» » চতুর্থ কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

তেত্রিশ

হাম্বা, হাম্বা, হাম্বা…

বারিধারার মোবাইলে শ্রবণের মেসেজ ঢুকেছে। তবে আজ গরুর গলাটা একটু কাঁপা। বারিধারা ভুরু কোঁচকাল। গলা কাঁপা কেন? গরুর কী হল? কোনো সমস্যা হয়েছে?

বারিধারা নিজের ঘরে। দাদুর কাছ থেকে এসে তার মন ভালো হয়ে আছে। মন ভালো হওয়ার কারণ দুটো। এক নম্বর কারণ, মধুজা রায়ের সঙ্গে আজ তার একটা হেস্তনেস্ত হবে। আর দু-নম্বর কারণ, দাদুর নতুন প্রজেক্ট ‘একটু পরে রোদ উঠবে।’ এই প্রজেক্টে যেসব অসহায়, গরিব মেয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে বাধা পায়, তারা আসবে। লেখাপড়া শিখবে। হাতের কাজ শিখবে। সেই জিনিস বিক্রি করে নিজেরাই নিজেদের খরচ জোগাড় করে নেবে। ফ্যানটাসস্টিক! দাদুর ঘর থেকে বেরিয়েই বারিধারা ঠিক করে ফেলেছে, ইউনিভার্সিটির পাট চুকে গেলেই সে ‘একটু পরে রোদ উঠবে’ প্রজেক্টে ফুলটাইম ঢুকে যাবে।

মধুজা ম্যাডামের ঘটনা নিয়ে দাদু যে প্ল্যান দিয়েছে, সেটাও ভালো। এই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করলে ম্যাডাম রেগে ফায়ার হয়ে যাবেন, অথচ কিছু বলতে পারবেন না। ম্যাডাম রেগে গেলে তার এফেক্ট অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। পরীক্ষার রেজাল্ট থেকে শুরু করে পি এইচ ডি, কেরিয়ার সব ঘেঁটে যেতে পারে।

বারিধারা ভালো করেই জানে কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্রছাত্রী, গবেষক, পার্টটাইম টিচার, ফুলটাইম টিচারদের ঘেঁটে দেওয়ার নানারকম সিস্টেম চালু আছে। যারা মনে করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটা বিরাট পবিত্র, সৎ জায়গা—তারা অনেকেই এইসব সিস্টেমের খবর জানে না। হিডেন সিস্টেম। চোরাগোপ্তা কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে গবেষকদের পারফরমেন্সের থেকে খুশি করবার ওপর নম্বর বেশি। ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটরের হাতে প্রশ্নপত্রের সেট থাকে। সবক্ষেত্রে না হলেও কিছুক্ষেত্রে তো প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটরকে তেল দিতে হয়ই। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। সব অপরাধ প্রমাণ হয়, ‘তেল অপরাধ’ প্রমাণ হয় না। শুধু কলেজ ইউনিভার্সিটির নম্বর বাড়ানো কেন, জীবনের সবক্ষেত্রেই সাকসেসের পিছনে তেলের বিরাট ভূমিকা। বাঙালি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে রান্নার তেলের ব্যবহার কমাচ্ছে, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। তেল ঢাললে হড়াৎ করে সবাইকে টপকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটিতে তেল দেওয়াকে ছেলেমেয়েরা বলে ‘এক্স’ পেপার। বারিধারা যতই মেধাবী ছাত্রী হোক সে জানে, পার্স্ট পেপার সেকেন্ড পেপারের সঙ্গে ‘এক্স’ পেপারেও নম্বর তুলতে হয়। সেমিস্টারের বেলাতেও তাই। কলেজের বেলায় সাজেশন পাওয়ার ব্যাপার থাকে। প্রশ্ন কে করেছেন? মডারেশন কার হাতে? কার টিউশনে সাজেশন মেলে—ছেলেমেয়েদের জানতে হয়। নইলে গেলে। পরীক্ষা সৎ ব্যাপার। টোকাটুকি করে ধরা পড়লে সাজা। কিন্তু যে টিচার টিউশন করে সাজেশন মিলিয়ে দেন, তিনি হলেন ‘মহামতি পরীক্ষাশ্রী’। সবার শ্রদ্ধেয়। সবার প্রণম্য। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে ছবি টাঙিয়ে রাখে। সাজেশন মেলে কী করে? পরীক্ষা ভগবান কি বাছা বাছা টিচারদের স্বপ্নে সাজেশন পাঠিয়ে দেন? তাই হবে। বারিধারা অনকে ভেবেও এসবের উত্তর পায়নি।

তবে বারিধারা জানে, এরাই সব নয়। সে তার জীবনে অনেক ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকা পেয়েছে। তারা দারুণ। শুধু বিদ্যা বুদ্ধি বা পড়ানোতে দারুণ নয়, ব্যবহারেও দারুণ। সবাইকে সমান চোখে দেখে। তারা ছেলেমেয়েদের শ্রদ্ধার মানুষ। এদের মেরুদণ্ড শক্ত। এরা কোনওরকম পার্সিয়ালটি নয়, ছাত্রছাত্রীদের সত্যিকারের লেখাপড়াকে ভালোবাসেন। নিজেরা লেখাপড়া করেন। তাদের ডিপার্টমেন্টের কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দম সেনগুপ্ত তো এরকমই। কল্যাণ সমাজপতি ফাঁকিবাজ মাস্টারমশাই। ধরে-বেঁধে ক্লাস করাতে হয়, নোটিস দেখাতে হয়। কিন্তু একেবারে খাঁটি। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে হানা দিলেও বিরক্ত হন না।

তবে ভালোরা বেশিরভাগ জায়গাতেই কোণঠাসা। শুধু ছেলেমেয়ে নয়, ভালো টিচারদের ওপরও ঝামেলা করা হয়। কলেজে পড়বার সময়ও বারিধারাকে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের ডিপার্টমেন্টে সুমনা সেন নামে এক অধ্যাপিকাকে কয়েকজন টিচার মিলে খুব হেনস্থা করত। সুমনা ম্যাডামের দোষ, তিনি ভালো পড়াতেন। ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ছিলেন। তাদের নিয়ে নাটক, ডিবেট, সেমিনার করতেন। রুটিন যাতে ঠিকমতো হয়, ক্লাস যাতে নিয়মিত হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া যাতে বেশি করে হয় তার জন্য সবসময় বলতেন। কয়েকজন মাস্টারমশাই তার পিছনে লেগে গেল। সুমনা ম্যাডাম একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন। যদিও ক্লাসে সেই মত কখনওই আনতেন না। সেটা নিয়েও অন্য টিচাররা ঘোঁট পাকাতেন। ছেলেমেয়েরাও সে খবর জানত। নোংরা মানুষকে সবাই ছি ছি করে। পুলিশ এলে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এসব জায়গার নোংরা লোকগুলো স্টেজে বসে মালা পায়। তার পরেও কলেজ, ইউভার্সিটিগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকা আর ছাত্রছাত্রীদের জন্য। তাদের শক্তি এত বেশি হয় যে, খারাপ লোকগুলো হাজার চেষ্টা করেও তাদের দমাতে পারে না। সাময়িকভাবে হয়তো কিছুদিন রাজত্ব করে। শেষ পর্যন্ত হারতে হয়।

বারিধারা ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট পরা হয়ে গেছে। টেবিল ঘেঁটে ব্যাগে বই-খাতা নিচ্ছে। বারিধারা বই-খাতা না নিয়ে কখনও ইউনিভার্সিটিতে যায় না। বন্ধুরা ঠাট্টা করে।

শমজিতা বলে, ‘তুই কি এখনও স্কুলে পড়িস বারি? গাদাখানেক বই-খাতা আনিস কেন?’

বারিধারা বলে, ‘মনে হয় স্কুলে পড়ি।’

স্বয়ংদ্যুতি বলে, ‘আমরা তো একটা কয়েকটা সাদা পাতা নিয়ে আসি। নোটস নিয়ে ফাইলে ক্লিপ করে রাখি।’

বারিধারা গম্ভীর গলায় বলে, ‘আমি অবশ্য তা করি না। খাতায় নোটস টুকি, তারপর বাড়ি যাওয়ার সময় ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিই।’

তিথি বলে, ‘বেশি স্মার্ট হতে চেষ্টা করিস না বারি। ইউনিভার্সিটিতে এত বই-খাতা আনা একটা ছেলেমানুষি হ্যাবিট। তুই ভালো স্টুডেন্ট হতে পারিস, কিন্তু ছেলেমানুষি করবার অধিকার নেই।’

বারিধারা বলে, ‘আমারও তাই মনে হয়। কী করব বল, ইউনিভার্সিটিতে আসবার সময় বই-খাতা না নিয়ে বেরোলে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মনে হয়, প্রপার জামাকাপড় পরিনি।’

শমজিতা চোখ টিপে হেসে বলে, ‘কী মনে হয়? ন্যুড হয়ে এসেছিস?’

সবাই খিলখিল আওয়াজে হেসে ওঠে। বারিধারাও হাসে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘তাতে তোর কী সুবিধে হবে শমজিতা?’

স্বয়ংদ্যুতি বারিধারার কাঁধ চেপে বলে, ‘বুঝতে পারছিস না? তাহলে ও সাহস পাবে। পরদিন থেকে ও কিছু না পরে ক্লাসে যাবে।’

তিথি গলা নামিয়ে চোখ বড় করে বলল, ‘সত্যি যদি এরকম একদিন হয়, কী হবে বল তো?’

বারিধারা তিথিকে নকল করে চোখ বড় করে বলল, ‘কী হবে তিথিরানি?’

‘আমরা মেয়েরা যদি সবাই একদিন ইয়ে হয়ে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকি।’

শমজিতা গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘কী আর হবে? যারা দেখবে তারা জ্ঞান হারিয়ে ধড়াস ধড়াস করে পড়ে যাবে।’

তিথি বলল, ‘সবাই মোবাইল বের করে ফটাফট ছবি তুলতে থাকবে। তারপরে ফেসবুকে লোড করবে।’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘বাকিটা বল। ভিসি পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করাবে।’

বারিধারা বলল, ‘এ আর এমন কী? পৃথিবীতে বহু জায়গায় ন্যুড অ্যাজিটেশন হয়। টিভিতে দেখায়। কাগজে ছবি বেরোয়। মেয়েদের ওপর অপ্রেশনের বিরুদ্ধে এই ধরনের অ্যাজিটেশন একটা কমন ব্যাপার। এতে সবার নজর পড়ে। ইস্যুটা সামনে চলে আসে।’

শমজিতা বলল, ‘আমরা কীসের জন্য বিক্ষোভ করব? পরীক্ষায় পাস করাতে হবে?’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘তাহলে শুধু মেয়েরা কেন, ছেলেরা কী দোষ করল? তাদের পরীক্ষায় পাস করতে হবে না?’

বারিধারা বলল, ‘ছেলেদের এই ধরনের আন্দোলনের কথা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। হয়তো হয়েছে। তবে এই ফর্মে বিক্ষোভ কোনও পারসোনাল সুবিধে আদায়ের জন্য হয় না। এটা প্রাোটেস্ট এগেইন্সট সোসাইটি, সিস্টেম। যে সোসাইটি, সিস্টেম মেয়েদের অসম্মান করে। অত্যাচার করে। মেয়েরা জামাকাপড় খুলে তখন বলে, এই সমাজ মেয়েদের লজ্জা নিবারণ, উপযুক্ত অধিকার, প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ, অযোগ্য। এই সমাজের কাছে মেয়েদের পোশাক অর্থহীন। এটা সমাজের ভুল নিয়মকানুন, মেকি ভদ্রতার ওপর একটা থাপ্পড়।’

শমজিতা বলল, ‘আমরা এখন এসব করতে গেলে, আমরাই থাপ্পড় খাব।’

বারিধারা বলল, ‘আমাদের সোসাইটি, কালচারে ন্যুড অ্যাজিটেশন ঠিক যায় না। তবে চারপাশে মেয়েদের ওপর যেসব কাণ্ড ঘটছে, একদিন হয়তো এটাও হয়ে যাবে। হয়তো একদিন কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল বেরিয়ে যাবে।’

তিথি চোখ বড় করে বলল, ‘ছি ছি। তাহলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে।’

বারিধারা হাত বাড়িয়ে তিথির থুতনি নেড়ে বলল, ‘চিন্তা করিস না। তোকে সেই মিছিলে ডাকা হবে না।’

তিথি বলল, ‘আর তোকে যদি ডাকা হয়? যাবি?’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘না, আমি যাব না। বললাম তো, আমি যে স্ট্রাকচারে আছি, তাতে এটা যায় না। প্রয়োজনও নেই। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অনেক মিছিল হয়েছে, কোনওটাতে মেয়েরা জামাকাপড় খুলে হাঁটেনি। তার পরেও সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। তাতে মেয়েরা লাঠি-গুলি কম খায়নি। কোথাও জামাকাপড় খুলতে হয়নি। গল্প শুনেছি, সত্তর দশকে ওয়ানে বহরমপুরে আমার মামাবাড়ির পাড়ায় গুণ্ডারা মেয়েদের খুব বিরক্ত করত। বিরক্ত বললে কম বলা হবে, অত্যাচার করত বলা উচিত। রাস্তায় বেরোলে হাত ধরে টানাটানি তো বটেই, এমনকী একটু সুন্দর দেখতে হলে জোর করে বিয়ে পর্যন্ত করতে চাইত। নইলে রেপ করে দেওয়ার হুমকি দিত। অ্যাসিড ছুড়ত। পুলিশকে বলে কোনও লাভ হত না। কমপ্লেইন করলে পুলিশ বাড়িতে এসে, থানায় ডেকে অসভ্যতা করে যেত। পাড়ার মেয়েরা আর সহ্য করতে পারল না। ছোট-বড় সবাই মিলে একদিন হাতা-খুন্তি-বঁটি, লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে ‘মার মার’ বলে বেরিয়ে পড়ল। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, গরিব, বড়লোক—সবাই ছিল। বাড়ি থেকে গুণ্ডাগুলোকে টেনে বের করে বেধড়ক মার দেওয়া হল। থানা ঘেরাও হল। গভর্মেন্টের টনক নড়ল। না পড়ে উপায় ছিল না। চারদিকে ছ্যা ছ্যা পড়ে গেল যে। দুদিনের মধ্যে অনেক গুণ্ডা-মস্তান অ্যারেস্ট হল। পাড়াছাড়া হল বাকিরা। কই কোনও মেয়েকে তো পোশাক খুলতে হয়নি!’

শমজিতা বলল, ‘বাঃ চমৎকার গল্প।’

বারিধারা বলল, ‘গল্প নয়, সত্যি কথা।’

তিথি বলল, ‘তাহলে বলছিস, মেয়েদের ন্যুড মিছিলের থেকে হাতা-খুন্তি-ঝাঁটা মিছিল বেশি এফেক্টিভ?’

বারিধারা বলল, ‘আমার তাই মনে হয়। অন্তত আমাদের সমাজে তো বটে।’

স্বয়ংদ্যুতি বলল, ‘এত ভারী ভারী কথা বলতে গিয়ে তুই কিন্তু আসল জায়গা থেকে সরে গেলি বারি।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, কাল থেকে ইউনিভার্সিটিতে ছেলেমানুষের মতো বই-খাতা আনব না। বড় মানুষের মতো হাতা-খুন্তি নিয়ে আসব। হবে তো?’

সবাই হেসে ওঠে।

ব্যাগ বন্ধ করে শ্রবণের মেসেজ পড়ল বারিধারা। মাঝারি সাইজ। ‘বারি, হঠাৎ করে আজ সকালে খুব জ্বর এসেছে। মে বি ম্যালেরিয়া। ডেঙ্গিও হতে পারে। এখন হেভি ডেঙ্গি হচ্ছে। বাড়িতে কেউ নেই। বসিরহাটের বড়পিসি অসুস্থ। তাকে দেখতে গেছে। দাদা ক্যান ড্রাইভ। সেই কারণে অফিস কামাই করে দাদাকে যেতে হয়েছে। আমি জ্বরে ধুঁকছি। প্লিজ ধারা, ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার আগে একবার কি আমাকে দেখে যাওয়া যায় না?’

বারিধারা রেগে গেল, আবার হেসেও ফেলল। জ্বরের গল্পটা গুল। এই মিথ্যে কথা বলে বছর খানেক আগে একবার ফাঁকা বাড়িতে তাকে ডেকে নিয়েছিল শ্রবণ। আবার একই কায়দা! ছেলেটার সাহস তো কম নয়! এর পরেও রাগ হবে না?

সেদিনটা ছিল খুব বৃষ্টির।

সকাল থেকে ঝরছে তো ঝরছেই। রাস্তায় জল জমে গেছে। ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না বারিধারার। মণিকুন্তলা ঘরে এসে তাড়া দিলেন। এত বেলা পর্যন্ত বাসি বিছানা তিনি সহ্য করতে পারেন না। এই ব্যাপারে ছুটির দিন মেয়েদের সঙ্গে তাঁর অনেকবার ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। বড় মেয়ে বিয়ে করে চলে যাওয়ায় ঝগড়া হাফ হওয়ার কথা। কিন্তু বেড়েছে। ছোট মেয়ে সহজে বিছানা তুলতে চায় না। অন্য কেউ হাত দিক তাও চায় না। কাজের মেয়েটাকে ধমক দেয়। তার সঙ্গে ঝগড়া করে। তার পরও মণিকুন্তলাদেবীর দেরি হলে মেয়ের ঘরে আসেন। শরীরটরীর খারাপ হল কিনা সে চিন্তা থাকে, বিশেষ করে পিরিয়ড শুরুর প্রথম দিন। বেশি কষ্ট পায়। ছোটবেলা থেকেই এই সমস্যা। তবে সেদিন এরকম কোনও সমস্যা ছিল না। দেরি দেখেই মণিকুন্তলা ঘরে এলেন। এই মেয়ের ঘরে আসা মানেই ঝগড়া। মেয়ে হয় ফাজলামি করবে, নয় পাত্তা দেবে না।

‘কীরে এখনও উঠিসনি?’

‘উঠেছি মা। আমি উঠে পড়েছি অনেকক্ষণ। এই যে আমি শুয়ে আছি, এটা আমি নই, আমার শরীর। যার ওপর আজ আর আমার কোনও কন্ট্রোল নেই।’

মণিকুন্তলাদেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘বাজে কথা না বলে উঠে পড়।’

বারিধারা শোওয়া অবস্থাতে হাত বাড়িতে মায়ের হাত ধরল।

‘মা, প্লিজ একটা কাজ করে দাও। ব্রাশ আর টুথপেস্টটা এনে দাও। আজ আমার বিছানা ছাড়তে করছে না। শুয়ে শুয়ে দাঁত মাজব।’

মণিকুন্তলা জোর ধমক দিতে যাবেন, এমন সময় বারিধারার মোবাইল হাম্বারবে শ্রবণের মেসেজ আসার কথা জানান দিয়েছিল। সেদিনও ঠিক একইভাবে শ্রবণ তাকে জ্বরের কথা বলে ডেকেছিল।

‘বারি, জ্বর হয়েছে। মনে হচ্ছে টাইফয়েড। বাড়িতে কেউ নেই। দাদা-বউদি শ্রীরামপুর। বউদির বাপের বাড়ি। বাবা-মা পুরী গেছে সে তো জানোই। একা ভয় করছে। ধারা, একবার আসবে প্লিজ?’