☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
সাতষট্টি
বারিধারা চোখ বুজে আছে।
তার কি ঘুম পাচ্ছে? না ঘুম নয়, ক্লান্তি। তার শরীর জুড়ে ক্লান্তি। ইচ্ছে করছে বারান্দায় একটা কোণ দেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ি। অল্প শীত শীত করছে। খানিক আগে পর্যন্তও বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধে পর্যন্ত মুষলধারে পড়েছে। তারপর বেগ কমলেও ঘ্যানঘ্যানে, একঘেয়ে ভাবে চলেছে একটানা। খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি নয়, কান্না। এই কান্না কোনওদিন থামবে না। যে মেঘ বৃষ্টি নিয়ে দুপুর পর্যন্ত আনন্দ, হইহই হয়েছে তা যে এতটা বিশ্রী আর ভয়ংকর হয়ে উঠবে কে ভেবেছিল! ঘণ্টাখানেক হল বৃষ্টি থেমেছে। তবে এখান-ওখান থেকে জমা জল পড়বার বিশ্রী আওয়াজ হচ্ছে। বারান্দাটা একদিকে খোলা। খানিক আগে পর্যন্ত জলের ছাঁট এসেছে, এখন ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। খানিকক্ষণ হল আকাশ দেখেছে বারিধারা। অন্ধকারেও বোঝা গেছে, মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে। আবার ঢালবে? কে জানে ঢালতে পারে।
এখন রাত কত? দুটো না আড়াইটে। বেশিই হবে। দিদি যখন বাড়ি গেল তখনইতো দুটোর কাছাকাছি বাজে। যাওয়ার আগে কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। নরম গলায় বলল, ‘বাড়ি যাবি বৃষ্টি? বাড়ি গিয়ে একটু শুয়ে নিবি? অনেক রাত হয়ে গেছে। দুটো বাজাতে চলল।’
বারিধারা মাথা নেড়েছিল। বলেছিল, ‘আমি যাব না। তুই যা দিদি। খুব ধকল গেছে তোর।’
মেঘবতী শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল, ‘বাড়ি চল। আবার কাল সকাল হতেই চলে আসবি। একটু না ঘুমোলে শরীর যে খুব খারাপ লাগবে।’
বারিধারা এবার শক্তভাবে বলল, ‘আমার কিছু হবে না। আমি রাত জাগতে পারি।’
মেঘবতী বোনের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘এখানে আর থেকে কী করবি? ডাক্তার, নার্স আছে, যদি কিছু লাগে তারাই দেখবে।’
বারিধারা এবার কঠিন গলায় বলল, ‘আমি জানি তারাই দেখবে। তার পরেও আমি যাব না। আমি এখানেই থাকব।’
দূরে দাঁড়িয়েছিল জ্যোতিষ্ক। এবার সে এগিয়ে আসে। বিরক্ত গলায় স্ত্রীকে বলল, ‘তোমার কী সমস্যা হচ্ছে বলো তো! বৃষ্টি যদি থাকতে চায় থাকুক না। খানিক পরেই তো সকাল হয়ে যাবে। তুমি কেন ওকে বারণ করছ?’
মেঘবতী লম্বা করে শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না, আমি বারণ করছি না। বলছিলাম, বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিলে পারত। কাল সকালেও তো থাকতে হবে। তা ছাড়া…তা ছাড়া বাবা-মা-ও চিন্তা করছে। মা একটু আগে ফোন করেছিল। জেগে বসে আছে।’
জ্যোতিষ্ক আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার মা কেন জেগে আছেন জানি না, বৃষ্টি থাকতে চাইছে থাকুক। তুমি চলো।’
মেঘবতী বলল, ‘বৃষ্টি এত রাতে হাসপাতালে একা থাকবে?’
বারিধারা মলিন হেসে বলল, ‘হাসপাতালে একা আবার কী? হাসপাতালে দিন-রাত বলেও কিছু হয় না। তুই নিশ্চিন্তে যা। আমি ছোট মেয়ে নই দিদি। তোরই তো বোন।’
মেঘবতী বোনের পাশে বসে বলল, ‘তা হলে আমিও থাকব। তোকে একা ছাড়ব না।’
জ্যোতিষ্ক এবার রেগে গেল। বলল, ‘উফ তোমাকে নিয়ে পারা গেল না। আমি বৃষ্টিকে একা ফেলে চলে যাব ভাবলে কী করে! তোমাকে বাড়িতে ছেড়ে আমি চলে আসছি। চলো, দেরি কোরো না।’
মেঘবতী ফের উঠে দাঁড়াল। তাকে বাড়ি যেতেই হবে। বাড়ি ফাঁকা রয়েছে।
‘ঠিক আছে। বৃষ্টি, আমি ওর হাত দিয়ে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিস লক্ষ্মী মেয়ে। অনেকক্ষণ খালি পেটে আছিস। এর পর অসুস্থ হয়ে পড়বি।’
বারিধারা খুব ভালো করেই জানে, জল বা চা ছাড়া কিছুই সে এখন খেতে পারবে না। খাবার কথা ভাবলেই বমি পাচ্ছে। হাসপাতালের নীচ থেকে এক বোতল জল কিনে নিয়েছে। দিদিকে বলে লাভ নেই। মাথা নেড়ে সায় দেওয়াই ভালো।
জ্যোতিষ্ক বারিধারাকে বলল, ‘তুমি ভিজিটরদের বসবার জায়গাতেই থেকো বৃষ্টি। আমি তোমার দিদিকে বাড়িতে নামিয়েই চলে আসছি। রাস্তায় জল জমে না থাকলে ম্যাটার অফ ফর্টি-ফর্টি ফাইভ মিনিটস।’
বারিধারা বলল, ‘হাতের কাছে পেলে গায়ের একটা হালকা চাদর পাঠিয়ে দিস। শীত শীত করছে।’
জ্বর আসেনি তো? যা ভেজা হয়েছে, তাতে জ্বর আসা অসম্ভব কিছু নয়। মেঘবতী উদ্বিগ্ন হয়ে বোনের কপালে গলায় হাত দিল। না, গা ঠাণ্ডা।
বারিধারা দিদির হাত ধরে বলল, ‘তুই যা, আমার জন্য এত চিন্তা করতে হবে না।’
মেঘবতী বোনের জন্য যতই চিন্তা করুক, সেই সবথেকে মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করেছে। শ্রবণের দাদা হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অপারেশনের পর ভাইয়ের অবস্থা ‘ক্রিটিকাল’ শুনে প্রেশার বেড়ে যায়। এমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে হয়। শ্রবণের বউদি এমনিতেই নার্ভাস প্রকৃতির মহিলা। দেওরের ঘটনা জানবার পর থেকেই হাত-পা কাঁপছিল। অপারেশনের সময় ও.টি.-র বাইরে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্নাকাটিও করছিল। বারিধারা তার হাত চেপে ধরেছিল। ফিসফিস করে বলেছিল, ‘শান্ত হোন। শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সব ঠিক হয়নি। ও.টি. থেকে বেরিয়ে ডাক্তার যখন থমথমে গলায় বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল। ব্রেন থেকে ব্লাড ক্লট আমরা বের করে দিয়েছি। কিন্তু পেশেন্টের কন্ডিশন ভালো নয়। কাল সকালের আগে কিছু বলতে পারব না।’
এরপরই শ্রবণের দাদা মাথা ঘুরে পড়ে যান। স্বামীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মহিলা আরও ঘাবড়ে গেছে। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ খাইয়ে মেঘবতী তাকে বলে, ‘আপনি ওনাকে নিয়ে বাড়ি চলে যান। একেই তো শ্রবণের এই অবস্থা, এরপর উনি যদি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন আর এক বিপত্তি হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা তো রইলাম। ফোন করে খবর দেব।’
মহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘শ্রবণের বাবা-মা-ও আসতে চাইছেন। বাড়ির সামনে এত জল জমে গেছে যে বেরতে পারছেন না। আমরা দুজনে কোনওরকমে জল ঠেলে এসেছি।’
মেঘবতী বলল, ‘খবরদার ওনাদের এখন হাসপাতালে আসতে দেবেন না। বয়স্ক মানুষ জলে পড়ে গেলে সমস্যা হবে। জল নামলে আসবেন। আর এখন এসেই বা কী হবে? অপারেশন হয়ে গেছে, পেশেন্ট আই সি সি ইউ-তে। দেখাও তো করতে দেবে না। এখন তো শুধু খবর নেওয়া। কাল সকালের আগে কোনও খবর হবে না। আপনারা চলে যান।’
হাসপাতালে এসে ছোটাছুটি করে মেঘবতীই সব করেছে। শ্রবণ তখন এমার্জেন্সিতে শুয়ে। ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা করে বললেন, ‘এখনই মাথায় স্ক্যান করতে হবে। মনে হচ্ছে মাথার ভিতরে কোনও ইনজুরি হয়েছে। তা হলে ইমিডিয়েট ও.টি.-তে নিতে হবে।’
বারিধারা টেলিফোনে শ্রবণের বউদিকে ধরে।
‘কী হয়েছে!’
‘ঠাণ্ডা মাথায় শুনুন। শ্রবণের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’
মহিলা চিৎকার করে ওঠে, ‘অ্যাক্সিডেন্ট! সে কী! কী করে হল? কেমন আছে শ্রবণ?’
বারিধারা গলা নামিয়ে বলেন, ‘টেনশন করবেন না বউদি। শ্রবণ ভালো আছে। খবর পেয়ে আমি আর আমার দিদি হাসপাতালে এসেছি। তবে এখনই একটা অপারেশন করবার দরকার হতে পারে। আপনি দাদাকে নিয়ে চলে আসুন।’
মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কী করে এমন হল!’
বারিধারা শান্তভাবে বলল, ‘আমিও পুরোটা জানি না। শ্রবণ গুছিয়ে বলতে পারছে না। ওর সঙ্গে যে দুজন ছিল, তাদের একজনের পায়ে চোট হয়েছে। ভেঙে গেছে মনে হয়। অন্যজন খুব শক পেয়েছে। সে এখনও ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার কাছ থেকে ঘটনা জানবার চেষ্টা করছি। তবে তার আগে শ্রবণের ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার। আপনারা আসুন তারপর সবটা বলব।’
এর পর মোবাইলে বারিধারার সঙ্গে শ্রবণের দাদার দফায় দফায় কথা হল। রাস্তায় এত জল জমেছে যে কিছুতেই তারা হাসপাতালে পৌঁছতে পারছে না। যে ট্যাক্সিটায় উঠেছিল সেটা রাস্তাতেই খারাপ হয়ে যায়। একটা অটোকে হাতেপায়ে ধরে রাজি করিয়েও লাভ হয়নি। সেটাও গর্তে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে বাস পেয়ে উঠেছে, সেই বাস রুট বদলেছে এবং জ্যামে আটকে পড়েছে। সারাদিনের বৃষ্টি কলকাতা শহরটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো অপেক্ষা করা যায় না। শ্রবণ বমি করছে। মেঘবতী দ্রুত ব্যবস্থা করতে থাকে। খানিকক্ষণের মধ্যে জ্যোতিষ্কও চলে আসে। স্ক্যান করে দেখা যায়, শ্রবণের মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, অপারেশনের সময় ঠিক করা, ব্ল্যাডের ব্যবস্থা করা, মেডিসিন জোগাড় সবই মেঘবতী করেছে। ওটিতে নিয়ে যাওয়ার সামান্য কিছু আগে শ্রবণের দাদা-বউদি পৌঁছে যায়।
এর মধ্যে শ্রবণের সঙ্গীরা ঘটনা জানায়। তারা শ্রবণের অফিসের সঙ্গে যুক্ত। একজন ক্যামেরা চালায়, অন্যজন তাকে সাহায্য করে। শ্রবণের কোনও একটা অ্যাড ফিল্মের জন্য বৃষ্টির কিছু দৃশ্য দরকার ছিল। দিনটার সুযোগ নিয়েছিল ওরা। গাড়ি নিয়ে বারুইপুরের কাছে শুটিং করতে যায় সকালে। একেবারে হঠাৎই ঠিক করে। অল্প সময়ের কাজ। ভালোভাবে কাজ শেষ করে ফিরেও আসছিল দুপুরের পর। আসবার সময় বাইপাসে গাড়ির চাকা পিছলে যায়। ধাক্কা মারে সামনের একটা বাসে। গাড়ির তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু একজনের পায়ে খুব জোর লাগে। শ্রবণের মাথাটাও পাশের জানলায় ঠুকে যায়। প্রথমে কিছু মনে হয়নি। মাথা থেকে রক্ত বের হয়নি। ফুলেও যায়নি। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে প্রবল যন্ত্রণা শুরু হয়। শ্রবণ তার সঙ্গীদের বলে, খুব কষ্ট হচ্ছে, হাসপাতালে যেতে হবে। গাড়ি নিয়ে তারা হাসপাতালের আসে। ততক্ষণে শ্রবণ জ্ঞান হারাতে শুরু করেছে। এমন সময় শ্রবণের মোবাইলে বারিধারার ফোন বাজতে থাকে। ক্যামেরাম্যান ছেলেটি বারিধারাকে চেনে। সে ফোন নিয়ে বারিধারাকে হাসপাতালে চলে আসতে বলে।
হাসপাতালের এই দিকটা মূলত শুনশান। লম্বা করিডরে অনেক দূরে দূরে একটা দুটো বসবার জায়গা। ভিজিটিং আওয়ারের পর এসব বেঞ্চে বাইরের কাউকে বসতে দেওয়া হয় না। এত রাতে বারণ করবার নেই। এমার্জেন্সি ভিজিটরদের যেখানে অপেক্ষা করবার কথা সেখান থেকে বারিধারা এদিকটায় চলে এসেছে। করিডর শেষ হলেই আই সি সি ইউ। কাচের দরজা বন্ধ। ভিতরে পর্দা টানা। দরজার মাথায় লাল আলো জ্বলছে। কাচের গায়ে লেখা, ‘নো, অ্যাডমিশন’। ওখানেই শ্রবণকে রাখা হয়েছে।
কাচের দরজার আওয়াজ শুনে বারিধারা চোখ খুলল। সাদা পোশাক পরে বয়স্ক একজন নার্স বেরিয়ে আসছেন। বারিধারা উঠে দাঁড়াল। একটু এগিয়ে যেতে নার্স থমকে দাঁড়ান।
‘কী ব্যাপার?’
বারিধারা কাঁপা গলায় বলে, ‘ওখানে আমাদের পেশেন্ট আছে। রাতে অপারেশন হয়েছে। নাম শ্রবণ রায়। তিনি কেমন আছেন একটু বলতে পারেন দিদি?’
নার্স মহিলা মোটার দিকে। চোখেমুখে রাগ। এত রাতে ডিউটি করতে হচ্ছে বলে সম্ভবত বিরক্তও। বারিধারার কথার জবাবে খুব শান্তভাবে বললেন, ‘আপনি কি হাসপাতালে নিয়মকানুন কিছু জানেন না? জানেন না এত রাতে পেশেন্টদের খবর দেওয়া হয় না? যদি দেওয়ার দরকার পড়ে আমরাই যোগাযোগ করব। জানেন না?’
বারিধারা অস্ফুটে বলল, জানি। কিন্তু খুব চিন্তায় রয়েছি।’
‘হাসপাতাল তো নাটক বা সিনেমা হল নয়। এখানে আপনি আনন্দ করতে আসেননি। এটা তো চিন্তারই জায়গা।’
বারিধারা বলল, ‘সরি দিদি।’
নার্স মহিলা এবার কড়া গলায় বললেন, ‘আপনি এতদূর পর্যন্ত এসেছেন কেন? এই ফ্লোরে আপনাকে উঠতে দিল কে? লিফটে সিকিউরিটি নেই।’
সত্যি নেই। গেটের সিকিউরিটি ঘুমোচ্ছে। লিফটম্যান একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল। এত রাতে যখন একটি সুন্দরী তরুণী ওপরে উঠছে নিশ্চয় প্রয়োজন আছে। তা ছাড়া খুব সিরিয়াস হলে তো অনেক সময় ওয়ার্ড থেকে ডেকেও পাঠানো হয়। সম্ভবত এই সব ভেবে আর আটকায়নি।
বারিধারা রাগী নার্স মহিলাকে কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছু বলবার মতো মনের অবস্থাও তার নেই। চুপ করে থাকে। নার্স বলেন, ‘এটা আপনি অন্যায় কাজ করেছেন। হয় আপনি চলে যান, নয় সিকিউরিটিকে বলছি।’
বারিধারা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘প্লিজ দিদি। আমাকে এখানে একটু বসতে দিন। আমি দূরে ওই বেঞ্চে বসে থাকব। কাউকে ডিসটার্ব করব না।’
নার্স মহিলা একটু থমকে গেলেন, বললেন, ‘পেশেন্ট আপনার কে হন?’
বারিধারা চুপ থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর মহিলার চোখে চোখ রেখে জোর গলায় বলল, ‘আমার বন্ধু হয়। আমরা বিয়ে করব।’
নার্স মহিলা ভুরু কুঁচকে বারিধারার দিকে তাকালেন। তার চোখ বলে দিচ্ছে, বারিধারার এই উত্তরে তিনি থমকে গেছেন। থমকে যাওয়ারই কথা। এখন সরাসরি ভালোবাসায় পরিচয় দেওয়ার জোর কতজনের আছে? তাও একটা কমবয়সি মেয়ে। মহিলা হাত দিয়ে নিজের গাল মুছলেন।
‘পেশেন্টের নাম কী বলছেন?’
বারিধারা আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘শ্রবণ রায়। হেড ইনজুরি। ব্লাড বের করা হয়েছে।’
নার্স মহিলা একটু চুপ করে থাকলেন। নরম গলায় বললেন, ‘আপনার নাম কী আমি জানতে পারি।’
‘আমি বারিধারা।’
নার্স আবার একটু চুপ করে রইলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললে, ‘বাঃ, সুন্দর নাম। আমার যতদূর মনে পড়েছে, আমি ভিতরে যেসব পেশেন্ট দেখছি তার মধ্যে শ্রবণ নামে একজন আছেন।’
বারিধারা উত্তেজিত হয়ে দু’পা এগিয়ে যায়। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
‘কেমন আছে? কেমন আছে শ্রবণ?’
রাগী মহিলা এবার একটা অদ্ভুত কাজ করেন। হাত বাড়িয়ে বারিধারার বাঁ-কাধে হাত রাখেন। ভীষণ নরম গলায় বলেন, ‘মন শক্ত করুন বারিধারা। পেশেন্টের অবস্থা ভালো নয়।’
কথা শেষ করে হাত দিয়ে মুখ মুছে, জুতোয় খটখট আওয়াজ তুলে করিডর ধরে এগিয়ে গেলেন। সেই আওয়াজে যেন মৃত্যুর পদশব্দ!
শরীর কাঁপছে বারিধারার। সে কোনওরকমে কাছের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। নার্স তাকে এ কী বলে গেল! শ্রবণের অবস্থা কি খারাপ হচ্ছে? সে কি বাঁচবে না? ভাবতেও পারছে না বারিধারা। ঝুঁকে পড়ে দু-হাত দিয়ে মুখ চেপে বসল। সে কি কাঁদবে? চিৎকার করে কেঁদে উঠবে? অনেকক্ষণ ধরেই সে কাঁদছে। লুকিয়ে কাঁদছে। কেউ যেন দেখতে না পায়। কান্নার পর চোখে মুখে জল দিয়ে ধুয়ে নিয়েছে। এই কান্না তো শ্রবণের জীবন-মৃত্যুর কান্না নয়, এ তার ভালোবাসার কান্না। এ কান্না কাউকে দেখাতে নেই। বারিধারা মুখ থেকে হাত সরাল। না, কাঁদবে না। কিছুতেই কাঁদবে না। হাওয়া দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া। গোটা শরীর অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঘোরের মতো লাগছে। এই ঘোরের মধ্যেই সে এক বুড়ো মানুষের গলা শুনতে পেল। সেই গলায় অল্প অল্প হাসি।
‘কীরে দিদিভাই, কেমন আছিস?’
‘দাদু, তুমি! তুমি কোথা থেকে এলে!’
‘কোথা থেকে এলাম মানে! কমলকান্তি সেন এখন সব জায়গায় থাকে।’
বারিধারা ঘোরের মধ্যেই ডুকরে কেঁদে ওঠে।
‘দাদু, তুমি এসো। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো। মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করো।’
‘দ্যাখ দেখি কাণ্ড! বোকা মেয়ে একটা। এই তো আমি তোর মাথায় হাত রেখেছি। তুই না আমার সাহসী নাতনি? বীর নাতনি। ছিঃ, সাহসী মেয়ে এত ভেঙে পড়ে?’
‘দাদু, শ্রবণ মারা যাচ্ছে।’
‘জন্ম-মৃত্যু সব এক বৃষ্টি। কেউ বেঁচে থেকেও মরে আছে, কেউ আবার মরে গিয়েও বেঁচে আছে। তোরা তো তোদের মায়ের মতো গান করতে শিখলি না, শিখলে জাতনিস, তবুও শান্তি, তবু অনন্ত জাগে।’
‘শ্রবণ না থাকলে আমিও একা হয়ে যাব দাদু। আমি বাঁচতে পারব না।’
‘পাগল মেয়ে একটা। বৃষ্টি তুই খুব বোকা হয়ে গিয়েছিস। হওয়াটাই স্বাভাবিক। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্ট নিয়ে যে আর মাথা ঘামাস না। সবাই অমন ভাবে। ভাবে ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে আর বাঁচব না। তারপরও বাঁচতে হয়। জীবন খুব নিষ্ঠুর, নির্মম রে পাগলি।’
‘সত্যি বলছি দাদু, শ্রবণের যদি কিছু হয়…সে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়…।’
‘মৃত মানুষরা কাউকে ছেড়ে যায় না রে বৃষ্টি। তারা জীবিতদের পাশে ঘুরে বেড়ায়। তারা হাসে কাঁদে আর বারবার বলে আমায় ভালোবাস, আমায় এমন ভালোবাস যেন আমি আবার ফিরে আসি। আবার ফিরে আসি তোমার কাছে। জীবিতরা সেকথা শুনতে পায় না।’
‘দাদু, কাল দুপুরে আমার বুকের ভিতর হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, শ্রবণের কোনও বিপদ হয়েছে। আমি ফোন করলাম। যদি ফোন না করতাম তাহলে আরও দেরি হয়ে যেত।’
‘মৃত্যু তার দায়িত্ব পালন করে। তোকে এখানে ডেকে খেলা করছে বলতে পারিস। তোরা আধুনিক সময়ের ছেলেমেয়ে এসব তো মানিস না।’
‘দাদু, তুমি এসব কী বলছ!’
‘কাঁদ বৃষ্টি। যত কাঁদবি, ভাব-ভালোবাসা তত শক্ত হবে। জীবনে হবে, মৃত্যুতেও হবে। ভয় কীসের? কেউ তোকে ছেড়ে যাবে না। আমি কি গিয়েছি? তুই খুব ক্লান্ত। তুই ঘুমো। অনেক যুদ্ধ বাকি আছে তোর। অনেক লড়াই।’
ধড়ফড় করে বসে বারিধারা। জ্যোতিষ্কদা, তার পিঠে হাত রেখেছে।
‘উফ এখানে বসে আছ! আমি তো গোটা হাসপাতাল খুঁজে ফেললাম।’
লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়াল বারিধারা। জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে বলল, ‘এ কী তুমি কাঁদছিলে নাকি! বোঝো কাণ্ড!’
বারিধারা তাড়াতাড়ি চোখ মুছল আর তখনই সে বুঝল, ভোর হচ্ছে! আলো ফুটছে। নরম আলোয় চারপাশ জেগে উঠেছে। তবে কি মেঘ কেটে গেল?
‘বেঞ্চে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘বেশ করেছিলে। চলো নীচ থেকে চা খেয়ে আসবে। তার আগে এই চাদরটা গায়ে দাও। তোমার দিদি পাঠিয়ে দিয়েছে।’
বারিধারা কিছু একটা বলতে গেল। বলতে পারল না। আই সি সি ইউয়ের কাচের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন সেই রাগী নার্স। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। সারা রাত রোগী সেবা করে পরিশ্রান্ত। এবার তাঁর ছুটি।
মহিলা বারিধারা আর জ্যোতিষ্কর সামনে এসে দাঁড়ালেন।
‘বারিধারা, কাল সারা রাত আপনি হাসপাতালের নিয়ম ভেঙেছেন। আজ সকালে আমি ভাঙব। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। নিয়ম না থাকলেও আমি আপনাকে আই সি সি ইউয়ের ভিতরে নিয়ে যাব। শ্রবণ রায়ের জ্ঞান ফিরেছে।’
জ্যোতিষ্ক তাড়াতাড়ি বলে, ‘আমিও যাব।’
ভারীক্কি চেহারার নার্স কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘না। আর কেউ নয়। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।’
বারিধারা এগিয়ে যাচ্ছে। তার দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। এদিক-ওদিক একজন দুজন করে জেগে উঠছে। তাদের মধ্যে যারা বারিধারাকে দেখতে পাচ্ছে তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আহা রে! কী সুন্দরই না লাগছে মেয়েটাকে!
হাঁটতে হাঁটতেই মুখ তুলল বারিধারা। বারান্দার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘহীন নীল আকাশ। একটু পরে রোদ উঠবে।