☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
চল্লিশ
‘এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা দেশের শ্রমিক শ্রেণী সংগ্রাম করে অর্জন করেনি, যেমনভাবে লেলিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। তবে সেইদিক দিয়ে বিচার করলে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তা অনেকটাই যেন ওপর থেকে চাপানো। শুধু তাই নয়, গোড়া থেকেই সোবিয়েতের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল সাংঘাতিক ভাবে প্রবল। তাই মিখাইল গরবাচেভের নেতৃত্বাধীনে সোবিয়েত যখন রাজনৈতিক সংস্কার হিসেবে ‘পেরেস্ত্রৈকা’ এবং আর্থ সামাজিক সংস্কার হিসেবে ‘গ্লাসনস্ত’ আত্মপ্রকাশ করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব ইউরোপের সকল দেশে এই ধরনের সংস্কার প্রবর্তনের জন্য প্রবল দাবি উঠল।
সোবিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ থাকার ফলে তারা মানুষের মধ্যে সংস্কার প্রবর্তনের আকুলতা অনুভব করতে পেরেছে এবং সেই অনুযায়ী তারা এই ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ অন্যান্য দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জনগণের যে সেই ধরনের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, তা যদি থাকত, তা হলে এই সমস্ত দেশে এইভাবে বালির প্রাসাদের মতো একটার পর একটা রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটত না। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র পতনের পিছনে আর একটি অন্যতম বড় কারণ হল, এই সমস্ত দেশে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব বলে কিছু ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থা কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্যের পরিবর্তে কতিপয় ‘টেকনোক্রয়াট’ ও ‘ব্যুরোক্রয়াটে’র দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে এ ঘটনা এমনভাবে ঘটেছে…’
এত পর্যন্ত পড়ে শেখর গুপ্ত থামল। বইয়ের নাম ‘মার্কসের পর মার্কসবাদ’। লেখক শমিত কর। বইটি বেশ কিছুদিন আগের। শেখরের পড়া ছিল না। কিছুদিন আগে ইন্দ্রদা দিয়েছে। ইন্দ্রদা পার্টির পুরোনো লোক। এখন বসে গেছে। পার্টির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। শেখরের কাছে মাঝে মাঝে আসে। গল্প করে, চা খায়। বই, পত্রিকা থাকলে ঘাঁটাঘাঁটি করে। মাঝে মাঝে কোনও বই পড়ে পছন্দ হলে দিয়ে যায়। এই বইটাও সেভাবে পেয়েছে শেখর। পড়া হচ্ছিল না। আজ ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছে। ব্যাগে বই নিয়ে বেরোনোর অভ্যেস শেখরের অনেক দিনের। একটা সময় পার্টির কাজে অনেক দূর দূর ট্রাভেল করতে হত। তখন সঙ্গে একটা বই না থাকলে অসুবিধে হত। বাসে, ট্রেনে সময় কাটতে চাইত না। সেই অভ্যেস রয়ে গেছে। খটমট প্রবন্ধের বইয়ের সঙ্গে কবিতার বইও থাকে। শেখরের মজা হল, যে-কোনও পরিস্থিতিতে বইতে ডুব মারতে পারে।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
ইন্দ্রদা বসে গেছে প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। বসে গেছে একেবারে অদ্ভুত একটা যুক্তি দেখিয়ে। সেই সময় পার্টির অনেকেই বলেছিল, হয় মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নয় রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাহানা খুঁজছে। ইন্দ্রদা অন্য জোনের হলেও পার্টির ওপর থেকে শেখরকে বলল, তুমি কথা বলো। সমস্যাটা বোঝবার চেষ্টা করো। এতদিনের পুরোনো একজন কর্মীকে পার্টি হারাতে চায় না।’
শেখর ‘কিন্তু কিন্তু’ করেছিল। বলেছিল, ‘আমার কথা বলা উচিত হবে? ইন্দ্রদার জোনের সেক্রেটারি বললে ভালো করতেন না?’
‘বলেছিল। লাভ হয়নি। উলটে সেক্রেটারি বিরক্ত হয়েছে। সে রিপোর্ট করছে ইন্দ্রর মাথার সমস্যা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা জানি উনি যেখানেই কাজ করুন, তোমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো।’
শেখর বলেছিল, ‘পার্টি কি আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছে?’
‘ঠিক অফিসিয়ালি নয়, তবে দিচ্ছে।’
শেখর ইন্দ্রদার সঙ্গে কথা বলেছিল।
‘তুমি হঠাৎ এরকম ঠিক করলে কেন?’
ইন্দ্রদা বলেছিল, ‘এভাবে রাজনীতি করা যায় না, শেখর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
শেখর অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কেন? সমস্যা কী?’
ইন্দ্রদা বলল, ‘পাটি করাটা পার্ট টাইম কাজ নয়। কমিউনিস্ট পার্টি তো নয়ই। চাকরি করব, সংসার করব, সামাজিকতা রক্ষা করব, তারপর পার্টি করব—এটা হয় না।’
শেখর অবাক হয়ে বলল, ‘কতজনই তো তাই করছে।’
ইন্দ্রদা বলল, ‘কে কী করল, আমি জানি না। আমি বুঝতে পারছি, এটা হয় না।’
শেখর বলল, ‘স্কুল কলেজ অফিসে কলকারাখায় আমাদের মেম্বার কত, তা তো তুমি জানো। কোটির কাছাকাছি।’
ইন্দ্রদা শুকনো হেসে বলেছিল, ‘এখানেই আপত্তি শেখর। পার্টি প্রফেশনালদের হাতে চলে যাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজ দরিদ্র সর্বহারাদের নিয়ে। আর আমরা কী করছি? দলকে দাঁড় করাচ্ছি, যারা উপার্জন করছে তাদের ওপর ভিত্তি করে। এটা ঠিক হচ্ছে না। এতে পার্টি তার মূল লাইন থেকে সরে আসছে। চাকুরে, ব্যবসায়ী-নির্ভর পার্টি যাদের আছে, তাদের সুযোগসুবিধে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের বেলাতেও তাই হচ্ছে। মাইনে, ডি এ, প্রাোমোশন, ট্রান্সফার এই সব নিয়ে পার্টি মাথা ঘামাচ্ছে বেশি। মেইন ফোর্সটাই তো আরও চাই, আরও দাও-তে চলে যাচ্ছে। যাদের কিছু নেই, তাদের জন্য ভাবনা থাকলেও সময় দিতে পারছি কম।’
শেখর বলল, ‘এ তোমার অদ্ভুত যুক্তি ইন্দ্রদা। সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট পার্টি অফিস কাছারি, কলকারখানায় অর্গানাইজেশন করেছে। তুমি রাশিয়ার ইতিহাস দেখো, চিনের মুভমেন্ট দেখো। পোলান্ড, চিলির দিকে তাকাও। সবসময়ই পার্টির একটা বড় অংশ প্রফেশনালদের হাতে ছিল।’
ইন্দ্রদা বলেছিল, ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। আমাদের সোশ্যাল, ইকনমিকাল স্ট্রাকচার একেবারে আলাদা। ওসব দেশে বিপ্লবের পরিস্থিতি ছিল। লেবারদের মিনিমাম ওয়েজ বলে কিছু ছিল না। এটাই সেই পরিস্থিতি। আমাদের তো তা নয়।’
শেখর বলেছিল, ‘আমাদের তো অসংখ্য হোলটাইমারও আছে ইন্দ্রদা। আছে না? তারা শুধু পার্টির কাজই করে।’
ইন্দ্রদা বলল, ‘আমিও ভেবেছিলাম তাই করব। তোর বউদিকেও সেরকম বলে রেখেছিলাম। অফিস ছেড়ে দিয়ে পুরো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম, তাতে কোনও লাভ হবে না। পার্টির বড় একটা অংশ পার্ট টাইমারদের হাতেই থাকবে।’
শেখর বিরক্ত হয়েছিল। বলেছিল, ‘এ তোমার ঠিক কথা নয় ইন্দ্রদা। তথ্যের দিক থেকেও তুমি ভুল। সর্বসময় কর্মীরাই আমাদের পার্টির সম্পদ। এই তো আমি, আমার কি পার্টিতে কোনও সে নেই? আমার কথা শোনা হয় না?’
ইন্দ্রদা বলল, ‘আমি তা বলিনি। কে নেতা, কে কমিটির মাথায় আছে, এটা ইমমেটেরিয়াল। আসলে কথা হল, কাদের নিয়ে পার্টি ব্যস্ত। কাদের দাবিদাওয়া মেটাতে উদগ্রীব। শেখর একটা কথা মনে রেখো তোমার মতো কয়েকজন কিছু করতে পারবে না। আজ পার্টি যাদের আরও পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত, বিপদের সময় তারা সবার আগে সরে যাবে। কোটির হিসেব কোথায় দিয়ে তখন ঠেকে দেখবে। আমি এই হিপোক্রেসিতে নেই। আমি চাই পার্টির ভালো হোক।’
শেখর সেদিন ইন্দ্রদার কথার সঙ্গে একেবারেই একমত হয়নি। এই যুক্তি অতি দুর্বল যুক্তি। সে একথা স্পষ্ট করে বলেওছিল।
‘ইন্দ্রদা তোমার যুক্তি ঠিক নয়। তুমি চাইছ, পার্টি শুধু শ্রমিক, সর্বাহারাদের সামনের সারিতে রেখে এগিয়ে চলুক। বাকি সবাইকে দূরে রাখুক। কেরানি, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, অফিসার, ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী পিছনে থাকবে। এটা বাস্তব কথা হল না। তুমি আমার থেকে ভালো জানো যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবের কোনও সম্ভাবনা এদেশে নেই। এদেশে কেন, এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতেই কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। আমি যেটুকু বুঝি তা হল, আমাদের পার্টি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় কিছু রিলিফের ব্যবস্থা করতে পারে মাত্র। সরকারে গিয়ে তাই করছেও। এটা যেমন দরিদ্র মানুষের জন্য করছে, তেমন মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের জন্যও করা হচ্ছে। এই উদার অর্থনীতির সময় কনজিউমারলেস সোসাইটি একটা ইউটোপিয়া মাত্র। তার কোনও অস্তিত্ব নেই। চিনেও নেই। আমরা যদি উপভোক্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তাহলে কৃষকের ফসল, শ্রমিকের তৈরি কাপড় জামা, কিনবে কে? তুমি কি কারখানা না করে পার্টি চালাতে বলছ ইন্দ্রদা?’
ইন্দ্রদা অন্যমনস্ক ভাবে বলেছিল, ‘কারখানা বন্ধ করতে বলিনি, শিল্পের প্রয়োজন, কিন্তু পার্টির কাছে কে বেশি ইমপর্টান্ট? কারখানার মালিক না শ্রমিক? হাবভাব দেখে কোনও কোনও সময় মনে হচ্ছে, গুলিয়ে ফেলছি।’
শেখর হেসে বলেছিল, ‘তাহলে তো তোমার সঙ্গে আর্গুমেন্টে গিয়ে লাভ নেই। কারখানা না হলে শ্রমিক কোথা থেকে পাব? তাদের নিয়ে পার্টি করবার প্রশ্নও উঠবে না। কারখানার জন্য মালিক চাই। আগে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমার ভাবতে একটু অবাকই লাগছে, এতদিন পার্টি করবার পর তোমার কোথায় যেন কনফিউশন তৈরি হচ্ছে। যে কনফিউশনের কোনও বেস নেই। কিছু মনে কোরো না, তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, মূল বিশ্বাসে তুমিই গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছ ইন্দ্রদা। এখন পার্টির ঘাড়ে চাপাতে চাইছ।’
এইসব কড়া কথার পরেও ইন্দ্রদার সঙ্গে সম্পর্ক রয়ে গেছে শেখরের। ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তবে আজ মনে হয়, সেদিন ইন্দ্রদার একটা কথা খানিকটা হলেও ঠিক ছিল। পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর উপার্জনক্ষম সদস্য, কর্মী, সমর্থকরা পার্টির পাশ থেকে দ্রুত সরেছে। এটাই মধ্যবিত্ত চরিত্র। সে মূলত সুবিধাভোগী। ইন্দ্রদার এই দূরদৃষ্টিটুকু হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু পার্টি ছাড়বার জন্য অতি দুর্বল যুক্তি।
ইন্দ্রদা এই বইটা দিয়ে বলেছিল, ‘পড়ে দেখিস। সঙ্কটের কথা সহজ করে বলা আছে।’
আজ বইটা পড়তে পড়তে শেখরের মনে হচ্ছে, তাদের পার্টির ক্রাইসিসের এই সময়ের কথাও ভালো করে লিখে রাখার দরকার। এখনও লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটা সংগঠনের রিপোর্ট নয়, শাসক দলের প্রতাপ। খুব বেশি হলে নেতারা প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখছেন। এতে হবে না। প্রতিটা পার্টি মেম্বারকে একটা করে ডাইরি দিয়ে দেওয়া উচিত। তারা প্রতিদিন পার্টি করতে গিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে, কেন সমস্যা হচ্ছে সে কথা লিখে রাখবে। সবথেকে বড় কথা, এই সময়টা কেন কমিউনিস্ট পার্টি সঙ্কটের সময় বলছে, সেটাও তো জানা দরকার। ইতিহাস হয়তো পরে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলবে, এটা সঙ্কটের সময় ছিল না। ক্ষমতায় না-থাকাটা কমিউনিস্টদের জন্য সমস্যা নয়। বরং এই সময়টাই পার্টির জন্য ভালো সময়। শত্রু-মিত্র চিনে নেওয়ার সময়। সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করবার সময়। সংগঠন করতে গিয়ে ভিতরে-বাইরে যত সংঘাত হবে, পার্টির জন্য তত শুভ। আচ্ছা, পার্টির ওপরের নেতাদের কাছে প্রস্তাবটা দিলে কেমন হয়? শুনবে? মনে হয় না। থাক, অত বলাবলির দরকার নেই। নিজের লোকাল কমিটিতে এই ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কেন পার্টি ক্ষমতা থেকে সরে গেল, সে বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক রিপোর্ট হয়েছে। সম্মেলন হয়েছে। এখন দরকার ক্ষমতার বাইরে থেকে রোজকার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করা।
ভাবনার এরকম একটা সময় হাবিলদার ধরনের একজন এল।
‘বড়বাবু ভিতরে ডাকছে।’
শেখর গুপ্ত পাশে বসা অর্চিনকে বলল, ‘চলো।’
থানায় ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল।