☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
ছত্রিশ
তিথির হাঁটু কাঁপছে।
যদিও হাঁটু কাঁপার মতো কোনও কথা মধুজা ম্যাডাম বলেনি। তারপরেও কাঁপছে। তিথির এই একটা সমস্যা। খুব অল্পতে সে নার্ভাস হয়ে যায়। কিছু হওয়ার আগেই নার্ভাস। ঘটনার আগে সাত-পাঁচ ভেবে ঘাবড়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই তার এই অসুখ। সেসব রাস্তায় ছেলেছোকরারা গল্পগুজব করত সেসব রাস্তা দিয়ে পারতপক্ষে স্কুলে যেত না। ছোট মফসসল শহর। সবাই সবাইকে চেনে। এত ভয়ের কিছু নেই। বাড়িতে বাবা, কাকা, খুড়তুতো দাদারা আছে। তাকে কেউ বিরক্ত করলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপরেও সাহস হত না। ঘুরপথে স্কুলে যেতে সময় লাগত। সে-ও ভি আচ্ছা। একবার কলেজ থেকে বাড়ি ফেরবার সময় বিরাট কেলেঙ্কারি করেছিল। সেই ঘটনা নিয়ে আজও সবাই হাসাহাসি করে।
সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত আটটা হয়ে গিয়েছিল। চারটে বত্রিশের গাড়িটা ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় ঝাড়া এক ঘণ্টা হাওড়ায় বসে থাকতে হল। তিথি ঠিকই করেছিল স্টেশন থেকে সাইকেল রিকশা নেবে। স্টেশন থেকে বাড়ি হাঁটাপথে মিনিট তেরো-চোদ্দো। ধীরে সুস্থে হাঁটলে পনেরো। বোসেদের পুকুরপাড় দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। সন্ধের পর তিথি ওদিক মাড়ায় না। স্টেশন থেকে বাড়ি এইটুকু পথের জন্য রিকশা নেওয়ার মানে নেই। তারপরেও কোনও কোনওদিন দেরি হলে নিয়ে নেয়। সেদিন স্টেশনের বাইরে এসে রিকশা স্ট্যান্ড ফাঁকা। ব্যাপার কী! যেখানে রিকশার ঠেলায় পথ হাঁটা যায় না, সেখানে একটাও রিকশা নেই কেন? স্টেশনের বাইরে ম্যাগাজিন নিয়ে বসে ‘বাচ্চুদা’। অনেকদিনের চেনা। তিথি এখান থেকে ম্যাগাজিন কেনে। আবার উলটেপালটে দেখে রেখেও দেয়। রান্না বা সিনেমার ভালো কোনও ইস্যু হলে ‘বাচ্চুদা’ নিজে থেকেই সরিয়ে রেখে দেয়।
‘কী হয়েছে বাচ্চুদা? রিকশা কই?’
‘দিদিমণি, আজ আর রিকশা হবে বলে মনে হয় না। কোথায় কে গোলমাল করেছে বলে থানায় তুলে নিয়ে গেছে। সবাই মিলে ছাড়াতে গেছে। না ছাড়লে গোটা রাত বসে থাকবে।’
তিথি মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই রে! আজ দেরি, আর আজই রিকশা নেই। অন্যদিন তো প্যাঁ পোঁ, প্যাঁ পোঁ করে কানের মাথা খেয়ে ফেলে।
বাচ্চুদা বলল, ‘নারীর মন পত্রিকায় এবার চিড়িংমাছের অনেকগুলো রেসিপি দিয়েছে, নেবে নাকি?’
তিথি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আজ থাক বাচ্চুদা।’
তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় নেমে এল তিথি। তার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। একেবারেই রাত হয়নি। রাস্তা লোকজনে ভর্তি। হাওড়া থেকে ট্রেন এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভিড় হবে। তারপরেও তিথির অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ কী? কারণ একটা লম্বা মতো লোক। ট্রেন থেকেই এই অচেনা লোকটা তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছিল। ট্রেনে ‘মেয়ে দেখা’ পুরুষমানুষ অনেক দেখেছে তিথি। গা সাওয়া হয়ে গেছে। মুখ ফিরিয়ে রাখলেই হল। কিন্তু এই লোক তার সঙ্গে স্টেশনে নেমেছে। সে যখন বাচ্চুদার সঙ্গে কথা বলছিল, তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনছিল। এই কারণে অস্বস্তি। একটু পরে তিথি বুঝল অস্বস্তি নয়, তার ভয় করছে। কারণ ঢ্যাঙা লোকটা মনে হচ্ছে, তার পিছু নিয়েছে। কী হবে? তিথি হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। লোকটাও মনে হয় স্পিড বাড়াল। তিথি এবারে নার্ভাস হয়ে গেল। তার বাড়ির এই পথটা একটু নির্জন। তার মানে এই নয় যে শুনশান। দোকান-টোকানও রয়েছে। চেনা দোকান। কোনও একটা দোকানে ঢুকে যাবে? ঢুকে কী বলবে? হাবিজাবি কিছু কিনবে? নাকি বলবে, ‘ও দাদা, ওই লোকটা আমাকে ফলো করছে। ওকে ধরুন।’ তারপর লোকজন বেরিয়ে এসে যদি সত্যি ধরে? মারধর শুরু করে যদি? যদি কেন, নিশ্চয় করবে। পাড়ার মেয়েকে অচেনা লোক সন্ধেবেলা ফলো করলে তাকে তো আর বসিয়ে রসগোল্লা খাওয়াবে না। কিন্তু তারপর? বিরাট একটা হইহুল্লোড় শুরু হয়ে যাবে। এখানে সবাই জেনে যাবে, তিথির পিছনে একটা লোক ঘুরঘুর করছিল তাকে ধরে ঠ্যাঙানো হচ্ছে। এইসব খবরে মানুষ মজা পায়। যাকে ধরা হয়েছে তাকে যেমন দেখতে চায়, যার পিছনে লেগেছিল তাকেও দেখবার জন্য ভিড় করে। ইস! মাগো! তিথি ঘামতে শুরু করল। না না, ওসব করা যাবে না। দাদাদের কাউকে ডেকে নেবে? মোবাইলে ধরবে? কিছু বলবে না। শুধু বলবে এসে আমাকে বাইকে নিয়ে যা। তারও উপায় নেই। দুজন দাদাই এখন বাইরে। তিথি মুখ ফ্যাকাশে করে আরও জোরে হাঁটতে শুরু করল। এবার একটা গলিতে ঢুকতে হবে। গলিটা সন্ধে হলেই নিঝুম হয়ে যায়। কী হবে? লোকটা তাকে ফলো করছে কেন? কিছু বলবে? খারাপ কথা নিশ্চয়। বাড়ি-টাড়ি চিনে যাওয়ার ফন্দি নেই তো। খবরের কাগজে প্রায়ই এরকম খবর থাকে। মেয়েদের বাড়ি চিনে যাওয়ার পর ওঁত পেতে থেকেছে। আচ্ছা, অ্যাসিড ট্যাসিড ছুড়বে না তো! হয়তো পুরোনো কোনও রাগ আছে। তাকে হয়তো কোনওসময় প্রেমপত্র দিয়েছিল। তিথি পাত্তা দেয়নি। গলিতে ঢুকে তিথি প্রায় দৌড়োতে শুরু করল। লোকটাও দৌড়োচ্ছে নাকি! তাই তো মনে হচ্ছে! কী ভয়ংকর!
‘অ্যাই মেয়ে, অ্যাই মেয়ে।’
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় লোকটা ডেকে উঠল। তিথির মনে হল ভয়ে মারাই যাবে। ওই তো বাড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে তিথি কোনওরকমে বাড়ির গেটের ওপর গিয়ে পড়ল। লোকটাও এসেছে।
‘অ্যাই, তুই শঙ্করের মেয়ে না? তোর নাম তো তিথি? আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি মন্টুমামা।’
তিথি আকাশ থেকে পড়ল। মন্টুমামা! দিল্লির মন্টুমামা!
মন্টুমামা পাশে এসে একগাল হেসে বলল, ‘অবশ্য তুই চিনবিই বা কী করে? লাস্ট দেখেছিস বারো বছর আগে। আমার কিন্তু তোকে ট্রেন থেকেই চেনা চেনা লাগল। আসলে ছোড়দির মুখটা পেয়েছিস তো। মনে হচ্ছিল ছোড়দি বসে আছে। একটু পরেই চিনে ফেললাম।’
তিথি স্বস্তি, আনন্দ, সাহস ফিরে পাওয়ায় ঢোঁক গিলে বলল, ‘মন্টুমামা আপনি এখানে!’
মন্টুমামা আরও হেসে বলল, ‘কেন, এখানে আসতে পারি না? তোরা তাড়িয়ে দিবি? কলকাতায় এসেছি। তোদের সারপ্রাইজ দিতে কাউকে না বলে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম স্টেশনে নেমে ঠিকানাটা একবার ঝালিয়ে নেব। কতদিন আগে এসেছিলাম। তোকে চেনবার পর মনে হল মজা করা যাক। চুপচাপ ভাগ্নিকে ফলো করে দেখি পৌঁছতে পারি কি না।’
তিথিও এক গাল হেসে বলল, ‘উফ! আর আমি ভেবেছিলাম…ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়ার জোগাড়।’
এই গল্প আজও চলে। কলেজে পড়া মেয়ে, নিজের পাড়ায় যদি এত নার্ভাস হয়ে যায় তা নিয়ে হাসিঠাট্টা চলবেই। তবে এখন হাসিঠাট্টার সিচুয়েশন নেই। এখন তিথির হাঁটু কাঁপছে।সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই অনলাইনে কিনুন
মধুজা রায় তাকে ঘরে ডেকে উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বলেছেন। তিথি বসবার পর তিনি একটু সময় চুপ করে থেকেছেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় কথা বলেছেন।
‘তিথি তুমি কি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে চাও না?’
এই কথা হাঁটু কাঁপার মতো কোনও কথা নয়। টিচাররা হামেশাই স্টুডেন্টকে এরকম কথা বলে। হয়তো কোনও একটা পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, অথবা নোটস তেমন হয়নি। আবার ক্লাস ফাঁকি দিলেও বলে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? আছে। মধুজা রায় যখন এ কথা বলে, তখন ছেলেমেয়েরা ভয় পাবে বই কী। এই মহিলার হাতে অনেক ক্ষমতা। তিনি এমন বলছেন মানে, হুমকি দিচ্ছেন।
তিথি কাঁপা গলায় বলল, ‘ম্যাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…আমি কি কোনও ভুল করেছি?’
মধুজা রায় চেয়ারে হেলান দিলেন। আজ তিনি মুখে মেকাপ দেওয়ার সময় সম্ভবত অন্যমনস্ক ছিলেন। মুখ আর গলার সঙ্গে রঙের পার্থক্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া বয়স কমানোর আয়োজন মুখে হলেও গলায় হয়নি। গলার চামড়া কুঁচকে গেছে। শীতের সময় মধুজা রায় গলা ঢাকবার জন্য রকমারি মাফলার পড়েন।
‘ভুল করোনি, ভুল করতে চলেছ।’
এই হেঁয়ালি ধরনের কথায় তিথি আরও নার্ভাস হয়ে গেল।
‘ম্যাডাম সত্যি আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কী করেছি?’
মধুজা রায় সামনে রাখা একটা কাগজ তুলে নিয়ে বললেন, ‘ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ছেলেমেয়ের গত কয়েকটা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখছিলাম। তোমার রেজাল্ট তো খারাপ নয় তিথি। আর একটু মন দিলে আরও ইমপ্রুভ করতে পারবে।’
তিথি ঠিক বুঝতে পারে না। মধুজা ম্যাডামের এই পরামর্শও কি হুমকি?’
মধুজা রায় গলা নরম করে বললেন, ‘ভালো রেজাল্ট না হলে ভালো কেরিয়ার করবে কী করে?’
তিথি মাথা নামিয়ে বলল, ‘চেষ্টা করব ম্যাম।’
মুখে বললেও তিথি অবশ্য জানে তার কেরিয়ারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সেই কেরিয়ার চাকরিবাকরি নয়, সেই কেরিয়ার বিয়ে। খুব শিগগিরই তার বিয়ে। ছেলের বাড়ির সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে। তিথির ফাইনাল পরীক্ষার ক’দিন পরেই তারিখ ঠিক হয়েছে। তিথি ইউনিভার্সিটিতে কাউকে এ কথা বলেনি। বারিধারাকেও নয়। এখন বলবেও না। বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েদের কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সমস্যা হয়। কেমন যেন আলাদা আলাদা হয়ে যায়। কলেজে পড়বার সময় ক্লাসে ভ্রমর নামে একটা দারুণ মেয়ে ছিল। সবার সঙ্গে মজা করত। হইচই করত। টেবিল বাজিয়ে গান করত, নাচত, ক্লাস কেটে সিনেমা যেত, কমনরুমে বসে সিগারেটও টানত। সব মেয়েরা ভ্রমরকে পছন্দ করত। এরা হল চারপাশ জমিয়ে রাখা মেয়ে। সব অনুষ্ঠানে ভ্রমরকে চাই। সেই মেয়ের একদিন দুম করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ব্যস, ভ্রমরও চুপ মেরে গেল, মেয়েরাও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। এখন সব গল্প নাকি তার সঙ্গে করে মজা নেই। ও নাকি এখন হবু বর ছাড়া কোনও মজাতেই মন দিতে পারবে না। কী বিশ্রী! ইউনিভার্সিটিতেও এই ঘটনা হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে কথাকলির বিয়ে হল। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে সবাই ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করল। তার মধ্যে নিরামিষ, আমিষ দু’রকমের ঠাট্টাই ছিল। মেয়েরা তো বলছিলই, ছেলেরাও কম যায়নি। কেউ জলের বোতল নিয়ে মাতাল দেবদাসের মতো অভিনয় করত। কেউ বলত, ‘ধুস তোর পাশে বসে আর লাভ নেই। নো চান্স।’ এইসব কারণেই বিয়ের কথা এখনই কাউকে জানাতে চায় না তিথি। তা ছাড়া একটা লজ্জার ব্যাপারও আছে। দিল্লির সেই মন্টুমামাই এই সম্বন্ধ এনেছে। সম্বন্ধ অতি লোভনীয়। ছেলে সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সে নিজেও যেমন লেখাপড়া করেছে, বউও চায় পড়াশোনা জানা। শুধু সুন্দরীর হলে হবে না, মেয়ের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি থাকা চাই। পাঁচজনকে যেন বলা যায়। ছেলে এখন পুনেতে আছে। এরপর মিডল ইস্টে কোথাও বদলি হবে। কুয়েত বা আবুধাবি। কোম্পানি মোটা বেতন, বাংলো, গাড়ি সব দেবে। ছেলের রসিকতা করবার শখ আছে। এর মধ্যে রাতে একদিন লুকিয়ে ফোন করেছিল। মোবাইলে অচেনা নম্বর দেখে দুবার লাইন কেটেও দেয় তিথি। তিনবারের বার ধারে।
‘তিথি কেমন আছ?’
‘আপনি কে?’
‘বলো তো আমি কে?’
তিথি ভয় পেয়ে আবার ফোন কেটে দেয়। ফের ফোন বাজে।
‘ফোন কেটে দিলে কেন তিথি?’
তিথি কড়া গলায় বলল, ‘আপনি কে?’
‘আমি তোমার বর। পুনে থেকে বলছি।’
তিথির বুক ধক করে ওঠে। পুনে থেকে ‘ও’ ফোন করেছে! কী ‘দুষ্টু’! নামটাও বলছে না।
‘কেমন আছো তিথি?’
তিথির ঘরে কেউ থাকে না। তারপরেও সে ঘরের চারপাশ ভালো করে দেখে ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথা থেকে?’
‘বলব কেন? বরেরা সব সময় হবু বউয়ের টেলিফোন নম্বর পেয়ে যায়। তার জন্য পরিশ্রম করতে হয় না।’
তিথির শরীরে এবার একসঙ্গে অনেকরকম কিছু হতে লাগল। লজ্জা, ভয়, ঝিমঝিমানি। এমন নয় সে কোনও দিন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেনি। বহুবার বলেছে। ইউনিভার্সিটিতেই ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। এই পুরুষ মানুষের গলা শুনে তা হলে কেন এমন হচ্ছে?’
‘তিথি, তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে ফোন করেছি।’
তিথির মজা লাগল। বলল, ‘কী কথা?’
‘তুমি যখন বিয়ের পোশাক-টোশাক কিনবে তখন মনে করে একটা জিনিস কিনো। এটা তুমি বাড়ির কারও হাতে ছেড়ো না। তারা না জানলেই ভালো।’
তিথি অবাক হয়ে বলল, ‘কী জিনিস?’
‘আসলে কী জানো তিথি, মিডল ইস্টে আমাদের কোম্পানির সবক’টা বাংলোতে সুইমিং পুল আছে। আমি যেটায় যাব সেটাতেও থাকবে। হট অ্যান্ড কোল্ড ওয়াটার সিষ্টেম।
তিথি খুব খুশি হল। নিজের বাড়িতে সুইমিং পুল সে শুধু সিনেমাতেই দেখেছে। এবার সত্যি সত্যি দেখবে।
‘তুমি কি সাঁতার জানো তিথি?’
তিথি বলল, ‘না জানি না।’
‘কোনও সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব। তুমি মনে করে অবশ্যই একটা সুইমিং কস্টিউম কিনে রাখবে। ওখানেও পাওয়া যাবে। কিন্তু সে আবার খোঁজ করতে করতে সময় নষ্ট। তার থেকে রেডি থাকাই ভালো।’
তিথি কিছু বলতে পারল না। তার লজ্জা করছে। সুইমিং কস্টিউম মানেই তো ছোট পোশাক। ইস!
‘বিকিনি হলে সবথেকে ভালো হয়। বিকিনি পরলে তোমার সুইম করতেও মজা, আমার শেখাতেও মজা।’
তিথির কান গরম হয়ে গেল। তার মনে হল, এই ছেলে যদি সামনে থাকত তা হলে সে পিঠে কিল মারত। বলত, ‘খুব আহ্লাদ না? বউকে বিকিনি পরিয়ে দেখবার খুব শখ হয়েছে না?’
এসব কথা কাউকে এখন বলা যায়? মধুজা ম্যাডাম কেরিয়ারের কথা বলছেন, চুপচাপ ঘাড় নাড়াই ভালো। তবে পরীক্ষায় ঠিকমতো পাস করতে হবে। নইলে বর বাবাজি খেপে যাবে। তার বিকিনিও চাই আবার এমএ ডিগ্রিও চাই। তবে বউ কাজকর্ম করবে না। বাড়িতেই থাকবে। ঘরসংসার করবে। সে-কথা ছেলের মা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। তিথির মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তার।
‘দেখুন দিদি, মাছে-ভাতের মতো আমার ছেলে হল পোস্তর বড়া আর চচ্চড়ির বাঙালি। বাইরে সে বাংলো পাবে, গাড়ি পাবে বেয়ারা বাবুর্চি পাবে, কিন্তু পোস্তর বড়া পাবে না। সেই জন্যই বিয়ে। তার খুব শখ মায়ের মতো বউও রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে। বউয়ের চাকরিবাকরির কোনও ব্যাপার নেই। ঘর সংসার করবে, গাড়ি চালিয়ে শপিংয়ে যাবে। বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি গেলে যত্ন আত্তি করবে। আমার হীরের টুকরো ছেলে এরকম বউ চায়। চাকরি করা বউ নয়, লক্ষ্মী বউ।’
তিথির মা গদগদ গলায় বলেছেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না দিদি, মেয়েকে আমি সব বাঙালি রান্না শিখিয়ে দেব। হাতে সময় আছে।’
এসব কথা বাইরে বলার কী আছে? মধুজা রায় যেমন কেরিয়ারে কথা বলছেন বলুন না।
মধুজা রায় সোজা হয়ে বসলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ভেরি গুড। তিথি, তোমার সঙ্গে আমি একটা জরুরি কথা বলব। জরুরি আর গোপন।’
আবার তিথির হাঁটু কেঁপে উঠল। ‘ধান্দা রায়’-এর মতো মানুষের গোপন কথা মানে নিশ্চয় খুব ভয়ের।
গোপন কথা বলবেন বলে মধুজা রায় খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তিথির ভয় বাড়ছে। ‘গোপন কথা’ ব্যাপারটা যেমন ইন্টারেস্টিং তেমন ভয়েরও। ভালো মানুষ বললে ইন্টারেস্টিং। পাজিরা বললে ভয়ের কথা হয়। ‘ধান্দা রায়’ ম্যাডাম পাজি মানুষদের দলে। তবে আর এক রকম ‘গোপন কথা’ও আছে। সেইকথা শুনলে ‘মুখ লাল’ করে দৌড়ে পালাতে হয়। সেইরকম গোপন কথাও তিথি একবার শুনেছে। তখন ক্লাস এইট। মামাতো দাদার বন্ধু মিন্টুদা তাকে ‘গোপন কথা’ বলেছিল। সেই ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে আছে তিথির। কারণ সেই ‘গোপন কথা’ ভয়ঙ্কর। গা ছমছমে।
গরমের ছুটিতে কাঁকিনাড়ায় মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল তিথি। খুব মজা হল। মামাতো দাদা সবে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে। বিরাট কোনও বয়সের পার্থক্য নয়। অনেকটা বন্ধুর মতোই। দাদার বন্ধুরা সেরকম। সবার কাছেই তিথি সহজ। এক দুপুরে মিন্টুদা এল। তিথি তখন বারান্দায় বসে মামিমার করা লেবু আচার খাচ্ছিল।
‘তিথি, তোর দাদা কোথায়?’
তিথি বলল, ‘ঘুমোচ্ছে। দাঁড়াও ডাকছি।’
মিন্টুদা কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘দাঁড়া ডাকতে হবে না। অ্যাই শোন, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।’ তিথি তখন আরও বোকা ছিল। কাউকে সন্দেহ করত না। মিন্টুদাকে করার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। অবাক হয়ে বলল, ‘কী কথা মিন্টুদা?’
মিন্টুদা এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখানে বলা যাবে না। ছাদে চল, ছাদে গিয়ে বলব। গোপন কথা।’
তিথি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এখানেই বলো না। এই রোদে ছাদে কেন?’
মিন্টু চাপা গলায় বলল, ‘এই বিকেলে রোদ কোথায়? তুই ছাদে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।’
তিথি কৌতূহল নিয়ে ছাদে গেল। ছাদের একপাশে, যেদিকটায় ছায়া পড়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে মিন্টুদা সিগারেট খাচ্ছিল। তিথিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল। কাছে গিয়ে তিথি বুঝল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। মিন্টুদার মধ্যে কেমন যেন ছটফটে ভাব। কী হয়েছে?
মিন্টুদা বলল, ‘কাউকে বলবি না?’
তিথি একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী কথা বলবে তো মিন্টুদা।’
মিন্টুদা বলল, ‘আর একটু সরে আয়।’
তিথি অবাক হল। তার ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি হল। মেয়েদের এই একটা গুণ। তাদের ভিতরে একজন কেউ থাকে যে সতর্ক করে। কিন্তু মিন্টুদাকে তো অনেকদিন ধরেই চেনে। খুব ভালো ছেলে। লেখাপড়ায় ভালো। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছে। ডাক্তারিতে চান্স পাবে। তবে শুধু বই মুখে থাকা টিপিক্যাল ‘গুডবয়’ নয়। খেলাধুলো করে, গল্প উপন্যাস পড়ে, নাটকের বই পড়ে। মামাবাড়ির সবাই মিন্টুদাকে পছন্দ করে। তিথিও করে। তাকে নানারকম বই পড়তে দিয়েছে। তার আজ হঠাৎ কী হল! তিথিকে একলা ছাদে ডেকে পাঠাল কেন? তাকে কাছে যেতেই বলছে কী জন্য?
তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এখান থেকেই বলো।’
মিন্টুদা হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘তোর মামিকে একটা কথা বলতে হবে।’
‘কী কথা?’
মিন্টুদা ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলবি তাদের ছেলে বাজে কিছু লোকের পাল্লায় পড়েছে।’
‘দাদা, দাদার কথা বলছ?’
মিন্টুদা ঠোঁটে হাত দিয়ে বলল, ‘শ শ। হ্যাঁ তোর দাদা। যে লোকগুলো তাকে ধরেছে, তারা তোর দাদাকে নানারকম ভুল বোঝাচ্ছে। পথে নামাতে চাইছে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, শুনছে না। বলছে এসব রাজনীতির বিষয়। আমার নাকি মাথায় ঢুকবে না। আমার ভয় করছে, এভাবে চলতে থাকলে, তোর দাদা বড় কোনও গোলমালে ঢুকে পড়বে। পুলিশ ধরেও নিয়ে যেতে পারে। লোকগুলো ভালো না। নিজেদের ধান্দায় মানুষকে তাতাচ্ছে। আমাকেও বলতে এসেছিল। হাটিয়ে দিয়েছি।’
তিথির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। মিন্টুদা কী বলছে এসব! দাদাকে পুলিশে ধরতে পারে। এর মানে কী?
‘মিন্টুদা, তুমি বলো।’
মিন্টুদা গলা নামিয়ে বলল, ‘এইটা পারব না। তোর দাদা, আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছে। ও যে পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে, সেটা ওর বাবা-মাকে আমি বলতে পারব না। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম, তোর মামিমাকে উড়ো ফোন করব? তোর মামার নামে বেনামে চিঠি লিখব? তোকে আজ দেখে চট করে মাথায় বুদ্ধিটা এসে গেল। তুই তো কাল বাড়ি ফিরে যাবি। যাবার আগে মামিমাকে বলে দে। বলবি, তোর কথা যেন না বলে। দেরি হয়ে গেলে বিপদ হয়ে যেতে পারে।’
তিথির মনে হল, সে কেঁদে ফেলবে। কোনও রকমে বলেছিল, ‘কী বলব?’
‘বলবি, দাদা কিছু বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছে। এখনই আটকাও।’
‘মামিমা যদি জানতে চায়, কে বলেছে?’
মিন্টুদা একটু ভেবে মাথা চুলকে বলল, ‘বলবি… বলবি তুই ওর বন্ধ দরজার বাইরে থেকে টেলিফোনের কথা শুনেছিস।’
তিথি বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কথা শুনেছি! আড়ি পেতে কথা শুনেছি? কী কথা?’
মিন্টুদা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘বলবি…। কাকে যেন বোমা-টোমার কথা বলছিল। এইটুকু মিথ্যে না বললে কিন্তু তোর দাদাকে বাঁচানো যাবে না তিথি। একদিন খুব বড় রকমে ফেঁসে যাবে।’
তিথি এরপর আর ছাদে থাকতে পারেনি। এই ‘গোপন কথা’ শুনে ভয়ে মুখ লাল করে দৌড়ে নেমে পড়েছিল। তবে মামিমাকে কিছু বলতে হয়নি। সেদিন মামা অফিসেই কার কাছ থেকে ছেলের নামে খবর শুনে এসেছিল। সে নাকি পলিটিক্সের নামে যারা বোমা মারে, আগুন ধরায়, মানুষ মারে তাদের দলে নাম লিখিয়েছে।
এইরকম গোপন কথাও তো আছে। মধুজা রায়ের কথা নিশ্চয় সেরকম নয়। কী বলবেন?
একটু সময় চুপ করে রইলেন মধুজা রায়। সম্ভবত মনে মনে ঠিক করে নিলেন, কীভাবে শুরু করবেন। তারপর তিথির চোখে চোখ রেখে চাপা গলায় বলতে শুরু করলেন।
‘তিথি, সেদিন কী হয়েছিল?’
তিথি অবাক হয়ে বলল, ‘কোনদিন ম্যাডাম?’
মধুজা রায় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘সে কী! তোমাকে নিয়ে এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, আর তোমারই মনে পড়ছে না!’
তিথি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে নিয়ে কী কাণ্ড হয়েছে!’
মধুজা আবার চুপ করলেন। এতক্ষণ টেবিলের কাছে এসে কথা বলছিলেন, এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! তোমার ব্যাপার তোমারই মনে নেই! যাক, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুদর্শন নামে ছেলেটার সঙ্গে তোমার গোলমাল হয়েছিল। কী গোলমাল?’
তিথি এবার বুঝতে পারল। কিন্তু সে ঘটনা তো নিজেই ভুলে গেছে। ম্যাডাম জানলেন কী করে? তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে এটা নিয়ে তো কোনও কাণ্ডই হয়নি। নাকি তার আড়ালে কিছু হয়েছে? ছি ছি। ব্যাপারটাই এত নোংরা, জানাজানি হলে লজ্জার শেষ থাকবে না।
‘কী হল চুপ করে আছ কেন তিথি? গোলমালটা কী হয়েছিল?’
তিথি অস্ফুটে বলল, ‘ম্যাডাম, সেসব তো মিটে গেছে।’
মধুজা রায় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মিটে গেছে! তোমার সঙ্গে ওই ছেলের কোনও ঝামেলা হয়নি?’
তিথি বলল, ‘আমি কোনওরকম ঝামেলায় থাকি না।’
মধুজা রায় ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসলেন। তাহলে তার খবর ঠিক। তিথি মেয়েটি নার্ভাস প্রকৃতির। শুধু নার্ভাস নয়, ভীতুও।
ডিপার্টমেন্টের দুজন মেয়েকে ডেকে খোঁজ নিয়েছেন। দুজনেই একই কথা বলেছে। কথাকলি আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে আলাদা আলাদা করে ডেকেছিলেন।
‘তোমাদের ইয়ারের একজন ডাকাবুকো মেয়ের নাম বলো তো। দিল্লিতে একটা সেমিনার হচ্ছে, সেখানে পাঠাব। মিনমিনে টাইপ হলে হবে না।’
কথাকলি বলেছিল, ‘আমি যেতে পারি ম্যাডাম। আমি তো কলেজে ডিবেটে ফার্স্ট হতাম।’
মধুজা বললেন, ‘এটা কলেজ নয়। ডিবেটও নয়। সেমিনারের পর অডিয়েন্সের কোয়েশ্চেন ফেস করতে হবে। তারা চেপে ধরবে। শুনেছি, তিথি নাকি বেশ সাহসী মেয়ে।’
কথাকলি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘তিথি! না না ম্যাডাম। ওই মেয়ে খুব ভীতু। দিল্লি যাবে কী, আমাদের সঙ্গে নন্দন পর্যন্ত যেতেই ভয় পায়।’
পরে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ডেকেও কথাটা যাচাই করে নিলেন মধুজা রায়। যাকে ভয় দেখাবেন, সে কতটা সাহসী সেটা তো জেনে নিতে হবে। কৃষ্ণকলিকে অন্য কায়দায় জিগ্যেস করলেন।
‘ডিপার্টমেন্টের ক’জন স্মার্ট মেয়ের নাম বলো তো কৃষ্ণকলি। দিল্লিতে একটা ইউথ প্রাোগ্রামে পাঠাব। সেমিনার টেমিনার হবে। ওরা ছেলেমেয়েদের নাম চাইছে। প্রাোগ্রামের দেরি আছে, তবে এখন থেকে নাম পাঠাতে বলছে। তিথি কেমন হবে?’
কৃষ্ণকলি বলল, ‘খুব খারাপ হবে ম্যাডাম। ওর মতো ক্যাবলা, নার্ভাস মেয়ে এই ডিপার্টমেন্টে আর একজনও নেই। আর যাদেরই আপনি টিমে নিন, তিথিকে নেবেন না।’
মধুজা রায় খুশি হলেন। তিনি যেমন যেমন চাইছিলেন, তিথির মধ্যে তার সবক’টা গুণই আছে।
‘তুমি কোনও ঝামেলায় থাকো না শুনে আমার খুব ভালো লাগল তিথি। একজন ভালো স্টুডেন্টের সেটাই হওয়া উচিত। সে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। কেরিয়ার করতে আসে। ঝামেলা করতে আসে না। আমি বুঝতে পারছি, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হবে। তুমি নিজের মতো চেষ্টা করো, বাকিটা তো আমি রইলাম।’
এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও তিথির মনটা খুশি খুশি হল। মধুজা ম্যাডাম পাজি হলে কী হবে, ক্ষমতা প্রচুর। উনি যদি সঙ্গে থাকেন পরীক্ষায় অনেক সুবিধে। আর ভালো রেজাল্ট হলে তো কথাই নেই। বর নিশ্চয় খুব খুশি হবে। তাকে যখন সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে, তখন বলবে, ‘এই আমার স্ত্রী তিথি। মেয়ে খুবই ভালো। শুধু রূপে-গুণে নয়, লেখাপড়াতেও এক নম্বর। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে।’ তিথির শুনতে খুব ভালো লাগবে। তার নিজের জন্য নয়, বরের জন্য ভালো লাগবে। সে বিশ্বাস করে, বিয়ের পর মেয়েদের নিজের সুখদুঃখ বলে কিছু থাকে না। স্বামীর সুখদুঃখই বউয়ের সুখদুঃখ।
মধুজা রায় এক মুখ হেসে বললেন, ‘ভেরি গুড। এই তো একটা ভালো স্টুডেন্টের মতো কথা। ভালো ছেলেমেয়েদের অন্য কোনও ঝামেলায় থাকতে নেই। তাদের একটাই ঝামেলা, কীভাবে রেজাল্ট ভালো করা যায়। আমি যত তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তত খুশি হচ্ছি তিথি। কিন্তু আমাকে তো একটা কথা তোমাকে বলতে হবে মাই ডটার।’
তিথি বলল, ‘কী?’
‘সুদর্শন সেদিন অনেকের সামনে তোমাকে কী বলে অপমান করেছিল?’
তিথির কান লাল হয়ে গেল। এখন এসব আলোচনা কেন? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। দুদিন পরে তার বিয়ে, এই সময় তাকে নিয়ে কোনও খারাপ ছেলে কী নোংরা কথা বলেছে, সেটা নিয়ে চর্চার কী প্রয়োজন?
মধুজা ম্যাডাম বোধহয় ছাত্রীর লজ্জা, ভয় বুঝতে পারলেন। তিনি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
‘তিথি, আমার জানা দরকার। তুমি আমার কাছে সংকোচ কোরো না। তুমি হয়তো জানো, ঘটনাটা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে একটা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা হচ্ছে। তোমার বন্ধুরা করছে, কয়েকজন মাস্টারমশাইও করছে।’
তিথির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নোংরা কথাটা নিয়ে তার আড়ালে আলোচনা হচ্ছে! সে কাঁপা গলায় বলল, ‘সে কী! আমি তো কিছুই জানি না।’
মধুজা ম্যাডাম বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ‘যারা ঘোঁট পাকায়, তারা এরকমই হয়। যাকে নিয়ে সমস্যা, সে জানতেও পারে না। তোমার মতো ভালো মেয়ে এসব বুঝবে না।’
তিথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি কিছু জানি না ম্যাডাম। আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম।’
মধুজা রায় বললেন, ‘তুমি বলোনি হয়তো, কিন্তু সেদিন যারা কথাটা শুনেছিল, তারা গোলমাল পাকাতে চাইছে। হয়তো ভাইস চ্যান্সেলর পর্যন্ত বিষয়টা যাবে। তখন একটা হুলুস্থুলু হবে।’
তিথির মনে হল, সে কেঁদে ফেলবে।
‘ম্যাডাম, আপনি আমাকে বাঁচান। আমাকে জড়িয়ে কোনও কিছু আমি চাই না।’
মধুজা রায় এই কথাটার জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তো তোমাকে বাঁচাতে চাই। সেই জন্যই তো তোমার রেকর্ড দেখেছি, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি, তোমাকে বললামও, তুমি ভুল করছ। কথাটার মানে কী? কথাটার মানে হল, তোমার উচিত ছিল, আমার কাছে এসে সবটা বলা। উচিত ছিল কিনা?’
‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম।’
মধুজা ম্যাডাম নরম গলায় বললেন, ‘যাক, ভুল হয়েছে। এবার ভুল সংশোধন করো। আমাকে সব বলো। ওই বদ ছেলে তোমাকে কী বলেছিল?’
তিথির এখন আর মধুজা ম্যাডামকে অত খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, ইনি সত্যি তাকে সাহায্য করতে চান।
‘খারাপ কথা ম্যাডাম।’
মধুজা রায় চোখ সরু করে থমথমে গলায় বলেছিলেন, ‘আমি শুনতে চাই।’
তিথি ঢোঁক গিলল। পিছনের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। মধুজা রায় বললেন, ‘বলো তিথি। আমাকে সংকোচ কোরো না। আমি তোমার দিদির মতো। আমার জানা দরকার।’
তিথি মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘সুদর্শন আমাকে সেদিন অনেকের সামনে বলেছিল, তোর মুখটা খুব সুন্দর। বুকটাও কি এত সুন্দর? আমরা কি দেখতে পারি?’
কথাটা বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল তিথি।
অপমানের কান্না।
মধুজা রায় খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিথিকে কাঁদতে দিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি যদি ওই বদ ছেলেটাকে কড়া শাস্তি দিই, তুমি খুশি হবে।’
তিথি মুখ তুলে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি কিছু চাই না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এই ঘটনাটা নিয়ে শোরগোল হলে বিয়ে ভেঙে যাবে।’
মধুজা রায় খানিকটা থমকে গেলেন। পরক্ষণেই এক গাল হেসে বললেন, ‘বাঃ দারুণ খবর। কনগ্র্যাচুলেশন।’
তিথি নাক টেনে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ও চায় আমি যেন ভালো করে পাস করি। আমাকে নিয়ে এসব বিশ্রী ঘটনা ঘটলে হয়তো…।’
মধুজা রায় বললেন, ‘ভেরি, ভেরি গুড। খুব খুশি হলাম।’
তিথি বলল, ‘আপনি এসব গোলমাল আটকান ম্যাডাম।’
মধুজা রায় চিন্তিত হওয়ার ভান করে বললেন, ‘আটকাতে তো হবেই। এখন যদি ইউনিভার্সিটিতে এটা একটা ইস্যু হয়, তাহলে সকলে তো জানতে চাইবে, ওই বদ ছেলে তোমাকে কী বলেছিল। সেটা খুব খারাপ হবে। আমি যদি ইউনিভার্সিটি থেকে সুদর্শনকে সাসপেন্ড করবার ব্যবস্থা করি, তাহলেও তো সমস্যা তিথি। সবাই কারণ জানতে চাইবে। আর যদি ছাত্রছাত্রীরা গোলমাল করে তাহলে তো মিটিং, মিছিল হবে, পোস্টার পড়বে। কাগজে, টিভিতে দেখাবে। তোমার ছবি দেখাবে।’
তিথি আঁতকে উঠল। কাতর গলায় বলল, ‘একটা কিছু করুণ ম্যাডাম।’
মধুজা রায় খানিকক্ষণ চোখ বুজে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমি যা বলব, তুমি করতে পারবে তিথি?’
তিথি বলল, ‘আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।’
মধুজা রায় বললেন, ‘তাহলে কাগজ, পেন নাও। যা বলছি লিখে সই করো।’