☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
ঊনচল্লিশ
কমলকান্তি সেন লিখছেন।
তিনি ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে চওড়া হাতলের ওপর কাগজ রেখেছেন। তিনি লেখালিখি আজকাল বিশেষ করেন না, যখন করেন ফাউন্টেন পেনেই করেন। ঝরনা কলম। তবে কয়েকটা ভালো কলম আছে। আজকের কলমটাও খুব নামি কোম্পানির। কোম্পানির নাম মঁ ব্লা।
একানব্বই বছর বয়সে লেখালেখি করতে হলে হাত কাঁপবে। এটাই স্বাভাবিক। বয়সের সঙ্গে নার্ভ এবং পেশির জোর কমে যায়। কিন্তু কমলকান্তি সেনের হাত কাঁপে না। হাত কাঁপে না বলে হাতের লেখাও কাঁপে না। তবে আজ তার বুক কাঁপছে। বেশি না, অল্প কাঁপছে। আনন্দে কাঁপছে। সেই আনন্দ-কম্পন তার হাতের লেখাতে প্রভাব ফেলছে। লেখা কেঁপে যাচ্ছে।
এই আনন্দ-কম্পনের কারণ কী?
আনন্দ-কম্পনের কারণ, কমলকান্তি সেন এখন তার স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নিয়ে বসেছেন। তিনি লক্ষ করে দেখছেন, আজকাল এই প্রজেক্ট নিয়ে যখনই কিছু ভাবনাচিন্তা বা লেখালিখি করেন, তখনই বুকের ভিতর এক ধরনের স্পন্দন অনুভূত হয়। তিরতির করে ওঠে। শান্ত দিঘির জলে ঢিল পড়লে যেমন হয়। জল প্রাণ পায়।
কমলকান্তি ঠিক করেছেন, সবার আগে তিনি একটা খসড়া তৈরি করবেন। এই খসড়াই বলে দেবে, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ কোনও উদ্ভট প্রজেক্ট নয়। বাস্তবের মাটির ওপর শক্ত পা এবং মনে দাঁড়িয়ে যাবতীয় কাজ চলবে। আন্তরিকতা থাকলে কাজ করতে কোনও অসুবিধে হবে না। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, যোগ্য সংগঠন এবং টাকাপয়সার ঠিক মতো ফ্লো থাকলে প্রজেক্ট নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগোনো সম্ভব। তাই এই তিনটি জিনিসকে আগে গুছিয়ে নিতে হবে। সেই গোড়ার কাজটাই সারতে চাইছেন কমলকান্তি। খসড়া তৈরির কাজ। সবার আগে আলোচনার সময় এই খসড়া তিনি হাজির করবেন। সকলের মতামত শোনা হবে। তারপর হবে অদলবদল।
এই পর্যন্ত প্রজেক্ট নিয়ে কমলকান্তি সেন যতটা লিখতে পরেছেন তা হল—
এক) ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রজেক্টের মূল কাজ হল, প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি খুঁজে বের করা। অর্থাৎ যারা এই প্রজেক্ট থেকে উপকৃত হবে, তাদের চাই। মনে রাখতে হবে, এই প্রজেক্ট সাধারণভাবে স্কুল ড্রপআউট মেয়েদের জন্য নয়। তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি নানা ধরনের ব্যবস্থা আছে। কোনওটা কাজ করে, কোনওটা শুধুমাত্র টাকার অপচয়। আবার কেউ ‘স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করছি’ বলে দেশের গ্রান্ট, বিদেশের ফান্ড থেকে টাকা, ডলার উপার্জন করে। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ এসব থেকে আলাদা হবে। মূলত যেসব মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে চেয়েও শিখতে পারেনি, তাদের জন্য এই প্রজেক্ট। যেখানে টাকাপয়সার পাশে সামাজিক বাধানিষেধের ব্যাপার আছে, যেখানে পরিবার মনে করেছে, মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে কোনও লাভ নেই, যেখানে ঘর-সংসারের চাপে ইচ্ছুক মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারে না—তাদের নেওয়া হবে। এদের নিয়েই প্রজেক্ট গড়ে উঠবে। সুতরাং এদের খুঁজে পেতে হবে। সেই খোঁজার কাজটা কঠিন। পথ বের করতে হবে। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে নানা ধরনের খবর বেরোয়। কোনও কিশোরী পড়তে চায় কিন্তু বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন হয়েছিল। মেয়েটি পালিয়ে থানায়, বিডিও অফিসে, স্থানীয় ক্লাব বা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠানের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সাহাস্য চেয়েছে। তারা সাহায্য করেছে। মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করেছে। ধমকধামক দিয়েছে। মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সমস্যা হল, সাময়িকভাবে একটা সুরাহা হলেও, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারল কিনা, তার কোনও খোঁজ হয় না। কাগজে ক’দিন হইচইয়ের পর সব চুপ করে যায়। এই প্রজেক্টে কোনও সাময়িক রিলিফের ব্যবস্থা থাকবে না। তবে বিভিন্ন পুলিশ থানা, বিডিও অফিস, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে আবেদন করতে হবে, এরকম কাউকে পাওয়া গেলে তারা যেন ‘একটু পরে রোদ উঠবে’তে যোগাযোগ করে।
দুই) জানতে হবে, ঠিক কোন ধরনের মেয়েদের এই প্রজেক্টে নেওয়া হবে। যারা লেখাপড়া করতে চায় কিন্তু সামাজিক বাধা যাদের সেই পথে যেতে দিচ্ছে না, এমন মেয়েদেরই নেওয়া হবে। এমন অনেকেই আছে যারা টাকাপয়সার কারণে মেয়েকে পড়তে না দিয়ে ঘরের কাজে আটকে রাখে। পরে বিয়ে দিয়ে দেয়। এদের বেলাতেও ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ হাত বাড়াবে। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে হবে মেয়েটি সত্যি পড়তে চায় কিনা। ইন্টারভিউ ধরনের কোনও একটা কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে তার মনোভাব বুঝতে হবে। যদি লেখাপড়ায় তার উৎসাহ থাকে, তবেই তার জায়গা হবে।
তিন) যেহেতু লেখাপড়ার কোনও বয়স নেই, এই প্রকল্পে বয়সের কোনও সীমা থাকবে না। সাত থেকে সত্তর যে-কোনও বয়সে এখানে যোগ দেওয়া যাবে। বালিকা, কিশোরী, তরুণী, মহিলা, বৃদ্ধা সবাই আসতে পারে। এমনও হয় টাকাপয়সার অভাব, সংসারের চাপে ছোটবেলায় লেখাপড়া হয়নি। বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরে আজও লেখাপড়া করবার ইচ্ছে। শুধুই আপশোস হয়। এনাদের জন্য ‘একটু পরে রোদ উঠবে’-র স্লোগান হবে আপশোস নয়, এখনও সময় আছে।
চার) শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবার ব্যবস্থা হবে। তার জন্য হস্টেল, বৃদ্ধাবাস ধরনের সব আয়োজনই করতে হবে। ধাপে ধাপে হবে। তবে যেহেতু প্রজেক্ট সাইট ভুলাভেদায়, তাই ঝাড়গ্রামের আশপাশে যারা থাকে তারা চাইলে বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারবে।
পাঁচ) সিলেবাস তৈরি হবে বয়স অনুযায়ী। বছর শেষে পরীক্ষা হবে। পাস-ফেল থাকবে না। যদি কেউ কোনও বিষয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিখতে না পারে, তাকে আবার শেখানো হবে। তার পরেও না পারলে অন্যগুলো বাদ দিয়ে তার জন্য যে বিষয়টা উপযুক্ত, সেটা পড়ানো হবে। এই পদ্ধতি কিছুদিন চলবার পর যদি দেখা যায় কেউ মেইন স্ট্রিমে লেখাপড়া করতে চায়, তাহলে তার গ্রাম, শহর এলাকায় যে স্কুল-কলেজ থাকবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রকল্প কোনও প্রথাগত স্কুল নয়। স্কুল হিসেবে সে কোনও সরকারি সিস্টেমের অনুমোদন নেবে না। এখানে লেখাপড়া করলে কোনও সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। ট্রফি দেওয়া হবে। খেলাধুলোর সময় যেমন দেওয়া হয়। এটাও এক ধরনের জয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবারের বাধার সঙ্গে লড়াইতে জয়। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ এই একটা লড়াইয়ের সঙ্গী। তার কাজ দমিয়ে দেওয়া, দমে যাওয়া ইচ্ছেকে সম্মান জানানো। সেই লড়াইতে জয়ী হওয়ার জন্য ট্রফি দেওয়া হবে। তবে যারা কমবয়সে এখানে আসবে চেষ্টা করা হবে, তারা যেন দ্রুত মূল স্রোতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যেতে পারে।
ছয়) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকবার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে। তার বেশি কাউকেই অ্যালাও করা যাবে না। নতুনদের জায়গা ছাড়তে হবে। এই সময়সীমা কতটা, সেটা সবাই মিলে বসে ঠিক করতে হবে।
সাত) এই প্রকল্পের খরচের জন্য কারও কাছে হাত পাতা হবে না। প্রারম্ভিকভাবে নীহারিকা সেনের টাকা এতে খরচ করা হবে। সেই টাকার পরিমাণ কম নয়। জমির ডেভেলপমেন্ট, বাড়িঘর তৈরির কাজ অনেকটাই করা যাবে। অন্য কেউ ব্যক্তিগত ভাবে টাকাপয়সা দিতে চাইলে দিতে পারে। তবে পরিবার বা পরিচিতজনের বাইরে কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়া হবে না। কেউ যদি এই প্রজেক্টে যুক্ত হতে চান, তাঁকে তাঁর বুদ্ধি, পরিশ্রম নিয়ে যুক্ত হতে হবে। তিনি যা জানেন, তিনি যে কাজে পারদর্শী সেই কাজ তিনি প্রজেক্টের জন্য দেবেন। কেউ পড়াতে পারেন, কেউ গান শেখাতে পারেন, কেউ বাগান করতে পারেন, কেউ জঞ্জাল পরিষ্কার করতে পারেন। যেমন কমলকান্তি সেন এখনই কথা দিলেন, প্রজেক্ট এলাকার ভিতর যে নালা বানানো হবে, তিনি কোদাল চালিয়ে তার শুভ সূচনা করবেন। এ বিষয়ে কারও আপত্তি শোনা হবে না। এতে প্রমাণ হবে, সবাইকে সব কাজ করতে হবে এবং ভালো কাজে বয়স কোনও বাধা নয়।
আট) কারও দান, সরকারের অনুদান নয়। ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নিজের খরচ নিজেই তুলবে। এখানে যারা থাকবে, তাদের হাতের কাজের ট্রেনিং দেওয়া হবে। মাটি, বাঁশ, শোলা, কাঁসা-পিতল, ডোকরা, কাপড়, ছবি, পুতুল—সবরকম ট্রেনিং হবে। হস্তশিল্প, লোকশিল্পের বাজার খুব বড়। সেই বাজারকে পরিকল্পনামাফিক ধরতে হবে। এই কাজটা এলেবেলেভাবে করলে চলবে না। আবাসিকদের বানানো জিনিস নিয়ে শুধু একজিবিশন আর মেলা হবে এমন নয়। গোড়া থেকেই ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে নামতে হবে। কর্পোরেট ভাবনা চাই। বিভিন্ন জায়গায় কাউন্টার করতে হবে। জিনিস বাইরে পাঠাতে হবে। এই কাজের জন্য একটা পৃথক কোম্পানি বানানো হবে। ব্যাঙ্ক লোন নেওয়া হবে। লোনের জন্য ‘একটু পরে রোদ উঠবে’-র জমি বন্ধক রাখা যেতে পারে। কোম্পানি চালাবে প্রফেশনালরা। তারা প্রাোডাকশন, মার্কেটিং, প্রাোমোশন সব দেখবে। উপযুক্ত বেতন, কমিশন সব পাবে। মনে রাখতে হবে, বিষয়টি এই প্রজেক্টের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হার্ট অফ দ্য প্রজেক্ট। গোটা শরীরে সে রক্ত সঞ্চার করবে। এই ব্যবসার টাকাতেই প্রজেক্ট চলবে।
এই পর্যন্ত লিখে কমলকান্তি সেন থামলেন। এক, পাঁচ আর আট নম্বরের পাশে বড় করে টিক মার্ক দিলেন। এই তিন পয়েন্ট ইমপর্টান্ট। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, ভাবনাচিন্তার ব্যাপার আছে। ব্যবসার বিষয়ে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে জড়ানো হবে না। একেবারে নতুন কোম্পানি হবে।
কমলকান্তি কাগজ ভাঁজ করলেন। মঁ ব্লা কলমের খাপ বন্ধ করে পাশের টেবিলে রাখলেন। ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চোখে বুজলেন। ক্লান্ত লাগছে। সে তো লাগবেই। মনের জোরে তো আর বয়সের সমস্যা আটকে রাখা যায় না। একটানা অনেকটা কাজ করে ফেললেন। আচ্ছা, বৃষ্টিকে নতুন কোম্পানির দায়িত্ব দিলে কেমন হয়? বয়স কম? হোক বয়স কম। বয়স কম হলেই উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি হবে। নতুন নতুন জিনিস ভাবতে পারবে। ওর একজন বয়ফ্রেন্ড আছে। কী নাম ছেলেটার? প্লাবন? না না, মনে পড়ছে, শ্রবণ। ছেলেটা আঁকতে পারে। নানারকম ভাবতে পারে। গুণী ছেলে। বৃষ্টিই একদিন তাকে এই ছেলের কথা বলেছে। গোপন কথা।
‘শ্রীমতী বারিধারা সেন, আজ আপনাকে এত খুশি খুশি লাগিতেছে কেন?’
‘শ্রীযুক্ত কমলকান্তি সেন মহাশয়, আজ আমার জীবনে একটি আনন্দের ঘটনা ঘটিয়াছে।’
‘মহাশয়া, আমার ধারণা, আজ আপনার কপালে ভালোমন্দ খাদ্যাদি জুটেছে।’
বারিধারা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, ‘কেন? আমি কি শুধু খাবার পেলে খুশি হই?’
কমলকান্তি বলেছিলেন, ‘না, তা নয়। খুশির পিছনে আরও কারণ থাকে। তবে তোকে যতটা চিনি, পছন্দের খাবার তোর খুশি হওয়ার একটা ইমপর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।’
বারিধারা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘যাও দাদু, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব না। আমাকে তুমি পেটুক বললে। তোমার সঙ্গে আড়ি।’
কমলকান্তি হেসে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে কথা বলতে হবে না। আজ কেন এত খুশি শুধু সেটা বল। এটা তো কোনও কথা নয়।’
বারিধারা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ওমা! এটা কথা নয়! এটা তবে কী?’
কমলকান্তি বলল, ‘এটা দাদু-নাতনির প্রেম।’
বারিধারা কমলকান্তির ইজিচেয়ারের পিছনে গেল। পিছন থেকে দাদুর গলা জড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘খুশির কারণ গোপন। তোমাকে বলা যাবে না।’
কমলকান্তি হাত নেড়ে বললেন, ‘তাহলে থাক বাবা। গোপন কথা শোনবার অনেক ঝামেলা। ফাইন দিতে হয়। মিশরীয় সভ্যতায় এই নিময় চালু ছিল। কেউ গোপন কথা শুনলে তার সাজা হত। জরিমানা দিতে হত। ওই সময় গোপন কথা বলার থেকে গোপন কথা শোনাটাই অপরাধ ছিল বেশি।’
বারিধারা বলল, ‘দুর যতসব বাজে কথা।’
‘না, সত্যি। এসব ছিল রাজাদের নিয়ম। রাজ্য শাসনের জন্য সর্বদাই গোপন শলাপরামর্শ করতে হত। সেই পরামর্শ যাতে কেউ না শুনতে চেষ্টা করে, তার জন্য এই নিয়ম চালু হয়েছিল।’
বারিধারা কমলকান্তির কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘আমার গোপন কথা শুনলে তুমি জরিমানা দেবে।’
কমলকান্তি বললে, ‘মোটেই না। সেই কারণে তো শুনতে চাইছি না। তুমি আনন্দে আছো, খুশিতে আছো এই যথেষ্ট। কারণ জেনে কী হবে।’
বারিধারা ঘুরে এসে কমলকান্তি সেনের সামনের চেয়ারে বসে পড়েছিল ধপ করে। এক গাল হেসে গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘দাদু, আজ আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কাটাকাটি হয়ে গেল। তাই এত আনন্দ।’
কমলকান্তি চোখ সরু করে নাতনির তাকিয়ে দিকে বললেন, ‘ভেরি গুড।’
বারিধারা ঝুকে পড়ে, আরও গলা নামিয়ে বলল, ‘তুমি কি সেই ছেলের নাম জানতে চাও?’
‘না, চাই না।’
বারিধারা বলল, ‘সেই ছেলের নাম শ্রবণ।’
কমলকান্তি সেন মনে মনে খুব মজা পেলেন। এই মেয়েকে তো সেদিন জন্মাতে দেখেছেন, এবার মেয়েটারও বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেল! চমৎকার! ভারী চমৎকার! এই জন্যই তো মনে হয়, আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকি। মনের মজা সেদিন মুখে প্রকাশ করেননি কমলকান্তি। বরং গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, ‘ছেলের নাম শ্রবণ না হয়ে শ্রাবণ হলে ভালে হত। বারিধারার সঙ্গে শ্রাবণ মানাত।’
বারিধারা হেসে বলল, ‘আর মানামানির প্রশ্ন ওঠে না। আমার সঙ্গে তো কাট। কেন কাট সেটা কি তুমি জানতে চাও দাদু?’
কমলকান্তি সেনের পেটের মধ্যে হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠল। এই মেয়ে তো বিরাট প্রেমে পড়ে আছে। প্রেমে পড়া মানুষই বেশি করে প্রেম ছাড়াছাড়ির গল্প বলতে চায়। যে ছাড়াছাড়ি তাদের কোনওদিনও হয় না।
‘না, আমি জানতে চাই না।’
বারিধারা দাদুর এই কথা পাত্তা না দিয়ে বলেছিল, ‘এই ছেলে অতি বোকা। ছবি আঁকে আর সর্বক্ষণ বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে বলে রোজ বুদ্ধি কমে। এত বোকার সঙ্গে আমার চলবে না। আজ তাকে বলেছি, গুডবাই।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ভেরি গুড। আমাদের মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টে এই ছেলের নাম ঢুকিয়ে দাও। তুমি কি আজ তার সঙ্গে দেখা করবে?’
বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন?’
কমলকান্তি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখা হলে তাকে জানিয়ে দিও, আমরা তার নাম লিস্টে রাখলাম। না জানিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।’
বারিধারা বলল, ‘আজ দেখা করব না। কাল করব। কাল বোকাটার সঙ্গে নাটক দেখব, আইসক্রিম খাব। এক ঘণ্টা হাঁটব। তারপর বিদায়। লাস্ট সাপারের মতো।’
কমলকান্তি হেসে ফেলেছিলেন।
এই ছেলেকে প্রজেক্টে নিতে হবে। গুণী ছেলে। দ্রুত সব ভেবে নিতে হবে। এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কমলকান্তি আবছা ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে মৃত নীহারিকা এলেন।
‘কেমন আছ নীহারিকা?’
‘ভালো নেই।’
‘সে কী, কী হয়েছে? ভালো নেই কেন? কী হয়েছে তোমার?’
‘আজকাল খুব একা লাগে।’
ঘুমের মধ্যেই কমলকান্তির মন খারাপ হয়ে গেল। এরকমটা হয় মাঝে মাঝে। মৃতা স্ত্রী কথা বলতে এলে মন খারাপ হয়ে যায়। আগে এরকম ছিল না। আগে ভালো লাগত। মনে হত, মেয়েটা কোথাও চলে যায়নি। তার সঙ্গে আছে। কথা বলছে, ভাবনাচিন্তা ভাগ করছে। এখন মন খারাপই বেশি হয়। যদিও কমলকান্তি সেই ভাব গোপন রাখেন। আজও রাখলেন।
‘একা লাগবার কী আছে নীহারিকা? এই তো আমার সঙ্গে কথা বলছ।’
নীহারিকা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কথা বলি, তার পরেও একা লাগে। মাঝে মাঝে খুব কান্না পায় জানো। তখন কাঁদি।’
কমলকান্তিকে অশান্ত লাগল। আহারে, সত্যি তো, নিজের লোকজন ছেড়ে আছে। কতদিন হয়ে গেল। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
‘এরকম করে না নীহারিকা। তুমি কষ্ট পেলে আমার যে কত খারাপ লাগে, সে কথা তুমি তো জানো। জানো না?’
‘জানি। ভাবি, তোমাকে এসব বলব না। তার পরেও বলে ফেললাম। কিছু মনে কোরো না। কোনও কোনও সময় নিজেকে সামলাতে পারি না।’
‘ছি ছি, এরকমভাবে বলো না। আমারও তোমার জন্য খুব মন কেমন করে নীহারিকা। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই। নিজেকে শান্ত করি। বোঝাই, এ সম্ভব নয়। এই বুড়ো বয়সে তো আত্মহত্যা করতে পারি না। যদি ইচ্ছামৃত্যু বলে কিছু থাকত, তাহলে হয়তো…।’
নীহারিকা বলেন, ‘বালাই ষাট। ওরকম বোলো না।’
কমলকান্তি বলেন, ‘বলি না নীহারিকা। এত বছর পরেও জীবনকে উপভোগ করবার চেষ্টা করি। ভালোবাসতে চেষ্টা করি। জীবন আসলে একেকটা বয়েসে একেকরকম। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া বয়েসে জীবন কেমন সেটাও একরকম অভিজ্ঞতা। আমার সৌভাগ্য নীহারিকা, অসুখ-বিসুখ আমার কম। কম কেন, বয়েসের তুলনায় নেই বললেই চলে। হয়তো রোগভোগের মধ্যে থাকলে এই বয়েসের জীবন বড় বিস্বাদ হত। শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। সে বেঁচে থাকা অভিশাপের মতো।’
নীহারিকা বললেন, ‘শুধু কি শরীর? তোমার চারপাশের মানুষ? তারাও যে বড্ড ভালো। তাদের মধ্যে থাকাটাই তো একটা বড় পাওনা।’
‘অবশ্যই নীহারিকা, অবশ্যই। এই বাড়িতে থাকবার জন্য আমি পদে পদে বুঝতে পেরেছি, বেঁচে থাকা শুধু শরীর নয়, মনও। সেই মন তৈরি হয় চারপাশ থেকে। একটা গাছ যেমন মাটি, আকাশ, জল থেকে তার বাঁচার রসদ খোঁজে, মানুষও তাই।’ একটু থামলেন কমলকান্তি। তারপর বললেন, ‘নীহারিকা তুমি যদি বাঁচতে, এই আনন্দ তুমিও উপভোগ করতে।’
নীহারিকা মৃদু হাসলেন যেন। বললেন, ‘তুমি যে পেয়েছ, তাতেই আমার পাওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া তুমি কাছ থেকে ওদের পাও, আমি দূর থেকে সবাইকে পাই। দূর থেকেই তাদের স্পর্শ করি।’
কমলকান্তি খুশি হলেন। নীহারিকা নিজেকে সামলে নিচ্ছে।
‘ঠিকই বলেছ। পাওয়াটাই আসল কথা। জীবন যেমন সব পাওয়াকে স্পর্শ করতে পারে না, এড়িয়ে চলে, হারিয়ে ফেলে, মৃত্যুও তেমন অনেক এড়িয়ে যাওয়া ভালোবাসা, দুঃখকে ছুঁতে পারে না। এই যে তোমার এই পৃথিবীর জন্য মন খারাপ হওয়া, সে তো খুব বড় পাওনা। বড় তৃপ্তি। মৃত্যু তো তাকে কাড়তে পারেনি। এ-ও এক আনন্দ। ভালোবাসার মানুষের জন্য মন খারাপ হওয়া খুব বড় প্রাপ্তি। একমাত্র মানুষই এই প্রাপ্তির অধিকারী। মৃত্যু তোমাকে বঞ্চিত করতে পারেনি।’
নীহারিকা অস্ফুটে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। এই জন্যই তোমার কাছে আসি।’
কমলকান্তি সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘জানো নীহারিকা, আমার নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দিয়েছি। একটু পরে রোদ উঠবে। আমার কী ভালো লাগছে!’
‘কতটা কাজ করলে?’
কমলকান্তি উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘মূল কাজটাই অনেকটা হয়ে গেছে। প্রজেক্টের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি।’
নীহারিকা খুশি গলায় বললেন, ‘বাঃ। এবার তাহলে হাতেকলমে শুরু হয়ে যাবে?’
‘অবশ্যই হবে। আজ একটু আগে খসড়া লিখে ফেললাম। এবার এটা ধরে এগোতে হবে। খসড়াটাই আসল কথা। ওটা ধরে এগোনো কোনও সমস্যাই নয়। আরেকটা বড় কাজ করেছি।’
নীহারিকা বললেন, ‘কী কাজ?’
কমলকান্তি মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘বলো তো।’
নীহারিকা বললেন, ‘আমার নামে যে টাকাপয়সা জমা আছে, সেই টাকা তুমি এই প্রজেক্টে লিখে দিয়েছ।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক বলেছ। ব্যাঙ্ককে জানিয়ে দিয়েছি। এবার থেকে তোমার টাকা খরচ হবে রোদ উঠবে প্রজেক্টের অ্যাকাউন্টে। শুধু টাকা নয়, ভুলাভেদার জমিটাও প্রজেক্টের নামে লিখে দিয়েছি। কেউ জানে না। খোঁজ নিলেই জানতে পারবে, সব খাতাকলমে করা আছে। আমার এই কাজে কে সাহায্য করবে জানো?’
নীহারিকা বলল, ‘জানি।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তাও জানো?’
নীহারিকা হেসে বললেন, ‘বাঃ, জানব না কেন? আমি কি তোমার বাড়ির বাইরের একজন হয়ে গিয়েছি নাকি? তোমাকে সব কাজে সাহায্য করছে মণিকুন্তলা।’
কমলকান্তি বললেন, ‘বড় ভালো পুত্রবধূ আমার। ছেলেটার মতো সিরিয়াস হওয়ার অসুখে ভোগে না। অথচ কত যত্ন করে সব কাজ করে দিয়েছে। আমি বারণ করেছি বলে কাউকেও বলেনি।’
কথাটা ঠিক, একটু পরে রোদ উঠবে প্রজেক্টের জন্য টাকা, জমির পাকা কাজ করতে মণিকুন্তলা শ্বশুরমশাইকে সাহায্য করেছেন। গোপনে উকিল, রেজিস্ট্রি অফিস, ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করেছেন। যেদিন শ্বশুরমশাই তাকে ডেকে প্রজেক্টের বিষয়ে বলেন, মণিকুন্তলা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে, খানিকটা সময় কথা বলতে পারেননি। কমলকান্তি বলেছিলেন, ‘কেমন ভেবেছি?’
মণিকুন্তলা উঠে গিয়ে শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করেছিলেন। খুব বড় মানুষ না হলে এমন একটা কাজের কথা কেউ ভাবতে পারে না। তার নিজেও লেখাপড়ার সাধ মেটেনি। ইচ্ছে ছিল, কলেজ পাস করবার পর আরও পড়বেন। সংসারের চাপে সব ভেস্তে গেছে। পড়তে কেউ আপত্তি করেনি। নিজে থেকেই আর সময় পাননি। দুই মেয়েকে বড় করা এত বড় সংসার সামলানোর পর আরও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সময় হল না। তার ওপর সংসারে শাশুড়ি নেই। ফলে, গৃহকর্ত্রীর হাল তাকেই ধরতে হল। এই সব শেষ করে, কী করে মাস্টার ডিগ্রি করবেন? কমলকান্তির কাছে রোদ উঠবে প্রজেক্ট শুনে আপ্লুত হয়ে গেলেন।
‘বাবা, আমি কি এখানে পড়তে পারব?’ লজ্জা লজ্জাভাবে জানতে চেয়েছিলেন মণিকুন্তলা।
কমলকান্তি প্রবল উৎসাহে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারবে। তবে এমএ, এমএসসি পড়ানো বা গবেষণা করাবার মতো কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো আমরা বানাতে পারব না মণিকুন্তলা। ইচ্ছে থাকলেও পারব না। পরে কী হবে জানি না, তবে এখনই যদি ওদিকে মন দিই, তাহলে আসল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে হবে। তবে তুমি অন্য কিছু পড়তে পারো। যে পড়া চিরাচরিত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নয়। যে পড়া হাতেকলমে শেখবার পড়া। আমরা তো ওখানে হাতের কাজ শেখবার ট্রেনিং সেন্টার খুলব।’
মণিকুন্তলা চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন, ‘সেটাই ভালো হবে বাবা। আমি আঁকা শিখব। পটচিত্র দেখলে আমার খুব হিংসে হয়। মনে হয়, ইস আমি যদি একটু আঁকতে পারতাম!’
কমলকান্তি বললেন, ‘বেশ তো, আঁকবে। কিন্তু তোমাকে ডেকেছি একটা গোপন কাজের জন্য।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘কী কাজ?’
কমলকান্তি গলা নামিয়ে বললেন, ‘জরুরি কাজ। এখন কেউ জানবে না।’
মণিকুন্তলা বললেন, ‘কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।’
কমলকান্তি বললেন, ‘আমি তোমার শাশুড়ির সব টাকাপয়সা এই প্রজেক্টের জন্য রেখে দিতে চাই। ঝাড়গ্রামের কাছে যে জমি আছে সেটাও। এই কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। সেই অর্থে তুমি হবে এই প্রজেক্টের প্রথম কর্মী।’
মণিকুন্তলা প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘দারুণ হবে! কী করতে হবে বলুন।’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘বাপরে, তুমি তো এখনই খুশিতে লাফাচ্ছ।’
‘লাফাব না। এরকম একটা দারুণ কাজের সঙ্গে প্রথমেই আমি যুক্ত হচ্ছি…এই সুযোগ ক’টা মানুষের জীবনে আসে?’
কমলকান্তি গাঢ় স্বরে বললেন, ‘তোমার মতো পুত্রবধূও ক’জন মানুষের বাড়িতে আছে, সেটাও একটা কথা মণিকুন্তলা। আমি সব না জানলেও এখনকার হালচাল কিছুটা জানি। এখনকার মেয়েরা মুখে আধুনিকতার বড়াই করে, আর চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকে, কখন শ্বশুরবাড়ির জমি, শাশুড়ির গয়না, জমানো টাকা পাব। আমি জানি না, এমন একজন পুত্রবধূকেও পাওয়া যাবে কিনা, সে হেলায় শ্বশুর-শাশুড়ির সম্পত্তি ত্যাগ করে। অথচ শ্বশুর-শাশুড়িকে কত হেলায় তারা ত্যাগ করে। বিয়ের পরদিনই স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়বার জন্য ছটফট করে। বলে, একসঙ্গে থাকাটা ওল্ড কালচার। মডার্ন সোসাইটিতে এসব চলে না। পরের বাড়ির মেয়ে কেন অন্য কোথাও মানিয়ে নেবে? জানো মণিকুন্তলা, আমিও এই ধারণায় বিশ্বাস করি। নিজের স্পেস চাই। একসঙ্গে থাকবার সিস্টেম ঠিক নয়। তবে আবার সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি, তাহলে টাকাপয়সা, জমিজমার ওপর দাবি করাও ঠিক নয়। হায়রে, আধুনিক মেয়েরা ওটাকে তাদের আধুনিক লিস্ট থেকে সরিয়ে রেখেছে। তুমি আলাদা। শাশুড়ির টাকাপয়সা, জমি কত অবলীলায় ছেড়ে দিচ্ছ। শুধু ছেড়ে দিচ্ছ না, প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দিচ্ছ। তোমার মতো মেয়ের পক্ষেই মানায়।’
মণিকুন্তলা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘এ আপনি কী বলছেন, বাবা! আমার অভাব কীসের? মায়ের টাকা এতবড় একটা কাজে লাগবে, এ তো আমাদের গর্ব। ছেড়ে দিচ্ছি কোথায়? আমিও তো আপনার এই কাজের একজন।’
কমলকান্তি বললেন, ‘শোনো মণিকুন্তলা। এখনই প্রজেক্টের কাজ কিছু হয়নি। ফলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। আমার চেনাজানা একজন ল’ইয়ারকে দিয়ে একটা লিখিতভাবে ব্যবস্থা করব। সেখানে বলা থাকবে, এই টাকা এবং এই জমি শুধুমাত্র ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ নামের প্রজেক্টের জন্যেই খরচ করা যাবে। এই কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’
কয়েক দিনের মধ্যেই কাজটা হয়ে গেল। বাড়ির কেউ জানতেও পারল না। এক কাজের দিনের দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে ল’ইয়ারকে দিয়ে লেখাপড়া হয়ে গেল।
নীহারিকা বললেন, ‘সত্যি মণিকুন্তলা খুব ভালো।’
কমলকান্তি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কথা হয়ে ভালোই হল। আমি ঠিক করেছি, ‘একটু পরে রোদ উঠবে’র একটা দিকে হেড হিসেবে ছোট নাতনিকে রাখব। কেমন হবে?’
নীহারিকা হেসে বললেন, ‘তুমি যা করবে সেটাই হবে। আমাকে বলবার দরকার নেই। তবে একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
নীহারিকা বললেন, ‘মন খারাপ করবে না তো?’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘তুমি মন খারাপ না করলে আমিও করব না।’
নীহারিকা বললেন, ‘তুমি যে ভাবছ সবাই তোমার এই কাজে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমনটা তো নাও হতে পারে। হতে পারে কেন, হবে না।’
কমলকান্তি বললেন, ‘ও এই কথা? এতে মন খারাপের কী আছে নীহারিকা? এটাই তো স্বাভাবিক। যাদের ভাবছি, তারা সবাই থাকবে না, আবার যাদের কথা ভাবছি না, যাদের জানি না, তাদের কতজন এই কাজে যোগ দিতে আসবে? মানুষটা আসল নয়। কাজটাই আসল।’
নীহারিকা বললেন, ‘বাঃ, খুব সুন্দর বললে তো।’
কমলকান্তি হেসে বললেন, ‘এর মধ্যে সুন্দর-অসুন্দরের কিছু নেই নীহারিকা। এটাই নিয়ম। মানুষ থাকে না, কাজ থাকে। এই যে তুমি নেই, তারপরেও তো তুমি এই প্রজেক্টে ভীষণভাবে আছ। আছ না? আবার আমি এখন আছি, কাল যদি না থাকি, তার পরেও প্রজেক্ট হবে।’
নীহারিকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি যাই তাহলে।’
‘তোমার কি মন খারাপ কমেছে নীহারিকা?’
নীহারিকা একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, কমেছে।’
কমলকান্তির ঘুমের মধ্যে যেভাবে এসেছিলেন নীহারিকা, সেভাবেই কমলকান্তিকে ছেড়ে চলে গেলেন। কমলকান্তি পরম নিশ্চিন্তে পাশ ফিরলেন।
এই ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন সেনবাড়ির প্রবীণতম মানুষ কমলকান্তি সেন। মারা গেলেন নিঃশব্দে এবং গোপনে। তার একটা হাত রইল ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ লেখা খাতার ওপর।