☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
ঊনত্রিশ
নিজের ঘরে মধুজা রায় গুম মেরে বসে আছেন। টেবিলের ওপর নানা ধরনের জরুরি কাগজপত্র। তিনি সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু দেখছেন না।
মধুজা রায়ের মেজাজ খারাপ। মেজাজ বেশি খারাপ হলে মানুষের নানারকম সমস্যা হয়। প্রেসার বাড়ার কারণে কারও ঘাড় মাথা চিনচিন করে, কারও রাগে কান ভোঁ ভোঁ করে, কারও মুখ তেতো হয়ে যায়। চিনির সরবত খেলেও মনে হয় নিমপাতার রস খাচ্ছি। মধুজা রায়ের ঘটনা অন্যরকম। মেজাজ বিগড়নোর সময়ে তার নাকের ভিতর সুড়সুড় করে। বার বার নাকে হাত দিতে ইচ্ছে করে। নাকে হাত দেওয়া একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। মনে হয়, নাক খুঁটছে। মধুজা রায় একজন মহিলা এবং ডাকসাইটে প্রফেসর। তার পক্ষে প্রকাশ্যে এই কাজ অস্বস্তিকর। আবার না করে উপায়ও নেই। নাকের ভিতর সুড়সুড় এমন একটা ঝামেলা যে, মুক্তির দ্বিতীয় বিকল্প নেই। মনে হয়, নাকে হাত না দিলে এক্ষুনি মারা যেতে হবে। সব মিলিয়ে খুবই ঝামেলা। তাই যতক্ষণ নাক সুড়সুড় ধরনের মেজাজ খারাপ থাকে, ততক্ষণ মধুজা রায় টেনশনে থাকেন। যতটা না মেজাজের জন্য টেনশন, তার থেকে অনেক বেশি নাকের জন্য টেনশন।
লব ঘরে ঢুকল। তার মুখও থমথমে।
‘দিদি, চা খাবেন।’
মধুজা রায় এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা কেউ এসেছিল?’
লব বলল, ‘না, এখনও আসেনি।’
যেহেতু মধুজা রায় বেশিরভাগ দিনই ক্লাস নিতে পারেন না, এমনকী ইউনিভার্সিটিতে আসতেও পারেন না, তিনি এলে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে। সিলেবাস, পরীক্ষা, রেজাল্ট, গবেষণা নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা থাকে। প্রশ্ন থাকে। সেগুলোর সমাধান করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের রেকমেন্ডেশনে সই করানোর থাকে। অন্য প্রফেসরদের ফোন করানোর থাকে। সেই সঙ্গে ছেলেমেয়েরা জানতে চায়, ম্যাডাম আজ ক্লাস নেবেন কিনা। নাকি বসে থেকে থেকে চলে যেতে হবে? সব মিলিয়ে ঘরের বাইরে একটা জটলা থাকে। মধুজা রায় এই জটলা পছন্দ করেন। বাইরের কেউ এলে এই জটলা দেখে মনে করবে, ইউনিভার্সিটিতে তিনি একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। সেই কারণেই ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগে আছে। যদিও ঘটনা সেরকম নয়। মধুজা রায়ের কাছে ছেলেমেয়েদের আসবার মূল কারণ তিনি ‘পাওয়ারফুল’। দুঃখের হলেও কথাটা সত্যি, আজকাল দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকেও ছাত্রছাত্রীদের পাওয়াফুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেশি প্রয়োজন। তারা নানা ধরনের ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে। মধুজা রায় এই ব্যাপারে তালিকার ওপর দিকে। ছেলেমেয়েরা ভয়ে এবং লোভেই তাঁর কাছে ভিড় করে।
লব বলল, ‘না, এখনও তো ছেলেমেয়েরা আসেনি।’
মধুজা রায় ভুরু কোঁচকালেন। এই তথ্য তাঁর পছন্দ হল না। তিনি চিন্তিত হলেন। উদ্বেগ চেপে রেখে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কেন! তাদের কী হল?’
লব এখানে তিরিশ বছর ধরে পিওনের কাজ করছে। প্রফেসর, অফিসারদের মেজাজমর্জি তার ভালো জানা আছে। মধুজা রায়কেও সে হাড়ে হাড়ে জানে। তার রাগ, মেজাজ, বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না। তার ওপর ইদানীং এই মহিলার ওপর রাগ হয়েছে। বাঁকুড়ার এক কলেজের অফিসে ভাগ্নেকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিল। ক্লার্কের পোস্ট। তার কাছে খবর ছিল, ওই কলেজের গভর্নিং বডিতে মধুজা রায়ের তিনজন চেনাজানা আছে। বললেই হয়ে যেত। তার পরেও মহিলা কিছু করেনি। শুধু করেনি বললে ভুল বলা হবে, এই ফাঁকে অন্য একজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই ছেলে অতি বদ। মধুজা রায়ের সঙ্গে চেনাজানার কথা নিজেই বলে ফেলেছে। একদিন ঝগড়ার সময় অফিসে গলা চড়িয়েছিল। সেখান থেকে জানাজানি হয়েছে। লবের কাছেও খবর এসে গেছে।
‘আমি কলকাতার মধুজা ম্যাডামের পরিচিত। আমাকে কেউ কিস্যু করতে পারবে না।’
এরপরই লবের রাগ বেড়ে গেছে। সেও বিরক্ত গলায় বলল, ‘ছেলেমেয়েরা কেন আসেনি, তা তো বলতে পারব না দিদি। আমি তো ছেলেমেয়েদের কাজ করি না। আমি আপনাদের কাজ করি।’
মধুজা রায় লবের বিরক্তি আঁচ করতে পারলেন। মাথায় সাৎ করে রক্ত চড়ে গেল। তার পরেও চুপ করে গেলেন। এদের ঘাঁটানো বিপদ। এরা স্টুডেন্টদের মতো চুপ করে থাকবে না। হয় ফস করে মুখের ওপর একটা অপমানজনক কথা বলে দেবে, নয় এমন কলকাঠি নাড়বে যে, কঠিন গোলমালে পড়ে যেতে হবে। তবে ছেলেমেয়েদের না-আসাটা ভালো লাগছে না। মনের ভিতর খচখচ করছে। কী হল?
‘চা খাবেন দিদি?’
‘না। তুমি এখন যাও লব। দরকার হলে ডাকব। আর স্টুডেন্টরা কেউ এলে বলবে, আজ দেখা করতে পারব না। আজ আমি ক্লাসও নেব না। আমার অন্য কাজ আছে।’
লব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মধুজা রায়ের মোবাইল বেজে উঠল। রিং টোনে পিয়ানোয় রবীন্দ্রনাথের গান। কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া…। চড়া নয়, চাপা বাজনা। এই গান মধুজা রায়ের পছন্দ নয়। আজকের দিনে আপনা ভুলিয়া বলে কিছু হয় না। এসব কথা রবীন্দ্রনাথের আমলে ছিল। এখন অবসলেট হয়ে গেছে। তার পরেও মধুজা গানটা মোবাইলে রেখেছেন। তাঁর কাছে খবর আছে, রাজ্যের একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী মোবাইলে এই গান রিং টোন করেছেন। যদি তার সঙ্গে কোনওদিন দেখা হয় এবং সেই সাক্ষাতে মোবাইল বেজে ওঠে, তাহলে কিছু একটা হলেও তো হতে পারে। এই আশায় রাখা। আদৌ তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা, দেখা হলে মোবাইল বাজবে কিনা, বাজলে মন্ত্রীসাহেব খুশি হবেন কিনা, হলে তিনি কিছু পাইয়ে দেবেন কিনা, সেসব কিছুই এখন বলা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি হয়? যদি কখনও কোনওদিন তার সঙ্গে দেখা হয় আর তখন যদি ফোন বেজে ওঠে অথচ সেই ফোনে আপনা ভুলিয়া গান না বাজে? তাহলে একটা আপশোসের ঘটনা হবে। মধুজা রায় চান্স নিয়ে রেখেছেন। অতি তুচ্ছ ঘটনাও জীবনে বড় মোচড় আনতে পারে। এরকম একটা ব্যাপার তাকে একসময়ে অনেক উপকার দিয়েছিল। সেও গান ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান নয়, অগ্নিগর্ভ বিপ্লবের গান। আগের গভর্নমেন্টের আমল তখন। পার্টি অফিসে শিক্ষা সেলের এক নেতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল একদল অধ্যাপক। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ঠিক করা নিয়ে জটিলতা হচ্ছিল। কাউন্সিলে দুজন অন্য মতের অধ্যাপক ঢুকে পড়েছিল। তাদের কীভাবে ঠেকানো যায় তাই নিয়ে মিটিং। মধুজা রায় তখন অল্প অল্প করে ক্ষমতাবানদের কাছাকাছি আসছেন। আরও আসবার জন্য ব্যগ্র। তিনি ম্যানেজ করে অধ্যাপকদের দলে ঢুকে পড়লেন। পৌঁছে গেলেন পার্টি নেতার কাছে। শিক্ষা সেলের নেতা খুবই পরিশীলিত মানুষ। পার্টির ভ্যাদভ্যাদে অশিক্ষিত মিটিং, মিছিল করা কর্মীদের থেকে শিল্পী সাহিত্যিক শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। শিক্ষার সঙ্গে সুন্দরী মহিলা যুক্ত থাকলে তো কথাই নেই। কথা বলবার উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে যেত। যাবেই তো। নারী শিক্ষাই তো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নেতা অতি উৎসাহে সেদিন নিজের গল্প শুরু করেন।
‘সে একটা সময় ছিল বুঝলেন। আমার তরুণ বয়েসের সময়। আমরা কমিউনিস্টরা তখন উদ্দাম, আমরা কমিউনিস্টরা তখন আগুন, আমরা কমিউনিস্টরা তখন সমাজ গড়বার লক্ষ্যে মাতোয়ারা। এই সময় সরকার আমাদের ওপর নামিয়ে এনেছে প্রবল দমনপীড়ন। একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আপনাদের মতো বড় মানুষদের কাছে সেই কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। সেদিন ছিল আমাদের সভা। আমরা গাইছিলাম গান। সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখ, পথে দেখ, পথে দেখ…’ ফাটা রেকর্ডের মতো কয়েকবার ‘পথে দেখ পথে দেখ’ বলে শিক্ষা-নেতা থমকে গিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘উফ! কী যেন পরের কথাটা…কী যেন…আহা! আমাদের যৌবনের সেই গান…আজ আর পুরোটা মনে পড়ে না।’
পিছনে বসা মধুজা রায় ভয়ে ভয়ে বলছিলেন, ‘আমি বলব স্যার?’
নেতা চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। খানিকটা বিস্মিত, খানিকটা মুগ্ধ।
‘বলুন।’
মধুজা বললেন, ‘সাথীদের খুনে রাঙা পথে দেখ হায়নার আনাগোনা।’
নেতা চওড়া হেসে বললেন, ‘ইয়েস হায়না, মনে পড়েছে হায়না, দে আর হায়নাজ। থ্যাঙ্কু ম্যাডাম। থ্যাঙ্কু ভেরি মাচ। তারপর কী হল শুনুন। আমরা তো স্টেজে গান ধরেছি। হঠাৎ দেখি পুলিশ…।’
এর সাত দিনের মধ্যে সেই নেতা মধুজা রায়কে ফোন করলেন।
‘আছেন কেমন? শুনুন নর্থবেঙ্গলের শিক্ষামেলায় একটা সেমিনার হচ্ছে। আমি আপনার নাম বলেছি। আপনি কিন্তু না করবেন না। আপনাদের মতো লেখাপড়া জানা মানুষ এগিয়ে না এলে হবে না।’
একেবারেই হঠাৎ শিকে ছিঁড়ল। পাড়ার মোড়ে শোনা গানের কলি মনে ছিল বলেই না চেনা পরিচয় হয়েছিল অত বড় নেতার সঙ্গে। তারপর কতবার যাতায়াত। থাক সে কথা। আসল কথা, কী থেকে কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে! একটা সময় ‘হায়না’ যখন এই কাণ্ড করতে পেরেছে, এখন খোদ রবিঠাকুর কতটা পারবেন তার ঠিক আছে? যদি দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রীর মনে ধরে যায়?
এই কারণেই মোবাইলে গান রাখা। অতীতের শিক্ষা।
ফোন তুললেন মধুজা। ফোনে নাম দেখলেন, অভ্রনাথ। উফ ছেলেটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে। বউয়ের ট্রান্সফার চায়। একটা ধমক দেওয়া উচিত।
মধুজা রায় নিজেকে সামলালেন।
‘তোমাকে তো বলেছি অভ্রনাথ, আমি কথা বলব। নর্থবেঙ্গল থেকে কলকাতার কলেজে নিয়ে আসা তো হুট বলতে হয় না। তুমি ধৈর্য ধরো।’
ওপাশ থেকে অভ্রনাথ গদগদ গলায় বলল, ‘অবশ্যই ধৈর্য ধরব মধুজাদি। শুধু ধৈর্য কেন, আপনি যা বলবেন তাই ধরে বসে থাকব। আপনি যেরকম বলবেন সেরকমটাই করব।’
মধুজা রায় গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, ‘করছ কই অভ্রনাথ? আরে ট্রান্সফারের জন্য তো পদ্ধতি প্রকরণ আছে। সেগুলো মানতে হয়। আমি না হয় কয়েকটি স্টেপ কমিয়ে দেব। সবক’টা তো পারব না। তুমি আমাকে আর ফোন কোরো না। সময় হলে আমি যোগাযোগ করে নেব’খন।’
‘আপনি যা বলবেন, তাই হবে মধুজাদি। আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে চিনি না।’
ন্যাকা। মুখে আপনি কাউকে চিনি না বলছে, এদিকে আরও তিনজনকে ধরে বসে আছে। কিছু করার নেই। লবি রাখতে এসব সহ্য করতে হয়। নইলে অভ্রনাথরাই অন্য দিকে চলে যাবে। ফোন কেটে মধুজা রায় দেখলেন, মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে। নাক সুড়সুড়ানি বাড়ছে।
মেজাজ বিগড়ানোর ঘটনা সকাল থেকে পরপর ঘটছে।
প্রথমটা ঘটিয়েছে কমলা। রান্নার লোক। আজ আবার কামাই। গত দু’মাসে দু’বার হয়ে গেছে। তবে সেগুলো ছিল জানিয়ে। আজ না জানিয়ে। রান্নার লোক কামাই করা মানে সব ঘেঁটে যাওয়া। ইন্টেলেকচুয়্যালপনা, সকাল থেকে ফোনে ধান্দাবাজি, গ্রুপবাজি সব সব বন্ধ। রান্নাঘরে ঘেমেনেয়ে একসা হয়ে রান্না করতে হয়। সুশান্ত আবার আজ বাজার করেছে বোকার মতো। গাদাখানেক মাছটাছ এনে একাকার কাণ্ড। মধুজার ইচ্ছে করছিল, ছুড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিই। প্রথমে খুব একচোট চেঁচামেচি করলেন। সুশান্ত বেচারি ভয়ে জড়সড় মেরে গেলেন। আমতা আমতা করতে থাকেন।
‘আমি তো জানতাম না কমলা আসছে না।’
‘কেন জানবে না? সংসার কি শুধু আমার? সব জানা আমাকে জানতে হবে?’
সুশান্ত স্ত্রীর চেঁচামেচিতে ভীত হয়ে বললেন, ‘তা নয়। বাজারে যাওয়ার আগে যদি একবার বলতে…।
‘কী করে বলব? কমলা কি আমাকে জানিয়েছে? বজ্জাত কোথাকার। জানালেই বা কী? মনে করে তোমাকে বলতে হবে? দেখতে পাচ্ছ না সকাল থেকে আমি লেখাপড়া করছি। ক্লাস আছে না আজ। তোমাদের মতো তো চাকরি নয়। দুটো কম্পিউটার টিপলেই হয়ে গেল। মাস গেলে গাদাখানেক মাইনে। প্রতিদিন আমাদের লেখাপড়া করে উপার্জন করতে হয়। ইস কেন যে মরতে এত পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। তার থেকে বাড়ির বউ হয়ে সকাল থেকে আনাজপাতি নিয়ে বসা ভালো। বদ মেয়েছেলেটা একবারও কি আমাকে জানাতে পারল না?’
এই ধাক্কা সামলানোর আধঘণ্টা পরে ফোন করল বীতশোক। ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র। খেলুড়ে ছেলে। সবদিক হাতে রেখে চলে। বাড়িতে ফোন করে ল্যান্ড ফোনে। ইচ্ছে করে ল্যান্ড। যাতে পরে কাউকে নম্বর দেখিয়ে চট করে প্রমাণ না করা যায় ফোন করেছিল। মধুজা রায় মাছ ধুচ্ছিলেন। আঁশটে হাতে কানে রিসিভার ধরলেন। ‘ম্যাডাম, জরুরি কথা আছে।’
‘কী হয়েছে?’ বিরক্ত গলায় বললেন মধুজা রায়।
বীতশোক নীচু গলায় বলল, ‘ডিপার্টমেন্টে কী প্রবলেম হয়েছে?’
মধুজা রায় থমকে গেলেন, ‘কী হয়েছে বলো তো?’
বীতশোক বলল, ‘আমি পুরোটা শুনিনি। ওভারহিয়ার করলাম। কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দমদা বলাবলি করছিল।’
মধুজা রায় বললেন, ‘চুপ করলে কেন? কী বলাবলি করছিল ওরা।’
বীতশোক খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘ফাইনাল ইয়ারের বারিধারা, বারিধারা সেন, তাকে নাকি কোন ছেলে অ্যাবিউস করেছে। সে প্রাোটেস্ট করেছে। চড়ও মেরেছে। আপনি…।’
মধুজা চাপা গলায় বললেন, ‘আমি কী?’
বীতশোক একটু থেমে বলল, ‘আপনি নাকি সেই ছেলেকে শেল্টার দিচ্ছেন। সে নাকি আপনার পরিচিত। আমি কিছু জানি না। যেটুকু শুনলাম মনে হল আপনাকে জানানো জরুরি। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অরিন্দমদা বলল, এরকম হলে ওরাও চুপ করে থাকবে না। ছেলেমেয়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। ঘটনার প্রতিবাদ করবে।’
শরীর ঝনঝন করে উঠল মধুজা রায়ের। কল্যাণ সমাজপতি আর অরিন্দম দুজনেই তার বিরুদ্ধে। দুটোই পাজি। সমস্যা হল, এরা কোনও লোভেই বশ মানে না। ছেলেমেয়েদের কাছে পপুলার টিচার। শিক্ষিত লোক ধান্দাবাজ হলে যেমন মারাত্মক, তেমন মেরুদণ্ড শক্ত হলেও বিপজ্জনক। এরা তাই। মেরুদণ্ড শক্ত থাকা মানুষ। সামনে পাত্তা না দিলেও মনে মনে মধুজা রায় এদের সমঝে চলেন। হাতে ক্ষমতা নেই বলে, এরা কিছু বলে না, তবে চান্স পেলে ছাড়বে না। তবে বীতশোক ছোকরাকে কিছু বলা ঠিক নয়। বললেই হয়তো ওদের ফোন করে জানাবে। মধুজা রায় শান্ত গলায় বললেন, ‘ও কিছু নয় বীতশোক। তুমি চিন্তা কোরো না। ওই দুটো তো আমার পিছনে লাগবে বলে সমসময় রেডি হয়ে থাকে। লাভ হবে না। মধুজা রায়ের হাত অনেক বড়।’
ফোন ছাড়বার পর থেকে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল।
সেই মেজাজ বিগড়ানো ইউনিভার্সিটিতে এসে বাড়ছে। তিনি থম মেরে বসে আছেন। নাক সুড়সুড় করে উঠল। মধুজা রায় হাত তুললেন। ইস, হাতে এখনও মাছ কাটবার আঁশটে গন্ধ। লব আবার ঘরে ঢুকল।
‘লব, ডিপার্টমেন্টে তিথি নামের মেয়েটা এসেছে কিনা খোঁজ নাও তো। এলে বলো, আমি ডাকছি।’