» » তৃতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

আঠাশ

তমসার আজ মন ভালো। আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। প্রতি বছর ঘুম থেকে উঠেই তমসার তারিখটা মনে পড়ে যায় আর ভালো লাগে। আবার লজ্জাও করে। আশ্চর্য লাগে, এত বছর হয়ে গেল তারপরে দিনটা সে ভুলতে পারেনি। তমসা জানে, এ তার ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই নয়। ছেলের দশ বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও এসব মনে থাকবার কথা নয়! নেহাত তমসাকে যারা চেনে তারা কিছুতেই তাকে ‘নেকা’ বলতে পারবে না, নইলে তারাও এই কথা শুনলে ‘নেকা’ বলত। অবশ্য এই ঘটনা কেউ জানে না। এটা তমসার গোপন কথা। কাউকে গল্প করবার মতো নয়।

আজ তমসাদের স্কুল ছুটি। স্কুলের গভর্নিং বডির এক মেম্বার মারা গেছেন। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছিল। তমসারা তাকে কখনও চোখেও দেখেনি। স্কুলের মিটিংয়েও আসতেন না। নামকাওয়াস্তে গভর্নিং বডিতে ছিলেন। তার পরেও একটা ছুটি পাওয়া গেল। আমাদের দেশে মানুষকে সম্মান জানানোর শর্টকাট পথ হল ছুটি। শুধু সম্মান কেন, কিছু একটা হলেই হল। শোকের ঘটনায় ছুটি, আনন্দের ঘটনায় ছুটি। ছুটি পেলে সবাই খুশি। তমসা খুশি নয়। সামনে পরীক্ষা আসছে। মেয়েদের সিলেবাস শেষ হয়নি। চাপ তো টিচারদের ওপরই পড়বে। কিন্তু করার কিছু নেই। তবে বাড়ির কাজ সারবার জন্য হঠাৎ একটা ফাঁকা দিন পাওয়া গেল।

তবে শুধু বাড়ির কাজ নয়, আজ পার্টি অফিসেও খানিকটা সময় দেবে তমসা। এলাকার মহিলাদের নিয়ে একটা আলাদা কিছু করবার  কথা ভাবা হচ্ছে। পুরোনো সমিতি নয়, তার থেকে আলাদা। আগের সমিতিগুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো নয়। ভালো না হওয়ারই কথা। একটা সময় সমিতির মহিলারা রাজনীতির থেকে বেশি পাড়ায় পাড়ায় খবরদারি করত। অন্যের সংসারে নাক গলাত। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াতেও ঝাণ্ডা হাতে চলে যেত। ওই চেহারা এখন চলবে না। সবাই দুচ্ছাই করে তাড়িয়ে দেবে। সেই কারণে অন্য ধরনের মঞ্চ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। লেডিস গ্রুপের মতো যদি কিছু করা যায়। তারা সারাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। বাইরে কাজ করবে। সমস্যা হচ্ছে, শহরে এই ধরনের গ্রুপ কী কাজ করবে এবং কীভাবে কাজ করবে সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। গ্রাম, কলোনি, বস্তি হলে কাজ সহজ হত। শহরের মেয়েরা এসব জায়গায় কতটা আসবে তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। পার্টি তমসাকে ভাবতে দিয়েছে। তমসা দু-তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। আজও করবে। তমসার ইচ্ছে অন্যরকম। একেবারে পার্টি থেকে বেরিয়ে কাজটা হবে। ক্লাবের মতো একটা কিছু তৈরি করতে হবে। গান-বাজনা-নাটক, এগজিবিশনের ক্লাব। পার্টির গণসঙ্গীত নয়, সাধারণ গানবাজনা। পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, মহালয়ায় কমিউনিটি হল নিয়ে ফাংশন হবে। এই কনসেপ্টে পার্টি রাজি হলে হয়। এটা যে আসলে কিছু মেয়েদের একসঙ্গে করবার একটা কৌশল সেটা কি নেতাদের মাথায় ঢুকবে? ঢোকা কঠিন। কমিউনিস্টরা চিরকালই নিজেদের ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে বসে থাকে। বইতে যেমন  লেখা আছে তেমনভাবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দল যে তাতে এগোচ্ছে না কে বোঝাবে? পার্টি ভোটের সময় ক্লাবকে কাজে লাগায়, কিন্তু নিজেরা ক্লাব মনোবৃত্তিকে সমর্থন করে না। এই ধরনের ফ্যালাসি নিয়ে চলা মুশকিল। দেখা যাক। তমসা ঠিক করেছে, দরকার হলে নেতাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে।

ছেলে স্কুলে গেছে। ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো হয়েছে যে। ভালো হয়েছে না বলে, লেখাপড়ায় মন হয়েছে বলা ঠিক হবে। নিজের পড়া নিজে করে নেয়। স্কুলে যেতে ভালোবাসে। ঝড়বৃষ্টিতেও কামাই করতে চায় না। নামে শান্ত, স্বভাবেও শান্ত হয়েছে। অনেকটা তার বাবার মতো। খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা তেমন নেই। যা দেওয়া হবে খেয়ে নেবে। শুধু রাতে শোয়ার পর গল্প শোনানোর বায়না করে। কোনও কোনওদিন তমসার ভালো লাগে না। ক্লান্ত লাগে। সেদিন বলে, ‘আজ গল্প-টল্প নয়, চুপ করে শুয়ে পড়।’

তারপরেও শান্ত ঘ্যান ঘ্যান করে। তমসা রেগে যায়।

‘এবার কিন্তু চড় দেব। পাশ ফিরে ঘুমোও।’

শেষপর্যন্ত শেখর উদ্ধার করে। সে তার বাইরের ঘর থেকে উঠে এসে ছেলেকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। শান্ত বড় হয়ে যাওয়ার পর শেখর বাইরের ঘরে শোয়।

তমসা ঘুম থেকে উঠে ঘর গোছাল। দু’কামরার বাড়ি। ভাড়াবাড়ি। জায়গা কম। ছেলে বড় হচ্ছে, জায়গা দিন-দিন আরও কমছে। বাড়িটা যেন সবসময় অগোছাল থাকতে চায়। তমসা গোছানো মেয়ে বলে সামলে চলে। আজও নিজেদের কোনও ঘরবাড়ি হল না। হওয়ার কথাও নয়। বাড়ির প্রধান মানুষ যদি উপার্জন না করে তা হলে বাড়ি হয় না। কথাটা সবাই মানতে চায় না। সবাই কেন, আজকের দিনে বেশিরভাগই মানে না। একবার এক মামির সঙ্গে তমসার এই নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছিল। তখন পার্টি সরকারে ছিল। মামিমা খুব অপমানজনক কথা বলেছিল। ঝগড়ার পর এক বছর সেই মামির বাড়িতে তমসা যায়নি।

মামিমা বলেছিল, ‘শেখরকে এবার একটা ফ্ল্যাট-ট্যাট কিছু করতে বল তমসা। ক’দিন ভাড়াবাড়ির ঘুপচিতে পড়ে থাকবি? ছেলেটাও তো বড় হচ্ছে।’

তমসা বলেছিল, ‘কী যে বলো মামি। শেখর ফ্ল্যাট করবে কোথা থেকে? তার টাকা কই?’

মামিমা চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ‘তার মানে! ফ্ল্যাট করবে কীভাবে মানে! এতদিন পার্টি করছে একটা ফ্ল্যাট করতে পারবে না?’

তমসা হেসে বলেছিল, ‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন পার্টি একটা বিজনেস। মিটিং, মিছিল করা মানে লাভ করা। ওর রোজগার কোথায় মামিমা? তুমি তো জানো শেখর পার্টির হোলটাইমার। মাস গেলে পার্টি থেকে ওয়েজ পায়। সে আর কত টাকা? আমার স্কুলের চাকরিটাই ভরসা। এতে ফ্ল্যাট-ট্যাট হয় না। কোনওরকমে সংসার চলে।’

মামিমা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘বাজে  কথা বলিস না তমসা। আমাকে টাকার গল্প শোনাস না।’

তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘টাকার গল্প শোনাচ্ছি মানে! তুমি কী বলছ? আমি বুঝতে পারছি না।’

মামিমা বলল, ‘বুঝে কাজ নেই। আমাকে বললি ঠিক আছে, বাইরের কাউকে এসব বলতে যাস না তমসা। হেসে গড়িয়ে পড়বে। খবরদার বলতে যাসনি।’

তমসা আরও অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলতে যাব না?’

মামিমা বলল, ‘পার্টি করে অথচ টাকা নেই এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন পার্টি করে সবাই গাড়ি-বাড়ি হাঁকাচ্ছে। দমদমে আমার বাপের বাড়ির ওখানে দেখছি না? আগে টালির ঘরে থাকত, এখন পার্টির লোকগুলো সব তিনটে-চারটে করে ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলেছে। নামে, বেনামে সম্পত্তি। তোর মামার অফিসে কাজ করে দাসবাবু। নির্মল দাস। কর্মচারী নাকি কী গুষ্টির পিণ্ডি ইউনিয়ন করে, এক সময়ে তোর মামার কাছ থেকে ধার করে সংসার চালাত। এখন তারও নাকি দুটো গাড়ি। কাজ তো কিছুই করে না। অফিসের ইউনিয়ন রুমে বসে বিড়ি ফোঁকে আর সময় সময় গেটে গিয়ে ঝাণ্ডা নাচিয়ে মানব না মানছি না করে। এরপরেও তুই বলছিস পার্টি করে পয়সা হয় না?’

তমসা শুকনো গলায় বলেছিল, ‘সবাই সমান হয় না মামিমা।’

মামিমা তেড়েফুঁড়ে বলেছিল, ‘সবাই সমান। পার্টির লোকগুলো সব চোর। প্রাোমোটার, বিজনেসম্যানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে আর টাকা কামায়। আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। তুই কাকে সাধুপুরুষ বলবি?’

তমসা খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সবাই চোর কথাটা তোমার বলা উচিত নয় মামিমা। পার্টিতে অনেক সৎ মানুষও আছে। একটা পয়সাও ছুঁয়ে দেখে না।’

মামিমা বিদ্র+পের ঢঙে বলল, ‘আছে নাকি! আমার তো বাপু বিশ্বাস হয় না। তারপরেও তুই যখন বলছিস আছে হয়তো। লুকিয়ে আছে। মুখ দেখাতে লজ্জা পায়।’

তমসা শান্তভাবে বলেছিল, ‘তোমার অভিযোগ সবটা মিথ্যে বলছি না। কিন্তু তোমার জানার বাইরেও বহু মানুষ আছে। তারা কষ্ট করে রাজনীতি করে, কষ্ট করে জীবনযাপন করে।’

অপমানিত হয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল তমসা। রাতে শেখর বলেছিল, ‘তুমি বিষয়টাকে এত কঠিনভাবে নিচ্ছ কেন তমসা?’

তমসা বলল, ‘কী বলছ! তোমাকে চোর বলছে, সেটা সহজভাবে নেব?’

শেখর হেসে বলল, ‘আমাকে নয়, পার্টির লোকদের বলছে।’

‘তাই বা বলবে কেন?’

শেখর গম্ভীর মুখে বলে, ‘এটাই তো আমাদের ভাবা উচিত তমসা। যে পার্টিতে এত লড়াই, এত স্যাকরিফাইজ, এত অনেস্টি সেই পার্টির লোকদের মানুষ চোর বলবে কেন? একটা মানুষও বলবে কেন? আমরা কি বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবি? ভাবি না। অনেক অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা হয়তো কমিশন-টমিশন বসিয়ে পার্টি থেকে বহিষ্কার করি, তাও বছরে একটা-দুটো, তার বেশি নয়। ব্যস, মানুষ কী বলছে সেদিকে তাকাই না। বরং গাল দিলে, সমালোচনা করলে তার ওপর রাগ করি। কোণঠাসা করি।’

তমসা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘মানুষের এই সব অভিযোগ তো সত্যি নয়। কানাইবাবু, কেষ্টদা, নিতাই সরকার, তালুকদারকাকা, অমিয় এরা তো ভয়ঙ্কর দুর্দশার মধ্যে সময় কাটায়। কেষ্টদা তো হস্টেলের বারান্দার মাদুর পেতে শোয়। রুমরেন্ট দিতে পারেনি বলে ঘরে জায়গা পায় না। এ সব কি মানুষ জানবে না?’

শেখর বলল, ‘না জানবে না। কারণ আমরা জানানোর কথা ভাবি না। সৎ ভাবে বেঁচে থাকাটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। ফলে মানুষ সামনে যে খারাপটাকে দেখতে পায়, সেটাকেই সব ভাবে। আলটিমেট বলে মনে করে।’

তমসা বলে, ‘ভাববে কেন?’

শেখর হেসে ফেলে।

‘কেন ভাববে এটা তুমি জিগ্যেস করতে পারো না তমসা। পারসেপশনটাই এরকম হয়ে যাচ্ছে। পার্টির লোক মানে চোর। চোর আছেও তো। অনেক চোরই আছে। আমরা একদিকে যেমন তাদের তাড়াতে পারি না, তেমন ভালো লোকদের সামনে আনি না। তার থেকে ভয়ের কথা, আমরা মানুষের সামনে নীতি, আদর্শের  কথা তুলে ধরতে পারছি না। তার ফলে ব্যক্তির জীবন, বাহুল্য দিয়ে পার্টির কথা প্রচার হচ্ছে। একজন মন্ত্রী সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে গেলে রাস্তার লোক গাল দেয়। তাদের দোষ নেই। তারা তো জানে না যে মানুষটা মন্ত্রী হয়েছে, সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে তার অতীত কী? সে কত লড়াই করেছে? সোসাইটিতে তার কন্ট্রিবিউশন কী? কেন তাঁকে সাইরেন বাজিয়ে আগে যেতে হবে? আমরা মানুষকে এসব বোঝানোর চেষ্টাও করি না। ইগনোর করি। আমার ধারণা এর ফল ভালো হবে না। যে গুণ্ডা মস্তান সাইরেন ছাড়াই পথ চলে সে গাড়িতে চড়লেও খারাপ, না চড়লেও খারাপ। তুমি তোমার মামিমার কথা নিয়ে মাথা ঘামিও না। উনি আমাদের কারণেই ভুল বুঝে আছেন।’

তমসা গজগজ করে বলেছিল, ‘যা-ই হোক, আমি ওর বাড়িতে আর কখনও যাব না।’

তমসা বাইরের ঘরে এল। শেখর উপুড় হয়ে লিখছে। নিশ্চয় দমদমের ওই পত্রিকার জন্য। খুব ভালো লাগল তমসার। মানুষটা এই যুগের সঙ্গে খাপ খায় না। সেই কারণেই বোধহয় এত ভালো। শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস নয়, নিজের জীবনের প্রতিও গভীর বিশ্বাস আছে। পায়ের আওয়াজে মুখ তুলল শেখর। হেসে বলল, ‘এসো তমসা। ঘর গোছানো হল?’

তমসা বহুদিন পর শেখরের পাশে মাদুরের ওপর বসে পড়ল। আঁচল দিয়ে কপালের গলার ঘাম মুছল। শেখর স্থির চোখে তাকিয়ে রইল স্ত্রীর মুখের দিকে।

তমসা গাঢ় স্বরে বলল, ‘কী দেখছ?’

শেখর মুচকি হেসে বলল, ‘তোমাকে। এই সময় তোমাকে কতদিন দেখিনি।’

তমসার গা শিরশির করে উঠল। শেখরের গায়ে হাত দিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘ধুত যত বাজে কথা। উনি যেন আমাকে দেখার জন্য  অপেক্ষা করে থাকেন।’

শেখর খাতার ওপর খোলা পেন রেখে সোজা হয়ে বসল। তমসার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কে বলল থাকি না?’

তমসা শেখরের হাত সরিয়ে দিতে দিতে অভিমান করা গলায় বলল, ‘বাজে কথা। আমার জন্য অপেক্ষা করতে বয়ে গেছে তোমার। খালি কাজ আর কাজ। এই মিটিং, সেই মিটিং। আমি যে একটা মানুষ মনেই থাকে না।’

শেখর তমসাকে কাছে টানল।

‘তোমাকে মনে না রাখলে এত কাজ করতেই পারতাম না তমসা। সত্যি কথা।’

স্বামীর স্পর্শে বহুদিন পর তমসার শরীর কেঁপে উঠল। মনে হল, নতুন মানুষ। এই প্রথম বুঝি কোনও পুরুষ তার গায়ে হাত দিল। ভালোবাসার হাত। ছেলে বড় হওয়ার পর এই সুযোগ কমে গেছে। দুজনের কাছে আসাই হয়ে ওঠে না। আজ শান্ত নেই। অসময়ে বাড়িতে দুজনে। তাই কি এই শিহরন? তমসা লজ্জা পেল। শেখরকে ঠেলে সরিয়ে দিতে গেল। শেখর চেপে ধরল। তমসা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘অ্যাই কী হচ্ছে?’

শেখর চাপা গলায় বলল, ‘কতদিন আদর করিনি বলো তো?’

‘বয়ে গেছে তোমার।’

শেখর তমসার মুখের দিকে মুখ এগিয়ে বলল, ‘না বয়ে যায়নি। খুব ইচ্ছে করছে তমসা। প্লিজ।’

তমসা বাঁ হাত দিয়ে স্বামীর মুখ সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ইস দিনের ফটফটে আলোয় বাবুর খুব ইচ্ছে না?’

‘রাতে আর তোমাকে পাই কোথায়?’ ছেলে ঘুমিয়ে পড়বার আগেই তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’

তমসা চাপা স্বরে বলল, মিধ্যে কথা। নিজের মনে পড়ে না সেটা বলো।’

শেখর হেসে বলল, ‘আচ্ছা, বেশ মনে পড়ে না। এবার তো এসো। এবার মনে পড়েছে।’

কাছে টেনে তমসার বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল শেখর। তমসা বাধা দিল আবার দিলও না। সে চোখ বুজল।

বিড়বিড় করে বলল, ‘মাগো! কত আলো।’

শেখর তমসার বুকের ওপর মুখ নামাতে নামাতে বলল, ‘কী সুন্দর!’

তমসা ব্লাউজ খুলতে খুলতে মাদুরের একপাশে শুয়ে পড়ল। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। কী অদ্ভুত ঘটনা! একেই কি কোইন্সিডেন্স বলে? আজ থেকে বারো বছর আগে আজকের এই দিনটায় শেখর তাকে প্রথম আদর করেছিল। তখনও তাদের বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথাও হয়নি। শুধু ভালোবাসার টান দুজনে অনুভব করেছিল। এরকমই এক সকালে তমসা এই বাড়িতে এসেছিল। এসেছিল পার্টির কাজে। কাজটাও মনে আছে। লোকাল কমিটির সম্মেলন হবে। সম্মেলন উপলক্ষ্যে সেমিনারের দায়িত্ব ছিল তমসা আর তার টিমের ওপর। সেই সেমিনারের বিষয় ফাইনাল করতে এসেছিল। ব্যবহারিক জীবনে মার্কসবাদের প্রয়োগ কি আজকের দিনে বাস্তবসম্মত?  কথা শেষ করে তমসা যখন উঠে পড়েছিল, শেখর খুব সহজভাবে তাকে বলেছিল, ‘তমসা কথাটা বলা উচিত নয়, তারপরেও যদি বলি তুমি কি রাগ করবে?’ তমসা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

শেখর বলেছিল, ‘আমরা দুজনেই আমাদের সম্পর্কের কথা জানি। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। সেই সম্পর্কের জেরে আজ যদি আমি আদর করতে চাই তুমি কি প্রত্যাখ্যান করবে তমসা? করলে সমস্যা নেই। আমি সহজভাবেই মেনে নেব। কিন্তু দয়া করে সত্যি কথা সরাসরি বলার জন্য আমার ওপর রাগ কোরো না। কোনও মানুষের তার ভালোবাসার জনকে আদর করতে চাওয়াটা অনুচিত হতে পারে, কিন্তু অপরাধ নয়!’

এমন সহজভাবে, কোনওরকম ভনিতা ছাড়া সরাসরি একজন পুরুষমানুষ কোনও মেয়েকে এই কথা বলতে পারে! তমসা বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিল দীর্ঘক্ষণ। যতক্ষণ না পর্যন্ত শেখর গিয়ে দরজার ছিটকিনি দেয় এবং এসে তার হাত ধরে।

ঘরের ভিতর, মেঝেতে পাতা মাদুরে দুটো নগ্ন শরীর যখন জগৎসংসার ভুলে মত্ত, দরজার বাইরে তখন এক তরুণ এসে দাঁড়াল। তার চেহারা বিধ্বস্ত। চোখে-মুখে গভীর দুশ্চিন্তা। তাঁকে পুলিশ খুঁজছে।

অর্চিন দরজায় ধাক্কা দিল। চাপা গলায় বলল, ‘শেখরদা, শেখরদা।’