☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
বত্রিশ
প্রথম হিসেবে কাজটা সহজ ছিল। তবে ইন্টারেস্টিং। এই দেশে জালজোচ্চুরি যে একটা চমৎকার শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা যায়। তার ওপর গোটা অপারেশনের মধ্যে অভিনয়ের একটা বড় অংশ আছে। এতে চিন্ময় ঘাবড়েছিল।
‘অভিনয় তো আমার জানা নেই।’
চিটিংকাঞ্চন বলেছিল ‘চিন্তা করবার কিছু নেই; অভিনয় জানতে হয় না। এটা নিজে থেকেই আসে। সারাক্ষণ তো অভিনয়ের ওপরই আছি। আছি কিনা? ঘরে-বাইরে আমরা এক-একজন বড় অভিনেতা। হাসি-কান্না, রাগ সব অভিনয়। চিন্তা নেই, কাজের সময় কী বলতে হবে, শুধু যেটুকু শিখিয়ে দেব। তারপর নিজের মতো এগোবে।’
চিন্ময় বলল, ‘যদি গোলমাল হয়ে যায়?’
চিটিংকাঞ্চন নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘গোলমাল তো হবেই। আজ না হোক, কাল হবে। আমার এখনও কত গোলমাল হয়।’
‘কী হবে তখন?’
চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘সেটা কাজের ওপর নির্ভর করছে। অপারেশন কেমন, তার ওপর নির্ভর করছে। পাবলিক ডিলের ব্যাপার হলে প্যাদানি হতে পারে। আরও বড় কেস হলে পুলিশে ধরতে পারে। সেখানেও অভিনয় করে, বুদ্ধি দিয়ে বেরোতে হবে। দু’নম্বরী কাজ আসলে বুদ্ধির কাজ। বোকা মানুষ পারে না। পারে না বলেই সৎ সেজে ঘুরে বেড়ায় আর আপশোস করে। বলে, হায়রে! জীবনে কিছু হল না। আরে বেটা, তুই গাধা তোর জীবনে হওয়ার কী আছে?’
কাঞ্চন লোকটাকে পছন্দ হল চিন্ময়ের। চিটিংয়ের কারবার করলেও এক ধরনের দার্শনিক দার্শনিক ভাব আছে। জালজোচ্চুরির মধ্যে ফিলজফি খোঁজে। এটা একটা মজার ব্যাপার।
‘অভিনয় নিয়ে ঝামেলা হবে না। কাজটা বের করে আনব এই টার্গেট মাথায় থাকলে, বাকিটা হয়ে যাবে। লোক ঠকানো একটা আর্ট। এই আর্টে অভিনয় যেমন লাগে, এই সহজ-সরল ভাবটাও লাগে। তোমার মধ্যে এই ভাব আছে।’
চিন্ময় অবাক হল। তার মধ্যে লোক ঠকানো ভাব আছে, এটা জানা ছিল না। বলল, ‘আচ্ছা চেষ্টা করব।’
বারাসাতের দিকে দশ কাঠা খাস জমির নকল মালিক সাজতে হবে। সরকারি জমি প্লট করে বেচবার জোচ্চুরি। জমি কেনবার জন্য পার্টি ধরে আনবে কাঞ্চন। এরপর কাজ শুরু। পার্টিকে প্রথমে দরদাম করে তাড়িয়ে দিতে হবে। সেই পার্টি আবার আসবে। আবার তাড়িয়ে দিতে হবে। তৃতীয়বার এলে তাকে বলতে হবে, টেন পার্সেন্ট ক্যাশ পেমেন্ট করলে তবে কথা বলব। নইলে আর নয়। বার বার কথা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে। পার্টি গাঁইগুঁই করবে। তখন বলতে হবে, ‘বাদ দিন ভাই। জমি কেনবার জন্য অনেক লোক আছে। পার্টি শেষ পর্যন্ত লাখ দুয়েক টাকা দেবে। তখন জাল দলিল দেখাতে হবে।
‘সার্চিংয়ের জন্য কাগজ পাঠানো হল। দশদিন পরে আসবেন। এসে ডুপ্লিকেট নিয়ে নিজের মতো জমির খোঁজখবর নেবেন। পছন্দ হলে নেবেন। নইলে টাকা নিয়ে যাবেন। আচ্ছা দাঁড়ান, এখনই টাকা নিয়ে যান।’
এই কথা শুনে পার্টি ঘাবড়ে যাবে। ভাববে, জমি অন্য কাউকে বেচে দেওয়া হবে।
‘আমি তো টাকা ফেরত চাইনি।’
বলতে হবে, ‘আপনি চাননি তো কী হয়েছে? আমি চাইছি। আসলে আমি দেখছিলাম, আপনার জমিটা নেওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা। নাকি শুধুই নাড়তে-চাড়তে এসেছেন। টাকা ওই কারণেই চেয়েছিলাম। টাকা পেয়ে বুঝলাম, ক্ষমতা আছে। নিন এবার টাকা ফেরত নিয়ে যান। জমি ঠিক কিনা দেখে টাকা দেবেন। তবে তার আগে আমরা নিজেরা দেখে নেব। কাগজপত্র যা পাওয়ার তারপর হাতে পাবেন।’
পার্টি এতে গলে যাবে। বলবে, ‘না না, টাকা যখন দিয়ে ফেলেছি, আর ফেরত নেব না। জমি আমার খুব পছন্দ। আমি নেব।’
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে হবে, ‘পছন্দ তো অনেকেরই। কিন্তু টাকা আমি আগে নেব না। ঠিক আছে আপনি যখন এত জোর করছেন, খানিকটা টাকা রাখছি। বাকিটা ফেরত নিন। নিন, এক লাখ টাকা ফেরত নিয়ে যান।’
পার্টি গদগদভাবে টাকা ফেরত নেবে। তার মান যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাও থাকবে না। এমনকী জমির দলিলটলিল ঠিক আছে কিনা, তাও জানতে চাইবে না। দশদিন পরে আসার কথা বলে হাসিমুখে চলে যাবে।
এই অভিনয় দশটা পার্টির সঙ্গে করতে হবে। দশ লাখ টাকার ব্যবসা হয়ে গেলেই পাততাড়ি গুটিয়ে ভ্যানিশ হতে হবে।
চিন্ময় বলল, ‘এতজনের সঙ্গে অভিনয়! পারব তো?’
কাঞ্চন বলল, ‘আমি থাকব। তা ছাড়া কথা তো একই। টাকা দিন, টাকা ফেরত নিন। টাকা ফেরত দিলে যে-কোনও মানুষ খুশি হয়।’
চিন্ময় একটু ভেবে বলল, ‘আমার কত?’
চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘ওয়ান পার্সেন্ট। এক লাখ। চেয়ার-টেবিলে বসে সাতদিনে এক লাখ রোজগার। মন্দ কী।’
চিন্ময়ের গা শিরশির করে উঠল। এক লক্ষ টাকা! কতদিন এত টাকা একসঙ্গে দেখেনি। বৈশাখী টাকা পেয়ে খুশি হবে? অবশ্যই হবে। মেয়েটা খুব টানাটানির মধ্যে থাকে। একটু স্বস্তি দেওয়া যাবে। ভালোমন্দ খাওয়া যাবে ক’দিন। কীভাবে টাকা পেল, সে কথা এখনই না বললেও চলবে।
চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘কাজ ঠিকঠাক পারলে পরের অ্যাসাইনমেন্ট দেব।’
‘আবার জমি?’
‘না, আর জমিটমি নয়। এক লোককে দিয়ে এক কাজ দু’বার হবে না।’
এসব কথা বৈশাখী তার স্বামীর কাছ থেকে পরে শুনেছিলেন। স্বামী লোক ঠকিয়ে রোজগার করছে শুনে বৈশাখী প্রথমটায় ধাক্কা খেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছিলেন। না মেনে উপায় ছিল না। ভদ্রলোকের মতো উপার্জনের পথ ‘ভদ্রলোক’রাই বন্ধ করে দিয়েছে। একটা ছোট প্রাইভেট স্কুলে কাজ পেয়েছিলেন। কলেজের পড়া শেষ করতে পারেননি। ফলে বেতনও সামান্য হল। সেই বেতনে যাতায়াতের খরচ উঠত না। একটা বেসরকারি অফিসে কিছুদিন রিসেপশনে বসতে বলল। সেখানে মাইনে মন্দ ছিল না, কিন্তু ডিউটি ছিল রাত পর্যন্ত। তাও ঠিক ছিল। ডিউটি শেষে অফিসের মালিক গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করত। লোকটা অফিসে ভালো, বাইরে নোংরা। এরপর বৈশাখী কাজ নিলেন সেলসে। বাড়ি ঘুরে মেয়েদের কসমেটিক্স বিক্রি করতে হবে। সস্তার জিনিস। প্রথম মাসে কাজ ভালো হল। পরের দুটো মাস মার খেতে হল। ইনচার্জ মহিলা গালিগালাজ করে অফিসে বসিয়ে রাখল। কাজ না পারার শাস্তি। অফিসে চা করতে হবে, টেবিল মুছতে হবে, জিনিসপত্রের ধুলো ঝাড়তে হবে। আটদিনের দিন চলে এলেন বৈশাখী। সরকারি কাজ পাওয়ারও চেষ্টা করেছেন। হায়ার সেকেণ্ডারি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখলে যতটা পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপন বেরোলে পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষা খারাপ দেননি। তবু চাকরিটা হল না। রেজাল্ট বেরোনোর পর দালাল চলে এল। হেলথ চেকআপ, পুলিশ ভেরিফিকেশন, আইডেনটিটি প্রুফের জন্য টাকা লাগবে। অনেক টাকা। নইলে কোনও কাগজ বেরোবে না। টাকা অনেক দূর পর্যন্ত দিতে হবে। এত টাকা কোথায়? বৈশাখীর তখন না আছে টাকা দেওয়ার মতো আত্মীয়, না আছে বিক্রি করবার মতো গয়নাগাঁটি। তাও হাল ছাড়লেন না। আবার পরীক্ষা দিলেন। প্রাইমারি স্কুলে দিদিমণির চাকরি। অনেকটা এগিয়ে সেখানেও আটকে যেতে হল। সেই টাকা। পোস্টিংয়ে টাকা লাগবে। একটা-দুটো টাকা নয়। বিশ হাজার টাকা। বৈশাখী শিখলেন, গরিব মানুষকে সবাই মারতে চায়। শেষ পর্যন্ত দোকানে বসবার কাজ নিলেন। মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকান। সেখানে তিনমাস পর হিসেবে ঝামেলা হল। টাকার হিসেবে গোলমাল নয়, জিনিসের হিসেবে গোলমাল। অর্ডারের সঙ্গে স্টকের হিসেব মিলল না। এক পেটি ব্রা, দু’পেটি প্যান্টি উধাও। দোকানে মোট তিনজন কর্মচারী। মালিক তাদের ডাকলেন।
‘ব্রা-প্যান্টি নিয়ে আমি থানা-পুলিশ করতে চাই না। সেটা ভালো দেখায় না। আমি চাই তোমরা নিজে থেকেই কাজ ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্ষতিটা যে খুব বড় হয়েছে এমন নয়। তোমরা জানো, ওই জিনিসের দাম খুব বেশি নয়। কিন্তু লক্ষণটা ঠিক নয়।’
কাজ ছেড়ে চলে এসেছিলেন বৈশাখী।
চিন্ময় এসে যখন চিটিংকাঞ্চনের গল্প, বারাসতের জমির ঘটনা বলল তখন প্রথমে ধাক্কা লাগলেও মনে হল, এটাই ভালো। একদিকে ঘুষ, অন্যদিকে অপমান। ভদ্রলোকেরাই এই ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে। যাতে ভদ্রলোকের মতো বাঁচা না যায় তার ব্যবস্থা। এর থেকে লোকঠকানো ভালো। একদিন চিন্ময় তাকেও কাজে ঢুকিয়ে নিল।
‘একটা কাজে আমাকে হেল্প করতে হবে বৈশাখী।’
বৈশাখী বললেন, ‘কী কাজ? জালিয়াতি?’
চিন্ময় গায়ে মাখল না। বলল, ‘আপত্তি আছে? আপত্তি থাকলে বলো, বাইরে থেকে কাউকে নিয়ে নেব। টাকা দিলে লোকের অভাব হবে না। তবে নিজেদের মধ্যে হলে সব দিক থেকে ভালো। টাকাটা বাইরে যায় না। রিস্কও কম থাকে।’
বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমি লোক ঠকাতে পারব না।’
চিন্ময় হেসে বলল, ‘প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম পারব না। পরে যখন বুঝলাম এই দুনিয়ায় হয় আমাকে ঠকাতে হবে, নয় আমি ঠকব—তখন পেরেছি। বৈশাখী, কোনও অসুবিধে হবে না। হাতে টাকা থাকলে সব অসুবিধে দূর হয়ে যায়। নাও, এত চিন্তা কোরো না।’
চিন্ময় নিয়ে গেল একজনের কাছে। ধুতি-ফতুয়া পরা সুদর্শন পুরুষ। একমাথা সাদা চুল। বয়স বেশি হলেও চেহারা শক্তপোক্ত। ঘরের দেওয়ালে দেবদেবীর ছবি। একদিকে উঁচু আলমারি। সেখানে বাঁধানো সার্টিফিকেট, স্মারক। এক পাশে ফটোর সারি। সেখানে নেতা, মন্ত্রী, বড় মানুষদের সঙ্গে ছবি। ভদ্রলোক পুজোআচ্চা, ধ্যানদান, সমাজসেবা নিয়ে থাকেন। এই সব সার্টিফিকেট, স্মারক, ফটো তার সমাজসেবা করে পাওয়া। ভদ্রলোকের চেহারায় এক ধরনের ঋষি ঋষি ভাব। চোখমুখ, ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয়, মানুষটার মধ্যে আর যাই থাকুক লোভ বলতে জিনিস নেই। মাটিতে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে আছেন। চিন্ময় পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর বৈশাখীকে বললেন, ‘বসো মা।’ তারপর কাজের কথা হল।
কাজ জটিল। এই ঋষি টাইপ সমাজসেবক মানুষটির মূল ব্যবসা বিধবার সম্পত্তি হাতানো। তার জন্য তিনি নানা ধরনের পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে দিয়ে যান। কখনও দরিদ্র মহিলার অসহায়তার সুযোগ নেন, কখনও আইনের প্যাঁচ কষেন, কখনও ভয় দেখান। চারদিকে তার লোক ছড়ানো আছে। তারাই খোঁজখবর আনে। সস্তায় সম্পত্তি হাতানোর জন্য তারা মহিলার কাছে পৌঁছে যায়। বলা বাহুল্য, সব সময়েই টার্গেট থাকে অসহায়দের প্রতি। যাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।
এবার অসুবিধেয় পড়েছেন। বাঁকুড়ার এক মহিলার কেস। মহিলার দেওর, ভাসুর এসে হাজির হয়েছে। তারা মহিলাকে বাড়ি-জমি-বাগান বিক্রি করতে দেবে না। মহিলাকে ভয় দেখাতে হবে। গুণ্ডা-মস্তানের ভয় নয়, সামাজিক বদনামের ভয়। এমন ভয় যাতে মহিলা ভাসুর-দেওরদের কথা না শুনে গোপনে দলিলে সই করে দেয়। কী সে ভয়? বৈশাখীকে তার স্বামীর গোপন স্ত্রী সাজতে হবে। বিধবার বেশে গিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হবে মহিলার সঙ্গে। সম্পত্তির ভাগ চাইতে হবে। এই চাপের মাঝে সমাজসেবক ফের দালাল পাঠাবে। সে-ও চাপ দেবে। পারিবারিক কেচ্ছা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেবে। মহিলা এবার দ্রুত বাড়ি-জমি বিক্রি করবেন। যা দাম পান তাতেই করবেন। গ্রামবাংলায় এখনও টাকার থেকে কেচ্ছার দাম বেশি।
বৈশাখী নিখুঁতভাবে কাজ করলেন।
সেই তার লোক ঠকানো শুরু। স্বামী মারা গেছে। আজও অপরাধের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বৈশাখী। ভূতের মতো তার কাঁধের ওপর চেপে আছে। হয়তো এটাই তার ভবিতব্য ছিল। নিজের জীবনের কাছে বার বার ঠকে, অন্যকে ঠকানোর নেশায় মেতে থাকেন। কখনও মনে হয়, এই নোংরামি থেকে বেরিয়ে আসবেন। টাকাপয়সার তো দরকার নেই আর। দুর্গাপুরে মাথা গোঁজবার মতো একটা আস্তানা রয়েছে। বাকি জীবনটা দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার মতো টাকা রয়েছে। আর এইসব খারাপ কাজ করে কী লাভ? পরক্ষণেই মনে হয়েছে, কী হবে কাজ ছেড়ে? কোথায় যাবেন? কী নিয়ে থাকবেন? বাবা-মা মারা গেছে। অনেক পরে পরে সব খবর পেয়েছেন। খবর পেয়েছেন, অর্চিন কলকাতায় দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মণিকুন্তলার বাড়ি। সম্পর্কে জ্যেটতুতো বোন হয়। তবে তাকে তেমন করে মনে করতে পারেন না বৈশাখী। ছোটবেলার চেনা। বহু বছর যাতায়াত ছিল না। এখন সেনবাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছেন। মাঝে মাঝে ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়ির উলটোদিকের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একদিন অর্চিনকে ফলো করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গেছেন। সামনে যেতে খুব মন চায়। নিজেকে আটকে রাখেন। থাক। জেলখাটা, লোকঠকানো মাকে না দেখাই ভালো। মাকে না দেখে এতদিন যখন পেরেছে, বাকি বছরগুলোও পেরে যাবে নিশ্চয়।
আজ ছেলেটাকে দেখা হল না। না হয়ে ভালোই হয়েছে। মায়া বাড়ানো ভালো নয়। আজ কি কলকাতায় থেকে যাবেন? কাল একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়? আর একটু সকাল সকাল নাহয় সেনবাড়ির উলটোদিকে গিয়ে দাঁড়াবেন। খারাপ হবে? থাক। মায়া বাড়বে। ফিরে যাওয়াই ভালো।
ফিরে যাবে ভেবেও ফেরা হল না। কলকাতায় থাকতে হল অর্চিনের মাকে। তবে ছেলেকে দেখবার জন্য নয়। অর্চিনকে যারা আশ্রয় দিয়েছে তাদের কোম্পানি ‘সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’কে ঠকানোর বরাত নিয়ে থাকতে হল। দ্য ক্যালকাটা হোটেলের উসকোখুসকো চেহারার পার্টি কাজের বরাত দিল। কাজটাও শক্ত, টাকার পরিমাণও ভালো। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কাদের কোম্পানি জানতে পারলেন না বৈশাখী, চানওনি। তবে জানতে পারলেন, এই ভয়ংকর কাজের পিছনে যে মানুষটা রয়েছে, তার নাম নিখিলেশ উপাধ্যায়। সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কোম্পানির বয়ঃজ্যেষ্ঠতম কর্মী। অবসর নেওয়ার বয়স দশ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। তার পরেও চাকরি করছে। মালিকপক্ষের গভীর বিশ্বাসের লোক।
এই লোক কোম্পানির বড় সর্বনাশ করতে চায়।