» » সপ্তম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

পঁয়ষট্টি

ঋষা ডান হাত দিয়ে কপালের দুটো রগ চেপে বসে আছে। তার মাথা নামানো।

একটু আগে যে মেয়েটি ঋষার অফিসে এসেছিল তার নাম বকুল। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। গায়ের রং মাজা, মুখে এক ধরনের শ্রী আছে। সব মিলিয়ে দেখতে মিষ্টি। বকুল অফিসে যখন ঢুকল, বৃষ্টি তখন খানিকটা ধরেছে। দরজার পাশে ভেজা ছাতা রেখে ঋষার টেবিলের সামনে এসে বসল।

ঋষা মেয়েটিকে চেনে। আগেও দু-একবার অফিসে এসেছে। বকুল এসেছে সুন্দরবন থেকে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও অত দূর থেকে এসেছে দেখে ঋষার ভালো লাগল। গ্রামে ঘুরে ঘুরে ডেটা কালেকশনের জন্য ক’টা টাকাই বা পায় কিন্তু কাজের ব্যাপারে এরা বেশির ভাগই রেসপন্সিবল। কাজটাকে শুধু উপার্জন হিসেবে দেখে না। এন জি ও-তে নানারকম গোলমাল থাকলেও এটা একটা ভালো দিক। যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে এক ধরনের আবেগ থাকে।

ঋষা বলল, ‘বৃষ্টিতে ভিজেছেন?’

বকুল শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথার আর হাতের জল মুছতে মুছতে হাসল। বলল, ‘না, তেমন নয়। বাস স্টপে দাঁড়িয়েছিলাম। জলটা ধরতে এলাম।’

ঋষা বলল, ‘আপনি বরং ওয়াশরুমে যান। ওখানে টাওয়াল আছে। মাথাটা মুছে আসুন। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’

বকুল বলল, ‘লাগবে না। এই তো মুছে ফেলেছি। বসি?’

ঋষা বলল, ‘অবশ্যই। বসুন। আপনি কি সোজা বাসন্তী থেকে আসছেন?’

বকুল বলল, ‘না, বাসন্তী থেকে এসেছি কাল বিকেলে। সন্তোষপুরে মাসির বাড়ি ছিলাম।’

ঋষা বলল, ‘তাও বাঁচোয়া। আজ যা অবস্থা।’

বকুল চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ব্যাগ রাখল। ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে বলল, ‘এ হপ্তায় কাজ বেশি পারিনি দিদি। শরীরটা ভালো ছিল না। একটা মাত্র গ্রাম ঘুরেছি। তারপর তো কাল থেকে বৃষ্টি নামল।’

ঋষা বলল, ‘আজ না এলেই তো পারতেন। এত বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘ভেবেছিলাম আসব না। তারপর ভাবলাম সন্তোষপুর পর্যন্ত যখন এসেছি, তখন যেটুকু কাজ হয়েছে দিয়ে যাই। মাসিও বলল, আজ যাস না। আমি বললাম, না, আবার কবে আসতে পারব, তার তো ঠিক নেই।’

ঋষা বলল, ‘ঠিক আছে দিন।’

আফিসে বাপু আছে। বাপু এখানে হোলটাইমার। পিওন কাম দারোয়ান। আবার ক্যান্টিনও চালায়। আজ বাকি স্টাফরা আসেনি। ঋষা বাপুকে চা বানাতে বলল।

বকুল কাগজপত্র এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই গ্রামটায় অদ্ভুত একটা ব্যাপার হয়েছে দিদি।’

‘অদ্ভুত ব্যাপার!’

বকুল বলল, ‘একটা সময় এখানে মেয়েদের হেলথ প্রবলেম অ্যাকিউট ছিল। নিউট্রিশনের অভাব ছিল খুব। মেয়েদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও গুরুত্বই ছিল না। নিজেরাও দিত না। যারা মাঠে, নদীতে কাজ করতে যেত তারা মুড়ি খেয়ে দিনের খিদে মেটাত। কোনও কোনও দিন একবেলা খেয়েই কাটত। বাড়ির কেউ খোঁজখবরও নিত না মেয়েটা কী খেল, আদৌ খেল কি না। এই নেগলিজেন্স একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। বংশ পরম্পরায় চলত। মেয়েরা বাইরে থেকে খেটে বাড়ি ফিরে আগে স্বামীর জন্য রান্না করতে বসত। সেই সঙ্গে ছিল ইনফেকশনের সমস্যা। অপরিচ্ছন্নতার কারণে নানারকম ইনফেকশন হত। পেটের অসুখ তো ঘরে ঘরে। পচা খাবারও খুব চলত। কেউ প্রাণে ধরে বাসি খাবার ফেলত না। গরিব মানুষ ফেলবেই বা কী করে? আর তার এফেক্ট পড়ত শরীরে।’

ঋষা মুখে ‘চুক চুক’ করে আফশোসের আওয়াজ করল। বলল, ‘ছি ছি। এটুকু সতেচন করা যায়নি। আপনি রিপোর্টে সব লিখেছেন তো? এগুলো ডিটেইলসে থাকা দরকার। আমি রিপোর্টে নোট দেব। শুধু কতজনের শরীরে ভিটামিনের অভাব, আর বি সি কম, এ সব লিখলে চলবে না। সচেতনতার অভাবটাও বলতে হবে।’

বকুল হেসে বলল, ‘মজার ব্যাপার কী জানেন দিদি, গত কয়েক মাসে এই সমস্যা কিছু কিছু করে কমছে। মেয়েরা নিজেদের খাবারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শিখেছে। নিজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে শিখছে। বাসি পচা খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে যে লোকসান বেশি বুঝতে পারছে। যতটা পারছে অ্যাভয়েড করছে।’

বাপু চা টেবিলে এনে রাখল। সঙ্গে প্লেটে ক’টা বিস্কুট। ঋষা বলল, ‘নিন আগে চা খেয়ে নিন।’

বকুল চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি তো এই গল্প শুনে অবাক। দুম করে হেলথ কনসাস হয়ে গেল। তাও আবার গ্রামের মেয়েরা।’

ঋষা চায়ে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, ‘সত্যি তো, ব্যাপার কী? কোনও গুরুমশাই গ্রামে গেছে নাকি?’

বকুল চোখ বড় করে বলল, ‘ঠিক ধরেছেন দিদি। কী করে বুঝলেন?’

ঋষা বলল, ‘গল্পে-সিনেমায় এরকম হয়। বাইরে থেকে কেউ একজন গিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলে। নিশ্চয় কোনও ডাক্তারবাবু।’

বকুল উত্তর দিল না। মিটিমিটি হাসতে হাসতে চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে লাগল। ঋষা মজা পেলে। মেয়েটা সাপপেন্স তৈরি করছে।

আজ সকাল থেকে অর্চিনের জন্য মন কেমন করছে ঋষার। সত্যি কথা বলতে কী, সেই মন কেমন কাটাতেই জলবৃষ্টিতেও অফিস চলে এসেছে। কৃষ্ণকলি বাড়িতে থাকলেও একটা কথা ছিল। সেও ক’দিনের জন্য নিজের বাড়িতে গেছে। একা একা থাকতে আরও মন খারাপ লাগে। অর্চিন শেষ এসেছিল তিন মাস আগে। কোর্টে তার মায়ের কেসের ডেট ছিল। ঋষাও গিয়েছিল। অর্চিনের মায়ের সঙ্গে দেখা করেছে। কোর্ট লকআপের ভিতর মহিলা বসেছিলেন। ক্লান্ত, অবসন্ন। ঋষা গিয়ে কাছে দাঁড়াল। পুলিশ এখন আর বাধা দেয় না। তবে খুব বেশিক্ষণ কথা বলতে দেয় না। বৈশাখী মলিন হেসে বললেন, ‘কেমন আছ ঋষা?’

ঋষার খুব খারাপ লাগছিল। যতবারই মহিলাকে দেখে, ততবারই কান্না পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ভালো আছি। আপনি ঠিক আছেন তো মাসিমা?’

বৈশাখী বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’

ঋষা বললেন, ‘শুনলাম জেলে আপনি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছেন না। এটা করবেন না। আমাদের খারাপ লাগবে।’

বৈশাখী বললেন, ‘না করব না। ক’টা দিন শরীরটা ঠিক ছিল না।’

‘ওষুধ খাচ্ছেন?’

বৈশাখী মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ খাচ্ছি। জেলের ডাক্তার খুব ভালো। যত্ন করে দেখে। এখন অনেকটা ঠিক আছি।’

বৈশাখী বললেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। বড় উকিল আপনার হয়ে লড়ছে।’

বৈশাখী এ কথার কোনও উত্তর দিলেন না। নীচু গলায় বললেন, ‘তুমি আমার ছেলেটার ওপর খেয়াল রেখো মা। বড্ড একগুঁয়ে। নিজে যা ভালো বোঝে, সেটাই করে।’

ঋষা কী বলবে বুঝতে পারেনি। কোনওবারই বুঝতে পারে না। মাথা নেড়েছে। আর সময় নষ্ট না করে অর্চিনকে কথা বলবার সুযোগ করে দিয়ে সরে আসে।

মামলার অবস্থা ভালো নয়। মহিলা পুলিশের কাছে যেভাবে সব স্বীকার করেছে, তাতে ফাঁকফোকর খুঁজে বের করা কঠিন। তার পক্ষের উকিল অনেকটাই হতাশ। বলেছে, একটাই পথ। কোর্টে বৈশাখীদেবীকে সব অস্বীকার করতে হবে। বলতে হবে, পুলিশ জোর করে তার বয়ান আদায় করেছিল। নিখিলেশ উপাধ্যায় নামের লোকটা সেদিন রেস্টুরেন্টে ডেকে তাকে টোপ দেয়, তারপর ভয় দেখায়। জালিয়াতির কাজটা না নিলে তাকে খুন করবে বলে শাসায়। একটা সময় তার গলা টিপে ধরতে যায়। বৈশাখী তখন বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। তাতে যে লোকটা মারা যাবে, বুঝতে পারেনি। এতে শাস্তি অনেকটা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গলায় রুমালের ছাপটা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে, সেটা অন্য কোনও কায়দায় সামলাতে হবে। একবার যদি আত্মরক্ষার থিওরিটা কোর্টে প্রমাণ করা যায়, তাহলে বাকিটাও করা যাবে। নিজেকে বাঁচাতে একজন মহিলা বন্দুক না রুমাল ব্যবহার করবে, সেটা তার ব্যাপার। সে অত কিছু ভেবে করে না। সেই সময়ও থাকে না। সমস্যা হল অর্চিনের মা রাজি হচ্ছেন না। উকিল অর্চিনকে বোঝাবার দায়িত্ব দিয়েছে। সেদিনও অর্চিন চেষ্টা করে।

আলিপুর কোর্ট থেকে বেরিয়ে ঋষা অর্চিনকে বলেছিল, ‘আমার বাড়িতে চল। কিছু খাবি। রেস্ট নিবি।’

অর্চিন মাথা নেড়ে বলল, ‘সল্টলেক অনেক দূরে। অতদূর যাব না। ফিরে যাব।’

ঋষা নরম গলায় বলেছিল, ‘আজকের দিনটা থেকে যা না অর্চিন। তোকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।’

অর্চিনকে সত্যি বিধ্বস্ত লাগছিল। বলল, ‘না, থাকা যাবে না। কাল সকালে ওখানে প্রাোগ্রাম আছে। অনেককে বলা আছে। দূর থেকে আসবে। সুন্দরবনে যাতায়াতটা একটা বড় সমস্যা। এসে ফিরে যেতে হলে সেটা অন্যায় হবে।’

ঋষা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘প্রাোগ্রাম একদিন বাদ দিলে হয় না। দুদিন কলকাতায় থেকে একটু রেস্ট নেওয়া যায় না? তোর কথাই সবসময় ফাইনাল হবে?’

অর্চিন বলল, ‘প্রাোগ্রাম একদিন কেন, সারা জীবনই বাদ দেওয়া যায় ঋষা। কিন্তু আমি তো তা করব না বলেই ঠিক করেছিলাম। সেই জন্যই তো সব ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়া।’

ঋষা মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, ‘আমারও তো কিছু চাওয়ার থাকতে পারে।’

অর্চিন একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘খিদে পেয়েছে। চল কোথাও বসে খাই।’

ঋষার খুব ইচ্ছে করল আরও কড়া কিছু বলে। বলে, ‘আমি খাব না।’

নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। যে ছেলে নিজের নীতি-আদর্শের জন্য সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে গিয়ে পড়ে আছে, যে ছেলে পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম তার মায়ের পরিচয় জানতে পায়, যে ছেলে জানে তার মা একজন ক্রিমিনাল, যে ছেলে তার মায়ের ফাঁসির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কড়া কথা বলা অন্যায়। অর্চিন যে এখনও শক্ত হয়ে আছে, এটাই যথেষ্ট। অন্য কেউ হলে দুমড়ে-মুচড়ে যেত।

একটা চিনা রেস্টুরেন্টে বসে সেদিন ঋষা নরম গলায় বলেছিল, ‘ল’ইয়ার যা বলছেন, তাতে মাসিমা রাজি?’

অর্চিন খিদে পেয়েছিল বলে খাবার নিলেও ঠিকমতো খাচ্ছিল না। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ঋষা, এই মামলাটা চালানো অর্থহীন।’

ঋষা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কেন? অর্থহীন কেন?’

‘মা কোনও কিছুতেই রাজি নয়। আজ তুই সরে যাওয়ায় বলল, আমার কোর্টে আসতে ভালো লাগছে না। তুই জজ সাহেবকে বলে দে, আমাকে যেন সাজা দিয়ে দেয়। যা ওনার খুশি। যেমনটা উনি মনে করেন, আমার ভালো লাগছে না।’

ঋষা বলল, ছি, ছি। এ সব কি হতাশার কথা? মাসিমাকে মনের জোর আনতে হবে।’

অর্চিন বলল, ‘জোর আনতে বললেই তো হয় না। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ঋষা। মাই মাদার লস্ট এভরিথিং। আমাকে বলল, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে এই যথেষ্ট। আর কিছু চাই না খোকা। আমার অশান্তি লাগছে। আমার ভালো লাগছে না। বন্দি জীবনে আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। আমিও ভাবছি…।’

একটু থেমে অর্চিন বলল, ‘ভাবছি…ভাবছি কেসটা আর চালাব না। মায়ের যখন ইচ্ছে নেই।’

ঋষা বলল, ‘অসম্ভব। এতদূর এগিয়ে থেমে যাওয়া যায় নাকি?’

অর্চিন শুকনো হেসে বলেছিল, ‘থেমে যাওয়ার বিষয় নয়, বিষয়টা হল মানুষটাকে রিলিফ দেওয়া। ল’ইয়াররা যা-ই বলুন, কিছু করা যাবে না আমি জানি। আমরা সবাই জানি। তা হলে কেন মিছিমিছি আর টানাহেঁচড়া? আমাকে ভেবে দেখতে হবে। মা জেনেছেন, আমি তার পাশে আছি। সন্তান হিসেবে আছি। ব্যস, এটাই আমি চেয়েছিলাম।’

অর্চিন চুপ করে বসে থাকে। ঋষা তাকে বিরক্ত করেনি। বাকি সময়টুকু চুপ করেই ছিল। বাসে ওঠবার আগে গলা নামিয়ে বলে, ‘ঋষা, তোর সঙ্গে কথা আছে।’

‘কী কথা? এখন বলবি?’

অর্চিন বলে, ‘না, এখন নয়। সময় হলে বলব। আজ যাই।’

তিন মাস সে কথা বলা হয়নি অর্চিনের। এই কদিন খুব একটা যোগাযোগও করেনি সে। আজ মন কেমনের মাঝখানে একবার ফোন করেছিল ঋষা। অর্চিনের মোবাইল সুইচ অফ।

বকুল বলল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন দিদি। গুরুমশাই বটে। তবে ডাক্তার নয়, কলকাতা থেকে গেছে। সেই ছেলেকে নিয়ে গ্রামের লোকদের খুব গর্ব দেখি। দাদা বলতে অজ্ঞান।’

ঋষা অবাক হয়ে বলল, ‘দাদা। দাদা কে?’

বুকল হাসিমুখে চোখ বড় করে বলে, ‘একটা কম বয়সি ছেলে দিদি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। কথা বলে।’

‘কী বলে?’

বকুল বলল, ‘অনেক কিছু। বলে শুধু রাজনীতি নয়, মেয়েদের সম্মান দিতে হবে। যত্ন করতে হবে। তারাই পরিবারে আসল মানুষ। তাদের অবহেলা করলে সবার ক্ষতি। মেয়েদের একটা দলও বানিয়েছে। নারী সমিতি না কী যেন। গ্রামের মানুষকে পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতার কথা বলে। কয়েক মাসের মধ্যে ইমপ্রুভ করেছে। শুধু মেয়ে নয়, ছেলেমেয়ে সবার ভালো হয়েছে। কী ক্ষমতা বুঝুন দিদি। বাইরে থেকে কদিন গিয়েই সবাইকে একেবারে বশ করে ফেলেছে।

ঋষাও হাসিমুখে বলল, ‘বাঃ, চমৎকার ছেলে তো। সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি রয়েছে। মানুষের বিশ্বাস পেয়েছে। আপনার ওই গ্রামের নাম কী?’

বকুল উজ্জ্বল চোখে বলল, ‘দিদি, গ্রামের নাম নোনাজল। আর ওই ছেলের নাম অর্চিন। আমি তো দেখা করতে চেয়েছিলাম। উনি কোথায় যেন মিটিংয়ে গেছেন।

ঋষার মনটা আনন্দে ভরে গেল। সে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলাল। অর্চিনকে সে চেনে এ কথা বলবার দরকার নেই। তা হলে তো অনেক কথা বলতে হয়। বলতে হয়, শুধু চেনে না, এই ছেলেকে সে নিজের থেকেও ভালোবাসে। বলতে হয়, তাদের বিয়ে হবে।

বকুল এবার গলা নামিয়ে বলল, ‘শুনলাম ওই ছেলে নোনাজল গ্রামে পাকাপাকি থাকবে। খুব শিগগিরই ওই গ্রামের জামাই হতে চলেছে।’

ঋষার প্রথমটায় মনে হল, ভুল শুনছে। সে ঠাণ্ডা ভাবে জিগ্যেস করল, ‘অর্চিন কী করবে বললেন?’

বকুল উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘আপনি ওনাকে চেনেন নাকি দিদি? উনি গ্রামের একটি মেয়েকে বিয়ে করবেন শুনলাম। নোনাজল গ্রামের। তার সঙ্গে ভাব ভালোবাসা চলছে। সেও তার সঙ্গে কাজ করে। কী যেন নাম বল…কী যেন নাম বলল…ইস, নামটা ভুলে গেলাম…হ্যাঁ, মনে পড়েছে নন্দনা। লেখাপড়ায় ভালো। হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলের টিচার। ভালোই হয়েছে। বিয়ে থা দিয়ে এই ছেলেকে গ্রামেই আটকে রাখা উচিত।’

ঋষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কড়া গলায় বলল, ‘বাঃ, আপনি তো অনেক খোঁজখবর রাখেন দেখছি। এন জি ও-র কাজ করতে গিয়ে একেবারে গ্রাম্য প্রেম-প্রীতি, বিয়ে পর্যন্ত জেনে এসেছেন। দিন কাগজপত্র দিন। অনেক সময় নষ্ট হল।’

‘দিদি’র এই হঠাৎ পরিবর্তনে বকুল অবাক হয়। সে খানিকটা থতমত ভাবেই হাতের কাগজ এগিয়ে দেয়।

কাজ বুঝে একই রকম কঠিন গলায় ঋষা বলে, ‘আপনি আসুন। দুর্যোগ বাড়ছে।’

কপাল থেকে হাত নামাল ঋষা। বাইরে বৃষ্টির জোর বেড়েছে। তার কান্না পাচ্ছে। সে এখন কী করবে? কাঁদবে? নাকি অর্চিনকে ফোন করে জানতে চাইবে, ‘তুমি কি নন্দনা নামের কোনও মেয়েকে ভালোবেসেছ? তাকে তুমি বিয়ে করবে? এই জরুরি কথাই কি তুমি সেদিন আমাকে বলতে চেয়েছিলে অর্চিন?’ নাকি সে এখনই নোনাজল গ্রামের উদ্দেশে রওনা হবে? এই ঝড়জল মাথায় করেই রওনা দেবে। সেখানে গিয়ে অর্চিনকে বলবে, ‘আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি ব্যাগ গোছাও। আমি একটা কথাও শুনব না।’

কী করবে ঋষা?