☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
ছেষট্টি
বারিধারার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল।
সে ঠিক করেছিল, আজ কোনওভাবেই শ্রবণের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। একটি নিটোল বৃষ্টিমুখর বিরহ ডে পালন করবে। এর জন্য মনকে কঠিন করতে হয়েছিল। শ্রবণ ফোন করবে, সে ধরবে না। মেসেজ করবে, রিপ্লাই দেবে না। হোয়াটসঅ্যাপে পিন হবে, হেলায় চোখ ফিরিয়ে নেবে। ফেসবুকেও যাবে না। তারপরেও সেই কঠিন মন গোলমাল করল। গোলমাল করল বড় অদ্ভুত একটা কারণে। এইসব বারিধারা কখনও বিশ্বাস করে না। আজও করেনি। তারপরেও নিজেকে পুরোপুরি সামলাতে পারল না। অবিশ্বাসের ঘাড়ে বিশ্বাস চেপে বসল। ভালোবাসার ক্ষেত্রে কত রকম যে কী হয়!
দুপুরের মেনুতে ছিল খিচুড়ি। বহুদিন পরে সবাই মিলে খাওয়া হল। যতই বৃষ্টি হোক, বিমলকান্তি অফিসে গিয়েছিলেন। লাঞ্চে এসেছিলেন, সবার সঙ্গে বসে খুশি মনে খেয়ে আবার চলেও গেছেন। খেতে বসার আগে মণিকুন্তলা বলেছিলেন, ‘জ্যোতিষ্ক থাকলে বেশ হত। জলবৃষ্টির দিনে একটা পিকনিকের মতো হত। হ্যাঁ রে, ডাকবি নাকি? অফিস থেকে আসতে পারবে? ঘণ্টাখানেকের তো মামলা।’
বারিধারা বলল, ‘না, মা। আজ সেনবাড়ির কোর কমিটি একসঙ্গে খাবে। পিতা-মাতা, আর তার দুই কন্যা। অন্য কাউকে ডাকা যাবে না।’
মেঘবতী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘কেন? ও আমাদের বাড়ির কেউ নয়?’
বারিধারা টেনে টেনে বলল, ‘অবশ্যই কেউ। জ্যোতিষ্কদা হচ্ছে সেনবাড়ির জামাই। সে তো কোর কমিটিতে নেই।’
মেঘবতী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘তোর যত সব গা জ্বালানো কথা। বাড়িতে আবার ওইসব কমিটি-ফমিটি কী?’
দিদির রাগ দেখে বারিধারা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘কোর কমিটি হল নিউক্লিয়াস বডি। বস্তুর একেবারে ভিতরের ব্যাপার। ধর বস্তুর মধ্যে যে অণু-পরমাণু আছে তাকেও যদি ভাঙতে থাকি…।’
মেঘবতী চোক কটমট করে বলল, ‘তুই থামবি বৃষ্টি?’
বারিধারা হেসে বলল, ‘আহা, রাগ করছিস কেন? বৃষ্টিতে ভেজবার পর সবসময় মন প্রসন্ন রাখতে হয়। নইলে বৃষ্টি দেবতা ত্রুদ্ধ হন। ঠাণ্ডা লাগিয়ে হাঁচি সর্দি করিয়ে দেবেন।’
মেঘবতী তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘এবার কিন্তু আমি না খেয়ে চলে যাব।’
বারিধারা বলল, ‘ঠিক আছে বাবা আমি চুপ করছি। তবে এটা মনে রাখিস কোর কমিটি ইজ কোর কমিটি। জামাইবাবু, মামাবাবুদের সেখানে অ্যালাউ নেই।’
মেঘবতী খেপে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মা, শুনতে পাচ্ছ? তোমার ছোট মেয়ে আমার বরকে কীভাবে অপমান করছে শুনতে পাচ্ছ? আমি কিন্তু সত্যি চলে যাব।’
মণিকুন্তলা রান্নাঘরে ফিনিশিং টাচে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বললেন, ‘তোরা ঝগড়া না থামালে আমি এবার বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যাব। দুটো ধেড়ে মেয়ে সারাক্ষণ খিচিরমিচির করছিস। তোরা কবে বড় হবি?’
বারিধারা বলল, ‘রোদ উঠলে। আপাতত মেঘে-বৃষ্টিতে আমাদের ছোটই থাকতে দাও।’
খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা। মাছের ব্যাপারে দুই বোন একেবারে দুই মেরুতে। মেঘবতী যেমন মাছ ভালোবাসে, বারিধারা ঠিক উলটো। সে মাছ দেখলে আঁতকে ওঠে। কাঁটার ভয়ে। ক্লাস ফোরে গলায় কাঁটা ফুটে গিয়েছিল, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তুলতে হয়েছিল। সেই থেকে মাছ দেখলেই দশ হাত দূরে। বুঝিয়ে, বকেও মণিকুন্তলা ছোট মেয়ের এই ভয় দূর করাতে পারেননি। তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়। আজও হয়েছে। ডিম ভাজা হয়েছে। কিন্তু মেঘবতী বোনকে ছাড়ল না। ‘ইলিশ ছাড়া খিচুড়ি খাবি কী রে! তুই তো বিরাট গাধা রে বৃষ্টি!’
বারিধারা বলল, ‘গাধা হই আর যাই হই, আমি বাবা অত কাঁটায় নেই। যদিও গন্ধটা মার্ভেলাস।’
বিমলকান্তি মাছ ভেঙে মুখে দিয়ে বললেন, ‘বাবা বলতেন ইলিশ মাছের গন্ধ নিয়ে এক হাঁড়ি ভাত খেয়ে ফেলা যায়। একসময় দার্জিলিং যেতে হলে ফরাক্কায় নেমে পড়তে হত। তখনও ব্রিজ হয়নি। বাক্স-পেঁটরা নিয়ে লঞ্চে নদী পেরিয়ে আবার ট্রেন। নদীর এদিকেও দার্জিলিং মেল, ওদিকেও দার্জিলিং মেল। ফরাক্কায় নামতে রাত হয়ে যেত। লঞ্চঘাটায় সারি দিয়ে ভাতের হোটেল। হোটেল মানে ওই আর কী, ঝুপড়ির মতো। সেখান থেকে চিৎকার করত, গরম ভাত ইলিশ মাছ, গরম ভাত ইলিশ মাছ…। বাক্স পেঁটরা লটবহর নিয়ে ছুটে গিয়ে গরম গরম ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়ে স্টিমার ধরতে ছুটতাম। আহা! দার্জিলিং বেড়ানোর প্যাকেজের মধ্যে এটা পড়ত। তোদের মাও খেয়েছে। মনে আছে মণি?’
মণিকুন্তলা প্লেটে আর এক হাতা খিচুড়ি নিয়ে বললেন, ‘মনে নেই আবার? একবার খেতে খেতে দেরি হয়ে গেল, কাঁটা বেছে ইলিশ খাওয়া বলে কথা, তারপর ছুটলাম লঞ্চ ধরতে। পা পিছলে পড়লাম। ইলিশের কাঁটা যেন গলার বদলে পায়ে বিঁধল। ব্যথা রয়ে গেল তিনদিন। বাপ রে!’
সবাই হেসে উঠল। অতি সামান্য ঘটনা, তারপরেও কী যে ভালো লাগল। প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকলে ছোটখাটো গল্পও মন ভরিয়ে দেয়। মনে হয়, একেই সুখ বলে। সিরিয়াস বিমলকান্তি সেনও আজ বহুদিন পরে যেন মন খুলেছেন। হাসি-ঠাট্টা করছেন।
গল্পের ফাঁকেই মেঘবতী তার বোনের প্লেটে সমানে কাঁটা বেছে মাছ দিয়ে গেছে। বারিধারাও অন্যমনস্ক হয়ে খেয়ে গেল।
বিমলকান্তি বললেন, ‘রবিবার একটা নেমন্তন্ন আছে। অল্প সময়ের জন্য হলেও যেতে হবে।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘কীসের নেমন্তন্ন।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘প্রহ্লাদ ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ। গৃহপ্রবেশ নয়। ফ্ল্যাট প্রবেশ।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘প্রহ্লাদ কে?’
‘আমাদের অফিসের স্টাফ।’
মণিকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি তো এ সব নেমন্তন্নে খুব একটা যাও না।’
বিমলকান্তি মুচকি হেসে বললেন, ‘যাই না, কিন্তু এটায় যেতে হবে। কারণ আছে।’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বাবা, মনে হচ্ছে কোনও রহস্য আছে।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘হ্যাঁ আছে। প্রহ্লাদ রহস্য।’
মেঘবতী বললেন, ‘প্রহ্লাদ রহস্য। সে আবার কী?’
বিমলকান্তি লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, ‘সে একটা ব্যাপার আছে। বলা যাবে না।’
বারিধারা বলল, ‘বলে ফেলো বাবা। এরকম হেভি বৃষ্টির দিনে সব বলে ফেলতে হয়।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘ব্যাপারটা যে সত্যি নয়, মিথ্যে।’
বারিধারা হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি আজীবন জানি/ সমস্ত কথাই সত্যি, সমস্ত কথাই মিথ্যে…শুধু/ সব কথা খুলে বলা ভালো।’
মেঘবতী বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আবার কী!’
বারিধারা গম্ভীর মুখে বলল, ‘বুঝলি না দিদি। এটা একটা কবিতার লাইন। কবিতার নাম শূন্যের বাঁশি।’
মেঘবতী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুই আবার কবিতা লিখিস নাকি?’
বারিধারা বলল, ‘কেন, লিখতে পারি না? তবে এই কবিতা আমার নয়। কবির নাম বিভাস রায়চৌধুরী।’
মেঘবতী ঠোঁট উলটে বলল, ‘তাই বল। আমি তাই ভাবছিলাম, এত সুন্দর কথা তুই কীভাবে বানালি! ঠাট্টা তামাশা করা ছাড়া তোর তো কোনও গুণ নেই।’
বারিধারা চোখ বড় বড় করে দিদির দিকে ঘুরে বসল। মণিকুন্তলা বললেন, ‘দেখো, দেখো, আবার দুজনে ঝগড়া করবার তাল করছে।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘এই প্রহ্লাদকে নিয়ে আমার একটা বিদঘুটে অসুখের শুরু হয়েছিল।’
মণিকুন্তলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘অসুখ! কী অসুখ?’
বিমলকান্তি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘অনেকদিন আগে প্রহ্লাদ আমার কাছে এসেছিল। টাকা চাইতে। সেদিনে আমি প্রহ্লাদ হয়ে গিয়েছিলাম।’
বারিধারা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘মানে! কী বলছ বাবা! তুমি প্রহ্লাদ হয়ে গিয়েছিলে! এ কথার মানে কী?’
বিমলকান্তি সংক্ষেপে গোটা ঘটনা বললেন। সবাই চুপ করে শুনল।
বিমলকান্তি সেন মৃদু হেসে বললেন, ‘চিন্তা নেই। বললাম তো ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম এটা কোনও অসুখ নয়, এটা আসলে আমার জীবনে একটা বাড়তি পাওনা ছিল সেদিন থেকে ফিলিংসটা আমার আর কখনও হয়নি। ওই যে বৃষ্টি তোর কবিতার মতো, যা সত্যি আবার যা মিথ্যেও। সম্ভবত গোটাটাই আমার মনের ভুল ছিল। সম্ভবত কেন? তাই হবে। মানুষের মনের ভিতর অনেকগুলো মন থাকে। কোনও কোনও মন হয়তো ঘুমিয়ে থাকে। আমরা তার খবরও পাই না। তাদের কেউ কেউ কোনও কোনও সময় জেগে ওঠে। আমার এটাই হয়তো সেরকম কিছু ছিল। অন্য মানুষ হয়ে যাওয়ার মন। কিছু সময়ের জন্য জেগে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।’
মণিকুন্তলা কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। মেঘবতী বলল, ‘বাবা, আমার ভয় করছে। তুমি কি আমার মনের কথা কিছু জানতে পেরেছ?’
বিমলকান্তিবাবু খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কারও মনের খবরই আমি জানতে পারিনি। অন্য মানুষ হওয়া মানে তার মনের কথা জানা নয় মেঘ। তার চোখে পৃথিবীটা দেখা। এটারও মাঝে মাঝে দরকার আছে।’
বিমলকান্তি একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘বাদ দাও এ সব ভারী কথা। যা ঘটবার ঘটে গেছে। এখন এভরিথিং ইজ নর্মাল। আমি এবার বেরোব। অফিসে মিটিং ডাকা আছে।’
মেঘবতী বাবার গাড়িতেই চলে গেল। মণিকুন্তলা বলেছিলেন, ‘থেকে যা না। এই বৃষ্টি-বাদলার সময় কোথায় যাবি? রাতে জ্যোতিষ্ক ফেরবার সময় নিয়ে যাবে। এখান থেকে খেয়েও যাবে।’
মেঘবতী বলল, ‘না মা, আজকাল বাড়ি বেশিক্ষণ ফাঁকা রাখতে ভয় করে। সেই ডাকাতির পর থেকেই…তার ওপর উনি তো বাড়িতে আর এক আর্টিস্টকে নিয়ে এসেছেন না। কুটকুটে নামের বালকটি এবার কোন কম্ম করে তার ঠিক আছে?’
মণিকুলন্তলা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘উফ! সব পাগলের পাল্লায় পড়েছি। একজন অন্য মানুষ হয়ে যায়, আরেকজন রাস্তা থেকে শিল্পী ধরে আনে। কী কুক্ষণে যে সেনবাড়িতে বিয়ে হয়েছিল।’
বারিধারা বলল, ‘আর একজন পাগলের কথা তো বললে না মা! যে মহিলা শ্বশুরমশাইয়ের পাগল টাইপ প্রাোজেক্টের যাবতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে বসে আছেন। মণিকুন্তলা সেন।’
মেঘবতী হেসে বলল, ‘তোর মতো পাগলি কে আছে বৃষ্টি।’
বারিধারা চোখ গোল করে, গলা ভারী করে বলল, ‘দিদি, কদিন পর থেকে অফিসে বসবি। সাবধানে থাকিস। দেখিস বাবা যেন তুই না হয়ে যায়। কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। বাবার যদি তোর মতো বুদ্ধি-টুদ্ধি হয়ে যায় সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে।’
মেঘবতী বোনের কথায় পাত্তা না দিয়ে মণিকুন্তলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, আমার বিজনেসে জয়েন করবার তাগিদটা আরও বেশি করে ফিল করছি। বাবার সত্যি রেস্ট দরকার।’
দিদি বাবার সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের ঘরে এল বারিধারা। খানিকক্ষণ থমকে থাকার পর বৃষ্টি আবার ঝিরঝির করে শুরু হয়েছে। জানালার একটা পাল্লা বন্ধ। বারিধারা জানালাটা পুরো খুলে দিল। বৃষ্টির ছাঁট আবার ঘরে ঢুকবে। ঢুকুক। আবার মা বকবে। বকুক। মেঘে মেঘে আকাশটা বড্ড সুন্দর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, দুনিয়ার যাবতীয় মন কেমন করা মেঘ বারিধারা সেন নামে এক ছটফটে তরুণীর সঙ্গে ছুটে ছুটে দেখা করতে এসেছে। তার সঙ্গে কথা বলছে।’
‘ওগো মেয়ে, তুমি কেমন আছ?’
‘ভালো আছি, খুব ভালো আছি। তোমাদের খুব সুন্দর লাগছে।’
‘ওগো মেয়ে, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কি জানো তুমিও খুব সুন্দর? তুমি যে মেঘ রঙের শ্লিভলেস ম্যাক্সিটা পরে আছ তাতে তোমাকে শুধু সুন্দর লাগছে না, খুব আকর্ষণীয় লাগছে। যে কোনও পুরুষ তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। তুমি কি সেটা জানো?’
বারিধারা মনে মনে হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘না জানি না। তুমি কি পুরুষ?’
মেঘ বলল, ‘না জানাই ভালো। যে সুন্দর সে নিজের রূপের কথা কখনও জানে, অন্যের সৌন্দর্য খোঁজে। আমরা যার কাছে যাই তখন তেমন থাকি। এখন যেমন তোমার কাছে এসেছি। তোমার সুন্দর চেহারা দেখে পুরুষ হওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।’
‘তোমরা খুব দুষ্টু তো।’
‘তোমাকে দেখে দুষ্টু না হয়ে থাকতে পারছি না। এটা যদি পাহাড় হত, জানলা দিয়ে ঠিক তোমার ঘরে ঢুকে যেতাম।’
বারিধারা হেসে উঠল। বলল, ‘আচ্ছা, পাহাড়ে যখন বেড়াতে যাব, তখন আসবে।’
‘ধন্যবাদ সুন্দরী।’
জানলা থেকে নিজের খাটের কাছে এল বারিধারা। এখন কী করবে? বই পড়বে? নাকি কম্পিউটার চালিয়ে সিনেমা দেখবে? চাদর মুড়ি দিয়ে একটা ঘুম দিলে কেমন হয়? বারিধারা ধপ করে শুয়ে পড়ল। বৃষ্টিতে ভেজা, ইলিশ সহযোগে খিচুড়ি ভক্ষণ আর বাবার গা-ছমছমে গল্পের পর দিবানিদ্রা জমবে। তার বয়সি মেয়েরা দুপুরে ঘুমনোর কথা ভাবতেই পারে না। ভুঁড়ি হয়ে যাবে। বিয়ের জন্য বর পাওয়া যাবে না। জিমে দৌড়তে হবে। তার এ সব চিন্তা নেই। তার ছিপছিপে চেহারায় ভুঁড়ি হওয়ার কোনও চান্স নেই। জীবন থেকে জিমের খরচ বেঁচে গেল। তা ছাড়া ভুঁড়ি হলেই বা কী? তার তো বিয়ের চিন্তা নেই। একটা হাঁদা ছেলে তাকে বিয়ে করবার জন্য বসে আছে। শ্রবণ চাকরিটা শুরু করলে বিয়ের জন্য চাপ দেবে। দিক গে, আপাতত বিয়ের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আগে নিজের একটা কিছু হোক। ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বের হলে এম ফিল, রিসার্চের ব্যাপার আছে। তারপর নানারকমের পরীক্ষা। কলেজে চাকরির হ্যাপা আছে। অনেক সময় লাগে। শ্রবণ কি এত ধৈর্য ধরতে পারবে? হয়তো নানা কথা বলবে।
‘আমার সঙ্গে মুম্বাই চলো বারি। ওখানেই লেখাপড়া করবে। তারপর না হয় পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে কলেজে পড়াবে?’
সে হয়তো আপত্তি করবে। বলবে, ‘খেপেছ। ওখানে গিয়ে আমি কী করব?’
হাঁদাটা শুনবে না। ঘ্যান-ঘ্যান করেই যাবে। হয়তো বলবে, ‘কেন ধারা, মুম্বাইতে কি কলেজ নেই? ওখানে কি কেউ পড়ায় না?’
তখন রেগে গিয়ে বলতে হবে, ‘না, পড়ায় না। ওখানে কোনও কলেজ নেই।’
‘আমি একা একা কী করে থাকব বারি? তুমি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি বোঝো ধারা।’
‘আমি জানি না তুমি কী করে থাকবে। একটা ধেড়ে ছেলে!’
আওয়াজ করেই হেসে ফেলল বারিধারা। চাপা গলায় মেঘ ডেকে উঠল বাইরে। শীত শীত করছে। বারিধারা হাত বাড়িয়ে চাদরটা টানতে গেল, আর তখনই ঘটনা ঘটল।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। হঠাৎ কোনও দুঃসংবাদ শুনলে যেমন হয় ঠিক সেরকম। বারিধারা ধড়ফড় করে উঠে বসেছে। কী হল? কেন এমন হল? নিমেষে বারিধারার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। শ্রবণের কিছু হয়নি তো? নিজেকে শান্ত করতে গিয়ে বারিধারা বুঝতে পারল তার বুকের ভিতর এখনও চাপা কাঁপুনি হচ্ছে। বুকের ভিতর? নাকি মনের ভিতর? হঠাৎ এমন হল কেন! শ্রবণের বিপদের কোনও ইনটিউশন সে অনুভব করল? এ কখনও হয়? অসম্ভব। এ সব উদ্ভট ব্যাপারে সে বিশ্বাস করে না।
তারপরেও বারিধারা খাট থেকে নেমে খানিকটা টলোমেলো পায়ে টেবিলের কাছে এল। মোবাইলটা তুলে শ্রবণের নম্বর টিপল। ফোন বেজে যাচ্ছে। বারিধারা বুঝতে পারল, তার কপালে ঘাম জমছে।