☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
বাষট্টি
‘পার্টি সংগঠনের প্রস্তুতি।’
কথাটা পাতার ওপর লিখে পেন তুলে নিল শেখর। কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর লেখাটা কাটল। এবার লিখল—’বিভিন্ন বাম পার্টি কীভাবে সংগঠন গড়ে তুলেছিল।’ এবারও হাত তুলে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল শেখর। তার চোখ মুখ বলছে, এই বাক্যটিও তার পছন্দ হয়নি। শেখর পেন কামড়ে বেশ খানিকক্ষণ ভাবল। পেন কামড়ানোর অভ্যেসটা তার বহুদিনের। আগে বেশি ছিল, তমসা বলে বলে কমিয়েছে।
‘ছেলে বড় হচ্ছে। বদভ্যাসগুলো কমাও, ছেলেও তো শিখবে।’
শেখর বলেছিল, ‘পেন কামড়ানো বদভ্যাস তোমায় কে বলল তমসা?’
তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি। অবশ্যই একটা বিচ্ছিরি হ্যাবিট। ময়লা মুখে যাচ্ছে।’
শেখর হেসে বলেছিল, ‘মাও লেখবার সময় পেন কামড়াতেন। পৃথিবীর ময়লা দূর করতে চেয়েছিলেন তিনি। শোষণ, বঞ্চনা ময়লা ছাড়া কী? কী জানি, হয়তো লং মার্চের জন্য পার্টিকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন, সেটাও হয়তো পেন কামড়ে লিখেছিলেন।’
তমসা রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘তুমি লং মার্চের চিঠি লিখছ না। মাও, হোচিমিন, লেনিন, চে গুয়েভারা করলেও এটা ঠিক নয়। তুমি করবে না।’
শেখর বদভ্যাস কমিয়ে এনেছে। তারপরেও লেখালিখির সময় কোথাও আটকে গেলে অজান্তে পেন মুখে চলে যায়।
শেখর এবার লিখল—’বিবিধ বাম দলের সূচনাকালীন সাংগঠনিক কাঠামো আমাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে?’
হেডিং হিসেবে বড় হয়ে গেল? হোক। এখানে ছোট বিষয় নয়, পার্টি নেতৃত্ব যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে। পুরো বাক্যটির নীচে লম্বা দাগ দিল শেখর। দ্রুত এই লেখা শেষ করতে হবে। নির্বাচনের রিপোর্ট নিয়ে লোকাল কমিটির গোলমালের পর জেলা সেক্রেটারি শেখরকে ডেকে পাঠালেন। ‘এসব নিয়ে বেশি চিন্তা কোরো না শেখর। যে কোনও বিপর্যয়ের পরই এই ধরনের বিরোধ তৈরি হয়। আমাদের পার্টির ইতিহাসে বারবার হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট যখন ভেঙে গেল, আমাদের পার্টির একটা বড় অংশ আমাদের ত্যাগ করল। পরে এমারজেন্সির সময়ও এক ঘটনা ঘটেছে। একদল বলল, এখনই আণ্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে। একদল বলল, আণ্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া এক কথা। তার থেকে সারফেসে থেকে কাজ করে জেলে যাওয়াই ঠিক হবে। এতে মানুষের মধ্যে পার্টির বিপ্লবী ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রভিনসিয়াল কমিটিতে এই নিয়ে তুলকালাম হল। শেষ পর্যন্ত এমন ধরপাকড় শুরু হল যে আণ্ডারগ্রাউন্ডে না গিয়ে উপায় ছিল না। এতদিন পাওয়ারে থাকার পর, পরাজিত হয়েছি। একবার নয়, পরপর দু’বার। এবার তো জটিলতা অনেক বেশি হবার কথা।’
শেখর বলল, ‘এটাই তো সবাই বুঝতে চায় না।’
সেক্রেটারি বললেন, ‘সবাই কোনওদিনই সবটা বুঝতে চায়নি শেখর। কমিউনিস্ট পার্টিকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, অতীতকে আঁকড়ে বসে থাকতে হবে। আমাদের নতুন করে সংগঠন গোছানোর কথা ভাবতে হবে। প্রয়োজনে নতুন পথ বের করতে হবে। স্ট্রাকচার বদলাতে হবে। তুমি একটা নোট তৈরি করো। আমার কাছে জমা দাও। পয়েন্ট ঝাড়াই বাছাই করে পার্টির কাছে প্রস্তাব হিসেবে পাঠাব।’
শেখর জিগ্যেস করেছিল, ‘সব এলসি কি নোট তৈরি করবে?’
জেলা সেক্রেটারি বললেন, ‘খেপেছ? সবাই জানে কী? নতুন করে পথ চিহ্নিত করবার কথা কথা কেউ ভাবে নাকি? বেশিরভাগই তো গয়ংগচ্ছ। যা চলছে তাই চলবে। আমি তোমার কাছ থেকে নেব, আমি নিজেও তৈরি করব।’
শেখর বলল, ‘এই নোটে কী থাকবে?’
সেক্রেটারি বললেন, ‘কী আবার থাকবে? অর্গানাইজেশন ঢেলে সাজানোর কথা থাকবে। জোরদার করবার কথা থাকবে। আরও ডিসেনট্রালাইজেশনের কথা থাকবে। নীচের কমিটিগুলোকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় সেই কথা ভাবতে হবে। কখন জেলা প্রাোগ্রাম পাঠাল তার জন্য হ্যাপিত্যেশ করে বসে না থেকে লোকাল ব্রাঞ্চকে নিজের মতো কর্মসূচি ঠিক করতে হবে। নিজের এলাকার এমন অনেক অ্যাক্টিভিটিস হতে পারে যা আমরা ওপরে বসে ভাবতে পারি না। তুমি সবদিক ভেবেচিন্তে একটা নোটস পাঠাও শেখর।’
শেখর ক’দিন ভাবনাচিন্তা করেছে। তার মনে হয়েছে, একেবারে শুরু থেকে ভাবাটাই উচিত। বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলো কীভাবে তাদের সংগঠন গড়েছিল সেগুলো একবার ঘষে মেজে দেখা যেতে পারে। সবার থেকে ভালো দিকটা নিয়ে নিজেদের চলবার দিশা বের করতে পারলে সবথেকে ভালো হয়। এই ভাবনা নিয়েই সে লিখতে বসেছে। আজ সকালে বেরোনো হয়নি। খুব বৃষ্টি পড়ছে। ছেলে পরীক্ষার পর ছুটি পেয়ে দু’দিনের জন্য মামাবাড়িতে গেছে। তমসা স্কুলে। সে যখন বেরিয়েছে, বৃষ্টি খানিকটা থমকে ছিল। বাড়িতে একা বসে শেখর মন দিয়ে লিখে চলেছে।
আমাদের পার্টির আদর্শ বিশ্বাস, ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে যদি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তৈরি করতে পারি তাহলে সংগঠন নিজে থেকেই গড়ে উঠবে। আমরা আগেই বুদ্ধিজীবীদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাই। পাড়ায় পাড়ায় তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সময় দেওয়া হোক। অতি বিপ্লবী দলের ভ্রান্ত পথ যেমন আমাদের কাছে পরিত্যজ্য, তেমন তাদের সাংগঠনিক কৌশল আমাদের গ্রহণ করবার মধ্যে কোনও দোষ নেই।
ডোর বেল বাজল। কেউ এসেছে। শেখর পেন নামিয়ে উঠে পড়ল। সামনে রাখা হাতঘড়িটা তুলে দেখল একটা বেজে গেছে। অনেক বেলা হল। সদর দরজার কাছে যেতে যেতে শেখর বুঝতে পারল, বৃষ্টির বেগ বেড়েছে।
দরজা খুলেই ঝাপটা মেরে খানিকটা বৃষ্টি ঘরে ঢুকে পড়ল। ভিজে চুপচুপে হয়ে তমসা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ছাতা। শিকভাঙা, নড়বড়ে ছাতা বৃষ্টি ঠেকাতে পারেনি। তমসাকে ভিজিয়ে ছেড়েছে।
তমসা ছাতা বন্ধ করতে করতে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
শেখর বলল, ‘কী হল? চলে এলে যে?’
তমসা এবার দরজা আটকে দিতে দিতে বলল, ‘রেনি ডে হয়ে গেল। আরও যদি বৃষ্টি বাড়ে, তাই ছুটি। সরো, আগে বাথরুমে যাই।’
শেখর বলল, ‘ইস একদম ভিজে গেছে। একটা রিকশো পেলে না?’
তমসা বলল, ‘কেউ আসতে চাইল না।’
তমসা বাথরুমের দিকে এগিয়ে বলল, ‘রাস্তায় জল জমেছে কিন্তু।’
শেখর সিগারেট ধরাল। বলল, ‘তা তো জমবেই, এইভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে ঘরেও জল ঢুকবে।’
তমসা বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘খেয়েছ?’
শেখর নিজের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে, ‘না। বিকেলে পার্টি অফিস যাব কী করে ভাবছি।’
তমসা বাথরুমের ভিতর থেকে বলল, ‘খাওনি তো সিগারেট ধরালে কেন? বিকেলে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না।’
শেখর টেবিলে ফিরে এল। লেখাটা শেষ করতে হবে। তবে এখন আর হবে বলে মনে হয় না। মুডটা কেটে গেল। খেয়ে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করতে হবে। যদিও তমসা চলে আসায় ভালোই হয়েছে। খাবার টাবারগুলো গুছিয়ে দেবে।
বরকে ভাত দিয়ে তমসাও বসে পড়ল। সে খেয়ে স্কুলে গিয়েছিল, তারপরেও খিদে পেয়ে গেছে। এতটা পথ বৃষ্টিতে হেঁটে এলে খিদে পাবারই কথা। এক হাতা ভাত খেলে ভালো হয়। বেশি করে লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে অমলেট ভেজে নিল। বৃষ্টির সময় ভাত ডালের সঙ্গে ঝাল ঝাল অমলেট অমৃত।
শেখর বলল, ‘একটা নোট তৈরি করছি।’
তমসা বলল, ‘কীসের নোটস?’
শেখর বলল, ‘অর্গানাইজেশন রিফর্ম।’
তমসা বলল, ‘তোমার কথা কে শুনবে? তুমি পার্টি সংগঠনের পুনর্বিন্যাস করবার কে?’
শেখর বলে, ‘এটা কোনও কথা নয়। ঠিকমতো বোঝাতে পারলে নিশ্চয় কিছুটা শুনবে। আর এ তো কোনও অফিসিয়াল পেপার নয়। জেলা সেক্রেটারি নিজের উদ্যোগে কিছু প্রাোপোসাল পাঠাতে চাইছে। আমার কাছ থেকে পয়েন্টস চেয়েছেন। ভালো কথা। ব্রাঞ্চ, লোকাল, জোনাল কমিটিগুলি যদি শক্তিশালী হয়, সংখ্যায় বাড়ে সেটা তো পার্টির জন্য ভালো।
তমসা খানিকটা নিস্পৃহ ভাবে বলল, ‘যদি হয় ভালোই তো।’
শেখর বলল, ‘আমি খেয়ে উঠে লেখাটা শেষ করব। বিকেলে তোমাকে পড়াব। একটু দেখে দেবে। মনে হচ্ছে, একটু বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। হোক বিতর্ক। বিতর্ক না থাকলে কোনও পার্টি টিকতে পারে না।’
তমসা বলল, ‘আচ্ছা দিও।’
শেখর ভেবেছিল খাবার পরই লিখতে বসবে। বৃষ্টি আরও বেড়েছে। তমসার সঙ্গে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
তমসা উদ্ভাসিত গলায় বলল, ‘দেখ, কী সুন্দর! চারপাশ একবারে সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সাদা ওড়না দিয়ে কিশোরী মুখ ঢেকে হাসছে। সেই হাসির সঙ্গে কান্নার মতো ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা! এই হাসি কান্না বুঝতে পারা যায়, আবার যায়ও না। তাই এত ভালো।’
শেখর বলল, ‘পার্টিকে বাচাতে গেলে আগে সংগঠনকে…।’
তমসা ঘুরে দাঁড়িয়ে শেখরের ঠোঁটে আঙুল দিল। মুচকি হেসে অস্ফুটে বলল, ‘তোমারে পাছে সহজে বুঝি, তাই কি এত লীলার ছল/ বাহিরে যবে হাসির ছটা, ভিতরে থাকে আঁখির জল। / বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা—/ যে কথা তুমি বলতে চাও, সে কথা তুমি বলো না।’
শেখর বউকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে এল। পোশাক খুলতে লাগল অতি যত্ন করে। যেন ফুল সাজাচ্ছে। বৃষ্টিদিনের আঁধার ঘরে শুধু মেঘের আলো। সেই ভেজা আলোয় নগ্ন তমসাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী, জীবনের পরম আনন্দ মুহূর্তের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বুকে মুখ নামিয়ে শেখর ঘ্রাণ নিল।
‘তমসা, তুমি সাবান মাখোনি।’
তমসা দু’হাত দিয়ে শেখরের এলোমেলো চুল চেপে ধরল গভীর আশ্লেষে।
‘না, মাখিনি।’
জলের ফোঁটার মতো নাভিতে দাড়ি না কামানো গাল ঘষতে ঘষতে জড়ানো গলায় শেখর বলল, ‘কেন?’
শেখরের কাঁধ খিমচে ধরে তমসা বলল, ‘তোমরা জন্য গায়ে বৃষ্টি রেখে দিয়েছি।’
শেখর সেই বৃষ্টিতে ডুব দিল। মেঘের গর্জন মুচকি হেসে তমসার শিৎকার ঢেকে দিল পরম ভালোবাসায়।
বিকেলে জেলা অফিস থেকে ফোন করে শেখরকে জানানো হল, তার লোকাল কমিটি ভেঙে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে পার্টিতে এত কমিটির কোনও প্রয়োজন নেই।