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা, মু‘আবিয়া ইবনে য়াযীদকে বিষ প্রয়োগ, ‘আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়র (রা)-এর পতন প্রভৃতি ঘটনার জন্ম দেয়। ইবনে উবাই ও ইবনে সাবার প্রেতাত্মারাই খলীফা সুলায়মানের ঘাড়ে ভর করে কেবলমাত্র মুহাম্মদ বিন কাসিমকেই নয়, তুর্কিস্তান বিজয়ী সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিম, আফ্রিকা বিজয়ী সেনাপতি মূসা বিন নুসায়র-পুত্র ‘আবদুল আযীয ইবনে মূসাকেও হত্যা করায়। মূসা বিন নুসায়র এবং তদীয় সেনাপতি স্পেন বিজয়ী তারিক ইবনে যিয়াদ এ মর্মান্তিক ঘটনায় এমনভাবে মুষড়ে পড়েন যে, অবশিষ্ট জীবন তাঁরা নির্জনতার মাঝে কাটিয়ে দেওয়াকেই শ্রেয় জ্ঞান করেন। বনী উমাইয়ার পরবর্তী বংশধরদের মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম হযরত ওমর ইবনে ‘আবদুল-‘আযীয (র)-কে বিষ প্রয়োগ করে যারা ব্যষ্টি ও গোষ্ঠী স্বার্থ নিরাপদ করতে চেয়েছিল তারাও ছিল ইবনে উবাই ও ইবনে সাবারই মানস-সন্তান। সেই থেকে আজকের দিনটি পর্যন্ত যেখানে যত দুষ্কর্ম সাধিত হয়েছে, মুসলিম ইতিহাসের যেখানে যত দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তার পেছনে কোন না কোন ইবনে সাবার গোপন হাত সক্ৰিয় দেখতে পাওয়া যাবে। হাসান আল-বান্না, সায়্যিদ কুত্ব শহীদ, মুহাম্মদ ম্যালকম এক্স, বাদশাহ ফয়সল প্রমুখের মৃত্যুর পেছনেও তাদেরই অদৃশ্য হাত নিয়োজিত ছিল। ইসলাম ও মুসলিম জাতির অস্তিত্ব আজও তাদের চোখে এক দুঃসহ বিভীষিকা। এরা মুসলমানদের অস্থি-মজ্জা ও শিরা-উপশিরায় মিশে আছে বিধায় ওদের পৃথক করা যায় না। ওরা বহুরূপী—তাই ওদেরকে চেনা যায় না। মার্জারের মত নিঃশব্দ গতি তাদের—তাই ওদের আগমন টের পাওয়া যায় না। ওরা এত সতর্ক যে, কখনো ধরা পড়ার উপক্রম হতেই নিঃশব্দে ও ত্বরিতে সটকে পড়ে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুতে কি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? হ্যাঁ, হয়েছিল। তাঁর আগমনে উপমহাদেশের বুকে ইসলামের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়ছিল তা এমনভাবে থিতিয়ে গেল যে, পরবর্তীকালে ইসলামের লক্ষ সন্তানের একক ও সম্মিলিত কোন প্রকার চেষ্টা-সাধনাতেই আর সেই জোয়ার সৃষ্টি হয়নি। ভারতের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তের নিপীড়িত মানুষের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভুত এই তরুণের অকাল মৃত্যুর মাঝ দিয়ে মুসলিম নামধারী খলীফাদের যে বীভৎস চেহারা তাদের মনে গেঁথে গেল তাতে কোনদিনই আর তারা এদের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ বোধ করেনি। পরবর্তীকালেও মুহাম্মদ বিন কাসিমের যথার্থ কোন উত্তরাধিকারের আগমন না ঘটায় আজও তাঁর স্থান অপূর্ণই থেকে গেল। বর্ণবাদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত এই উপমহাদেশের কয়েক কোটি অস্পৃশ্য মানুষ আজও সাধারণ মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জানি না কবে ইবনে কাসিমের শূন্যস্থান পূরণ হবে আর কবে অধিকার বঞ্চিত এসব আদম সন্তান তাদের অধিকার ফিরে পাবে। সাম্যের ধর্ম, মুক্তির ধর্ম ইসলাম এখনো বিদ্যমান আছে, তবে সে সাম্য শুধু সালাতের কাতারে আর ‘ঈদের জামা’আতে। ভাতের থালার সাম্য কৈ? গাছতলার আর পাঁচতলার ব্যবধান ঘুচল কই? ব্যবধান শুধু এখানে যে, এতদিন কচ্ছপ গতিতে অসাম্যের দিকে এগুচ্ছিলাম, আর এখন ধাবিত হচ্ছি খরগোশের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। কে সেই তরুণ যে এ গতিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেবার দুঃসাহস রাখে? মুসলিম জাতির আগামী দিনের নেতৃত্ব তারই অপেক্ষা করছে।
নিরন্তর কর্ম ব্যস্ততার মাঝে বইটি অনুবাদ করতে হয়। অখণ্ড মনোযোগ দেবার মত সময় হাতে ছিল না। তবুও চেষ্টা করেছি অনুবাদকে যতটা সম্ভব সুখপাঠ্য করে তুলতে। একে সুন্দরতর করে তোলার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন এর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় অগ্রজ-প্রতীম মওলানা আবদুল মতীন জালালাবাদী। প্রশংসা করার মত কিছু থাকলে সেটা তাঁর, আর নিন্দাটুকু আমার। ভবিষ্যৎ সংস্করণগুলোকে অধিকতর উন্নত করার চেষ্টা করা যাবে।
প্রকাশনার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করায় ফাউণ্ডেশন কর্তৃপক্ষকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। অনুবাদ বিভাগের পরিচালক জনাব মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, সহকারী পরিচালক অধ্যাপক মোশাররফ হোসাইন ও জনাব আবুল বাশার আখন্দ-এর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে সাধারণ ধন্যবাদ জানিয়ে সে সম্পর্কের মাঝে কোন ব্যত্যয় ঘটাতে চাই না। এ বই প্রকাশের পেছনে তাঁদের অবদানই সর্বাধিক। ইসলামিক ফাউণ্ডেশন প্রেসের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্মীবৃন্দ যেভাবে তাঁদের দায়িত্ব আনজাম দিয়েছেন সেজন্য তাঁদেরকেও আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। পাণ্ডুলিপির অনেকাংশ কপিকরণে স্নেহভাজন জিল্লুর রহমানের এবং নির্ঘন্ট তৈরীতে আবদুল হান্নান ও সিরাজুল ইসলামের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেয়েছি—এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সহকর্মী মোহাম্মদ মোকসেদ প্রুফ দেখার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকেও আমি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ পাক সবাইকে নেক বদলা দিন।
— আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী